শনিবার, ২৭ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

ট্রাম্প প্রমাণ করলেন তিনি ঝানু ব্যবসায়ী

নূরে আলম সিদ্দিকী

ট্রাম্প প্রমাণ করলেন তিনি ঝানু ব্যবসায়ী

ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মধুচন্দ্রিমার মাহেন্দ্রক্ষণ অতিবাহিত করেছেন। আমেরিকার ২৪০ বছরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সবচেয়ে বিতর্কিত ও সমালোচিত ছিল তার নির্বাচিত হওয়ার ঘটনাটি। অসংলগ্ন, বাস্তবতা-বিবর্জিত এবং মানবতাবিরোধী নানা অপ্রাসঙ্গিক কথায় তিনি নিজেকে তো প্রশ্নবিদ্ধ করেছেনই, বরং মানবতাবাদী বিশ্ব-জনগোষ্ঠীকে আতঙ্ক, উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠার ঘনঘোর অমানিশার মধ্যে এমন নিষ্ঠুরভাবে নিক্ষেপ করেছিলেন যে, বিশ্বের শান্তিকামী প্রান্তিক জনতা কম্পমান বক্ষে এক নব্য হিটলারের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলেন। পপুলার ভোটের হিসাবে এমনিতেই তিনি ৩২ লাখেরও অধিক ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারির চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন। ইলেক্টোরাল ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে বহুদিন পর্যন্ত আমেরিকার প্রায় ৫৮ ভাগ নাগরিক, সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহলের প্রতিনিধিত্বে যারা ছিলেন তারা তাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্বীকারই করেন না। নির্বাচনটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে ইলেক্টোরাল পদ্ধতি আমেরিকার মানুষের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম কিনা, আমেরিকানদের মধ্যে এ প্রশ্নও জোরালোভাবে উঠেছিল। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো নির্বাচনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রভাব ও কেজিবির হ্যাকিংয়ের প্রশ্নটি আমেরিকাবাসীকে শুধু বিপর্যস্তই করেনি, তাদের ২৪০ বছরের গণতন্ত্রের অনুশীলন, প্রত্যয় ও প্রতীতির ওপর নির্মম আঘাত হেনেছিল। আমেরিকার বিশাল অঙ্গরাজ্য ক্যালিফোর্নিয়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ারও আওয়াজ তুলেছিল। আমেরিকার মতো রাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো উগ্রবাদী ব্যক্তির রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠান সারা বিশ্বের কাছে শুধু বিস্ময়করই নয়, অগ্রহণযোগ্য, অকল্পনীয় এবং একটি মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে প্রতিভাত হয়। আমেরিকার অভ্যন্তরে অনেক এলাকায় নির্বাচন-উত্তরকালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ একটি নজিরবিহীন ঘটনা। বিশ্বজোড়া আমেরিকার আগ্রাসননীতি সর্বজনবিদিত বলেই মুসলিম-বিদ্বেষী ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচন ও নির্বাচন-উত্তর মুসলমানবিরোধী কথাবার্তার প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্যালেস্টাইনের চার হাজারেরও অধিক ইহুদি অভিবাসীকে স্থায়ীভাবে জেরুজালেমে অধিষ্ঠিত করেন। জেরুজালেমের পবিত্র আল আকসা মসজিদটিও বন্ধ করে দেওয়ার স্পর্ধিত পাঁয়তারা করা হয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের মধ্যে সবচাইতে বয়োজ্যেষ্ঠ, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা বিবর্জিত নিছক ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যেই তার কার্যকলাপ, নিজের পারিবারিক ব্যক্তিবর্গকে হোয়াইট হাউসের কর্তৃত্বে আনার নির্লজ্জ পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে আমেরিকার রাষ্ট্রপতির ইতিহাসে একগুঁয়েমির প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ইসরায়েল সফরের প্রাক্কালেও তিনি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি স্থাপনের অভিলাষ ব্যক্ত করেন। তবে ইহুদিদের পবিত্র উপাসনাগারের দেয়ালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনিই প্রথম তার মন্তব্য খচিত করেন।

এবারের মধ্যপ্রাচ্য সফরে রিয়াদে পৃথিবীর প্রায় সব মুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানদের একটা অভূতপূর্ব সমাবেশে তিনি সৌদি বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজের আমন্ত্রণে উপস্থিত হয়ে সারা বিশ্বকে হতচকিত করে মুসলিমবিদ্বেষী অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন। নির্বাচনের প্রাক্কালে এবং পরে বারাক ওবামা ও হিলারি ক্লিনটন বারংবার তাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছিলেন, গোটা মুসলিম বিশ্বকে সন্ত্রাসী হিসেবে অভিহিত বা সম্বোধন না করতে। বরং জঙ্গি-সন্ত্রাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভ্রান্ত মুসলমানদের বিরুদ্ধে সার্বজনীন জনমত গড়ে তুলে এর বিরুদ্ধে মুসলমানসহ সারা বিশ্বের সব ধর্ম-বর্ণের মানুষকে একযোগে লড়াই করার উদাত্ত আহ্বান রাখার জন্য ট্রাম্পকে অনুরোধ করেছিলেন তারা। ডোনাল্ড ট্রাম্পের শিরায় শিরায়, নাড়ির রন্ধ্রে রন্ধ্রে, অনুভূতির পরতে পরতে মুসলিমবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ ও নারীবিদ্বেষ সমুদ্রের ঊর্মিমালার মতো প্রবহমান। রাজনৈতিক শালীনতাবিবর্জিত ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনোই শালীন, পরিমার্জিত ভাষায় এ তিন প্রশ্নে কথা বলেননি। আমেরিকার রাজনীতিকদের বিরুদ্ধেও অনেক কৌতুক, ঠাট্টা-তামাশা ও বিদ্রূপ করেছেন এবং তার মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ পদে রিপাবলিকান কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অধিষ্ঠিত হতে পারেননি।

সৌদি আরবের বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজের আমন্ত্রণে রিয়াদে গিয়ে তিনি যে ভাষণটি দিয়েছেন, সন্দেহাতীতভাবে সেটি পরিশীলিত, পরিমার্জিত এবং মুসলিমবিদ্বেষ থেকে কিছুটা সরে আসার ইঙ্গিতবহ। চতুর ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প মুসলমানদের প্রতি কতটুকু সহানুভূতিশীল হয়েছেন বা হবেন— তার এসব উক্তি আদৌ এর নিশ্চয়তা বিধান করে না। কারণ ব্যবসায়ী রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প ইতিমধ্যেই ১১০ বিলিয়ন ইউএস ডলারের সমরাস্ত্র বিক্রির চুক্তি সম্পন্ন করেছেন সৌদি বাদশার সঙ্গে। এখানে একটি প্রশ্নে সবাই বিদগ্ধ চিত্তে সুতীব্র যন্ত্রণামিশ্রিত হয়ে জ্বলজ্বল করে জ্বলে ওঠে, সৌদি বাদশা বিপুল অঙ্কের অস্ত্র কিনে ট্রাম্পকে কিছুটা নিবৃত্ত করলেন? মুসলিমবিদ্বেষী মননশীলতা থেকে কিছুটা সরিয়ে আনলেন, না ব্যবসায়িক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ১১০ বিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র বিক্রির কৌশলী প্রক্রিয়ায় সফল হলেন? বিশেষজ্ঞ না হয়েও বলা যায়, ডোনাল্ড ট্রাম্প এক্ষেত্রে তার বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলী ব্যবসায়িক প্রজ্ঞাকে অতি সূক্ষ্মভাবে ব্যবহার করেছেন। ইসরায়েলেও তিনি প্যালেস্টাইনে শান্তির যে আহ্বান রেখেছেন, তাও তার সুচতুর রাজনৈতিক কৌশলের একটি অবিভাজ্য আঙ্গিক। অন্তত এখন আমেরিকাবাসী তার ব্যবসায়িক দূরদর্শিতার কিছুটা হলেও প্রশংসা করবেন, এটা নির্দ্বিধায় বলা চলে। অস্ত্রগুলোর সবগুলোই ইয়েমেনের বিরুদ্ধেই ব্যবহূত হবে এটিই চুক্তির মূল শর্ত।

জঙ্গি-সন্ত্রাস, মানুষ হত্যা ইসলামে একান্তই হারাম। কোনো যুক্তিতেই গুপ্তহত্যা, জঙ্গি আক্রমণকে কোনো মুসলমান সমর্থন করতে পারেন না। আল্লাহর বিধান ও রসুল (সা.)-এর জীবনাদর্শ (হাদিস) একে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ধর্মযুদ্ধ ব্যতিরেকে যেকোনো অবস্থায় যেকোনো ধর্মের মানুষ হত্যা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষেধ। এমনকি ধর্মকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করারও বিধিনিষেধ রয়েছে ইসলামে। আইএস, আল-কায়েদা, তালেবান—এরা কোনো যুক্তিতেই হত্যা, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসকে ইসলামিক কর্মকাণ্ডের আবর্তে আনতে পারবে না। আমি প্রত্যয়দৃঢ়ভাবে পুনরুল্লেখ করতে চাই, পূর্বঘোষিত জিহাদ ছাড়া কোনো অবস্থাতেই মানুষ হত্যার কোনো অধিকার ইসলামে নেই। ইসলামের শান্তির ললিতবাণীকে তারা কেবল পরিহাসই করছে না, বরং তাদের জঙ্গি-সন্ত্রাস ও মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ ইসলামকে বিকৃত করছে। মুসলমানদের সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি করছে। আইএস, আল-কায়েদা, তালেবানের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো মূলত আমেরিকার সিআইএ ও ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সৃষ্টি। অথচ তাদের সব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ভার এসে বর্তায় মুসলমানদের ওপর।

আমি অত্যন্ত গুনাহগার একজন মুসলমান (আল্লাহ রিয়ার গুনাহ মাফ করুন), প্রতিনিয়ত তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ি এবং পৃথিবীর সর্বত্রই জঙ্গি-সন্ত্রাসের হাত থেকে সারা বিশ্বের, বিশেষ করে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করি। বর্তমানে বাংলাদেশে আরেকটি বর্ণচোরা শত্রু মুরতাদ। নাম-ধাম ও বংশ পরিচয়ে তারা রমরমা মুসলমান কিন্তু মননশীলতায় তাদের ইসলামের মূল শিক্ষা তো নাই-ই, বরং একটা নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। জ্ঞানে-অজ্ঞানে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে এরা প্রায়শই এমন সব উক্তি করেন, যা শুধু বিভ্রান্তিকরই নয়, ধর্মপ্রাণ নিরীহ মানুষের হৃদয়ে তা নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করে। অনেক অনৈতিকতার মধ্যে আজকে তারা ভাস্কর্যের নামে মূর্তি প্রতিষ্ঠার অপকর্মে ব্যাপৃত। আশ্চর্যান্বিত ও বিস্ময়াভিভূত হয়ে অবহিত হলাম যে, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সামনে গ্রিক দেবী থেমিসের মূর্তি স্থাপনের বিষয়ে স্বয়ং সরকার প্রধানও অবহিত ছিলেন না! এটা কীসের ইঙ্গিত বহন করে? আমাদের দেশে স্বাধীনতাবিরোধী একটি শক্তি সর্বদাই ঘাপটি মেরে রয়েছে। যেকোনো ছল-ছুতোয় একটা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির সুযোগ নিতে সার্বক্ষণিক সচেষ্ট থাকে তারা।

আমাদের পূর্বসূরিরা যারা শহীদ মিনার ও জাতীয় স্মৃতিসৌধ গড়েছেন, এর মধ্যে অন্তর্নিহিত দেশপ্রেম রয়েছে যেটা প্রতীকী। সেখানে মূর্তির কোনো অবস্থান নেই। একটি নতুন স্লোগান এসেছে, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। এ উৎসবের প্রশ্নে আমি পয়লা বৈশাখ, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি বা নজরুল, রবীন্দ্র জয়ন্তীকে মনে করি। কোনো অবস্থাতেই কোনো ধর্মীয় উৎসব সার্বজনীন নয়। সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক সার্বজনীন উৎসবের মধ্যেও পরিশীলিত, পরিমার্জিত এবং পূতপবিত্র চিত্তের পরস্ফুিটন ঘটুক। এর সঙ্গে সঙ্গে নৈতিকতাবিবর্জিত অশ্লীল ও কদর্য যেকোনো কর্মকাণ্ডই সমাজকে অনৈতিকতার দিকেই বারবার টেনে নিয়ে যাবে। যা শুধু নতুন প্রজন্মকে অন্ধকার অমানিশার মধ্যেই ঠেলে দেবে। সব কূপমণ্ডূকতার আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে পবিত্র ও আলোকস্নাত নতুন প্রজন্ম শুধু আলোর পথেই হাঁটবে; জঙ্গি-সন্ত্রাস সৃষ্টির আশঙ্কাও ক্রমান্বয়ে দূরীভূত হবে।

মৌলিক অধিকারবিবর্জিত হলেও বাইরে থেকে দেখলে পরিদৃষ্ট হবে যে, বাংলাদেশ ছিমছামভাবেই চলছে। হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনাটির পর র‌্যাব ও পুলিশের সুতীক্ষ নজরদারিতে বড় কোনো সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বাংলাদেশে ঘটেনি। এটি একটি স্বস্তিদায়ক বিষয়। রোহিঙ্গা ইস্যুতেও বাংলাদেশ বিশ্বজনমতের ইতিবাচক দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ১২ মণ দুধে এক ফোঁটা গো-চনার মতো ভারতের সঙ্গে আমাদের অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর সম্মানজনক সমাধানের ব্যর্থতা বাংলাদেশের মানুষকে শুধু উদ্বিগ্নই করছে না, বরং দুশ্চিন্তার আবর্তে নিক্ষেপ করছে। ভারত কী বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে পানি সমস্যা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক আদালত কর্তৃক সমুদ্রসীমার যে যৌক্তিক সমাধান এসেছে, তাকে উদার চিত্তে গ্রহণ করবে না? অনেক দেরিতে হলেও এই অভাজনের কথাটাই তো সত্য প্রমাণিত হতে যাচ্ছে। ভারতবর্ষ নরেন্দ্র মোদি, যোগী আদিত্যনাথদের উগ্র হিন্দুত্ববাদের কশাঘাতে আজ জর্জরিত। ভারতের মুসলমানরা আজ অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। যে নথুরাম গডস মহাত্মা গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করেছিল, হত্যাস্থলে তার প্রতিকৃতি নির্মাণ সার্বিকভাবে ভারতের স্বাধীনতার প্রতি একটি নির্মম কটাক্ষ ও উপহাস বৈ কিছু নয়।

এর আগের নিবন্ধেও আমি এ বিষয়টি নিয়ে লিখেছি। ফলে কেউ কেউ না বুঝে আমাকে ভারতবিদ্বেষী বলতেও সংকোচ করেন না। এ প্রেক্ষাপটে আমি সবাইকেই বিনম্রচিত্তে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, বিস্তীর্ণ ভারতের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আমার চিত্তকে উদ্বেলিত করে, উচ্ছ্বসিত করে। ভারতকে আমি সব সময়ই বাংলাদেশের বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে দেখতে চাই, প্রভু হিসেবে কখনোই নয়। বিস্তীর্ণ ভারতের কোটি কোটি নাগরিক অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতান্ত্রিক মননশীলতার উদার চিত্তের অধিকারী। ভারতের বিশাল প্রান্তজুড়ে অসাম্প্রদায়িকতার প্রদীপ্ত সূর্য আলো ছড়ায়। কিন্তু বিজেপির নেতৃত্বের একটি অংশ ভারতকে হিন্দুস্তানে পরিণত করার যে হুঙ্কার ছাড়েন, তা শুধু বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ক্ষতবিক্ষত করে না; ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক মননশীলতার মানুষও তাতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং প্রতিবাদ করে।

মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পৃক্ততার কারণে আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, যখন অবলোকন করি, এদেশে সুশীল সমাজের একটি খণ্ডিত অংশ ভারতের প্রভুত্ব তো বটেই, বাংলাদেশ ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য হলেও যেন তারা বর্তে যান। এরা তাদের কথোপকথন, লেখালেখি ও আলোচনা-পর্যালোচনায় নিজেদের বুদ্ধিজীবী হিসেবে জাহির করলেও অসাম্প্রদায়িকতার নামে এমন সূক্ষ্ম প্রচারণা চালান, যেটি কোনো অবস্থাতেই জাতির জন্য কল্যাণকর নয়। জঙ্গি-সন্ত্রাস হারাম, গুপ্তহত্যা হারাম—এটা ইসলামের শাশ্বত সত্য। এটা না মানা মানে ইসলামকেই অস্বীকার করা। জঙ্গি-সন্ত্রাসের যত কঠোর বিরোধিতাই করা হোক, ব্যক্তিগতভাবে আমি তা সমর্থন করি। জঙ্গিবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত। কিন্তু যখন জঙ্গি-সন্ত্রাসের বিরোধিতা করতে গিয়ে জঙ্গি-সন্ত্রাসের সঙ্গে তারা মৌলবাদী শব্দটি সম্পৃক্ত করে দেন (মৌলবাদ ও জঙ্গি-সন্ত্রাস রুখতে হবে) তখনই আমার আপত্তি। কারণ ধর্মের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় অনুসরণ করাই হলো মৌলবাদ। সন্ত্রাসের সঙ্গে একে গুলিয়ে ফেলার মানসিকতা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সংকীর্ণতার বহিঃপ্রকাশ। ইসলামের মূল আদর্শ হলো—শান্তি, ভ্রাতৃত্ববোধ ও মানুষের মৌলিক অধিকারের পরিপূর্ণ স্বীকৃতি। অথচ তরুণ প্রজন্মের একটি অতি উৎসাহী অংশকে মগজধোলাই করে জঙ্গি-সন্ত্রাসের মতো ন্যক্কারজনক কাজে লাগানো হচ্ছে। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তো বন্ধ হবেই না, বরং আশঙ্কা রয়েছে গোটা ইসলামটাই সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত হবে। রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, সংবাদকর্মী, শিক্ষক, এমনকি প্রতিটি পরিবারের সদস্যের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ কূপমণ্ডূকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমরা তা পারব ইনশাল্লাহ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম একটু বিলম্বে হলেও বিজয়ী হবেই। সেই বিজয়ের সূর্যস্নাত আলোয় অবগাহনের অধীর আগ্রহে রয়েছি আমি ও বাংলাদেশের প্রান্তিক জনতা।

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

সর্বশেষ খবর