শিরোনাম
শনিবার, ২৭ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

টার্কি পালনে অভূতপূর্ব সাফল্য

শাইখ সিরাজ

টার্কি পালনে অভূতপূর্ব সাফল্য

নব্বইয়ের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে ঢাকার খিলগাঁওয়ের তালতলায় একটি বাসার বারান্দার এক কোণে আধুনিক পদ্ধতিতে মিসেস জামানের খাঁচায় মুরগি পালনের (কেইজ কালচার পোলট্রি) একটি প্রতিবেদন ধারণ করেছিলাম। তখন আমি বাংলাদেশ টেলিভিশনে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করতাম। কৃষিবিষয়ক এ অনুষ্ঠানটির আবেদন আমাদের কৃষিজীবী সমাজ তো বটেই, শহুরে মানুষের কাছেও ছিল সমানভাবে গ্রহণযোগ্য। এ জাতীয় অনুষ্ঠানকে টেলিভিশন ভাষায় বলা হয় পাবলিক ইউটিলিটি প্রোগ্রাম। অর্থাৎ যে অনুষ্ঠান সমাজের কল্যাণ করে। ধারণ করা মিসেস জামানের মুরগির খামার পর্বটি মাটি ও মানুষ-এ প্রচারিত হওয়ার পর সারা দেশে সাড়া পড়ে গেল। তখনকার বাংলাদেশে মোরগ-মুরগি পালনের চিত্র মানে গ্রামীণ জনপদে বসতভিটায় দুয়েকটি মুরগি ঘুরে-ফিরে খাচ্ছে। কখনো কখনো গৃহস্থের উঠানের এক কোণে মাছ ধরার পলোর নিচে কয়েকটি মুরগির বাচ্চা দেখা যেত। এই ছিল পোলট্রি। মিসেস জামানের পোলট্রি খামার প্রতিবেদনটি প্রচারের পর দর্শকের কাছে এর ব্যাপক সাড়া দেখে একটি ফিলার (তিন মিনিট সময়ের তথ্যচিত্র) নির্মাণ করা হয়েছিল। যাতে টেলিভিশনে নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচারসূচির ফাঁকে ফাঁকে এটিকে বহুবার চালানো যায়। আজকে এ দেশে বাণিজ্যিক মুরগির খামার গড়ে ওঠার পেছনে এটি ছিল টেলিভিশনের মাধ্যমে একেবারে প্রাথমিক উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি। বলতে দ্বিধা নেই, আজকের বাংলাদেশে লাখের কাছাকাছি বাণিজ্যিক পোলট্রি খামার, ৬০-৭০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান, এ যাবৎ এ খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ— এর পেছনে টেলিভিশনের সেই সময়ে মিসেস জামানের মুরগির খামার শিরোনামের পর্ব এবং পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে পোলট্রিবিষয়ক অসংখ্য প্রতিবেদন প্রচারের ভূমিকা অপরিসীম।

দেখতে দেখতে প্রায় ৩০ বছর পার হয়ে গেল। হাজার হাজার তরুণ উদ্যোক্তা খামারি, গৃহবধূ, বেকার যুবক— এদের হাত ধরেই গড়ে উঠল অগণিত পোলট্রি খামার। আমাদের আমিষের চাহিদার অনেকটা জোগান এলো পোলট্রি থেকে। ৩০ বছর আগে যখন এই প্রচারণাগুলো শুরু করি বাংলাদেশ টেলিভিশনে, তখন অনেকেই আমাকে বিদ্রূপ করত। সমালোচনার তীর ছুড়ত। কেউ কেউ বলতেন, এই ফার্মের মুরগি বা ডিম খাবে কে? পাঠক, এতদিন পর যদি আমি আপনাকে প্রশ্ন করি পোলট্রির এই বিকাশ যদি না হতো, তাহলে এই ডিম বা এই মুরগি হয়তো দেখতে হতো জাদুঘরে গিয়ে। কারণ দেশি মোরগ-মুরগি তো প্রায় বিলীন হওয়ার পথে। যুব উদ্যোক্তাদের শ্রম, অর্থ, মেধা, বিনিয়োগে গড়ে ওঠা এই খামার এখন অতিক্রম করছে এক নিদারুণ দুঃসময়। একদিন বয়সের বাচ্চার আকাশছোঁয়া দাম, পোলট্রি খাদ্যের ঊর্ধ্বমুখী বাজারমূল্য, বড় বড় কোম্পানিগুলোর বাণিজ্যিক উৎপাদনে পর্যদুস্ত ছোট খামারি, ঋণ সুবিধা না পাওয়া, সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতার অনুপস্থিতি, এখনো পর্যন্ত কোনো পোলট্রি নীতিমালা না থাকা—সব বিষয় মিলিয়ে বিপর্যস্ত ছোট-বড় খামারিরা। প্রায়শই আক্ষেপ করে বলতে শোনা যায়, আমাদের কোনো অভিভাবক নেই। অথচ আমরা বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের আওতাধীন।

পাঠক, আমার আজকের লেখার বিষয় এটি নয়। আজকের বিষয় টার্কি পালন। লিখতে গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে এ বিষয়গুলোর অবতারণা করলাম। কৃষক, খামারি, উদ্যোক্তা—এরা সবাই নিজের মতো করে উদ্ভূত পরিস্থিতিকে অতিক্রম করে নতুন দিক খুঁজে বের করে। আজকে সে রকম আর একটি বিষয় অবতারণা করছি। যাদের কথা বলব এরা সবাই একসময় বাণিজ্যিক মোরগ-মুরগির খামারি ছিলেন। তরুণ এই খামারিরা অধিকাংশই বিভিন্ন জেলা, উপজেলা বা মফস্বল শহরের। খামার করে কখনো লাভের মুখ দেখেছেন, কখনো অসম বাজার ব্যবস্থাপনার জন্য ভরাডুবি হয়েছে। অনেকেই পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে। কেটে গেছে সেখানে কয়েক বছর। মাটির টানে আবার ফিরে এসেছেন জন্মভূমিতে। সেই তরুণদের হাত ধরে এ দেশে পোলট্রি পরিবারে নতুন একটি দিক উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। যার নাম টার্কি।

৯ মার্চ। সকাল ৭টা। ২০১৭। নরসিংদীর পলাশ উপজেলা। হৃদয়ে মাটি ও মানুষের ধারক দল। প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু এই উপজেলার খানেপুর, পাইকসা গ্রামগুলোতে সবার অগোচরে গড়ে ওঠা টার্কি খামার। এটি বর্তমান সময়ে বাণিজ্যিক কৃষি ও খামারের একটি প্রবণতা বলা যেতে পারে। বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক কৃষি উদ্যোগে বিনিয়োগ বাড়ে এবং তা দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ঠিক এই সময়টিতে সারা দেশে শৌখিন ও বাণিজ্যিক কৃষি উদ্যোক্তাদের পোলট্রি প্রজাতির অন্যতম সদস্য টার্কি পালনে বেশ আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। টার্কি সম্পর্কে অনেকেরই কমবেশি ধারণা আছে। উত্তর আমেরিকার বংশোদ্ভূত এক বিশেষ জাতের পোলট্রি। যা আমাদের দেশে টার্কি মুরগি নামে পরিচিত। এক সময়ের এই বন্যপাখি এখন গৃহে বা খামারে পালন হয়ে থাকে। ইউরোপসহ পৃথিবীর বহু দেশে টার্কি লালন-পালন হয়ে আসছে অনেক আগে থেকে। আমাদের দেশে শুরু হয়েছে গত কয়েক বছর। আস্তে আস্তে টার্কির মাংস জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কারণ টার্কির মাংসে প্রোটিন বেশি কিন্তু কোলেস্টেরল নেই বললেই চলে। সাম্প্রতিক সময়ে টার্কি পালনের অনন্য এক ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে নরসিংদীর পলাশ উপজেলার খানেপুর ও পাইকসা গ্রাম। গ্রাম দুটিকে টার্কির গ্রাম বললেও ভুল হবে না। গ্রাম দুটিতে গড়ে উঠেছে প্রায় শতাধিক ছোট-বড় খামার।

রাস্তার মুখেই খামারি শফিকুল ইসলামের বাড়ি। দীর্ঘদিন বিদেশ থেকে দেশে ফিরে টার্কি পালনে নিয়োজিত হয়েছেন। এখন তার খামারে টার্কির সংখ্যা ছোট-বড় মিলে ৩০০টি। শফিকুল জানালেন তার খামারে এখন রয়েছে তিনটি ব্যাচ। দিলেন এক আশ্চর্য তথ্য— টার্কির বাচ্চা ডিম ফুটে বের হলেই অর্থাৎ একদিনের বাচ্চার দাম হয় ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। দুই সপ্তাহের বাচ্চার দাম হয় ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা। দুই মাস লালন-পালনের পর প্রতিটি টার্কির মূল্য দাঁড়ায় ১৬০০ থেকে ২০০০ টাকা। তিন মাস লালন-পালন করলে এর দাম ৩৫০০ টাকা পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়। বয়স যখন ৬-৭ মাসে পড়ে তখন টার্কি ডিম দেওয়া শুরু করে। আর তখন প্রতিটির বাজার দর দাঁড়ায় ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। এর পেছনে শফিকুলের খরচ হয় মাত্র দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। আরও একটি তথ্য দিয়ে রাখতে চাই শফিকুলের খামার নিয়ে। সাধারণত দুই মাস পর পর ব্যাচ বের হয়। তবে  কোনো কোনো ব্যাচ দেড় মাস পরেও বের হয়। শফিকুল ইসলাম আরও বললেন টার্কির খাওয়া সাধারণ মুরগির খাবারের সঙ্গে সঙ্গে ঘাস, লতা, পাতা, পোকা-মাকড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক খাবার। তাই খাবার খরচ অনেক কম। আবার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি বলে চিকিৎসা বা রোগ-বালাইয়ের জন্য অতিরিক্ত খরচ করতে হয় না। আরেক খামারি মতিউর রহমান দীর্ঘদিন ব্রয়লার লালন-পালন করে বেশ লোকসানের মুখে পড়েছিলেন। শফিকুল ইসলামের সাফল্য দেখে তিনিও উদ্বুদ্ধ হন টার্কি মুরগি লালন-পালনে।  ব্রয়লার নিয়ে মতিউরের অভিজ্ঞতায় শুধু ক্ষতির পরিমাণটাই উঠে এলো। রোগ-বালাইয়ের ক্ষেত্রে ব্রয়লারের মৃত্যুহার বেশি হওয়ায় লোকসানে পড়তে হয়েছে অনেকবার। সেদিক থেকে টার্কি বেশ লাভজনক মতিউরের কাছে। বললেন এর মাংস বেশ সুস্বাদু। চার বছর আগে বিদেশ থেকে ফিরে মাত্র ১২টি টার্কির বাচ্চা দিয়ে শুরু করেছিলেন আবদুর রব। এখন শতাধিক টার্কি নিয়ে চলছে তার খামার। যেখান থেকে ব্যাপক লাভ আসছে, জানাচ্ছেন তিনি। দেখা হলো আলমগীর হোসেনের সঙ্গে শফিকুলের খামারে। আলমগীর এসেছেন গাজীপুর থেকে। অনেক দিন হলো বিদেশ থেকে ফিরেছেন। কিন্তু কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। শফিকুলের খামারের খবর পেয়ে সোজা চলে এসেছেন টার্কির বাচ্চা কিনতে। ১০টি টার্কির বাচ্চা ২০ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছেন তিনি। এখন তারও স্বপ্ন দ্রুত লাভের মুখ দেখবেন তিনি। বড় করবেন তার টার্কির খামার।

প্রিয় পাঠক, পাইকসা গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির আনাচে-কানাচে প্রায় সব জায়গায় টার্কির বিচরণ। অনেকটা দেশীয় মুরগির মতোই, শুধু আকারে ভিন্ন। ১০, ২০, ৩০ থেকে শতাধিক টার্কি নিয়ে প্রায় ৬০-৭০টি খামার গড়ে উঠেছে এই পাইকসা গ্রামে। নারী-পুরুষ কিংবা বেকার যুবক সবাই ঝুঁকছেন টার্কি পালনে। ঘরের কোণে, উঠানে আলাদা ছোট ঘর করে অথবা খোলা জায়গায় এসব টার্কি পালন করছেন তারা। সবার ওই একই কথা—অতীতের অন্য যে কোনো ধরনের পোলট্রি থেকে টার্কি পালনে অধিক লাভ অথচ ঝুঁকি কম।

এ তো গেল নরসিংদী জেলার কথা। নওগাঁ জেলায় ঘরে পালন উপযোগী পাখির এক অভয়াশ্রম গড়ে তুলেছেন শালুকা গ্রামের জিল্লুর রহমান। নানারকম পাখির ভিড়ে তার কাছে সবচেয়ে লাভজনক হচ্ছে পোলট্রি প্রজাতির তৃণভোজী টার্কি। ২০১২ সালে মাত্র ২২টি টার্কি দিয়ে শুরু হয় তার এই যাত্রা। এখন তার খামারে রয়েছে বড় আকারের ১০০টি টার্কি। আর প্যারেন্টস বা মা মাতৃজাত আছে ২০০টি। যা দিয়ে প্রতি মাসে গড়ে ৫০০টি বাচ্চা উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। তিনি জানাচ্ছেন, ৮ থেকে ১০ মাসে একটি টার্কি সঠিক প্রতিপালনে ১০ থেকে ১২ কেজি ওজনের হতে পারে। তিনি বলছেন টার্কি শাক-সবজি খেতে পছন্দ করে। পাশাপাশি দানাদার খাবারও দিচ্ছেন টার্কিকে। বাংলাদেশের আবহাওয়া টার্কির জন্য উপযুক্ত বলে মনে করেন জিল্লুর রহমান। দেশি-বিদেশি পাখির জীবনচক্র আর ভালো-মন্দের সঙ্গে মিশে গেছেন জিল্লুর রহমান। নিজের উদ্যোগে তৈরি করেছেন ইনকিউবেটর। কম মূল্যে বাচ্চা উৎপাদন করে সরবরাহ করছেন তিনি। পোলট্রি শিল্প যখন একদিনের বাচ্চার দুর্মূল্যের কারণে বিপর্যয়ের মধ্যে আছে, তখন জিল্লুর রহমানের এই উদ্যোগ দৃষ্টান্তমূলক। তিতির এবং টার্কি মিলে একসঙ্গে এক হাজার ৭০০ বাচ্চা ফোটানোর মতো ব্যবস্থা রয়েছে তার হ্যাচারিতে। প্রতিটি একদিনের বাচ্চার মূল্য ৭শ টাকা। উৎপাদনক্ষমতা আরও বাড়ানো গেলে বাচ্চার মূল্য কমে আসবে বলে আশাবাদী এই উদ্যোক্তা। প্রিয় পাঠক, আমিষের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে উঠছে টার্কি। আমি টেলিভিশনে আগেও দেখিয়েছি দেশের বিভিন্ন জেলার শৌখিন ও কৃষি অনুরাগী উদ্যোক্তারা গড়ে তুলছেন টার্কি ও তিতিরের খামার। অল্পদিনেই পাচ্ছেন ভালো সাফল্য ও লাভ। দানাদার খাবারের তুলনায় প্রাকৃতিক ঘাস জাতীয় খাবারই টার্কির জন্য উপাদেয়। এতে খাদ্যের খরচ যেমন কম অন্যদিকে মাংসের গুণগত মানও অনেক ভালো। সম্পূর্ণ কোলেস্টেরলমুক্ত মাংস হওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপীই টার্কির মাংস অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর হিসেবে স্বীকৃত। এসব দিক বিবেচনায় নতুন উদ্যোক্তারা গড়ে তুলছেন টার্কির খামার। এতে বোঝা যায়, অল্পদিনেই আমাদের উত্কৃষ্টমানের আমিষের চাহিদা পূরণে টার্কি রাখবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

     [email protected]

সর্বশেষ খবর