শনিবার, ২৭ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকাররমের খুতবা

মাহে রমজানের প্রস্তুতি

মুফতি এহসানুল হক জিলানী
পেশ ইমাম, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ

মাহে রমজানের প্রস্তুতি

রমজান হিজরি সনের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম মাস, সবচেয়ে বেশি ফজিলতের মাস, সবচেয়ে বেশি সওয়াব অর্জনের মাস। রমজান হলো মুসলমানদের সওয়াব অর্জন করার সিজন। ব্যবসায়ীদের যেমন ব্যবসার সিজন থাকে, যখন তাদের ব্যবসা ও মুনাফা বেশি হয়। তদ্রূপ মুমিনদের জন্য রমজান মাস হলো সওয়াব অর্জনের সিজন। যখন একটা  নফল ইবাদত একটা ফরজের সমতুল্য হয়ে যায় এবং একটা ফরজের সওয়াব ৭০টা ফরজের সমান হয়ে যায়।

ব্যবসায়ী তার সিজন আসার আগে মনে মনে প্রস্তুতি নেয় যে, এ সিজনকে আমার কাজে লাগাতে হবে। অন্য কোনো কাজ আমি বুঝি না, কোথাও বেড়ানো, কোথাও ঘোরাঘুরি আমি বুঝি না। সিজনের সময় আমি ব্যবসা ছাড়া আর কিছু বুঝি না, রমজানের জন্যও এরকম মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে। দুনিয়ার যত ঝামেলা আছে, রমজান আসার আগেই আমি সে সব ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে যাব। অন্তত এতটুকু মুক্ত হয়ে যাব যে, রমজানের রোজা রাখতে রমজানের অন্যান্য ইবাদত যেমন—তারাবি পড়া, কোরআন তেলাওয়াত করা ইত্যাদির জন্য কোনো বাধা না থাকে। সব বাধা আগেই আমি দূর করে নেব। রমজানের জন্য আগে থেকেই এরকম প্রস্তুতি নেওয়ার দিকে ইঙ্গিত করে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা শাবান মাসের চাঁদ ঠিকমতো গণনা করে রাখা।’ শাবানের কয় দিন যাচ্ছে আর কয়দিন রমজান আসতে বাকি আছে ঠিকমতো খেয়াল রাখ। রমজানের খাতিরে তোমরা এটা কর। মানুষ যখন মনে মনে কোনো বিষয়ের প্রস্তুতি গ্রহণ করে, তখন সে বিষয়টি যতই কঠিন হোক সে করতে পারবে। মনের হিম্মত কঠিন কাজকেও সহজ করে দেয়। কেউ যদি হিম্মত করে আমি রোজা রাখবই, তাহলে সামান্য একটু গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা, একটু স্বাস্থ্যের দুর্বলতা, এসব অজুহাত কোনো বাধা হতে পারবে না। এসব অজুহাত দিয়ে রমজানের রোজা তরক করার কোনো অবকাশ নেই। তবে বাস্তবিকই যদি কেউ অসুস্থ হন এবং দীনদার ডাক্তার তাকে রোজা না রাখার পরামর্শ দেন, তাহলে রোজা ছাড়া যাবে। তবে এরকম রোজাও পরে সুস্থ হলে কাজা করে নিতে হবে। অনেক সময় ডাক্তারদের জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজনও হয় না, নিজের মনকে জিজ্ঞাসা করলেই মন থেকে উত্তর পাওয়া যায় যে, বাস্তবেই আমি রোজা ছাড়ার মতো মাজুর না কি অসুস্থের কথা বলে রোজা ছাড়ার বাহানা করছি। রসুল (সা.) অনেক ব্যাপারে বলতেন : ‘তোমার মনের কাছে ফতুয়া জিজ্ঞাসা করে দেখ।’ অতএব আমি রোজা রাখতে সক্ষম না অক্ষম তা নিজের কাছেই জিজ্ঞেস করলেই উত্তর পেয়ে যাবে। মানুষকে অনেক কিছু বলে বোঝানো যায় যে, আমার এই ওজর সেই ওজর, কিন্তু মনের ভিতর চোর লুকানো আছে কি-না তা অন্য কোনো মানুষ না দেখলেও আল্লাহপাক তো দেখবেন। আল্লাহ মনের বিষয় সম্পর্কেও সম্যক অবগত। তাই অহেতুক অজুহাত বের করে রোজা ছাড়লে আল্লাহর কাছে ধরা পড়তে হবে। হাদিস শরিফে এসেছে, রসুল (সা.) বলেন : ‘প্রকৃত পক্ষে অসুস্থ নয়, শরিয়তে তাকে রোজা ছাড়ার অনুমতি দেয়নি এ অবস্থায় কেউ যদি রমজানের রোজা ছাড়ে তাহলে সারা জীবন সেই রোজা কাজা করতে থাকলেও ওই ঘাটতি পূরণ হবে না।’ তাই রোজা রাখার হিম্মত করতে হবে। হিম্মত করলে রোজা রাখা সহজ। হিম্মত না রাখলে কঠিন। অনেকেই এই হিম্মতের অভাবেই তারাবিও পড়তে পারে না। মনে করে ২০ রাকাত তারাবি পড়তে হবে, এটা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। এভাবে তারা হিম্মত হারিয়ে ফেলে। হিম্মত হারালে চলবে না। তারাবি পড়া সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ এবং ২০ রাকাত তারাবি পড়া সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। তারাবির নামাজে পুরো কোরআন শরিফ নিজে পড়া বা শোনা অর্থাৎ খতম তারাবি পড়া, এটাও সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। বিনা ওজরে শরিয়ত সম্মত কারণ ছাড়া সুন্নতে মুয়াক্কাদা তরক করা গুনাহ।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন : ‘হে মুমিন, তোমাদের ওপর রোজাকে ফরজ করে দেওয়া হয়েছে, যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্যও রোজাকে ফরজ করে দেওয়া হয়েছিল যাতে করে মুত্তাকি হতে পার।’ মুফাসিরীনে কেরাম বলেছেন : এখানে পূর্ববর্তী লোকদের রোজা রাখার কথা এজন্য উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে মানুষ রোজা রাখতে কষ্টবোধ না করে। কারণ এটা শুধু আমাদের জন্যই নয়, বরং আগের যুগের লোকেরাও করে আসছে। যখন মানুষ কোনো একটা কষ্টের বিষয়ে আরও অনেককে শরিক দেখতে পায়, তখন সে বিষয়টা তার কাছে আর কষ্টকর বোধ হয় না। আরও একটা কথা মনে রাখতে হবে— কেউ যদি কোনো ভালো কাজ করতে চায়, আর সেটা করতে পারে, আল্লাহপাকই তাকে সেটা করার তৌফিক দান করেন। হাদিস শরিফে এসেছে : রসুল (সা.) বলেন, ‘যদি কেউ মনে মনে মজবুত এরাদা রাখে যে, আমি মানুষের দারস্থ হব না, তাহলে আল্লাহপাক তাকে মানুষের দারস্থ হওয়া থেকে মুক্ত রাখেন।

কেউ যদি গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে পবিত্র জীবনযাপন করতে চায়, আল্লাহপাক তাকে গুনাহমুক্ত পবিত্র জীবনযাপন করার তৌফিক দেন। যদি কেউ ইবাদতের ওপর অটল থাকতে চায়, আল্লাহপাক তাকে ইবাদতের ওপর অটল থাকার তৌফিক দান করেন।’ এ হাদিসে বোঝানো হয়েছে, আমরা কোনো নেক কাজের এরাদা করলে আল্লাহপাকই আমাদের জন্য সব ব্যবস্থা করে দেবেন, আল্লাহপাকই আমাদের সেটা করার তৌফিক দেবেন। কাজেই আমরা যদি মজবুত এরাদা করে নেই, ঠিকমতো রোজা রাখব, ঠিকমতো তারাবি আদায় করব, রমজানের হক আদায় করে কোরআন তেলাওয়াত করব, তাহলে আল্লাহপাক আমাদের এগুলো করার তৌফিক দান করবেন। আমিন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর