শনিবার, ৩ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

চিকিৎসক লাঞ্ছিত হাসপাতালে বিশৃঙ্খলা সমাধান কী?

ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

চিকিৎসক লাঞ্ছিত হাসপাতালে বিশৃঙ্খলা সমাধান কী?

কিছু দিন আগে সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক ছাত্রীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ভাঙচুর ও চিকিৎসকদের ওপর হামলা চালায় একদল শিক্ষার্থী। পাশাপাশি ওই ঘটনায় হাসপাতালের পরিচালক এবং চিকিৎসকদের মারধর করা হয়। পরে নয়জনকে আসামি করে মামলাও করা হয়। তাদের অভিযোগ, ভুল চিকিৎসায় এবং ভুল ওষুধে তার মৃত্যু হয়েছে। ইদানীং প্রায়ই রোগীদের চিকিৎসা ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে অবহেলার অভিযোগে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ল্যাবরেটরি ভাঙচুরের ঘটনাসহ ডাক্তার, নার্স এবং কর্মচারীদের ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে, মামলা দায়ের করে হয়রানি করার মতো ঘটনা ঘটছে। বর্তমানে এ অবস্থা ভয়াবহ উদ্বেগজনক, এমনকি সুষ্ঠু চিকিৎসার পরিবেশের অন্তরায়। সামান্য ঘটনার জের ধরে অযথাই চিকিৎসকদের গায়ে হাত তোলার মতো ঘটনা ঘটেই চলেছে। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে জটিল ও মুমূর্ষু রোগীকে জরুরি চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে গিয়ে চিকিৎসকরা ভীতির মধ্যে কাজ করছেন। একটু সমস্যা মনে হলেই অনেক চিকিৎসক রোগীকে অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেরা রোগীর চিকিৎসাসেবা এড়িয়ে যেতে চাচ্ছেন। ফলে জরুরি চিকিৎসাসেবাও অনেকাংশে হুমকির সম্মুখীন। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বন্ধ হওয়ার উপক্রম। একদিকে অন্য রোগীরা আতঙ্কিত হয়ে যাচ্ছেন, অন্যদিকে হাসপাতালের কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। এমনও শোনা যায়, কিছু দুষ্কৃতিকারী অর্থ আদায়ের লোভে অথবা ক্লিনিকের বিল পরিশোধ না করার দুরভিসন্ধি নিয়ে এসব ঘটনা ঘটিয়ে থাকে।

শুধু আমাদের দেশেই নয়, অন্য অনেক দেশেই বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় এমনটা প্রায়ই দেখা যায়। পাশের দেশ ভারতেও এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে চিকিৎসকদের মারধর, মামলা, হয়রানি, হাসপাতাল ভাঙচুর ইত্যাদি সম্পর্কে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০০৯ সালে এক যুগান্তকারী রায় দেয়। সেই রায় অনুযায়ী কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ তোলা হলে তার প্রাথমিক সত্যতা ছাড়া ওই চিকিৎসককে গ্রেফতার করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে প্রথমে কোনো যোগ্য বিশেষজ্ঞ বা বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মতামত নিতে হবে। এর পরই শুধু সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে নোটিস জারি করা যাবে। আদালত মনে করে চিকিৎসা পেশাকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করায় অত্যন্ত তুচ্ছ ঘটনায়ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই তদন্ত প্রক্রিয়ায় যারা শেষ পর্যন্ত দোষী সাব্যস্ত হবেন না, তারা যেন অযথা হয়রানির শিকার না হন, তা নিশ্চিত করা দরকার বলে আদালত মত প্রকাশ করে। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক করে বলা হয়, আনীত অভিযোগ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসকদের যেন গ্রেফতার বা হয়রানি না করা হয়, অন্যথায় তাদেরও আইনগত ব্যবস্থা মোকাবিলা করতে হবে। ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের ওই রায়ে আরও উল্লেখ করা হয়, প্রকৃত অর্থে যেসব চিকিৎসক চিকিৎসায় অবহেলার সঙ্গে জড়িত, তাদের প্রতি আদালতের কোনো সহানুভূতি নেই।

২০১০ সালে ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকার চিকিৎসকদের ওপর হামলা বন্ধে একটি আইন পাস করে। ওই আইনে কেউ চিকিৎসকদের ওপর হামলা করলে তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান করা হয়। মহারাষ্ট্র মেডিকেল সার্ভিস পারসন্স অ্যান্ড মেডিকেয়ার সার্ভিস ইনস্টিটিউশন্স (প্রিভেনশন অব ভায়োলেন্স অ্যান্ড ড্যামেজ প্রপার্টি) অ্যাক্ট, ২০১০ নামে এ আইন পাস হওয়ার পর চিকিৎসকরা স্বস্তিবোধ করছেন। সত্যিকার অর্থে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করলে আইন প্রণয়ন করতে হয়, তা সহজেই প্রণিধানযোগ্য। ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের দাবি ছিল, অভিযোগ প্রমাণের আগে যেন চিকিৎসকদের গ্রেফতার ও হয়রানি করা না হয় এবং চিকিৎসকদের ওপর হামলায় দায়ীদের যেন আইনের আওতায় আনা হয়। যেহেতু এ ধরনের ঘটনা আমাদের দেশেও ঘটছে, তাই এ রকম আইন করা যায় কিনা, তা সংশ্লিষ্ট সবার ভেবে দেখা উচিত।

অনেক জটিল রোগী যেমন স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনি বা লিভার নষ্ট হয়ে গেলে, ব্লাড ক্যান্সার বা অন্য অনেক ক্যান্সার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিরাময়যোগ্য নয়। মুমূর্ষু রোগীদের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়, সেখানেও মৃত্যুর হার বেশি। শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে চিকিৎসা কখনো সম্ভব নয়। মৃত্যু অমোঘ, চিরন্তন। মৃত্যুর হাত থেকে চিকিৎসক এবং কেউই বাঁচাতে পারবে না। চিকিৎসক শুধু রোগ নিরাময় আর রোগীকে রোগের উপশম দেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। কোনো অবহেলা বা অপচিকিৎসা বা ভুল চিকিৎসা যেন না হয়, সেদিকে ডাক্তারকে বেশি যত্নবান হতে হবে। দু-একটি ক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। রোগীর মৃত্যু বা বড় কিছু হলেই তার লোকজন ও আত্মীয়স্বজন উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, তারা সেবাদানকারী ডাক্তার-নার্সের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ, এমনকি শারীরিক নির্যাতন বা হাসপাতাল-ক্লিনিকে হামলা চালিয়ে প্রচুর ক্ষতি সাধন করেন। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই যুক্তিহীন এসব কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। ফলে যে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডাক্তাররা চিকিৎসা দেওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন।

আসলে দেশে চিকিৎসা ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজমান। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, চিকিৎসা আজ অনেক ক্ষেত্রে বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ যথাযথ সেবা পাচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালের কাজকর্মে অবহেলা আর অনীহা, ঠিকভাবে রোগীর সেবায় আত্মনিয়োগ না করা, রোগী এবং তার লোকের সঙ্গে সহযোগিতা না করা, রোগ সম্পর্কে তাদের অবহিত না করা, এ ধরনের অভিযোগ তো অহরহ ঘটছেই। বেসরকারি হাসপাতালেও বিপুল টাকা-পয়সা খরচের পরও অনেক ক্ষেত্রে উপযুক্ত সেবা না পাওয়ার অভিযোগও কম নয়। কিছু কিছু নামিদামি হাসপাতালে চিকিৎসা খরচ এতটাই আকাশচুম্বী যে, গরিব, নিম্নবিত্ত এমনকি অনেক মধ্যবিত্তের পক্ষে সেখানকার সেবা নেওয়া কষ্টকর। দেখা যায়, অনেকেই না জেনে নামিদামি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান, কিন্তু চিকিৎসা শেষে যখন বিশাল অঙ্কের বিল ধরিয়ে দেওয়া হয়, তখন শুরু হয় অসন্তোষ আর ভাঙচুর। অনেক রোগীর অভিযোগ, বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার চেয়ে চিকিৎসা বাণিজ্যই চলে বেশি। অনেকে ওইসব হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে শেষে নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসেন। দেখা যায়, মনঃক্ষুণ্ন হয়ে গালিটা ডাক্তারকেই দেওয়া হয়।

সেবার চেয়ে অর্থই যখন মূল প্রেরণা হয়ে যায়, তখন চিকিৎসায় যথাযথ প্রাপ্তি মেলার সম্ভাবনা কমই থেকে যায়। আসলে এসবের জন্য ডাক্তার-নার্সকেই ঝক্কিটা পোহাতে হচ্ছে বেশি, যদিও তারা এককভাবে দায়ী নয়। মেডিকেল কলেজগুলোতেও শুরু হয়েছে উচ্ছৃঙ্খলতা। সুষ্ঠুভাবে পড়াশোনার পরিবেশের যেমন অভাব, তেমনি শিক্ষক সংকট, যোগ্য শিক্ষকের অভাব, দলীয় অথবা রাজনৈতিক প্রভাব বলয় সবকিছুই যোগ্য ডাক্তার তৈরির অন্তরায়। যত্রতত্র প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ গড়ে ওঠায় চিকিৎসা শিক্ষার মান আরও নিম্নমুখী। সেখানে মেধার বিকাশের চেয়ে টাকা উপার্জনটাই মুখ্য। ভালো ডাক্তার তৈরির ব্যবস্থা না করে, ভালো সেবা পাওয়া কি সম্ভব? এ ব্যাপারে একতরফা ডাক্তারদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিলে অসন্তোষই বাড়বে, সমস্যার সমাধান হবে না, চিকিৎসার উন্নতিও হবে না, মানুষ ভালো সেবাও পাবে না। জনগণের মনে রাখা উচিত, এসব ব্যাপারে ডাক্তারদের কিছুই করার নেই, দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণ কর্তৃপক্ষের।

ডাক্তারদেরও ভেবে দেখা উচিত, এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সৃষ্টি কেন হচ্ছে? কেনই বা জনসাধারণ অপ্রাপ্তি বা অসন্তোষের কারণে এতটা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে? যারা চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন তাদের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধা আর সম্মান থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল, তার বদলে এই অশ্রদ্ধা কেন? চিকিৎসকদের উপলব্ধি করা দরকার, মানুষ অত্যন্ত দায়ে পড়ে তাদের শরণাপন্ন হন। একজন রোগী যখন চিকিৎসকের কাছে যান, তখন উদ্বিগ্ন থাকাই স্বাভাবিক। তাই তার প্রতি একটু সদয় আচরণ অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে পারে। চিকিৎসার শুরুতেই রোগী ও তার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যথাযথ তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। অনিরাময় রোগ সম্পর্কে রোগী বা তার আত্মীয়স্বজনকে ভালোভাবে ধারণা দিয়ে রাখা উচিত। অনেকের অভিযোগ, ডাক্তাররা রোগীর সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলেন না, রোগীদের কথা মন দিয়ে শোনেন না, ভালোভাবে পরীক্ষা করেন না। এ ধরনের অভিযোগ একেবারেই অমূলক নয়, এদিকে সব চিকিৎসকের দৃষ্টি দেওয়া উচিত। সব রোগ চিকিৎসা করে নিরাময় করা যাবে না, পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেও নয়, এ কথাটুকুই রোগীর স্বজনকে বুঝিয়ে দিতে হবে। এতে কথায় কথায় রোগীদের অভিযোগ যেমন— ভুল চিকিৎসা হলো, রোগ ধরতে পারল না ইত্যাদি কমে যাবে। ডাক্তারকে মনে রাখতে হবে, কোনো রোগীর প্রতি যেন অবহেলা বা দুর্ব্যবহার না হয়। একটা ছোট বাচ্চা অসুস্থ হলে স্বভাবতই তার পিতা-মাতা, দাদা-দাদি, নিকটাত্মীয় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন, সেটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে ডাক্তারদের আরও নমনীয় ও সহনশীলতার সঙ্গে বাচ্চার চিকিৎসাসহ তার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে হবে।

ডাক্তারদের অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে, কথায় কথায় তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে কোনো অবস্থাতেই ধর্মঘট করা একেবারেই অনুচিত। এমনকি অনেক সময় ধর্মঘটের নামে জরুরি চিকিৎসাসেবাও বন্ধ করে দেওয়া হয়, যা নিতান্তই অমানবিক। এ অবস্থার সৃষ্টি হলে ডাক্তারদের মানুষ কেন শ্রদ্ধা করবে? ফলে ডাক্তার ও রোগীর পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি ঘটতেই থাকবে।

মানবসেবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মেধাবী ছেলেরাই ডাক্তারি পেশায় আসার পরে অনেকাংশেই বদলে যান। পেশাটা হয় অর্থ উপার্জনের নেশা। ফলে নৈতিকভাবে ডাক্তারি পেশার মান-মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়। একজন ডাক্তার অবশ্যই তার মেধা, দক্ষতা আর মমত্ববোধ দিয়ে রোগীর সেবা করবেন। এটাই রোগীরা চান। চিকিৎসা দিতে গিয়ে রোগীর আর্থিক বিষয়টা বিবেচনায় নেওয়া উচিত। অযথা অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দেওয়া উচিত হবে না, যা একজন নিম্নবিত্তের পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু বাস্তবে অনেক ডাক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই, তারা বিভিন্ন ল্যাবরেটরি থেকে কমিশন নিয়ে অযথা অপ্রয়োজনীয় মাত্রাতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান। অনেক ডাক্তার অপ্রয়োজনে অনেক ওষুধ লিখে থাকেন। ওষুধও যে রোগীর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, তা অনেকেই মনে রাখেন না। এই সংশয় দূর করার জন্য ডাক্তারকেই এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, তাদের যেমন ভালো ডাক্তার হতে হবে, ভালো মানুষও হতে হবে। নিজের ভালো না লাগলেও রোগীর যে কোনো কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। রোগীকে ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। সম্ভব হলে তার রোগ সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। রোগী যেন বুঝতে পারে ডাক্তার আসলেই তার প্রতি আন্তরিক। এতে ডাক্তারের প্রতি রোগীরাও আকৃষ্ট হবে, বার বার তার কাছেই যাবে, গড়ে উঠবে আত্মার সম্পর্ক।

রোগী ও তার আত্মীয়স্বজনের বোঝা উচিত, যেহেতু ডাক্তারের কাছে কোনো না কোনো সময়ে চিকিৎসার জন্য যেতেই হবে, তাই তাদের সঙ্গে ভদ্র, মার্জিত, সহনশীল আচরণ করা উচিত। একতরফা শুধু ডাক্তারকে দোষ দেওয়াটাও অন্যায়। হাসপাতালে ওষুধ নেই, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নেই, বিছানাপত্র ভালো নেই, খাওয়া-দাওয়ার মান নিম্নমুখী, পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বাইরের ল্যাবরেটরিতে যেতে হয়, এগুলোর দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণ সরকার আর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। অথচ এসবের জন্য দোষ দেওয়া হয় ডাক্তারদেরই। ফলে ভুল বোঝাবুঝি আরও বাড়ে। অনেক সময় দেখা যায়, হাসপাতালের নির্ধারিত ভিজিটিং সময় ছাড়াও রোগীর আত্মীয়স্বজন জোর করে ঢুকে পড়েন, চিকিৎসায় বাধার সৃষ্টি করেন। ফলে হাসপাতালে কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। বিশ্বের কোনো দেশেই নির্দিষ্ট সময়ের পর রোগীর স্বজনদের বিশেষ অনুমতি ছাড়া ভিতরে থাকতে দেওয়া হয় না। হাসপাতালে কেউ গোলযোগ করতে পারে না। শুধু তাই নয়, হাসপাতালের বাইরের রাস্তার মোড়ে মোড়ে লেখা থাকে, গাড়ির ভেঁপু বাজানো নিষেধ, সামনে হাসপাতাল। আমাদের দেশেও কাগজে-কলমে একই নিয়ম, বাস্তবে পদে পদে এসব নিয়ম লঙ্ঘিত হয়।

আমাদের দেশে রোগীর সংখ্যা বেশি, চিকিৎসার সরঞ্জামাদি ও ওষুধপত্র সীমিত, ডাক্তারসহ অন্য লোকবলও সীমিত। ফলে সত্যিকারের সেবাদান আসলেই সম্ভব হচ্ছে না। অনেকের মানসিকতা এমন, উন্নত ভালো সেবা চাই, কিন্তু টাকা খরচ করতে চাই না। অথচ অন্য অনেক খাতে আমরা ঠিকই টাকা খরচ করি। এসবের কারণে ডাক্তার ও রোগীর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি এবং দূরত্ব থেকেই যাচ্ছে। সবশেষে এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, আমরা একজন আরেকজনের ওপর শুধু দোষ দিয়েই যাচ্ছি, নিরাময়ের চেষ্টাটা কমই হচ্ছে। তাই সবাইকে সত্যিকার কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। ভালো, মানসম্মত ডাক্তার তৈরির যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য ভালো শিক্ষক ও শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ডাক্তারদের মেডিকেল শিক্ষার বাইরেও রোগী এবং তার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আচার-আচরণ কীভাবে করতে হয়, তারও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র মেডিকেল কলেজ খোলার ব্যাপারে আরও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ডাক্তারের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে, তা অবশ্যই যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে করা উচিত। শুধু আবেগের বশে ভাঙচুর বা উচ্ছৃঙ্খল আচরণ যেন না হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশের চিকিৎসকদেরও ভুল হয়। এ ধরনের ভুলের ক্ষেত্রে মামলা অবশ্যই হতে পারে। কিন্তু দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কোনোভাবেই চিকিৎসকদের গ্রেফতার করা উচিত নয়। ডাক্তারদের সঙ্গে খুনের মামলার আসামির মতো আচরণ কোনোক্রমেই কাম্য হতে পারে না। চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে স্বাভাবিক চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। এ বিষয়টি রোগী ও তার স্বজনদের উপলব্ধি করতে হবে।

সরকার ও কর্তৃপক্ষের একটি নৈতিক অবস্থান নেওয়া উচিত। কোনো হাসপাতালে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা বা এর পরিণামে এক মুহূর্তও ধর্মঘট চলতে দেওয়া হবে না— এ রকম একটি জাতীয় সমঝোতা স্মারকপত্র গৃহীত হওয়া দরকার, যেখানে স্বাক্ষর করবেন চিকিৎসক, কর্তৃপক্ষ এবং সমাজের প্রতিনিধিরা। রোগীদের প্রতি সরকারসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ ও চিকিৎসকদের একটি অঙ্গীকার থাকা উচিত। কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে চিকিৎসাসংক্রান্ত মামলা হলে গ্রেফতারের আগে বিএমডিসির অনুমতি নেওয়া উচিত। সবশেষে মনে রাখতে হবে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নতির যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে ভারতীয় কোর্টের রায়ের মতো আমাদের এখানে রায় হলেও তা বাস্তবায়ন হবে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাবে।

লেখক : অধ্যাপক ও ডিন, মেডিসিন অনুষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর