সোমবার, ৫ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

জাতীয় বাজেট : কৃষকের প্রাপ্তি কতখানি

শাইখ সিরাজ

জাতীয় বাজেট : কৃষকের প্রাপ্তি কতখানি

জাতীয় বাজেট এখন শুধু অর্থনৈতিক বরাদ্দ ও নীতি পরিকল্পনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। জাতীয় বাজেট এখন সব শ্রেণিপেশার মানুষের ভালোমন্দের একটি বাৎসরিক খতিয়ানে পরিণত হয়েছে। এ সম্পর্কে মানুষের জানা-বোঝাও বাড়ছে। সরকারের সঙ্গেও দূরত্ব কমছে সাধারণ মানুষের। সময়ের বিবর্তনে নানাভাবে বিভিন্ন স্তর ও শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে নানা প্রক্রিয়ায় নিবিড় হচ্ছে সরকার।  মানুষের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমরা চ্যানেল আই-এর হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের পক্ষ থেকে ১৩ বছর ধরে দেশের প্রত্যন্ত এলাকার কৃষক নিয়ে প্রাক-বাজেট আলোচনা করে আসছি। এ কার্যক্রমে সরকারের মন্ত্রী পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যবৃন্দ উপস্থিত থাকেন। খোদ বাজেট প্রণেতা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এদেশের সফল অর্থমন্ত্রী হিসেবে সপ্তমবারের মতো এ কার্যক্রমে উপস্থিত থেকেছেন। এটি কৃষকের সঙ্গে সরকারের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক; এবার বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী নিজেই তুলে ধরেছেন তার এ অভিব্যক্তি। অর্থমন্ত্রী জাতীয় বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে যেসব সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রাক আলোচনা করে থাকেন, তাদের কাছে অকুণ্ঠচিত্তে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। এবার অর্থমন্ত্রীর এই বাজেট বক্তৃতায় বিশেষভাবে উঠে আসে হৃদয়ে মাটি ও মানুষ আয়োজিত কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট প্রসঙ্গ।

অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেন, ‘আমি সবসময় বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক করতে চাই। এ লক্ষ্যে প্রতিবারের মতো এবারও বাজেট প্রণয়নের প্রাক্কালে আমরা কথা বলেছি সংসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ, পেশাজীবী এবং ব্যবসায়ী সংগঠন, এনজিও নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক এবং মন্ত্রণালয়/বিভাগের সচিবদের সঙ্গে। বাজেট বিষয়ে কৃষকের ভাবনা ও মতামত গ্রহণের জন্য আমি ঝালকাঠিতে একটি মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণ করি। ‘মাটি ও মানুষ’ প্রোগ্রামের ব্যানারে ‘চ্যানেল আই’ এ সভাটি আয়োজন করে। ‘চ্যানেল আই’ কৃষকের বাজেট ভাবনা নিয়ে এ ধরনের ছয়টি অনুষ্ঠান শেষে একটি সুপারিশমালাও আমাকে প্রদান করে। অন্যান্য ১১টি আলোচনায়ও বিভিন্ন মহল থেকে সবাই আমাকে বিভিন্ন আঙ্গিকে বাজেট প্রণয়নে নানা ধরনের পরামর্শ প্রদান করেন। আমরা প্রথমবারের মতো শিশুদেরও মতামত গ্রহণ করেছি। তাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত আমাদের বাজেট ভাবনাকে করেছে সমৃদ্ধ। চেষ্টা করেছি প্রস্তাবিত বাজেটে তার প্রতিফলন ঘটাতে। অর্থ বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং সব প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়/বিভাগের বাজেট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণের নিরলস প্রচেষ্টায় বাজেট প্রণয়নের সুবিশাল ও শ্রমসাধ্য কর্মযজ্ঞটি সুচারূভাবে সম্পন্ন হয়েছে। তাদের সবার জন্য রইল আমার আন্তরিক অভিনন্দন। সর্বোপরি, প্রতিবারের মতো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা এবং প্রাজ্ঞ মতামত ও পরামর্শ দিয়ে বাজেট প্রণয়নে সহায়তা করেছেন। আমার ওপরে অব্যাহত ও অবিচল আস্থা রাখায় আমি তার প্রতি জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। উল্লেখ্য, এর আগেও বাজেট বক্তৃতায় চ্যানেল আই ও হৃদয়ে মাটি ও মানুষ আয়োজিত কৃষি বাজেট ও কৃষকের বাজেট আলোচনায় অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এই স্বীকৃতি শুধু চ্যানেল আইয়ের হৃদয়ে মাটি ও মানুষের নয়, এ স্বীকৃতি বাংলাদেশের কোটি কৃষকের। একই সঙ্গে সব গণমাধ্যমের। কারণ, দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি যে কৃষক, তাদের বাইরে রেখে জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এখন এই বিপুল কৃষক গোষ্ঠী গণমাধ্যমের কল্যাণেই সরকারের সঙ্গে তাদের সেতুবন্ধ রচনা করতে সমর্থ হয়েছে। আর সরকারের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে এখানে কৃষক অনেক বেশি গর্বিত ও অনুপ্রাণিত হয়েছেন।

গত ১ জুন অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় বাজেট। যার আকার ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। উন্নয়ন অনুন্নয়ন মিলিয়ে এই বিশাল বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ ১৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বরাদ্দের এই হার ৩ দশমিক ৪০ শতাংশ।  ২ লাখ ৪৫ হাজার ১৪ কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেটের বিপরীতে কৃষির ভাগে জুটেছে ১১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, যা ২ দশমিক ৬ শতাংশ, আর অনুন্নয়ন ১ লাখ ৫৫ হাজার ২৫২ কোটি টাকার মধ্যে বিভাজনে কৃষির অংশটি ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, যা ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে ‘সাফল্য গাথার একটি বছর : বাস্তবায়ন অগ্রগতি’তে উল্লেখ করেন বর্তমান সরকারের নেওয়া কিছু পদক্ষেপের কথা। অর্থমন্ত্রী বলেন, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য স্বাভাবিক ভর্তুকির অতিরিক্ত হিসেবে কৃষিজাত সামগ্রী রপ্তানির ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। ২০ শতাংশ হারে ছাড় প্রদান করছে সেচযন্ত্রে ব্যবহূত বিদ্যুৎ বিলের ওপর। বর্তমানে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে উন্নয়ন সহায়তার হার হাওর ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় ৭০ শতাংশ এবং দেশের অন্যান্য এলাকার জন্য ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। বিগত এপ্রিল মাসের আকস্মিক বন্যায় সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা এবং কিশোরগঞ্জ এলাকায় খাদ্যশস্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সারা দেশের খাদ্য উৎপাদন মোটামুটিভাবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হবে বলে মনে করছে সরকার। ইতিমধ্যে কৃষি খাতে নতুন প্রযুক্তির সহায়তায় মত্স্য এবং শাকসবজি উৎপাদনে সরকারের কৃতিত্বের কথা উঠে এসেছে। পাটের উন্মোচিত জিনোম তথ্য কাজে লাগিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য ও নিম্ন তাপমাত্রাসহিষ্ণু তোষা পাটের দুটি এবং দেশি পাটের একটি অগ্রবর্তী লাইন উদ্ভাবন করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন, আমাদের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। শিল্পের প্রসার এবং তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়ন সত্ত্বেও এখনো দেশের প্রায় ৪৫ শতাংশ মানুষ কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এখানে স্মরণ রাখতে হবে যে, আমাদের কৃষিজমি অনবরত হ্রাস পাচ্ছে। সে জন্য গ্রামে যত্রতত্র স্থাপনা নির্মাণকে নিয়ন্ত্রণে আনার বিষয়টি এখন থেকেই আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কৃষকের উন্নয়নে চলমান কার্যক্রম আমরা আরও জোরদার করব। এসব কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে বৈরী পরিবেশে অভিযোজনে সক্ষম ধানের জাত উদ্ভাবন, ফসলের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমানো, কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন, উন্নতমানের বীজ সরবরাহ, সেচ সম্প্রসারণ, নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত আমদানি নিশ্চিতকরণে সংঘনিরোধ কেন্দ্র স্থাপন, জেনেটিক্যালি মোডিফাইড প্রযুক্তির প্রচলন, প্রতিকূলতাসহিষ্ণু পাটের জাত উদ্ভাবন এবং বহুমুখী পাটপণ্য উদ্ভাবন সংক্রান্ত গবেষণা, পরিবেশবান্ধব কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, কৃষি খাতে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, ঠধষঁব ঈযধরহ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ইত্যাদি। পাশাপাশি, কৃষি গবেষণালব্ধ ফলাফল, কৃষি তথ্য ও প্রযুক্তি এবং কৃষিসেবা কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে সারা দেশে ২৩৫টি কৃষক সেবাকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগও আমরা গ্রহণ করেছি। উল্লেখ্য, কৃষি শুধু এককভাবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকেই নির্দেশ করে না। অধিকাংশ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে কৃষির যোগসূত্র রয়েছে। এ বিবেচনায় এবার বাজেটে কৃষির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বহুসংখ্যক খাতে দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। যার মধ্য দিয়ে কৃষকের অনেক প্রত্যাশা পূরণের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় পল্লী অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন প্রসঙ্গ। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, সড়ক, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের মাধ্যমে গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়ন ধারাবাহিকতায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রায় ৫ হাজার ২৫০ কি.মি. নতুন সড়ক নির্মাণ, ১১ হাজার ৫০০ কি.মি. পাকা সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ, ৩২ হাজার ৩৫০ মিটার সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের ৮২টি ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, ৫৫টি উপজেলা কমপ্লেক্স ভবন এবং ৯৫টি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণের পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। এ ছাড়া দরিদ্র গ্রামীণ মহিলাদের ক্ষমতায়নের জন্য দুগ্ধ উৎপাদনে ঘাটতি রয়েছে এমন ৫০টি উপজেলায় সমবায়ের কার্যক্রম সম্প্রসারণের মাধ্যমে দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধিসহ দুধের বহুমুখী ব্যবহার বৃদ্ধির উদ্যোগ আমরা গ্রহণ করব। পাশাপাশি, পল্লী ও চরাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে চলমান অন্যান্য কার্যক্রম আমরা অব্যাহত রাখব।

এ সঙ্গে আয়বর্ধনমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের আওতায় প্রকৃত দরিদ্র/ছিন্নমূল/ভিক্ষুক পরিবার বাছাই করা হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে, এসব পরিবারকে সমিতিবদ্ধ করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষুদ্র সঞ্চয় মডেলের আওতায় স্থায়ী তহবিল গঠন করে দেওয়া। এর ধারাবাহিকতায় আগামী ৪ বছরে সারা দেশে ১ লাখ ভিক্ষুক পুনর্বাসনসহ ৩৬ লাখেরও অধিক দরিদ্র পরিবারকে সম্পৃক্ত করে আরও ৬০ হাজার ৫১৫টি গ্রাম উন্নয়ন সমিতি গঠনের পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। এ প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের রেশম চাষে সম্পৃক্তকরণের পরিকল্পনা আমরা গ্রহণ করেছি। এর প্রাথমিক পর্যায়ে ২০টি জেলার ২৫টি উপজেলায় এ কার্যক্রম সম্প্রসারণের কার্যক্রম আমরা হাতে নিয়েছি।

এবার কৃষি ও এর উপখাতের কয়েকটি জায়গায় বিশেষ প্রণোদনার কথা উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী। কৃষি খাতের অন্যতম প্রধান উপকরণ বিশেষ করে সার, বীজ, কীটনাশক ইত্যাদি আমদানিতে শূন্য শুল্কহার এবং কৃষকের উৎপাদিত ধান চালের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকল্পে চাল আমদানিতে সর্বোচ্চ শুল্কহার অব্যাহত রাখা হয়েছে। কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত গম, ভুট্টা ও আলু থেকে উৎপাদিত স্টার্চের আমদানির ওপর ইতিপূর্বেই উচ্চতর শুল্ক হার আরোপ করা হয়েছিল। তবে কাসাভাসহ অন্যান্য স্টার্চের স্থানীয় উৎপাদন না থাকায় এগুলোর ওপর নিম্ন শুল্ক হার প্রযোজ্য ছিল। প্রায় একই ধরনের পণ্যে শুল্ক হারে পার্থক্য থাকায় মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে পণ্য আমদানির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সে কারণে সব ধরনের স্টার্চের শুল্ক হার যৌক্তিকীকরণ করা হয়েছে। একইভাবে দেশীয় শিল্পের প্রতিরক্ষণে বিভিন্ন ধরনের অয়েল কেকের শুল্ক হারও যৌক্তিকীকরণ করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের চারাগাছের পরিচর্যায় ব্যবহূত মালচ এবং গ্রিন হাউস প্রযুক্তিতে ব্যবহূত শেডিং নেটের ওপর শুল্ক হার হ্রাস করা হয়েছে। নতুন যুগের কৃষি নিয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে এবার বাজেটের প্রাক্কালে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। এমনটি কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেটের সুপারিশমালা প্রদানের দিনও কৃষির পরিবর্তিত প্রবণতা তুলে ধরার চেষ্টা করি। ঠিক এ বিষয়গুলো এবারই জাতীয় বাজেটে উল্লিখিত হওয়ায় অর্থমন্ত্রীকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই। খামারিদের দাবির প্রেক্ষিতে এবারের বাজেটেও কৃষির অন্যতম উপখাত এবং দেশের মানুষের আমিষের প্রধান উৎস মত্স্য, পোল্ট্রি ও ডেইরি খাতের খাদ্যসামগ্রী ও নানাবিধ উপকরণ আমদানিতে শুল্ক ও কর অব্যাহতি বহাল রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে কৃষির গুরুত্বপূর্ণ এসব উপখাতের জন্য প্রয়োজনীয় আরও কতিপয় পণ্যে শুল্ক সুবিধা তথা প্রণোদনা প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে।

বর্তমানে কৃষিকাজে ব্যবহার্য অধিকাংশ যন্ত্রপাতি যাতে কম খরচে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা যায় সে লক্ষ্যে এসব যন্ত্রপাতি তৈরির উপকরণে শুধু ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক নির্ধারণ করে বিগত অর্থবছরে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। এ বছর আরও কিছু উপকরণে এ সুবিধা সম্প্রসারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তামাক চাষকে নিরুৎসাহিত করার জন্য আমরা সরকারের কাছে নানাভাবে দাবি জানিয়ে আসছি। আমরা দেখেছি, দেশের যেসব এলাকায় কৃষক কোম্পানির প্রলোভনে তামাক চাষে বাধ্য হয়, তারা পরবর্তীতে আর্থিক ও শারীরিকভাবে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েন। বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে এবার তামাক ও তামাকজাত পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে তামাকজাত পণ্য রপ্তানিতে ২৫ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক আরোপেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এ কথা উল্লেখের অবকাশ রাখে যে, বাজেটের আকার অনুযায়ী কৃষি খাতে বরাদ্দ এবারও কমেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি খাতে মোট ১৩ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছিল। এর মধ্যে অনুন্নয়ন খাতে ১১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন খাতে ১ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে কৃষি খাতের বরাদ্দ ৭৬ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। যাই হোক, বাজেটের এ বরাদ্দের রকমফেরের মধ্যে খুব বেশি প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নির্ভর করে না। নির্ভর করে, সরকার কৃষককে নীতি সহযোগিতা নিয়ে কতটা এগিয়ে নেবে সে বিষয়টি। সেই সঙ্গে সরকার যে যে খাতে ব্যয় বরাদ্দের মধ্যেমে তৃণমূল জনগোষ্ঠীকে শক্তিশালী করতে চায়, সেসব ক্ষেত্রে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়াও জরুরি। কারণ সাধারণ তৃণমূল মানুষের কাছে জাতীয় বাজেটের প্রাপ্তি-প্রত্যাশার ফারাক রয়েই গেছে। বাজেট ঘোষণার পরক্ষণেই দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষকের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি, অধিকাংশ কৃষক বলেছেন, বাজেটের মধ্যে আমাদের ভাগ্য উন্নয়নের কিছু নেই। আমরা পণ্যের দাম পেলেই মনে করি বড় কিছু পাওয়া হলো।

হতাশার সুর পোলট্রি খামারিদের মধ্যেও। তারা প্রস্তাবিত বাজেটে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন বা কাঙ্ক্ষিত কোনো কিছুই আশা করতে পারছেন না। টাঙ্গাইলের পোলট্রি খামারি আবদুল আওয়াল বলেছেন, আমাদের প্রত্যাশা ছিল পোলট্রি খাদ্য ও এক দিনের বাচ্চার মূল্যের ব্যাপারে বাজেটে কোনো দিকনির্দেশনা থাকবে, কিন্তু তা নেই। বাজেটে পোলট্রি শিল্পকে রক্ষা করার মতো কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় খামারিরা হতাশ হয়েছেন। মত্স্য খামারিরা বলছেন, ৮০’র দশকে দেশে মাছের উৎপাদন ছিল মাত্র ১২ লাখ টন। এখন শুধু মাছ চাষের কল্যাণেই দেশে মাছের উৎপাদন পৌঁছেছে ৩৮ লাখ টন-এ। কিন্তু জাতীয় বাজেটে মত্স্য চাষকে প্রণোদিত করার জন্য কোনো দিকনির্দেশনা নেই। উপরন্তু মত্স্যখাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ সয়াবিন কেকের ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এর বিরাট নেতিবাচক প্রভাব পড়বে মাছের উৎপাদনে।  দুগ্ধ খামারিদের পক্ষ থেকেও এসেছে একই রকম হতাশার সুর।

তারপরও জাতীয় বাজেটের বরাদ্দও দিকনির্দেশনার পাশাপাশি বাজেট বাস্তবায়নের কৌশলের ওপর নির্ভর করে অনেক কিছু। আমরা আশা করছি, কৃষক ও খামারিদের সমস্যা ও সংকটগুলো বিশেষভাবে মূল্যায়তি হবে বাজেট বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপটে। একইভাবে কৃষির আধুনিকতা বিবেচনায় আগামীর খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজার কৌশল নিয়ে সময়োপযোগী ভাবনা,  সরকার ভাববে এ প্রত্যাশা আমাদের।

     লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

     [email protected]

সর্বশেষ খবর