শুক্রবার, ৯ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

বাংলাদেশের সর্বনাশের নাটের গুরু

মেজর অব. মো. আখতারুজ্জামান

বাংলাদেশের সর্বনাশের নাটের গুরু

ব্যক্তিগতভাবে আমি সব ধর্মের কট্টর মৌলবাদী ও ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী এবং পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনীকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি। প্রাচীন ইঙ্গ, বঙ্গ ও কলিঙ্গের যত সর্বনাশ হয়েছে, তার সবটাই হয়েছে উগ্রবাদীদের কারণে। উচ্চবর্ণের প্রাচীন হিন্দুরা সাধারণ মানুষের অধিকার কখনো মেনে নেয়নি এবং এখনো মেনে নিচ্ছে না, যার ফলে শান্তি এখনো নাগালের বাইরে।  সেই প্রাচীনকালে সম্রাট অশোকের আমল থেকে দেখা যায় সাধারণ মানুষ শুধু বুকের রক্ত দিয়ে গেছে, কিন্তু মর্যাদা পায়নি। খ্রিস্টপূর্ব ২৬৪ সালে সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের নাতি অশোক ক্ষমতায় আরোহণ করে সাম্রাজ্য বিস্তারে ঝাঁপিয়ে পড়েন। হত্যা করেন অগণিত মানুষকে। তখন জনশ্রুতি ছিল যে, অশোকের বন্দীশালার ভয়াবহতম নির্যাতন সেল থেকে কারও জীবন্ত বেরিয়ে আসার কোনো প্রমাণ নেই। অশোকের আমলে তার সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা ছিল তিন কোটির মতো; কিন্তু এক কলিঙ্গ যুদ্ধেই অশোক হত্যা করেন তিন লাখেরও বেশি নিরীহ মানুষকে। অশোক জৈন ধর্মের অনুসারী ছিলেন; কিন্তু তারপরে কলিঙ্গ গণহত্যার পরে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে লেবাস পরিবর্তন করে তথাকথিত ধর্ম শাসন শুরু করেন। অশোকের শান্তি ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সেই ধর্মের দাবানলে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে জনপদের পর জনপদ, জীবন দিয়েছে লাখ লাখ মানুষ, কিন্তু শান্তির ধর্ম আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মৌলবাদী উচ্চবর্ণের উগ্র হিন্দুদের রক্ত পিপাসা এখনো মিটেনি, যার আলামত এখনো প্রতিবেশী দেশে বিদ্যমান। অশোক ধর্মের নামে পশ্চিমে আফগানিস্তান, পূর্বে বাংলাদেশ, উত্তরে হিমালয় এবং দক্ষিণে কলিঙ্গ পর্যন্ত বিশাল ভারত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করছিলেন কিন্তু তাতে ভারতের আম-জনতার কী লাভ হয়েছিল সে প্রশ্নের উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি। একশ্রেণির মানুষের কাছে অশোক যতই মহান হোক না কেন, কলিঙ্গ তথা উড়িষ্যাবাসী কোনো দিন তা মেনে নিতে পারবে না। ভারতবর্ষে এখনো চন্দ্রগুপ্তের উচ্চবর্ণের মৌলবাদী বংশধররা অখণ্ড সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নেও বিভোর সেখানে ক্ষুদ্র বঙ্গ কলিঙ্গরা তাদের অস্তিত্ব লড়াইয়ের সংগ্রামে লিপ্ত। উগ্র হিন্দু মৌলবাদীরা স্বপ্ন দেখে তাদের সুখের রাজ্যের বিস্তার আর প্রতিবেশী আমরা ক্ষুদ্র রাষ্ট্র চিন্তিত আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে। আমাদের এ লড়াই চিরন্তন, তাই ওদের হীনমন্যতাকে ঘৃণা করি।

সেদিন গুলশানের এক অভিজাত হোটেলে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ঢাকার কিছু নির্বাচিত নাগরিকের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। আমার ওখানে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। ক্যামেরন প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় বাংলাদেশে আশার সুযোগ হয়নি। তবে এখন এনজিওর জন্য দূতিয়ালি করতে এসেছিলেন। বাংলাদেশ পশ্চিমা এনজিওগুলোর ভালো লাভজনক বিচরণক্ষেত্র। যাই হোক, সেদিন ক্যামেরন সাহেব আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস ও বিশ্ব বাণিজ্য নিয়ে সংক্ষেপে অনেক কিছু বলার চেষ্টা করলেন। উক্ত সভায় ক্যামেরন সাহেবের মোদ্দা কথা ছিল— আইএসএস পৃথিবীতে সন্ত্রাস করে যে সংকট সৃষ্টি করছে, তা সভ্যতাকেই ধ্বংস করে দেবে এবং অবাধ ও মুক্তবাণিজ্য ধারা অব্যাহত না থাকলে সভ্যতা ঠেকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যাবে। উপস্থিত নাগরিকদের কাছ থেকেও কিছু প্রশ্ন নিয়ে উত্তর দিলেন। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, ১৬০০ সালে ইংল্যান্ডে ব্রিটিশ সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারত ও পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলে একচ্ছত্র বাণিজ্যিক অধিকার দিয়ে বাণিজ্য করতে পাঠানো হয়েছিল। সেই কোম্পানি কোন আইনি সনদ বলে ১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীনতা হরণ করছিল। যা পরবর্তীতে সমগ্র ভারতের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছিল। আরও প্রশ্ন করেছিলাম মধ্যপ্রাচ্য সংকট, আফগান সংকট, ইরাক, সিরিয়া, মিসর, ইয়েমেন সংকট ও সন্ত্রাস কাদের সৃষ্টি এবং সেখানে ব্রিটিশ সরকারের অবদান কতটুকু? আমার প্রশ্নে ক্যামেরন সাহেব অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর এড়িয়ে যান। তবে আমার প্রশ্নে ক্যামেরন সাহেব অসন্তুষ্ট না হলেও (হলেও কিছু ছিল না। ওরা আমাদের মারতে পারবে আর তাকে মৌখিক কিছু বলতে পারব না?) আমাদের অনেক নেটিভ ভাইয়েরা মনে খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। পরের সপ্তাহে একই হোটেলে রাতের একটি অনুষ্ঠানে হোটেল মালিক বিখ্যাত সাবেক ছাত্রনেতা আমাকে খাবার টেবিলে পাশে পেয়ে বললেন, তিনি হলে ওই দিনের ওই প্রশ্নটি করতেন না। আমি শুধু বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলাম, সে জন্যই আমি তিনি হতে পারিনি।

আজকের বিশ্বের যত সমস্যা তার বেশির ভাগ সৃষ্টি ব্রিটিশ সরকারের। ১৪৪২ সালে স্পেনের নাবিক কলম্বাসের আমেরিকা যাওয়ার সমুদ্রপথ আবিষ্কার এবং ১৪৯৭ সালে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামার ভারতের সমুদ্রপথ আবিষ্কারের পর থেকেই ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী বাণিজ্যের নামে বিশ্ব দখল করার প্রতিযোগিতায় নামে এবং সারা বিশ্বে অশান্তি ও ষড়যন্ত্রের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়। প্রথমে অন্যের আবিষ্কারকে কুক্ষিগত করার জন্য স্পেন, পর্তুগিজ, ফ্রান্স ও ব্রিটিশ মিলে ইংল্যান্ডে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি করে বৈদেশিক বাণিজ্য করার ফাঁদ পাতে। কিন্তু পরবর্তীতে ইংরেজরা যেখানে গেছে সেখানেই নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছে এবং ওই সব দেশ থেকে যুদ্ধ করে প্রথমে অন্য ইউরোপীয়দের বিতাড়িত করেছে এবং পরে স্থানীয় শাসকদের সরিয়ে ব্রিটিশ রাজ প্রতিষ্ঠা করছে। ব্রিটিশ যেখানে গেছে ভারত, চীন, মালয়, ইন্দোচীন সব এলাকার চিত্র এক। শুধু ব্যতিক্রম ছিল আমেরিকা। কারণ সেখানে কোনো স্থানীয় শাসক ছিল না, যাদের হাত করে রাজ্য দখল করা সম্ভব হতো; কিন্তু তার জন্য আমেরিকাকে ২০০ বছরের সিভিল ওয়ারের মূল্য দিতে হয়েছে।

১৭৯৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের পর বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্রের ব্যাপক পরিবর্তন আসে এবং ক্ষমতার কেন্দ্র চলে যায় আমেরিকায়; কিন্তু তারপরও ইংরেজরা দুই-দুটি বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে দেয়। ইংরেজদের আধিপত্য ধরে রাখার জন্য বিশ্বব্যাপী ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী যে কোনো ধরনের চাল চালতে সর্বদা প্রস্তুত এবং অব্যাহতভাবে চালিয়ে আসছে। ইংরেজদের এখন গুরু হলো যুক্তরাষ্ট্র। এই দুই শক্তি মিলে তারা বিভিন্ন জায়গায় আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তার করতে যায় এবং তাদের ওই কাজে যারা বাধা সৃষ্টি করে, তাকেই বিশ্ব সন্ত্রাসী বানিয়ে ছাড়ে। আধুনিক সভ্যতা মানুষকে প্রচণ্ডভাবে কল্পনির্ভর জীবনযাত্রা, সুন্দর প্রত্যাশা এবং সুখ ও শান্তির জন্য ভীষণভাবে আবেক তাড়িত করে তুলেছে। বর্তমান সভ্য সমাজ মিডিয়ার খবর বাইবেলের চেয়ে বেশি সত্য বলে মনে করে। যার সুযোগ নিয়ে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী বিশ্বের সামনে ইংরেজ ও মার্কিন-বিরোধীদের বিশ্বসন্ত্রাসী বানিয়ে ছাড়ছে। আজ আমার বাংলাদেশের সব সমস্যার মূলেও ব্রিটিশদের সন্ত্রাস ও বাণিজ্যনীতি।  তাই তারা আমার ঘৃণার পাত্র।

পাকিস্তানি বর্বর মিলিটারি আমার ঘৃণার পাত্র যার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সবার জানা। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংগ্রাম করে মুসলমানদের জন্য যে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, বর্বর সেনাবাহিনীর জন্য সে দেশটি আমরা ধরে রাখতে পারিনি।

পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী যদি আমাদের শাসন ও শোষণ করতে না চাইত, তাহলে এত রক্ত দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা কিনতে হতো না।  তাই পরিশেষে বলতে চাই, এই তিন অপশক্তি আমাদের কাছে ঘৃণ্যতম।

     লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর