শুক্রবার, ৯ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

সহমর্মিতার মাস রমজান

মুফতি মাওলানা মুহাম্মাদ এহছানুল হক মুজাদ্দেদী

সহমর্মিতার মাস রমজান

পবিত্রকোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর সিয়াম (রোজা) ফরজ করা হয়েছে,  যেমনিভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে করে তোমরা মোত্তাকি (আল্লাহ ভীরু) হতে পার। (সূরা বাকারা : ১৮৩)। মোত্তাকি সেই ব্যক্তিকে বলা হয়, যিনি সংযমের জীবনযাপন করে। লাগামহীন জীবনযাপন যার অভ্যাস নয়। সংযমের জীবনে অভ্যস্ত করার জন্যই আল্লাহতায়ালা আমাদের ওপর এক মাসের সিয়াম সাধনা ফরজ করেছেন।

মাহে রমজানের এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে বান্দা সংযমের প্রশিক্ষণ নেয়। আর এটা সম্ভব হয় একে অন্যের প্রতি সহমর্মিতার চর্চার মাধ্যমে। তাই বলা যায়, পবিত্র রমজান সহমর্মিতা চর্চারও মাস। সন্দেহ নেই— ধৈর্য, সহনশীলতা, তাকওয়া অর্জনই সিয়াম সাধনার মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু এসবের বাইরেও রোজার বড় একটা উদ্দেশ্য হলো, মানব জাতিকে সহানুভূতি-সহমর্মিতার অনুপম শিক্ষা প্রদান করা। ইসলামে সাম্য-মৈত্রীর যে নান্দনিক দর্শন রয়েছে, সিয়াম সাধনার মাধ্যমেই মূলত এর বাস্তবায়ন হয়ে থাকে। রমজান যেমন বান্দার প্রতি মহান আল্লাহর রহমত বা দয়াকে আকর্ষণ করে, ঠিক তেমনি এক বান্দার প্রতি অপর বান্দার, এক মানুষের প্রতি অপর মানুষের অন্তরে মমত্ব, সহানুভূতি, দয়া, ভালোবাসার উপলক্ষ সৃষ্টি করে। সংযম সাধনার এ মাসে ক্ষুধা ও পিপাসার প্রকৃত অনুভূতির মাধ্যমে বিত্তবান-সচ্ছল রোজাদার মানুষ দরিদ্র ও অভাবী মানুষের না খেয়ে থাকার কষ্ট বুঝতে সক্ষম হন। এ উপলব্ধির আবেশেই বিত্তশালী ব্যক্তি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা নিয়ে অন্যের পাশে দাঁড়ানোর স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণা বোধ করেন।

প্রিয় রসুলে কারীম (সা.) রমজানকে শাহরুল মুওয়াসাত তথা সহমর্মিতা-সহানুভূতির মাস বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর এ সহমর্মিতার ক্ষেত্র শুধু আর্থিক সহযোগিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আর্থিক সাহায্যের পাশাপাশি অপর মুসলমান ভাইয়ের সঙ্গে সর্বোত্তম বিনম্র আচরণ, সদুপদেশ প্রদান, তার জন্য প্রভুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা— সবই সহমর্মিতার মধ্যে গণ্য। এ বিষয়টির অপরিহার্যতা ফুটে উঠেছে নু’মান ইবনে বাশির (রা.) বর্ণিত সুন্দর একটি হাদিসে। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনদের একে অপরের প্রতি সম্প্রীতি, দয়া ও মায়া-মমতার উদাহরণ (একটি) দেহের মতো। যখন দেহের কোনো অঙ্গ ব্যথা পায়, তখন তার জন্য পুরো শরীরই অনিদ্রা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়।’ (সহিহ বোখারি : ৬০১১)

আমি নিজকে যতটুকু ভালোবাসি। নিজ দেহের যত্ন নিই যতটুকু, যতটুকু নিজের পরিচর্যা করি, অবহেলা করি না—তেমনি অন্যের প্রতিও অবহেলা দেখানো যাবে না। মানুষের প্রতি দয়াশীল হতে হবে, মন উজাড় করে মানুষকে ভালোবাসতে হবে। পরিপূর্ণ সহানুভূতি আর সুহৃদ্যতার দ্বারা মানবসেবায় নিজেদের এগিয়ে আসতে হবে।

রমজান মানুষের ঘুমন্ত আত্মাকে জাগিয়ে তোলে। দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রেরণা জোগায়। নতুন উন্নত পোশাক পরিধান যাদের কাছে স্বপ্ন ছাড়া কিছু নয়, রমজানে বিত্তবান কর্তৃক সেই দরিদ্র্য শ্রেণির মানুষদের নতুন জামাকাপড় প্রদান এক অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা ঘটায়। ইসলামের নিষ্কলুষ সৌন্দর্য এখানেই। যে সৌন্দর্য পবিত্র মাহে রমজানের সহমর্মিতার মোড়কে বিমূর্ত হয়ে আছে যুগ যুগ ধরে, শত-সহস্র কাল ধরে। প্রতি বছর বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন কর্তৃক দুস্থ-অভাবীদের নিমিত্তে ইফতার ভোজনের যে সমৃদ্ধ আয়োজন আমরা অবলোকন করি, বলা চলে তা রমজানের সহমর্মিতার প্রশিক্ষণেরই বাস্তবচিত্র। আত্মিক তৃপ্তি প্রশান্তি মূলত এ সহমর্মিতা প্রকাশেই রয়েছে। প্রিয় নবী করিম (সা.) যেমনটি বলেছেন, ‘আত্মার অভাব মুক্তিই হচ্ছে আসল অভাবমুক্তি।’ (বোখারি শরিফ)।

রমজান মাসের সহমর্মিতার এই শুভ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ আমরা যদি বছরব্যাপী অনুশীলন করি, তবেই মানব সমাজে আর দেখা যাবে না কোনো রকম অসাম্য ও শ্রেণিবৈষম্য। দূর হয়ে যাবে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশান্তি-হানাহানি। তাই আসুন! মাহে রমজান থেকে সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃবোধের শিক্ষা নিয়ে আমরা সামনের জীবন পরিচালনা করি।  মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। কোরআন, সুন্নাহ এবং আওলিয়া কেরামদের জীবনী আমাদের পাথেয় হোক। আমিন। বিহুরমাতি সাইয়্যেদিল মুরছালিন।

লেখক : মুফাসসিরে কোরআন, বেতার টিভির ইসলামী উপস্থাপক। প্রিন্সিপাল, মনিপুর বাইতুর রওশন মাদ্রাসা কমপ্লেক্স, মিরপুর, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর