শুক্রবার, ১৬ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

এতেকাফ : গুনাহ মাফের উত্তম পন্থা

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

এতেকাফ : গুনাহ মাফের উত্তম পন্থা

প্রতিবছর রমজানে বিশেষ করে রমজানের শেষ ১০ দিন এতেকাফ করার জন্য মৌমাছির ন্যায় দলে দলে মানুষ হারামাইন শরিফাইনের পথে ছুটে চলে। এ এতেকাফ কাকে বলে?  এতেকাফের ফজিলত কি তা জানা থাকা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অবশ্য কর্তব্য। মানুষ যখন মসজিদে কিছু সময় অবস্থান করেন তখনই তা এতেকাফে পরিগণিত হয়।  পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, যখন আমি কাবা গৃহকে মানুষের জন্য সম্মিলনস্থল ও শান্তির আলয় করলাম আর তোমরা ইবরাহিমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাজের জায়গা বানাও এবং আমি ইবরাহিম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, অবস্থানকারী ও রুকু-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ। (সূরাতুল বাকারা : ১২৫)। বোখারি শরিফের এক হাদিসে এসেছে, হজরত আয়শা (রা.) বলেন, রসুল (সা.) সব সময় রমজানের শেষ ১০ দিন এতেকাফ করতেন। ইন্তেকাল পর্যন্ত এ নিয়ম তিনি পালন করেছেন। রসুল (সা.) এর ইন্তেকালের পর উম্মাহাতুল মুমেনিনগণ এতেকাফের ধারাবাহিকতা চালু রেখেছিলেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রসুল (সা.) প্রতি রমজানে ১০ দিন এতেকাফ করতেন। কিন্তু যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন, সে বছর ২০ দিন এতেকাফ করেছিলেন। (বোখারি ও মুসলিম)। এতেকাফের বিভিন্ন দিক রয়েছে তন্মধ্যে রমজান মাসের শেষ ১০ দিন এতেকাফ করা সুন্নত। এতেকাফের মাসায়েল আমরা হক্কানি উলামায়ে কেরামদের কাছে জেনে নেব। এখন আমাদের এতেকাফের গুরুত্ব ও ফজিলত বুঝতে হবে, কেন রমজানের শেষ ১০ দিন রসুল (সা.) এতেকাফ করতেন বা উম্মতের ওপর এতেকাফ করা কেন সুন্নত?

 

 

প্রথম বিষয় হলো, আমার রসুল যেহেতু রমজানের শেষ ১০ দিন এতেকাফ করেছেন, তাই আমাকেও এ ১০ দিন এতেকাফ করতে হবে। এরই নাম ইত্তেবায়ে রসুল বা রসুল (সা.) এর অনুকরণ ও অনুসরণ। যেমন : কোনো এক কবি কত সুন্দর বলেছিলেন, ‘আল্লাহ ছাড়া মাবুদ নেই, রসুল ছাড়া উপায় নাই, সেই রসুলকে পেতে হলে সুন্নতওয়ালা জীবন চাই।’ দ্বিতীয় বিষয় হলো, আলোচ্য ১০ দিনের মধ্যে যে কোনো বেজোড় রাতে পবিত্র লাইলাতুল কদর হওয়ার খুবই সম্ভাবনা রয়েছে। রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, তোমরা রমজানের শেষ ১০ দিনের যে কোনো বেজোড় রাতে কদরের রাতকে তালাশ কর। এতেকাফের মাধ্যমে হাজার মাসের থেকেও শ্রেষ্ঠ রজনীর পূর্ণ তালাশ হয় ও কদরের ফজিলত ও বরকত পাওয়ার আশা করা যায়। এ ছাড়াও মানব আত্মার পরিশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য এতেকাফ একটি উত্তম ও শ্রেষ্ঠ পন্থা। কারণ এ দুনিয়ায় হাজারও ব্যস্ততা ও সমস্যার মধ্য দিয়ে মানুষকে জীবনযাপন করতে হয়। পাপের সামগ্রী বহন করেই অনেক সময় চলতে হয়। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় প্রতিটি মুহূর্তে গুনাহের সম্মুখীন হতে হয়। ইবলিস মানুষের কাছে গুনাহের কর্মগুলোকে সুশোভিত ও লোভনীয় করে প্রকাশ করে। অতি মোহনীয় করে উপস্থাপন করে। দরিদ্রতার ভয় দেখিয়ে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের পথ বাতলে দেয়। পুরো সময়কে দুনিয়া আর অর্থের পেছনে পড়ে থাকার জন্য উদ্বুদ্ধ করে, সে মানুষের পাপাত্মাকে সুড়সুড়ি দিয়ে জাগ্রত করে। যাতে মানুষ পুরো টাইম অন্যায় ও অশ্লীল কাজে লিপ্ত থাকে। অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত থাকে। অনেক নির্বোধ মানুষ বুঝে বা না বুঝে তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে দুনিয়া ও পরকালে ধ্বংসপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। নিজের ওপর আল্লাহর আজাব টেনে আনে। মুতাকিফ ব্যক্তি ইবলিসের সব কূটকৌশল পরিহার করে দুনিয়াবি সব কাজ কর্ম থেকে ফারেগ হয়ে কিছু দিনের (রমজানের শেষ ১০ দিন) জন্য আল্লাহর ঘরে আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য বসে পড়ে। যেখানে তার পরিবার-পরিজনের ফিকির নেই, লেনদেন বা সামাজিক কোনো কাজকর্মের চিন্তা তার মাথায় নেই। তার মাথায় একটি মাত্র চিন্তা। কীভাবে আপন মাওলা থেকে নিজের অপরাধসমূহ ক্ষমা করিয়ে নেবে। তাই সে এতেকাফে বসে প্রতিটি মুহূর্তে ধ্যান করে, আল্লাহর প্রেমকে গভীরভাবে অনুভব করে এবং জাহান্নামের কথা স্মরণ করে ভীতবিহ্বল হয়ে ওঠে এবং আল্লাহর কাছে জান্নাতে যাওয়ার আশা ব্যক্ত করে কান্নাকাটি করে। ভবিষ্যতে তিনি যতদিন হায়াত বরাদ্দ রেখেছেন তাঁরই সঠিক ও সরল পথে চলার সংকল্প করে। এতেকাফকারী এতেকাফের মাধ্যমে পবিত্রতা, পরিশুদ্ধতা ও পরহেজগারিতা অবলম্বন করে আল্লাহর প্রিয় পাত্র হতে চায়। কারণ একমাত্র নেককার ও পবিত্র আত্মার লোকেরাই আল্লাহর প্রিয় পাত্র হতে পারে। এদিকে ইবলিস যখন দেখে একজন গুনাহগার বান্দা মাওলার দরজায় পড়ে আছে নিজের পাপগুলোকে ক্ষমা করানোর জন্য। তাও এক দিন দুই দিন নয় দীর্ঘ ১০ দিন। রাত-দিন একাকার করে আপন মাওলার দরবারে পড়ে আছে। আর বলতে থাকে মাওলা তুমি যদি আমাকে ক্ষমা না কর তাহলে আর কে ক্ষমা করবে? তুমি ব্যতীত আর কেউ ক্ষমাকারী নেই। তুমি তো পরম দয়াবান ও ক্ষমাকারী সত্তা। তুমি ছাড়া তো আমার আর কোনো মাওলা নেই। যদিও আমাকে ছাড়া তোমার অনেক বান্দা আছে। এ ফকির বান্দা তোমার ক্ষমার দরবার কখনো ছাড়বে না যদি তুমি তাকে ক্ষমা না কর। এতেকাফের মাধ্যমে বান্দার এসব কর্মকাণ্ড দেখে ইবলিসের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়ে পড়ে। এতেকাফ এমন এক ইবাদত যা মানুষের ওপর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রভাব সৃষ্টি করে, মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে থাকে। মানুষকে পরহেজগারির পথে পরিচালিত করে এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের পথ বাতলে দেয়। ফলে এক সময় দেখা যায় মানুষ আল্লাহর ওলি হয়ে যায়। প্রিয় পাঠক! আর মাত্র পবিত্র রমজানের শেষ ১০ দিন বাকি আছে। এ পবিত্র সময়কে অযথা নষ্ট না করে ১০ দিনের জন্য মসজিদে এতেকাফের নিয়ত করি। সময় আল্লাহপাকের এক মহা নেয়ামত। আমরা যদি এতেকাফের নিয়ত করি, আল্লাহপাক অবশ্যই আমাদের সুযোগ করে দেবেন। এতেকাফ কোনো ব্যক্তি বিশেষের সঙ্গে সীমাবদ্ধ নয়। বরং আমরা যারা মুসলমান, ইমানদার হিসেবে দাবি করে থাকি। আমাদের সবার ওপরই এতেকাফ করা সুন্নত। এ সময়টাকে মূল্যবান মনে করে এতেকাফে বসার পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করি। এ রমজানে নিজেদের গুনাহগুলো মাফ করানোর দৃঢ় সংকল্প করি। কারণ আগামী বছর পর্যন্ত হায়াত পাব এতেকাফে বসে নিজেদের পাপ ক্ষমা করাব তার বা গ্যারান্টি কি? আল্লাহতায়ালা গুনাহ মাফ করানোর এ মোক্ষম সময়কে কাজে লাগানোর জন্য আমাদের সবাইকে তৌফিক দান করুন।  আমিন।

     লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব বারিধারা ঢাকা।

সর্বশেষ খবর