শনিবার, ১৭ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

রোজা ফরজ হয়েছে যে কারণে

হাফেজ কারি মাওলানা মুহা. মুনিরুজ্জামান নূরানী

রোজা ফরজ হয়েছে যে কারণে

‘সাওম’ শব্দটি আরবি। সাওম বা সিয়াম শব্দের আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। শরিয়তের পরিভাষায়, সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়তসহকারে পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত থাকাকে ‘সাওম’ বা রোজা বলা হয়। বিশ্বপ্রতিপালক আল কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমনিভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। আর এজন্যই ফরজ করা হয়েছে যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে সক্ষম হও।’ (আল বাকারা : ১৮৩)। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, আল্লাহ বলেছেন, তেমনিভাবে রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমনি তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। এ বাণীটির দ্বারা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে আল্লাহতায়ালা সাহস প্রদান করেছেন। আমাদের দেশের কোনো অফিসে যদি কেউ নতুন চাকরিতে যোগদান করেন আর উপরস্থ অফিসার যদি নতুন একটি কাজ করার জন্য দিয়ে থাকেন এবং বলেন যে, আপনাকে এ কাজটি দেওয়া হলো আপনি এটি সম্পন্ন করবেন, আপনার আগে যিনি এই পদে ছিলেন তাকেও এই কাজ দেওয়া হয়েছিল। এতে নতুন ব্যক্তির অন্তরে সাহসের সঞ্চার হবে। তিনি ভাববেন যে, আমার আগে যিনি ছিলেন তিনি যদি কাজটি করতে পারেন তাহলে আমার পক্ষেও করা সম্ভব, আমিও করতে পারব। ঠিক তেমনি আল্লাহ পূর্ববর্তীদের কথা উল্লেখের মাধ্যমে মুসলিম জাতিকে উজ্জীবিত করেছেন। এরপর মহান প্রতিপালক বলেছেন, ‘লায়াল্লাকুম তাত্তাকুন’। এজন্য রোজা ফরজ করা হয়েছে, যাতে তোমরা তাকওয়াবান হতে পারো। এ বাণীর দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায়, রোজা ফরজ করা হয়েছে এজন্য যাতে ইমানদারগণ তাকওয়াবান হয়। এই তাকওয়াবান হওয়াই হলো রোজার অভীষ্ট লক্ষ্য। মানব জাতির উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য যে নৈতিক মূল্যবোধ প্রয়োজন, তা আজ আমাদের নেই। আজ আমরা জানি না শান্তি নামক সাদা পায়রাটি কোথায় বাস করে। উন্নত চরিত্রের ক্ষেত্রে কালের চক্রে আদর্শের ময়দানে আজ আমরা পরাজিত। আজ আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আবিষ্কারে সত্যিই এক অসাধারণ কৃতিত্বের দাবিদার, কিন্তু নীতি-নৈতিকতায় ফিরে গেছি অন্ধকার যুগে। মানবীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় না হলে এই উন্নতি আমাদের বসবাসযোগ্য একটি সুন্দর পৃথিবী উপহার দিত। আমরা এই মাহে রমজানে সাহরি-ইফতারিসহ সব বন্দেগির মাধ্যমে আমাদের জীবনকে আলোয় আলোয় ভরে তুলতে পারি। আজ আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানবীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করা। আর এজন্য প্রয়োজন তাকওয়ার যা অর্জন হয় সিয়াম পালনে। আমরা জানি, ইবাদাত কবুল হওয়ার শর্তসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো সত্তার জানিয়ে দেওয়া পাথেয়কে উদ্দেশ্য মনে না করে উদ্দেশ্য সাধনের মাধ্যম মনে করে ইবাদতটি করা। এখানে উদাহরণস্বরূপ বলতে চাই, আমি যদি বরিশালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই, তাহলে আমাকে পথ খরচ নিতে হবে এবং লঞ্চ তথা বাহনে উঠতে হবে। আমার উদ্দেশ্য হলো বরিশাল যাওয়া, আর পৌঁছার মাধ্যম হলো, পাথেয় তথা পথ খরচ ও লঞ্চ। কিন্তু আমি যদি লঞ্চ কিংবা পথ খরচকেই সব মনে করি তাহলে আমার উদ্দেশ্যে পৌঁছা সম্ভব হবে না। ঠিক তেমনিভাবে রোজা ফরজ করা হয়েছে তাকওয়াবান হওয়ার উদ্দেশ্যে আর এ উদ্দেশ্যে পৌঁছার মাধ্যম হলো সাহরি খাওয়া, ইফতার করা, সব ধরনের প্রবৃত্তির চাহিদা থেকে বিরত থাকা। কিন্তু আমি যদি এই সাহরি খাওয়া, ইফতার করা, সব ধরনের প্রবৃত্তির চাহিদা থেকে ফিরে থাকাকে সাওম মনে করি, তাহলে আমার উদ্দেশ্যে পৌঁছা সম্ভব হবে না। এগুলোকে উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য সাধনের মাধ্যম মনে করতে হবে। আর যখনই কোনো ব্যক্তি উদ্দেশ্য সাধনের মাধ্যম মনে করে পালন করবে এবং লক্ষ্য সাধিত হবে, তখনই রোজা এবং কোরআন ওই ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করবে কিয়ামতের দিনে। রোজা বলবে, হে আল্লাহ! আমি তাকে পানাহার এবং সব ধরনের প্রবৃত্তির চাহিদা থেকে ফিরিয়ে রেখেছি। অতএব ওই ব্যক্তির জন্য আমার সুপারিশ কবুল কর। আর কোরআন বলবে, হে আল্লাহ! আমি তাকে রাতের নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি। অতএব তার জন্য আমার সুপারিশ কবুল কর। এই রমজান মাসই হলো তাকওয়া অর্জনের উত্তম মৌসুম। যেমন রসুল (সা.) বলেছেন, যখন রমজান মাস আসে তখন আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। অন্য বর্ণনায় এসেছে, জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তানকে করা হয় শৃঙ্খলিত। অন্য বর্ণনায় এসেছে, রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়।

তাই আসুন, এই মাসে নিজেকে আপন সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিনয়ের সঙ্গে পেশ করি। কোরআন নাজিলের এই মাসে কোরআন পড়ি, কোরআন শিখি এবং নিজেকে পূত-পবিত্র করে গড়ে তুলি। রোজার মাধ্যমে আল্লাহভীতি বা তাকওয়া সৃষ্টি করি, যা মানুষকে আত্মসংযমী ও আত্মশুদ্ধিতে উদ্বুদ্ধ করে। যা নৈতিক চরিত্রের জীবনীশক্তি। যার মাধ্যমে সমাজ ও ব্যক্তি এক মহান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ও কলুষমুক্ত হতে পারে। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন। আমিন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও পীরজাদা : আলহাজ মাওলানা মুহা. ইয়াসিন (রহ.) পীর সাহেব চরখালী, ভাণ্ডারিয়া, পিরোজপুর।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর