রবিবার, ১৮ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

দাগি-দোষীরা যেন ‘নৌকা’ ‘ধানের শীষ’ মার্কা না পায়

কাজী সিরাজ

দাগি-দোষীরা যেন ‘নৌকা’ ‘ধানের শীষ’ মার্কা না পায়

আমাদের বর্তমান জাতীয় সংসদ নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশ্ন আছে, বিতর্ক আছে। এর কারণ কারও অজানা নয়। বর্তমান সংসদ গঠন উপলক্ষে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তা ছিল একতরফা। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট, গণফোরাম, বিকল্প ধারা, সিপিবি, বাসদ, কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগসহ ৪২টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ৩০টিই সেই নির্বাচন বর্জন করে। শুধু তাই নয়, ৩০০ আসনের সংসদের ১৫৩টি আসনে কোনো নির্বাচনই হয়নি। শাসক লীগ এবং এরশাদের জাতীয় পার্টি সমঝোতার মাধ্যমে আসনগুলো ভাগাভাগি করে নিয়ে নিয়েছে। বিএনপি নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অটল থাকে; সরকার তাদের দাবি অগ্রাহ্য করে। ফলে বিএনপি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না—এই যুক্তিতে। মনোনয়নপত্র দাখিলের একেবারে শেষ সময়ে সরকার অবস্থান পরিবর্তন করে সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রস্তাব দেয়; এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ পছন্দের মন্ত্রণালয় অফার করে বিএনপিকে। বিএনপি তাত্ক্ষণিক নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেও ওই সময়ের মধ্যে মোটামুটি প্রার্থী ঠিক করে ফেলতে পারত। এত বড় দলে প্রার্থী তো আগে থেকেই ঠিক থাকার কথা। একটি সূত্রে প্রকাশ, নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে চিন্তা-ভাবনা চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জোটসঙ্গী জামায়াতের নেতিবাচক ভূমিকার কারণে সিদ্ধান্ত নিতে বিএনপি দেরি করে ফেলে। সময় পেছানোর তদবিরও নাকি হয়েছিল সরকারঘনিষ্ঠ অন্য এক দলের নেত্রীর মাধ্যমে। কিন্তু সরকার তাতে রাজি হয়নি। তবে এখানে একটা বড় প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার যখন সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দিলই, তখন শিডিউল ঘোষণার আগে বা পরপরই তা করল না কেন? হাতে সময় থাকতেও নির্বাচনের তারিখ সপ্তাহ খানেক পিছিয়ে দিল না কেন? সরকার রাজি হলেই তো নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারত। এবার পরিস্থিতি ভিন্ন বলেই মনে হচ্ছে। একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে জাতীয়-আন্তর্জাতিক একটি জোরালো অভিমত খুবই স্পষ্ট। সবাইকে নিয়ে একটা ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠান সরকারের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের জন্যও খুবই জরুরি। আবার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে করতে কাহিল, লাচার বিএনপিরও দলের আরও সর্বনাশ রোধের জন্য আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা অপরিহার্যের মতো। তাই এখন পর্যন্ত নির্বাচনের ব্যাপারে উভয় দলের ভূমিকা ইতিবাচকই শুধু নয়, প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বক্তব্য বিবৃতি দেখে-শুনে মনে হয়, একাদশ সংসদ নির্বাচনের বুঝি আর বেশি দিন বাকি নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ অন্য মন্ত্রী-মিনিস্টার ও দল-অঙ্গ দলের নেতারা প্রতিদিনই আওয়ামী লীগকে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আবারও সরকার গঠনের সুযোগ দেওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সরকার গঠনে আওয়ামী লীগ হ্যাটট্রিক করবে এবং বিএনপি হ্যাটট্রিক করবে পরাজয়ের। অপরদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ৩০ সিটও পাবে না। পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের আগে লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন বিএনপি ১০ সিটের বেশি পাবে না। কিন্তু তারা ১৪০ আসনে জিতে জামায়াতের ১৮ এমপির সমর্থনে সরকার গঠন করে। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা মাঝে মাঝে ‘দৈবজ্ঞের’ মতো এমন সব কথা বলেন, বাস্তবে তা ফলে না। তাদের ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবে না ফললে তাদের সমর্থক-অনুরাগীরা লজ্জা পেলেও নেতা-নেত্রীরা লজ্জা পান কিনা জানি না। নেতা-নেত্রীরা যখন এমন সব কথা বলেন, সাধারণ মানুষও তখন তাদের বাস্তব বর্জিত ধারণা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে। এ জাতীয় মন্তব্যের পর ফল উল্টো হতে দেখেছে মানুষ। একবার নয়, একাধিকবার। এবার বাগযুদ্ধে কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলছেন না। দুটি বিষয় কিন্তু লক্ষ্যণীয়। ১. আওয়ামী লীগ তাদের ২০তম কাউন্সিল থেকেই নৌকা নিয়ে নেমে পড়েছে বলতে হবে। বিএনপিও তাদের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল থেকে নির্বাচনী মিশন নিয়েই ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করে। ৯ মে ২০১৭ ঘোষিত ভিশন-২০৩০ তারই বর্ধিত রূপ। বেগম জিয়া ধানের শীষে ভোট দেওয়ার জন্য জনগণের প্রতি প্রথম আহ্বান জানাল গত ১৪ মে ঢাকা উত্তর বিএনপির ইফতার মাহফিলে। বোঝা যায়, একাদশ সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে দুই দলই প্রস্তুত; ২. জনগণের মধ্যেও নির্বাচন নিয়ে বেশ উৎসাহ থাকলেও তা প্রত্যাশা অনুযায়ী হবে কিনা, সে ব্যাপারে সন্দেহ-সংশয় এখনো কাটেনি। যে কোনো নির্বাচনের ব্যাপারে অংশগ্রহণকারী মূল রাজনৈতিক দলগুলো এবং জনগণের আগ্রহ একটি ভালো নির্বাচনের আভাস দিলেও নির্বাচনটি আদৌ ভালো হবে কিনা, সে ব্যাপারে সংশয় ভালো কথা নয়। কেন এই সংশয়? নির্বাচনে জিততে চাওয়া ও সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখা কোনো রাজনৈতিক দলের অপরাধ নয়। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা যখন যে কোনো উপায়ে ক্ষমতা ‘দখলে’ রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠে এবং ক্ষমতাপ্রত্যাশী সরকার বিরোধীরাও সরকার ফেলে দিয়ে ক্ষমতা ‘দখলের’ জন্য অস্থির হয়ে পড়ে, আবার সরকারি বাধা-বিপত্তি ও কূট-কৌশলকে পরাস্ত করে লক্ষ্য অর্জনের নিশ্চয়তা না পেয়ে নেতিবাচক পথ ধরে এগোতে থাকে, তখন নির্বাচন নিয়ে একটা ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েই যায়। এটা হয় দেশের রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে বড় রাজনৈতিক দলগুলো যখন নীতি-আদর্শ বিসর্জন দিয়ে শুধু ক্ষমতার জন্যই রাজনীতি করে এবং নির্বাচনে লড়ে তখন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশের জনগণ রাজনৈতিক ও আদর্শিক কারণে দলগুলোর সমর্থক, এমনকি নিজ দলের জন্য ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত থাকার পরও দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাছে সমর্থক ও জনগণের এই মূল্যবান চাওয়ার কোনো মূল্যই নেই। তাদের কাছে ক্ষমতাটাই প্রধান। হ্যাঁ, এটা সত্য যে, কোনো একটি রাজনৈতিক দল ‘রামকৃষ্ণ মিশনের’ মতো সেবাশ্রম নয়। দল যদি সত্যিই কোনো মহৎ দর্শনভিত্তিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণ করতে চায়, তাহলে রাষ্ট্রক্ষমতার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা তথা সরকারে যাওয়া অবশ্যই জরুরি। কিন্তু আমাদের জনগণের দীর্ঘদিনের খারাপ অভিজ্ঞতা হচ্ছে, প্রধান দুটি দলের কেউ-ই সেই লক্ষ্যে ক্ষমতা চায় না। তারা ক্ষমতা চায় ব্যক্তি, গোষ্ঠী, পরিবার ও দলের স্বার্থে। তাতেও মহৎ কোনো উদ্দেশ্য থাকে না। ফুলে-ফেঁপে মোটাতাজা হওয়ার জন্যই তারা ক্ষমতা চায়। দুটি দলই অধিকাংশ সময় দেশ শাসন করেছে। যারা যখন ক্ষমতায় থেকেছে প্রতিপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ করেছে। আওয়ামী লীগ বিএনপিকে বলে দুর্নীতিবাজ, বিদেশে লুটের টাকা পাচারকারী দল; হাওয়া ভবনের দুর্নীতি, তারেক-কোকোর অর্থ পাচারের কিছু তথ্য, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতির মামলা তাদের প্রচারের হাতিয়ার। সবই যে অসত্য, তা কিন্তু মানুষ মনে করে না। সবার চোখের সামনেই তো স্পঞ্জ স্যান্ডেল পরে রাস্তায় এক কাপড়ে হেঁটে বেড়ানো অনেককে কোটি কোটি, শত কোটি টাকার মালিক হতে দেখেছে মানুষ, শত শত বিঘা জমির মালিক আর অসংখ্য ফ্ল্যাট-বাড়ির মালিক হতেও দেখেছে। জোর গলায় তাই বলতে পারে না, বিএনপির কেউ দুর্নীতি করেনি, লুটপাট করে হঠাৎ বড়লোক হয়নি। সবারই তো এক একটা ‘আমলনামা’ আছে না! ওটা লুকাবেন কী করে যে, মাত্র ক’বছর আগেও কী ছিলেন, এখন এত হৃষ্টপুষ্ট হলেন কোন জাদুর বলে! আওয়ামী লীগ এর আগে যতবার ক্ষমতায় ছিল একই কাজ করেনি এ কথা বলতে পারে না। এখনো আবার আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কিছু কিছু বলতে শুরু করেছে বিএনপি। বলছে মেগা প্রজেক্টের নামে মেগা দুর্নীতির কথা। বিদেশে লুটের টাকা পাচারের কথা। নাম ধরে না বললেও কার বা কাদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়, তা একেবারে দুর্বোধ্য নয়। তবে এটা ঠিক যে, ক্ষমতায় যারা থাকেন ক্ষমতাকালে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা তত সহজ নয়।

রাষ্ট্রীয় প্রশাসন তখন তাদের বড় আশ্রয় হিসেবে থাকে। তারেক-কোকোর অর্থ পাচারের এবং কিছু অর্থ ফেরত আনার যে খবর দেশবাসীকে দেওয়া হয়েছে সে কাজে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যে ভূমিকা পালন করেছে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে সে ‘বাহাদুরি’ কী তারা দেখাতে পেরেছে? আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এখন বিএনপি যেসব মেগা দুর্নীতির ভাসা ভাসা অভিযোগ করছে, আওয়ামী লীগ কখনো ক্ষমতা হারালে এবং বিএনপি আবার ক্ষমতায় যেতে পারলে তখন হয়তো দেখা যাবে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের ‘উৎসাহী তৎপরতা’ বা ‘বাহাদুরি’ এবং জানা যাবে অভিযোগের সত্যাসত্য। তবে বর্তমান সরকার আমলে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি দৃশ্যমান। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মো. হাবিবুর রহমান তার জীবদ্দশায় শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে একবার বলেছিলেন, ‘দেশ এখন বাজিকরের হাতে।’ চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজি, সন্ত্রাসবাজি ইত্যাদিকে তিনি ‘বাজিকরি’ আখ্যা দিয়েছিলেন। বেঁচে থাকলে তিনি এই আমলকেও হয়তো আরও জুতসই কোনো বিশেষণে চিহ্নিত করতেন। আমাদের প্রায় সবারই মনে থাকার কথা যে, ছাত্রলীগের এই ধরনের নানামুখী ‘বাজিকরি’তে অতিষ্ঠ হয়ে দুর্বিনীত ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুধু ছাত্রলীগ নয়, পত্রপত্রিকার খবর থেকে জানা যায়, দল ও বিভিন্ন অঙ্গ দলের অন্য অনেকেও পিছিয়ে নেই।

দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কিছুদিন পরপরই দলের ভিতরকার ‘বাজিকর’দের বিরুদ্ধে সাবধানবাণী উচ্চারণ করছেন। কাজেই কোনো দলই সব সৎ ও আদর্শবাদীর দল দাবি করতে পারে না। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে দলের ভিতর শুদ্ধি অভিযানের কথা আমাদের মনে আছে এবং মনে আছে খালেদা জিয়ার আমলে ‘অপারেশন ক্লিন হার্টের’ নামে মূলত দলীয় দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর কথাও। ওবায়দুল কাদের এখন আওয়ামী লীগের বিতর্কিতদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করছেন। কাজেই এ ব্যাপারে দুই দলই ‘আত্মস্বীকৃত’ দোষী। অভিযোগ ও ধারণা মিথ্যা নয় যে, এরা দেশ ও জনগণের কল্যাণে নীতি আদর্শকেন্দ্রিক কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে ক্ষমতা চান না, ক্ষমতা চান কিছু লোকের ভাগ্য বদলের জন্য। দুশ্চিন্তার কারণ হচ্ছে, এরা পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করলেও কোনো বড় দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা কখনো কেউ গ্রহণ করেনি ক্ষমতায় থাকাকালে। খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের আমলে আওয়ামী লীগকে বলতে শুনেছি, কাউকে পালানোর সুযোগ দেওয়া হবে না। ১৯৯৬ সালে-ই ক্ষমতায় এসেছিল আওয়ামী লীগ। কী করেছিল? কিছুই করেনি। দুর্নীতির মাধ্যমে আহরিত অর্থবিত্ত স্পর্শ না করে কয়েক মাস জেল খাটলেই সব সাফ-সুফা হয়ে যায়! পরেরবার ২০০১ সালে ক্ষমতায় এলো আবার বিএনপি। দুই ভলিউমে দুর্নীতিবাজদের কালো তালিকা প্রকাশ করল। কিছুই করল না। বরং আরেকটি দুর্নীতি করল তালিকাভুক্তদের ‘ছাড় দেওয়ার সুযোগদানের’ প্রক্রিয়ায়। কেউ আসলে কিছু করে না। এখনইবা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কী করা হচ্ছে রাজনৈতিক হয়রানি করা ছাড়া? এ জন্যই বলা হয়, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগও এখন আর নেই, বিএনপিও আর শহীদ জিয়ার বিএনপি নেই। আগামী নির্বাচনে দুই দলই কায়েমি স্বার্থে ক্ষমতা ছাড়া অন্য কিছু ভাবছে না। এটা সকলেরই জানা কথা যে, আদর্শের লড়াইয়ে ক্ষমতার বিষয়টা জনগণের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। নির্বাচনে কারচুপি বা অনৈতিক কোনো প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করা হয় না। ‘জয়লাভের’ চেষ্টা আর ‘দখল করার’ উন্মত্ততা এক নয়। আমাদের দেশের সাম্প্রতিক বিভিন্ন নির্বাচনী অভিজ্ঞতায় ‘ক্ষমতা’ ও ‘দখল’ শব্দ দুটি সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ গণতন্ত্রে ক্ষমতাকে ভাবা হয় ‘দায়িত্ব’ আর দখলের পরিবর্তে ভাবা হয় ‘গণরায়ের’ কথা।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উভয় দলের মধ্যে ক্ষমতা ‘দখলের’ প্রবণতাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকারি দল মাঠের প্রধান বিরোধী দলকে কঠিন চাপের মধ্যে রেখে নির্বাচনে তাদের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির তৎপরতা চালাচ্ছে। শিডিউল ঘোষণার আগেই মনোনয়ন ঘোষণা ছাড়া বাকি সব তৎপরতাই তারা চালিয়ে যাচ্ছে। আগামী জুলাই মাস থেকে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ভোটের প্রচার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরুর কথা বলা হয়েছে গত ১৪ জুন। অথচ ইতিমধ্যে সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে জনগণকে পক্ষে টানার চেষ্টা করছে তারা। মন্ত্রী-মিনিস্টাররা সরকারি কর্মসূচির আবরণে দলীয় ভোট প্রচারণায় সভা-সমাবেশ করে চলেছেন। কিন্তু প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল বিএনপিকে একই ধরনের তৎপরতা চালানোর সুযোগ দিচ্ছে না বলে অভিযোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সত্য বলে প্রমাণ হচ্ছে। দলের প্রধান খালেদা জিয়া এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অধিকাংশ নেতা এবং হাজার হাজার মাঠকর্মী অসংখ্য মামলায় জর্জরিত। নতুন নতুন মামলারও অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। গুম-হত্যার ভয়াবহ তাণ্ডবও চলছে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের লোকজনও বাদ যাচ্ছে না। অবস্থাটা দাঁড়িয়েছে এমন, নির্বাচনের যথেষ্ট আগেই এবং শিডিউল ঘোষণার অনেক বাকি থাকতেই নির্বাচন নিয়ে একটি নেতিবাচক ও ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টিরও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বাগযুদ্ধে বিএনপির বিরুদ্ধে সরকারি দলের অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষ হলেও সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট কিছু কিছু ক্ষেত্রে (দুর্নীতি-সন্ত্রাস) প্রমাণ যে একেবারে নেই, তাও নয়। আগেই উল্লেখ করেছি, সব তো ঘটেছে মানুষের চোখের সামনেই। বিএনপি এখন সরকারের দুর্নীতি সম্পর্কে যে অভিযোগ করছে তা ঢালাও অভিযোগ; স্পষ্টতা ও সুনির্দিষ্টতা নেই। তবে এ আমলের সব কিছুও ঘটছে জনগণের সামনেই। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বিএনপির মূল নেতাদের অনেকেরই ‘আমলনামা’ খারাপ হওয়ায় এবং এমনিতেই মামলা-মোকদ্দমা ও নানামুখী চাপে থাকায় অভিযোগ সুনির্দিষ্টকরণে সাহস পাচ্ছে না। সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্যও কোনো সাহসী পদক্ষেপ দলটি নিতে পারছে না নেতৃত্ব ও সংগঠনের দুর্বলতার কারণে। এটা সত্য যে, বিএনপির জনসমর্থন এখনো মোটেও কমেনি। বরং এটাও সত্য যে, সাড়ে ৮ বছর আওয়ামী শাসনের নানা দুর্বলতার কারণে জনগণের সমর্থনের পাল্লা তাদের দিকে আরও বেশি ঝোঁকার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিশেষ করে আকস্মিক চালের মূল্য বৃদ্ধিতে সরকার খুবই বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। কিন্তু তাও সঠিকভাবে কাজে লাগাতে সাহসী কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না বিএনপি। এত কিছুর পরও জনগণ দেশে একটি গ্রহণযোগ্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশী। প্রধান দুই দলের এ ব্যাপারে পজিটিভ ভূমিকা ছাড়া এই গণপ্রত্যাশা পূরণ হওয়ার নয়। এ ব্যাপারে শাসক দলের দায়িত্ব সর্বদাই বেশি থাকে। আওয়ামী লীগকে সে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাদের ভূমিকা রাখতে হবে একটি ‘প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল’ হিসেবে, ‘সরকারি দল’ হিসেবে নয়। বিএনপিকেও নির্বাচনী সড়ক থেকে নেমে যাওয়ার জন্য কোনো ফাঁকফোকর না খুঁজে দলের বিপুল সমর্থনকে পুঁজি করে সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে। আমলনামা খারাপওয়ালারা যত উচ্চাসনেই থাকুন না কেন, তাদের হঠিয়ে দিতে হবে। তাদের পক্ষে অন্য যাই হোক, সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের মহৎ কাজ করার সাহস দেখানো সম্ভব নয়। একটি সত্যবাণী হচ্ছে, অসৎ লোকরা মহৎ কাজ করতে পারে না। সৎ, যোগ্য, শিক্ষিত ও মেধাবী নবীন-প্রবীণের যৌথ নেতৃত্বই পারে বিএনপিকে লক্ষ্যপানে এগিয়ে নিতে। উভয় দলের উচিত অসৎ ও অযোগ্যদের বাদ দিয়ে ৩০০ আসনে মনোনয়ন দেওয়া। আওয়ামী লীগ ঘোষণা করেছে, খারাপ পারফরমারদের এবার নমিনেশন দেবে না। দেখা যাক, সত্যি হয় কিনা। বিএনপিও ঘোষণা দিক দুর্নীতিবাজ, লুটেরাদের নমিনেশন দেবে না, কোনো নমিনেশন বাণিজ্য হবে না। কার্যত তা হলে নির্বাচনের চরিত্রও পাল্টে যাবে এবং একটা ভালো নির্বাচন হবে। দুই দলের আচরণের ওপরই নির্ভর করবে জনগণের বর্তমান আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব কাটবে কিনা।

একটি অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন যেমন মানুষ চাচ্ছে, তেমনি এটাও নজর রাখছে প্রধান দুই দল নৌকা আর ধানের শীষ দিয়ে কাদের পাঠাচ্ছে জনগণের কাছে। আওয়ামী লীগ ‘দাগি-দোষী’ এমপিদের পুনরায় মনোনয়ন দেবে না বলে বলেছেন দলের সাধারণ সম্পাদক। এটা কি তার দলের সিদ্ধান্ত? কবে, কোন সভায় এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে? ভোটের মাঠে যারা আবার চাষবাস শুরু করেছেন তারা তো সেই পুরনোরাই। যদি তেমন সিদ্ধান্ত নেওয়াও ছয়, এমপিদের বাইরে থেকে যাদের ‘নৌকা’ দেওয়া হবে তারা কারা? অন্য যারা মাঠে দাপাদাপি করছেন তারা কি দাগ-দোষহীন? একইভাবে বিএনপি যাদের ইতিমধ্যে মাঠে ছেড়েছে তাদের অনেকে হয় সে আগের ‘সাধু বাবারা’, নয়তোবা ‘ক্রয়সূত্রে’ নমিনেশন পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত ব্যক্তিরা। ‘নৌকা’-ধানের শীষ নিয়ে শিক্ষিত, সৎ, মেধাবী ও নিবেদিত নেতা-কর্মী বাদ দিয়ে যদি খারাপে-খারাপেই লড়াই হয় তো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলেই বা লাভ কী? দুই দলের মধ্যেই জনগণের পছন্দ করার লোক আছে অনেক। সেই ‘ঝাঁপিগুলো’ খুলুক না দুই দল।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর