সোমবার, ১৯ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

সংবাদপত্রে ভ্যাটের থাবা : সরকারের কত লাভ?

মোস্তফা কামাল

সংবাদপত্রে ভ্যাটের থাবা : সরকারের কত লাভ?

শুল্ক আর ভ্যাটের পাগলাঘণ্টায় অস্থির সংবাদপত্র শিল্প। নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে ভ্যাট, বিজ্ঞাপনেও ভ্যাট। ভ্যাটের থাবা ছাপার কালি-প্লেটসহ আশপাশের টুকিটাকিতেও। এত ভ্যাটের খাবলায় পত্রিকা টিকিয়ে রাখা নিয়ে প্রমাদ জপছেন উদ্যোক্তারা। তা সাংবাদিকসহ সংবাদপত্রে নির্ভরশীলদের নতুন করে বেকারত্বেরই হাতছানি। এমনিতেই নানা কারণে দেশের সংবাদ শিল্পে একটি নিদানকাল চলছে। নিয়মিত বেতনভাতা হওয়া পত্রিকা হাতেগোনা। কয়েকটিতে চলছে ছাঁটাইয়ের মচ্ছব। এর মধ্যেই গজবের মতো নাজিল হয়েছে শুল্ক ও ভ্যাটের খড়গ। যাপিত জীবনে এ ধরনের পরিস্থিতিতে পুরান ঢাকার মানুষ বেখেয়ালেই বলে বসে- ‘এমনিই যায় না, তারওপর তেনা প্যাঁচায়’ প্রবাদটি। কুমিল্লা অঞ্চলে বলা হয়, মরার মরণ।

বাজেটের প্রস্তাব মতো শুল্ক-ভ্যাট কার্যকর হলে ১ জুলাই থেকে সংবাদপত্র ছাপানোর কালি, প্লেট, নিউজপ্রিন্টসহ অন্যান্য খাতে গুনতে হবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট। নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে ৫ শতাংশ শুল্ক বলা হলেও আনুষঙ্গিক ভ্যাট-শুল্ক মিলিয়ে অঙ্কটি আরও বড়। কালিতে ৬২ শতাংশ কর। প্লেট আমদানি শুল্ক এক শতাংশ থাকলেও অন্যান্য কর-শুল্ক মিলিয়ে তা দাঁড়ায় সাড়ে সাত। প্রিন্টিং কেমিক্যালে পাঁচ শতাংশ শুল্কসহ মোট কর দাঁড়ায় ৩৫ শতাংশে। সব মিলিয়ে পত্রিকার খরচ গিয়ে ঠেকবে প্রায় দ্বিগুণে। মফস্বলের সংবাদপত্রগুলোর অবস্থা হবে আরও গুরুচরণ। ভ্যাট আইন ২০১২ অনুসারে ভ্যাট অব্যাহতির কিছু বিষয়-আশয় থাকলেও সেগুলোর মধ্যে সংবাদপত্র সংশ্লিষ্ট বেশিরভাগ পণ্য ও সেবার জায়গা হয়নি। ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইনে সংবাদপত্রকে সেবা খাত হিসেবে ভ্যাটমুক্ত করা হলেও এতে ব্যবহার হওয়া আমদানিকৃত উপকরণে ভ্যাট দিতে হচ্ছে। আগামী অর্থবছর থেকে চুক্তি মতো বিজ্ঞাপন বিল আদায় হোক- না হোক কোনো সংবাদপত্রকে তা আদায় হিসেবে দেখাতে হবে। এখানেই শেষ নয়, এরপর বিজ্ঞাপনের উল্লিখিত বিল আদায় না হলেও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এর ১৫ শতাংশ রাজস্ব শোধ দিতে হবে। ঘটনা ও পরিস্থিতির তোড়ে সংবাদপত্রগুলোকে কখনো কখনো বিজ্ঞাপনের রেট কমাতে হয়। কিন্তু বাড়ানোর ক্ষমতা বা স্বাধীনতা নেই।

মত প্রকাশের বিশাল ক্ষেত্র সংবাদপত্রের আয়-ব্যয় এ পেশায় সংশ্লিষ্ট অনেকেরও জানার বাইরে। অথবা সবার তা জানতে হয় না। না জানলেও চলে। যত তাড়না-যন্ত্রণা সইতে হয় উদ্যোক্তা, পেশাদার সম্পাদকসহ কয়েকজনকেই। অন্যদের সেই বেদনায় ভুগতে হয় না। সংবাদপত্রের মূল আয় বিজ্ঞাপন। আর নামমাত্র আয় আসে সার্কুলেশন অর্থাৎ পত্রিকা বিক্রি থেকে। আয়ের মূল রাস্তা বিজ্ঞাপনে প্যাঁচানো এ তেনা হজম করে সংবাদপত্রের এখন লোকসান দিয়ে টিকে থাকাও কঠিন হবে। সরকারি বিজ্ঞাপনে বিরতিহীন খরা অনেকদিন থেকেই। সরকারি দরপত্রের বড় বড় বিজ্ঞাপন বন্ধই প্রায়। ই-টেন্ডার চালু হওয়ায় সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন মিনিমাম সাইজে দিলেই চলে। পূর্ণ পৃষ্ঠার দরপত্র বিজ্ঞাপনের সাইজ নেমেছে দুই কলাম দুই ইঞ্চিতে। আবার সরকারি আর বেসরকারি বিজ্ঞাপনের রেটের ফারাকও বিশাল। বেসরকারি বিজ্ঞাপনের তুলনায় অনেক কমে সরকারি বিজ্ঞাপন ছাপতে হয় পত্রিকাগুলোকে।

একসময় সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনদাতারাই ভ্যাট পরিশোধ করতেন। পরে তা উল্টে ফেলা হয়েছে। বিজ্ঞাপনদাতারা এখন বিল শোধের সময়ই চার শতাংশ আয়কর কেটে রাখেন। যার রসিদ মেলানো কঠিনেরও কঠিন। এ ছাড়া অনলাইন ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক হওয়ায় বিজ্ঞাপন ছাপা হওয়ার আগেই মাশুল গোনা শুরু হয়। বিলের কাগজ পাওয়ার পর দু-এক দিনের মধ্যেই ভ্যাট শোধ বাধ্যতামূলক। অথচ বিল কবে আসবে সেই নিশ্চয়তা নেই। সংবাদপত্রে সংশ্লিষ্ট অনেকেরও জানা নেই, চলতি বছরের সরকারি বিজ্ঞাপনের টাকা কখনো কখনো আগামী বছরও মেলে না। কোটি কোটি টাকা বিজ্ঞাপনের বিল বকেয়া, অনাদায়ী এমনকি তামাদি হয়ে যাওয়ার ঘটনাও থাকে। অথচ ভ্যাট শোধ করতে হয় অ্যাডভান্স। এ কারণে অ্যাড আর অ্যাডভান্স নিয়ে সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন বিভাগে রয়েছে কষ্টমাখা নানা মন্তব্য।

সারা দুনিয়াতেই প্রিন্ট মিডিয়া বেশ ঝুঁকিতে। দেশে দেশে বড় পত্রিকাগুলোতে খরচ কমানোর যজ্ঞ চলছে। তা করতে গিয়ে কেউ সংস্করণ কমিয়ে দিচ্ছে, কেউ কমিয়েছে সার্কুলেশন। আর ছাঁটাই করছে সবাই। এ মরণযাত্রা থেকে রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালির মতো দেশে সরকার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহায়তা দিচ্ছে সংবাদপত্রে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর সংবাদপত্রগুলোকে অন্তত ৯০ কোটি ডলার রাজস্ব ছাড় দেওয়া হচ্ছে। ফিনল্যান্ড ও ফ্রান্সে সংবাদপত্র বিক্রির আয় ছাড়াও বিজ্ঞাপন, নিউজপ্রিন্ট, ছাপাখানা ও ছাপাখানায় ব্যবহৃত সব ধরনের উপকরণ ভ্যাটমুক্ত। আর আঞ্চলিক পত্রিকাগুলোকে দেওয়া হয় ভর্তুকি। ফ্রান্সে কম বিজ্ঞাপন পাওয়া পত্রিকাগুলোকে ভর্তুকির পাশাপাশি ছাপাখানা ও নতুন প্রযুক্তি স্থাপনে দেওয়া হয় বিশেষ সহায়তা। ইতালিতেও দেওয়া হয় নামমাত্রে সুদে ঋণসহ নানা প্রণোদনা। প্রতিবেশী ভারতে নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে কোনো শুল্ক না থাকার পরও সংবাদপত্রশিল্পে দুর্দশা চলছে।

বাংলাদেশেও প্রিন্ট মিডিয়াকে চাপে ফেলেছে ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়া। এ দুই মিডিয়া প্রিন্ট মিডিয়াকে বেশ কোণঠাসা করে ফেলেছে। বিনিয়োগে গতি না থাকায় বেসরকারি খাতের বিজ্ঞাপন কমে গেছে। সেখানে ভাগ বসিয়েছে বিপুলসংখ্যক টেলিভিশন ও অনলাইন। আগে সংবাদপত্রের আয়ের বড় উৎস ছিল মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপন। তারাও এখন বিজ্ঞাপন কমিয়ে দিয়েছে। অনেক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি বাংলাদেশের সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়ার বদলে পাশের দেশের টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন প্রচার করছে।

বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি জনসংখ্যার তুলনায় দেশে সংবাদপত্র কম। সার্কুলেশন একেবারে সীমিত। ১৬ কোটি মানুষের দেশে সব মিলিয়ে বিক্রি ২৫ লাখের বেশি নয়। এ অবস্থায় সংবাদপত্রশিল্প রাষ্ট্রীয় সহায়তার বদলে পড়ল বাড়তি কর ও ভ্যাটের চাপে। এ চাপ সইবার সামর্থ্য এ শিল্পের নেই। নামেমাত্র অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা পত্রিকাগুলো এ ধাক্কায় প্রথমেই বিদায় নেবে। কোনোরকমে লাভ-লসে টিকে থাকাগুলো পড়বে কািচত হয়ে। ছোট ও মাঝারি পত্রিকাগুলো যাবে বন্ধের পথে। আর সামর্থ্যবান বলে পরিচিত পত্রিকাগুলো চেষ্টা করবে ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে টিকে থাকার। বেড়ে যাওয়া খরচ কমাতে উদ্যোক্তাদের হাতে পথ থাকে শুধু ছাঁটাইয়ের। উল্লেখ না করলেই নয়, সামনে নবম ওয়েজ বোর্ড। তা বাস্তবায়ন করতে গেলেও সাংবাদিকদের বেতন-ভাতাসহ সংবাদপত্রে ব্যয় বাড়বে। এর আগে, ২০১৩ সালে সংবাদপত্রের কর্মীদের জন্য অষ্টম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নে খরচ একবার বেড়েছে।

মনে রাখা দরকার সংবাদপত্র ভিন্নমাত্রার শিল্প। তেল-সাবান, চাল-নুন, আদা-মসলার সঙ্গে তুলনা করা পণ্য নয়। ভ্যাটের ফাঁদে ফেলার পণ্য নয় এটি। এ শিল্পটিকে কাবু করে কত লাভ হবে সরকারের? কী উপকার হবে দেশের?-এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। মরারে আরও মারার মধ্যে বীরত্ব থাকে না। শুধু বিকৃত আনন্দই মেলে। ভ্যাটের এ ধকল থেকে সংবাদপত্র শিল্পটিকে বাঁচানো নির্ভর করছে একেবারেই সরকারের নিয়ত ও বোধ-বুদ্ধির ওপর। এ ছাড়া কাগজের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ কি সরকার শিক্ষা প্রসারের স্লোগানের সঙ্গে মেলে? চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার বাহাদুরির সঙ্গে মানায়? বরং তা সংবাদপত্রের কণ্ঠ রোধের পর্যায়ে। টুঁটি চেপে ধরারই শামিল।

এতে সমাজের তথ্যপ্রবাহ আটকে যাবে। গণতন্ত্রের বিকাশ হুমকিতে পড়বে। অবাঞ্ছিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত তথ্য পরিবেশনার উপদ্রব বাড়বে। যাদের জবাবদিহি বা দায়িত্বশীলতা বলতে কিছু নেই। ওরা যখন যা ইচ্ছা করে। কক্সবাজার-রামুতে বৌদ্ধপল্লীতে আগুন ভাঙচুরের ঘটনা কিন্তু ওই তথ্য কারবারিদেরই কারবারের জের। সংবাদপত্রের টিকে থাকার পথ বন্ধ করে সরকার ওই উপদ্রবের দুয়ার খুলে দেবে তা এখনো বিশ্বাস হয় না।

     লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর