বৃহস্পতিবার, ২২ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

বাংলাদেশের পাকিস্তানপ্রেমী এবং পাকিস্তানবিদ্বেষী

তসলিমা নাসরিন

বাংলাদেশের পাকিস্তানপ্রেমী এবং পাকিস্তানবিদ্বেষী

দুই দল বাংলাদেশে, একদল পাকিস্তানপ্রেমী, আরেক দল পাকিস্তানবিদ্বেষী। দুই দলই পাকিস্তানের পক্ষে এবং বিপক্ষে ভীষণ মারমুখো। পাকিস্তানপ্রেমীদের কথা ভাবতে গেলেই আশঙ্কা হয়— দেশটিকে একদিন ওরা হয়তো আস্ত একটা পাকিস্তান বানিয়ে ফেলবে। ভালো খেলার জন্য হাততালি দাও ঠিক আছে। আমি তো ভালো খেললে, সে যে দলই খেলুক, সমর্থন করি। গত বছর এশিয়া কাপে ভারত-পাকিস্তানের খেলায় পাকিস্তানের সমর্থনে বাংলাদেশের পাকিস্তানপ্রেমীরা আনন্দে যখন চিৎকার করছিল, তারা পাকিস্তান ভালো খেলছে বলে সমর্থন করছিল না। তারা পাকিস্তানকে সমর্থন করছিল পাকিস্তান মুসলমানের দেশ বলে। পাকিস্তানকে সমর্থন করতে গিয়ে, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলতে বা পাকিস্তানের পতাকা ওড়াতে তাদের একটুও কণ্ঠ কাঁপেনি, হাত কাঁপেনি। এখনো তো অর্ধশতাব্দীও পার হয়নি। তিরিশ লক্ষ মানুষকে খুন করে গেছে পাকসেনারা, দু’লক্ষ মেয়েকে ধর্ষণ করে গেছে। জানি পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ বা ক্রিকেটাররা খুন বা ধর্ষণ করেনি, তার পরও পাকিস্তানের জন্য পাকিস্তানপ্রেমীদের বিকট আনন্দধ্বনি শুনে মনে হয় এক ধর্ষিতা নারী আনন্দধ্বনি করছে তার ধর্ষকের সমর্থনে।

আর ওদিকে পাকিস্তানবিদ্বেষীদের অনেকে ‘মুক্তচিন্তক’ বলে পরিচিত। মুশকিল হলো, ওরা ওদের এক গুরুর কাছে শিখেছে, পাকিস্তানিদের অবিশ্বাস করতে হবে, যে করেই হোক অবিশ্বাস করতে হবে, পাকিস্তানিরা ফুল নিয়ে এলেও অবিশ্বাস করতে হবে। পাকিস্তানিদের প্রসঙ্গ এলেই ওরা গুরুর মন্ত্রটি জঁপে। সেদিন আইসিসি চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে পাকিস্তান জেতার পর পাকিস্তান এবং পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে এত তীব্র ঘৃণা ছড়িয়ে দিচ্ছিল ওরা, যে, আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি। এ তো দেখি পাকিস্তানপ্রেমীদের যেমন ভারতের প্রতি ঘৃণা, ঠিক তেমন পাকিস্তানবিদ্বেষীদের পাকিস্তানের প্রতি একই রকম ঘৃণা। পাকিস্তানিদের ঘৃণা করার পেছনে ওদের যত যুক্তি, সব আমি মেনে নিতে পারি না।

খেলায় সাধারণত আমি অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলকে, অপেক্ষাকৃত গরিব দেশের খেলোয়াড়দের সমর্থন করি। অস্ট্রেলিয়া আর ভারত খেললে ভারতকে, ইংল্যান্ড আর শ্রীলঙ্কা খেললে শ্রীলঙ্কাকে, জার্মানি আর কেনিয়া খেললে কেনিয়াকে। কোনো দল আবার খুব বেশি ভালো খেললে অটোমেটিক্যালি তার প্রতি সমর্থন চলে আসে। সে যে খেলার ক্ষেত্রেই হোক। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, রাগবি, বেসবল। কে আমার দেশের শত্রু, কে বন্ধু— সেই হিসেব করি না। সেটা রাজনীতির সম্পর্ক। কোনও দেশের শাসকশ্রেণি বা রাষ্ট্রব্যবস্থা আমি পছন্দ না করলে সেই দেশের খেলাকে বা সেই দেশের খেলোয়াড়দের আমার অপছন্দ করতে হবে, তাদের হার চাইতে হবে— এর কোনও মানে নেই। পাকিস্তানের বর্বর সৈন্যরা যে অন্যায় করেছে, তা কোনওদিন ক্ষমা করবো না, তারপরও কিন্তু পাকিস্তানের ক্রিকেট দল ভালো খেললে তাকে সমর্থন না করার পক্ষে আমি কোনও যুক্তি দেখি না। এই সমর্থনের সঙ্গে কিন্তু পাকিস্তান ভালো না খেললেও পাকিস্তানপ্রেমীরা পাকিস্তানকে যে সমর্থনটি করে, তা মেলে না। দুটো সম্পূর্ণ দু’জিনিস। ক্রিকেট দলের খেলাকে পছন্দ হওয়া মানে একাত্তরে পাকিস্তানের বর্বরতাকে পছন্দ করা নয়, পাকিস্তানের মৌলবাদকে বা সন্ত্রাসকে পছন্দ করা নয়। পাকিস্তানে মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী লেখক শিল্পী আছেন, ধর্মমুক্ত প্রগতিশীল নারীবাদী মানুষও প্রচুর আছেন। তাদের শ্রদ্ধা করা মানে একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী সামরিক শাসককে শ্রদ্ধা করা নয়। পাকিস্তান একটি সন্ত্রাসে বিধ্বস্ত আর ধর্মে আচ্ছন্ন দেশ, ক্রিকেটের ছেলেগুলো দেশে চ্যাম্পিয়নশিপের কাপ নিয়ে ঢুকলে দারিদ্র্যপীড়িত দেশের মানুষগুলো খুশিতে আত্মহারা হবে। অন্তত খেলার এই বিজয় তাদের কিছু দিন সুখে রাখুক। সুখে থাকার খুব বেশি কিছু তো দেশটির নেই।

পাকিস্তান কিন্তু শুধু পাকিস্তানের শাসক এবং সামরিক বাহিনী নয়। পাকিস্তান মানে লক্ষ কোটি সাধারণ মানুষ। যাদের আমাদের মতোই সুখ-দুঃখ। পাকিস্তানি সরকারের বিরোধিতা করেও পাকিস্তানি খেলার দলকে সমর্থন করতে পারি। সুস্থ সচেতন মানুষের কোনও দেশ থাকে না, গোটা পৃথিবীটাই দেশ।

পাকিস্তানি শাসকদের বর্বরতার আমি সমালোচনা করি, পাকিস্তানের মৌলবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের আমি নিন্দে করি, পাকিস্তানের জন্মটাই ভুল জন্ম বলে বিশ্বাস করি, কিন্তু নাক সিটকানোর মতো ঘৃণা একটি দেশের প্রতি আমার নেই, কারণ পাকিস্তানে মৌলবাদী এবং সন্ত্রাসবাদীরা যেমন আছে, এগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করার মানুষও তেমন আছে। ঠিক বাংলাদেশের মতো, সচেতন মানুষদের চাপাতি দিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে মারার ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা যেমন আছে, মদিনা সনদে দেশ চালাবার শপথ করা হেফাজতিদের বন্ধু সরকার যেমন আছে, তেমন সন্ত্রাসবিরোধী আর মৌলবাদবিরোধী প্রগতিশীল মানুষও আছে। বাংলাদেশকে শুধু সন্ত্রাসীদের কারণে কেউ ঘৃণা করতে চাইলে নিশ্চয়ই আমরা আপত্তি করবো।

পাকিস্তানিদের দ্বারা কম ক্ষতি হয়নি আমাদের পরিবারের! ময়মনসিংহ শহরে আমাদের বাড়ি ছিল হিন্দুপাড়ায়। একাত্তরে পাড়ার হিন্দুরা ঘরবাড়ি জিনিসপত্র যেভাবে ছিল, সেভাবে ফেলে চলে গিয়েছিল ভারতে। আমাদেরও শহর ছেড়ে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল গহিন গ্রামে। একবার দেশ স্বাধীন হয়েছে এ রকম একটি খবর পেয়ে গ্রাম থেকে শহরে চলে এসেছিলাম। এসে দেখি পাড়া বদলে গেছে। হিন্দুদের বাড়িতে পরিবার পরিজন নিয়ে থাকছে অচেনা উর্দুভাষী লোক। শুনলাম ওরা বিহারি। ওই বিহারিদের কেউ নিশ্চয়ই পাক আর্মিকে খবর দিয়েছিল। আমাদের বাড়িকে বড়লোকের বাড়ি হিসেবেই বিচার করা হতো। তারপর এক রাতে আমাদের বাড়িতে ঢুকে যা কিছু ছিল লুট করে নিয়েছে পাক আর্মি, টাকা পয়সা, সোনা রুপো। আমার নানির, মা-খালাদের, মামীদের সবার গয়না ছিল একটা ঝুড়িতে, যে ঝুড়িটা নানি আগলে আগলে রাখতো যেখানেই যেতো। পাক আর্মি সেই ঝুড়িটা নিয়ে গেছে। ওরা বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে নানি আর মা ধর্ষণ বা খুন থেকে বাঁচতে তড়িঘড়ি কোথাও লুকিয়েছিল। ঝুড়িটা নানির পাতা জায়নামাজের পাশেই ছিল। মা’র অনন্ত বালা ছিল রেহেলে রাখা খোলা কোরআনের ওপর। সব নিয়ে গেছে পাক আর্মি। আলমারি খুলে যা টাকা পয়সা ছিল নিয়েছে। আমার বাবাকে নারকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়েছিল, বেয়নেটের আঘাতে বাবার শরীর রক্তাক্ত করেছিল। বাবা হয়তো সে রাতে মরেই যেতো। আমাকেও হয়তো ওরা তুলে নিয়ে যেতো ক্যাম্পে, ধর্ষণ করতো মাসের পর মাস, বাধ্য করতো আত্মহত্যা করতে, কিন্তু বয়স আমার অল্প বলে আমাকে তুলে নিয়ে যায়নি। ঘুমের ভান করে পড়ে ছিলাম সে রাতে। এখনো দুঃস্বপ্নের মতো একাত্তরের সেই মধ্যরাত।

আগেই বলেছি পাকিস্তানিরা আমাদের তিরিশ লক্ষ লোককে খুন করেছে, দু’লক্ষ মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। বাংলাদেশের যুদ্ধ প্রমাণ করেছে মুসলিম ভ্রাতৃত্ব একটা ভুল ভাবনা, প্রমাণ করেছে দ্বিজাতিতত্ত্ব একটা ভুল থিওরি। পাকিস্তানিরা বাহান্নোতে আমাদের হত্যা করেছে, ঊনসত্তরে হত্যা করেছে, একাত্তরে করেছে। পাকিস্তানিদের নিয়ে আমার ভীষণ একটা ভয় ছিল, সেই ছোটবেলা থেকেই। আমার মনে হতো পাকিস্তানের সবাই বোধহয় মন্দ লোক, সবাই মৌলবাদী, সবাই রক্ষণশীল, নারীবিরোধী। কিন্তু তা সত্য নয়। ভালো লোক ওখানেও আছে, বিজ্ঞানমনস্ক, মুক্তচিন্তক, যুক্তিবাদী, মানববাদী ওখানেও আছে। তারাই হয়তো একদিন দেশটাকে বাসযোগ্য বানাবে। ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কোনও দেশকে আধুনিক দেশ হিসেবে গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব, তার পরও চেষ্টা করা ছাড়া আর তো কোনও উপায় নেই।

প্রতিটি দেশেই মুক্তচিন্তকের সংখ্যা রক্ষণশীলদের সংখ্যার চেয়ে কম, পাকিস্তানেও ঠিক তাই। পাকিস্তানের মুক্তচিন্তক যুক্তিবাদীদের যেমন দেশটাকে মৌলবাদীদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে, বাংলাদেশের মুক্তচিন্তকদেরও তাই করতে হবে।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর