রবিবার, ২৫ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

ওই বাচ্চারা যেন ওরই সন্তান

সমরেশ মজুমদার

ওই বাচ্চারা যেন ওরই সন্তান

বছর চল্লিশেক আগে অগ্রজ লেখক বরেন গঙ্গোপাধ্যায় এবং অভ্র রায়ের সঙ্গে জামশেদপুরে গিয়েছিলাম। তখন আমি বেশ কয়েকটা ‘ছোটগল্প’ লিখে ফেলেছি ‘দেশ’ এবং বিভিন্ন পত্রিকায়। অগ্রজ লেখকরা পিঠ চাপড়াচ্ছেন। যতদূর মনে পড়ছে, বরেনদাকে ওখানে নেমন্তন্ন করা হয়েছিল এক সাহিত্যসভায়। আমরা সঙ্গী হয়েছিলাম।

সেই সময় এক সন্ধ্যায় যখন বিশাল চাঁদ উঠল তখন বরেনদা বললেন, ‘চল,  কমল আজ আমাদের খাওয়াতে চাইছে, যাওয়া যাক।’

‘কে কমল?’

বরেনদা বললেন, ‘টেলকোতে কাজ করে, দারুণ গদ্য লেখে। তরুণ তুর্কি।’

সে সময় আমি একজনকেই তরুণ তুর্কি লেখক হিসেবে জানতাম যিনি স্বচ্ছন্দে লিখেছিলেন, ‘পুলিশ, কবিকে দেখে টুপিটা তোর খুলিস।’ তিনি তুষার রায়।

কমল চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা হলো। সুদর্শন যুবক। বরেনদার সঙ্গে যখন কথা বলল তখন বুঝলাম, যুবক বিনয়ী। আমাদের গোটা চারেক দেশে প্রকাশিত গল্পের নাম বলে মাথা নাড়ল, ‘ফাটাফাটি।’ তারপর আকাশছোঁয়া একটি জলের ট্যাঙ্কের সিঁড়ি ভাঙিয়ে আমাদের ওপরে নিয়ে গেল। জলের ট্যাঙ্কের ওপরটা বেশ বড়, দুটো টেনিস কোর্টের সমান। ঠিক মাঝখানে বসলাম আমরা। দিগন্ত ছেড়ে তখন গোল চাঁদ আকাশ দেখতে পেয়ে হামাগুড়ি দিচ্ছে। সেই চাঁদ দেখতে দেখতে কবিতা ডালপালা মেলল কমলের গলায়, চলল পান আহার।

আমরা চারজন চাঁদের আলোয় সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে শুয়ে থাকলাম জলের ট্যাঙ্কের ঠিক মাঝখানে। কিন্তু চাঁদ যখন নিম্নগামী হলো তখন কমল বলল, ‘চলুন, এবার ধরা যাক কয়েকটা ইঁদুর। এবার নামতে অসুবিধে হবে না।’ ততক্ষণে সবার দৃষ্টি স্বাভাবিক, মস্তিষ্ক শরীরটাকে বশে এনে ফেলেছে।

কমল চক্রবর্তীর সঙ্গে সেই প্রথম আলাপ। কলকাতা থেকে বহুদূরে দুজন মানুষ লিটল ম্যাগাজিন বের করে আমাদের শ্রদ্ধা আদায় করেছেন। একজন বালুরঘাটের অজিতেশবাবু তার ‘মধুপর্ণী’ কাগজের জন্য, দ্বিতীয়জন কমল চক্রবর্তী তার ‘কৌরব’ বের করে।

মাঝে মাঝেই হাতে পেতাম আর চমকে উঠতাম তার সম্পাদনা দেখে, লেখাগুলো পড়ে। বইমেলায় দেখা হতো, জড়িয়ে ধরতাম পরস্পরকে। কমলের গদ্য অসাধারণ। আমাদের সমসাময়িক যে কোনো লেখকের চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী। এই কমল শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছায়ার মতো মিশে থাকত সুযোগ পেলেই। শক্তিদার সঙ্গে চাইবাসা, টেবোয় গিয়ে হুলস্থুল করেছে মহুয়া আর হাঁড়িয়া খেয়ে। ওর তখনকার লেখায় সেই বহেমিয়ান জীবন পেরেকের মতো গেঁথে আছে। আমি ওকে কখনো বলিনি একটা আফসোসের কথা, আমাকে কখনো ‘কৌরব’-এ লিখতে বলেনি। নিশ্চয়ই কমল জানত আমার লেখা কৌরবের মান স্পর্শ করতে পারেনি। বরেনদা বলতেন, ‘তুই জলপাইগুড়ি থেকে আর কমল জামশেদপুরের। দুজনে মিলে একদিন বাংলা সাহিত্য জ্বালিয়ে দিবি।’ ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়নি। কিন্তু কমল সচেষ্ট হলে পারত। মুশকিল হলো একজন লেখককে লেখক হতে হলে শুধু অসম্ভব ভালো গদ্য, জীবন থেকে ঠিকঠাক মালমশলা তুলে লিখলেই হবে না, তাকে প্রফেশনাল হতে হবে। নিয়মিত অনুশীলনে থাকতে হবে। এক ম্যারাথন দৌড়। প্রথমেই প্রাণপণে ছুটলে দৌড়ের মাঝখানেই থেমে যেতে হবে। তাই প্ল্যানিংয়ের বড় দরকার। ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এগুলোর দিকে কমল নজর দেয়নি। উল্টে উড়তে গিয়ে ফুরিয়ে যাওয়ার আনন্দে বুঁদ হয়েছিল।

তারপর আর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল না। ও কখনই কলকাতার বাসিন্দা হয়নি। শুনেছিলাম জামশেদপুরেই চাকরি করছে। তারপর শুনলাম চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। মাঝেমধ্যে কলকাতার কোনো কোনো কাগজে কমল চক্রবর্তীর লেখা ভেসে উঠেছে। সব কাগজ দেখার সুযোগও তো হয় না।

এক সময় খবরটা পেলাম। পুরুলিয়ায় মরা মাটিতে প্রাণ আনতে চাইছে কমল। লাখ লাখ গাছ লাগিয়েছে চেয়েচিন্তে টাকা জোগাড় করে। সেখানে নাকি সে একটা স্কুলও তৈরি করেছে। আশপাশে কোনো ঘরবাড়ি নেই। বহুদূর থেকে শিশু বালক-বালিকাদের নিয়ে এসে খাওয়ায়, পড়ায়, আবার বিকালে তাদের ঘরে ফিরিয়ে দেয়। একটা হাঁসুলিবাঁকের কথা, একটা দেবযান লেখার চেয়ে এই কাজ কোনো অংশেই কম কৃতিত্বের নয়। জানলাম একেবারে শূন্য হাতে সে অন্তহীন, অসহায় মানুষদের কাছে গিয়ে তাদের শিশুদের চেয়ে নিয়ে আসছে স্বপ্ন দেখাবে বলে। প্রাথমিক সন্দেহ বা ভ্রান্তি কাটিয়ে উঠে সেই মানুষেরা সাড়া দিয়েছেন।

এরকম কাজ আমি করতে পারিনি। যারা পারেন তাদের সৃষ্টির কাছে নিজেকে বড্ড বামন বলে মনে হয়। ধূর্জটিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় নামের অফুরন্ত প্রাণশক্তির এক মধ্যবয়সী যুবকের সঙ্গে আলাপ হলো। তিনি আমাকে একটি পত্রিকা দিলেন যার সম্পাদক কমল চক্রবর্তী। ধূর্জটি ওই কাগজের পিতা এবং মাতা। কাগজটির নাম ‘প্রকৃতি ভালোপাহাড়’। হাতে নিয়ে চমকে উঠলাম। সম্পূর্ণ আর্ট পেপারে ছাপা প্রকৃতি-বিষয়ক পত্রিকা আমি আগে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে বলে জানি না। ধূর্জটি পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু প্রায় পিতৃস্নেহে কাগজটিকে লালন করে চলেছেন তিনি।

কলকাতায় বসে ভালোপাহাড়ের সঙ্গে প্রতি ঘণ্টায় যোগাযোগ রেখে চলেন। ভালোপাহাড় যেন কমলের মতো ওঁরও ফুসফুস। পরে আর একজনের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর জেনেছিলাম শুধু কমল এবং ধূর্জটি নয়, আরও অনেকেই আছে ভালোপাহাড়ের পাশে। যেমন উত্তরপাড়ার শঙ্করবাবু।

‘প্রকৃতি ভালোপাহাড়’-এর পাতা উল্টাতে গিয়ে সোজা হয়ে বসলাম। কমলের লেখা রয়েছে। লেখাটার নাম ‘জাংগল বয় রামু’। চোখ আটকে গেল লাইনগুলোয়, ‘এবার বনে বনে ফলগুলো ফলতে থাকবে। শুরু হবে অভিযান। সারা রাত ধরে ফল বড় হবে। পাকবে। কেউ কাঁচায় খাদ্য। কেউ কাঁচা, পাকা দুবারেই খাদ্য। সারা রাত ফল প্রকৃতির নরম আঙুলের আসরে বড় হবে। যেভাবে শেয়াল মা ঠ্যাং ছড়িয়ে বাচ্চাদের দুধ দিচ্ছিল, একইভাবে প্রকৃতি দুহাত ছড়িয়ে শরীর রাখবে ফলে ফলে... একটা বিশাল শরীর। কত যে দুধের বাঁট। ফল বেড়ে যাচ্ছে।’

‘জয় বাবা বৃক্ষনাথ।’ কমলের ফোন এলো ক’দিন বাদে।

‘আসে! তুমি এখন কোথায়?’ চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। তারপর ঠিক হলো যাব। ও কোনো ভালোপাহাড়ে কীরকম ভালো আছে দেখতে যাব।

কিন্তু ইচ্ছেটা সাধু হলেও সময় বের করতে পারিনি পুজোর লেখার চাপে। যাব যাব করছি যখন তখন কমল এক সকালে ফোনে বলল, ‘আর কত পরীক্ষা নেবে? এখানকার মানুষ, বৃক্ষ, পাখিদের মন কেউ আসবে বলে না এলে বড় কষ্ট পায়।’

কীভাবে যাব? হাওড়া থেকে টাটানগরের আগের স্টেশন গালুডিতে নামলে কুড়ি কিলোমিটার পথ, পাহাড় ডিঙ্গোতে হবে। বন্ধু মুকুন্দদাস খোঁজ নিয়ে জানাল ভোরের স্টিল এক্সপ্রেস সেখানে থামে। অত ভোরে যাবেন সমরেশ? তার চেয়ে ওইদিন সকাল সাড়ে ৮টায় লালমাটি এক্সপ্রেস ধরা যাক। ঘাটশিলায় থামবে। দূরত্ব বেড়ে তিরিশ কিলোমিটার হবে। তিন নম্বর সদস্য সন্দীপ ব্যানার্জি মানবেন্দ্র মুখার্জির ছাত্র ছিলেন, এখনো গলায় গান আছে, বললেন, ‘ধীরে সুস্থে যাওয়াই ভালো।’

কিন্তু শুভানুধ্যায়ীরা সতর্ক করলেন, ‘তুমি কি পাগল? ওই ঝাড়খণ্ড পুরুলিয়ার বেল্টে মাওবাদীরা থিকথিক করছে। বান্দোয়ানের নাম শোনোনি? একটা পেনসিল কাটা ছুরি দেখিয়েই তোমাকে কিডন্যাপ করে ২০ লাখ টাকা চাইতে পারে। ওখানে কেউ যায়?’

উপদেশের চাপে পড়ে বাধ্য হলাম কমলকে ফোন করতে। সে হো হো হাসি হাসল, বলল, ‘এসেই দ্যাখো।’

ঘাটশিলায় নেমেছিলাম পৌনে ১২টায়। স্টেশনের বাইরে এসে জিনস আর গেঞ্জি পরা একটা স্মার্ট প্রৌঢ়ের চেহারা খুঁজলাম। কমল তো এখন আমারই মতোন। কিন্তু ওর জামশেদপুরের চেহারা বৃদ্ধ হতে পারে না। একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। গাড়ির গায়ে লেখা ভালোপাহাড়। দরজা খুলে নেমে এলেন যিনি তাকে বৃদ্ধ না বলে উপায় নেই। গলা পর্যন্ত ধবধবে দাড়ি, পরনে খাটো পাঞ্জাবি আর ধুতি যার প্রান্ত ভাঁজ করে শরীরে জড়ানো। মাথায় কাঁচা পাকা চুল। সামনে এসে বললেন, ‘জয় বাবা বৃক্ষনাথ।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কমল।’

পরস্পরকে জড়িয়ে ধরা, বন্ধুদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার এই চেহারায় এমন পোশাক কেন?’

কমল বলল, ‘এতে আমি বেশ ভালো থাকি ভাই।’

কিছু কেনাকাটা করার পর আমরা রওনা হলাম। গাড়ির ড্রাইভার একটি তরুণ সাঁওতাল যুবক। সুঠাম। অনেকটা ‘মৃগয়া’ ছবির মিঠুন চক্রবর্তীর মতো।

বললাম, ‘ভাসা ভাসা শুনেছি, ভালোপাহাড়ের কথা বলো।’

কমল বলল, ‘এখান থেকে মাত্র তিরিশ কিলোমিটার দূরত্ব, কিন্তু রাস্তা এত খারাপ করে রেখেছে যে পৌঁছতে ঘণ্টাখানেক লাগবেই। একটু বাদেই জঙ্গল দেখতে পাবে। অনেকটা তোমার ডুয়ার্সের জঙ্গুলে পথ পেয়ে যাবে এখানে। তারপর ওই দূরের পাহাড়টা পেরিয়ে যেতে হবে আমাদের। দ্যাখো, তাকালেই বুকের ভিতর একটা স্বর্গ তৈরি হয়ে যায়।’

‘এখানে এলে কী করে?’

‘ইচ্ছে করে আসিনি। ইচ্ছে নিয়ে কোথাও গেলে ফিরে যাওয়া যায়। একটা জায়গা খুঁজছিলাম। নির্জনে ছোট্ট ডেরা বাঁধব বলে। এক বন্ধু আমায় দেখাল জমিটা। প্রায় কাঁকর বিছানো মাটি। জায়গাটা পুরুলিয়া। অনেক সময় টানা দু’বছর বৃষ্টি হয় না। তবে চারধারে পাহাড়ের মাঝখানে বলে চোখের আরাম হয়। দু’বিঘে জমি চেয়েছিলাম। বছর আঠারো আগের কথা। বন্ধুর চালে পড়ে জলের দামে অনেক অনেক বিঘে কিনে ফেললাম সঞ্চয় ভেঙে। তারপর কিনতে কিনতে এখন জমির পরিমাণ প্রায় দেড়শো বিঘে। একটু একটু করে গাছ লাগাতে লাগলাম। এক লাখ গাছ। সেই গাছেরা বড় হলো। পাতা ঝরাল। সেই পাতা পচে যে সার হলো তাতে ঘাস জন্মাল। ছায়া হলো তখন ফলমূলের গাছ। মাথা গোঁজার ছাদ। আমার আর টাকা কোথায়? সে সময় দেখলাম আশপাশের তা ধরো দশ-বারো মাইল দূরের গ্রামগুলোয় কী ভয়ঙ্কর অভাব। ওদের বাচ্চারা অক্ষর চেনে না। যুগ যুগ ধরে ওরা বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে আছে। সিদ্ধান্ত নিলাম ওদের জন্য স্কুল করব। হাত পাততে লাগলাম বন্ধুদের কাছে। দ্যাখো, হাত পরিষ্কার থাকলে কিছু না কিছু পাওয়া যায়। প্রথমে ভাঙাচোরা স্কুলবাড়ি হলো। টিসকোতে ভালো চাকরি করত বাঁকুড়ার ছেলে প্রদীপ, সব ছেড়ে চলে এলো মাস্টারি করতে। বিভিন্ন সংস্থার কাছে আবেদন করে বাচ্চাদের এখানে নিয়ে আসার জন্য বাস পেয়ে গেলাম। সকালে এই বাস চলে যায় সেই বহু দূরের গ্রামগুলোতে। বাচ্চাদের তুলে আনে। প্রদীপের সঙ্গে আরও কয়েকজন চলে এলেন ওদের পড়াতে। দুপুরে আমাদের সঙ্গে ডালভাত খায় বাচ্চাগুলো। তারপর বিকালের মুখে ওদের পৌঁছে দেওয়া হয় গ্রামগুলোতে। নার্সারি থেকে শুরু করেছিলাম যাদের নিয়ে তারা এখন ক্লাস এইটে পড়ে। এখন স্কুলপড়ুয়ার সংখ্যা ১৭০ জন। যারা একটু খাটে তাদের রেখে দিয়েছি আমাদের কাছে, যাতে আরও একটু নজর দিতে পারা যায়। গরু কিনেছি ওদের দুধ খাওয়াবো বলে। কিছুই করতে পারি না, কিন্তু যখন সবাই পাস করে উপরের ক্লাসে ওঠে তখন মনে হয় খুব তাড়াতাড়ি যেন না মরি।’

‘আর?’

‘আরও গাছ লাগিয়েছি। পুকুর কাটিয়েছি। কোনো সরকার এক পয়সাও সাহায্য দেয়নি। মানুষ দিয়েছে। এই যে গাছ, এদের আশ্রয়ে আছি আমরা। ফুল ফল পাতার কথা ছেড়ে দাও, গাছ না থাকলে পাখি থাকত না, ওষুধ তৈরি হতো না। আমার ঈশ্বর তাই বৃক্ষনাথ। ভালোপাহাড়ের মানুষ বলে জয় বৃক্ষনাথ।’ কমলের মুখে অদ্ভুত আলো।

বড় টিনের গেটের গায়ে ভালোপাহাড় লেখা। গাড়ির শব্দ পেয়ে ছুটে এলো কয়েকজন। গেট খুলতেই বিশাল বাগান আর কিছু ঘরবাড়ির সঙ্গে জয়তীকে আবিষ্কার করলাম। ভালো চাকরি ছেড়ে মা-কে নিয়ে এই বৃহৎ ব্যবস্থার হাল ধরে আছে মেয়েটি। মধ্য তিরিশের এই মেয়েটির মুখে হাসি সেঁটে আছে যেন। হাজার দশেক টাকার একটা রোজগার আছে ওর। তা থেকে আড়াই হাজার দেয় খাওয়া থাকার জন্য। আর পরিশ্রম করে ভোর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত। এই গাছগুলো, ওই বাচ্চারা যেন ওরই সন্তান। রান্না করে বসু নামের যে লোকটি, সে আছে ১২ বছর। এখানকার মাটিতে তার শেকড় বহু নিচে চলে গেছে। এরা ধান চাষ করছে। অবাক হয়ে দেখলাম উত্তর বাংলার কালা-নোনিয়া, রায়গঞ্জের তুলাই পাঁজি চাল এখানে জন্ম নিয়েছে এদের চেষ্টায়।

তিন রাত তিন দিন বুকভরে শুধু অক্সিজেন নিইনি, জীবনের কিছু সারল্যকে গোগ্রাসে গিলেছি। ঘুরে বেড়িয়েছি ভালোপাহাড়ের আকাশছোঁয়া গাছেদের গায়ে, পুকুরের শান্ত জলে রাজহাঁসের সাঁতারে দেখেছি ছবি আঁকা চলছে। বিকাল নামলেই শীতল বাতাস তৈরি করছে এক চমচমে জ্যোত্স্নার জন্য সমস্ত চরাচরকে। সকালে ক্ষিপ্ত হয়ে গেল কমল। যার দায়িত্বে ছিল গরুগুলো, সে গরহাজির হওয়ায় নোংরা মেখে মশার কামড় খাচ্ছিল তারা।  নিজের হাতে তাদের মুক্ত করে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল সে, ‘অবলা জীবগুলো কী কষ্ট পাচ্ছিল সমরেশ।’

আর আমি দেখছিলাম বহু বছর আগেরকার কমল কী করে বদলে গেল। কী নিষ্ঠায় সে প্রতিদিন পথের পাঁচালি, হাঁসুলিবাঁক লিখে চলেছে গাছগাছালি গরু-হাঁসদের ভালোবেসে। ১৭০টি বালক আর এই বিশাল প্রকৃতির সংসার চালাতে খরচ হয় প্রতি মাসে লাখ টাকার ওপর।  কমল বিশ্বাস করে যতদিন মানুষের মনে ভালোবাসা থাকবে, ততদিন সে হার মানতে পারে না।

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর