রবিবার, ২৫ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিদেশে কূটনীতিকদের কাণ্ডে দেশের সর্বনাশ

মোস্তফা কামাল

বিদেশে কূটনীতিকদের কাণ্ডে দেশের সর্বনাশ

সামান্য সময়ের ব্যবধানে নিউইয়র্কে বাংলাদেশের দু-দুজন কূটনীতিক গ্রেফতার, জামিনসহ পরবর্তী ঘটনাবলি দেশ ও সরকারের জন্য চরম অপমানের। একজন  বাংলাদেশের ডেপুটি কনসাল জেনারেল শাহেদুল ইসলাম। আরেকজন নিউইয়র্কেই জাতিসংঘে কর্মরত ইউএনডিপির কর্মকর্তা হামিদুর রশীদ।  দুজনকেই পাকড়াও করা হয় তাদের গৃহকর্মীর বেতন-সংক্রান্ত অভিযোগে। এ ধরনের গ্রেফতার দেশের জন্য সর্বনাশের। আর পররাষ্ট্র ক্যাডারের ইমেজে চপেটাঘাত। যদিও এ ধরনের অপমান বা আঘাত তারা সয়েই আসছেন। দেশ তো সইছেই। বিদেশে কর্মরত কূটনীতিকরা শুধু চাকরি করেন না। তারা সেখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধি। তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড ও আচরণ দেশের ভাবমূর্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

আত্মপক্ষ সমর্থনে কূটনীতিকরা বলেছেন, অভিযোগ ডাহা মিথ্যা। হতে পারে তাদের যুক্তি সঠিক। সংশ্লিষ্ট গৃহকর্মীরা আমেরিকাতে থেকে যাওয়ার মোহেই এমন অভিযোগ সাজিয়েছে। কিন্তু কূটনীতিকদের কি সতর্ক থাকা উচিত ছিল না? কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে বলছেন, মিশন কর্মকর্তাদের বিদেশে গৃহকর্মী রাখার বিধানটা তুলে দিতে। যুক্তি হিসেবে তারা বলতে চান, গৃহকর্মী নেওয়ার নামে আমেরিকায় আদম ব্যবসায় একটা কারসাজি রয়েছে। দূতাবাস ও কিছু পররাষ্ট্র কর্মকর্তার যোগসাজশেই চলে কাণ্ডকারখানাগুলো। যুক্তরাষ্ট্রে সচরাচর কেউ গৃহকর্মী রাখে না। ড্রাইভার রাখার বালাইও নেই বললেই চলে। আমেরিকানরা নিজের কাজ নিজে করেন। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যাওয়া ব্যক্তিরাও সেখানে চাকরি, পড়াশোনা, ব্যবসার পাশাপাশি হাটবাজার, লন্ড্রি, সব কাজই করেন। বাংলাদেশের কূটনীতিকরা গৃহকর্মী বলে যাদের নেন তাদের বেশির ভাগই আত্মীয়স্বজন। অথবা আদম। অনেক সময় মোটা টাকার বিনিময়ে গৃহকর্মী বলে নিয়ে যায়। পরে টাকা-পয়সার হিসাব বা অন্য কিছুতে গরমিল হলে কথিত গৃহকর্মীরা বেঁকে বসে। ১১৯শে ফোন করে গণ্ডগোল পাকিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির হয় মার্কিন পুলিশ। নিয়োগকর্তা বা মনিবকে তখন খেতে হয় আচ্ছা রকমের নাকানি-চুবানি। 

এ ছাড়া এ গৃহকর্মীরা সেখানে খুব ক্ষমতাধর। সেখানে রাজনীতি, আদম ব্যবসাসহ বহু সাইডওয়ার্ক তাদের। কূটনীতিক বা দূতাবাস কর্মকর্তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে এ চাকররা আমেরিকা বা অন্যান্য দেশে প্রচুর অর্থ সম্পত্তির মালিক হয়। পরিবারের অন্যদেরও সেসব দেশে সেটেলড করে। এসব যুক্তিতে কূটনীতিকদের বিদেশে গৃহকর্মী রাখার বিধান তুলে দেওয়ার কথা এসেছে। কিন্তু বিষয়টি এভাবে সরলিকরণের মতো নয়। সমস্যাটি গৃহকর্মী রাখা, না রাখার কারণে নয়। আরও কিছু বিষয় এখানে প্রাসঙ্গিক। গৃহকর্মী পাওয়া আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের একটি গ্লোবাল প্রিভিলেজ। সারা দুনিয়াতেই কূটনীতিকরা এ সুযোগটি পান। আমাদের দেশে কর্মরত বিদেশ কূটনীতিকরাও এ সুবিধা ভোগ করেন। সমস্যাটা হয় এ প্রিভিলেজের অসৎ ব্যবহারের কারণে। 

এর আগে ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে ঘটিয়ে এসেছেন গা শিউরে ওঠা যত কাণ্ডকীর্তি। নেপালে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পেয়েই তিনি শুরু করেন অপকর্ম। দায়িত্ব পালনের সময় নারী কেলেঙ্কারি, মোটরসাইকেলে ড্যান্স বারে বেসামাল যাতায়াত, নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলানো, নিজের গাড়িতে ভারতীয় পতাকা লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো, ভিসার জন্য ঘুষ, শিক্ষাবৃত্তি কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে নৈতিক স্খলনের যাবতীয় ক্রিয়াকর্মের আর কিছু বাকি রাখেননি। উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় আসা নেপালি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ঘুষ আদায়, ভারতীয় নারী কূটনীতিকের পেছনে লাগা, লং ড্রাইভে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া, তার বাসভবনে গিয়ে ওঠা, অভিনেত্রী মনীষা কৈরালার সঙ্গেও অসংযত আচরণ— এগুলো কি সুস্থ মানুষের কাজ? দূতাবাসের কর্মীদের জন্য বরাদ্দ করা ১০ হাজার ডলারের গাড়ি মাত্র তিন হাজার ডলারে বিক্রি করে দিতেও তার বুক কাঁপেনি।

তিনি একদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা শিক্ষক। আরেকদিকে বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মীয় সংগঠনের প্রসিদ্ধ নেতা। রুচিজ্ঞান, মানসিক মান, আত্মসম্মানবোধ কত তলানিতে নামতে পারে তা দেখিয়ে দিয়েছেন এ বুদ্ধিজীবী। নেপাল সরকার তার কায়কারবারে বিরক্তির কথা বাংলাদেশকে জানালেও বিহিত না করে ওভারলুক করা হয়েছে। সায়ও দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, নিম ভৌমিক বড় বিদ্বান। তিনি পূজা পরিষদ নেতা। বাঙালি ও বাংলাদেশের প্রতি বহু অবদান তার। তাই ওভারলুক করতে হবে। তাকে অসম্মান করা যাবে না কোনোভাবেই।

জাপানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এ কে এম মজিবুর রহমান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধেও উঠেছিল নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ। জাপানি মেয়ে কিয়োকো তাকাহাসির অভিযোগ ছিল রাষ্ট্রদূতের সোস্যাল সেক্রেটারি হিসেবে যোগদানের প্রথম দিনেই রাষ্ট্রদূত তার রুমে ডেকে নিয়ে জাপটে ধরে চুমু খান। তাকাহাসিকে তিনি বুঝিয়েছিলেন ঢাকায় এমনই হয়। এটা বাংলাদেশের সংস্কৃতি। তিনি তাকাহাসির সঙ্গে আরও কিছুর চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে রাষ্ট্রদূতের মতলব বুঝতে পেরে তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির প্রতিবাদ জানিয়ে পদত্যাগ করেন তাকাহাসি। নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছিল ইতালির বাণিজ্যিক শহর মিলানে নিযুক্ত বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল মো. তাওহীদুল ইসলামের বিরুদ্ধেও। তার বিরুদ্ধে মিশনেরই এক নারী সহকর্মী যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন।

বিভিন্ন সময় কূটনীতিকদের এ ধরনের কেলেঙ্কারির কিছু কিছু তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগেরই ফলাফল শূন্য। তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। কখনো তদন্ত প্রতিবেদন ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। কখনো তদন্তে অভিযুক্ত কূটনীতিকের অপকর্ম আড়াল করা হয়েছে। অপরাধকে ‘ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি’তে দেখার সুপারিশও করা হয়েছে। এতে তারা ধরেই নেন শেষতক কিচ্ছু হবে না। যা ইচ্ছা করা যাবে এমন একটা মনোবল ও নিশ্চয়তা নিয়েই তারা পোস্টিংয়ে যান দেশে দেশে। এরপর আর কাউকে কেয়ার করতে হয় না। অনুমতি বা মন্ত্রণালয়কে না জানিয়েই হঠাৎ হঠাৎ ভাবসাবে দেশ সফর করে ফিরে যেতেও কাউকে কিছু বলতে হয় না।  

কূটনীতিক বা মিশন কর্তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের তালিকা বেশ দীর্ঘ। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়ার তালিকা নেহায়েতই ছোট। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে রয়েছেন রাষ্ট্রদূত মুজিবুর রহমান, আশরাফ উদ্দীন ও  মারুফ জামান। দুদকে মামলা হয়েছে রাষ্ট্রদূত সুপ্রদীপ চাকমা ও এ টি এম নাজিম উল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে। অর্থ আত্মসাতের দায়ে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ২১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এ টি এম নাজিম উল্লাহ চৌধুরীকে। কিন্তু তিনি চম্পট দিয়েছেন। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।

পররাষ্ট্র ক্যাডারে চাকরি গৌরবের। বিদেশে দূতাবাস বা মিশনে চাকরি পাওয়া আরও গৌরবের। মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভিতর লুকিয়ে রাখা পরম মমতায় লালিত স্বপ্ন এ ক্যাডারটি। তারা গড়ে ওঠেন ওভাবেই। কিন্তু বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাস বা মিশনে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগেরই এর ওজন বোঝার মুরোদ নেই। যেখানে তাদের মূল দায়িত্ব বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা, সেখানে তারা করেন একেবারে উল্টোটা। দলবাজি এবং সুযোগ পেয়ে ভোগ-উপভোগই তাদের কাছে মুখ্য। বিদেশে দূতাবাসে নিয়োগ মানেই এনজয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অঘটনগুলো ঘটে তাদের মাধ্যমেই। পেশাদার কূটনীতিকরাও যে তত পিছিয়ে থাকছেন তাও নয়। গৌরবের ক্যাডারটির গৌরব রক্ষার চেয়ে ভোগ-বিলাসের মোহ তাদের শুধু ভাবের দিকেই টানে। ভাবের সঙ্গে ভঙ্গিও। দেশের ঝড়-ঝঞ্ঝা, রোদ-বৃষ্টি, বন্যা-খরা কোনো কিছুর ছটাই তাদের পায় না। তারা গুরুত্বে অপরিসীম। লাইফ স্টাইলটাই অন্যরকমের। কিন্তু এ বিশালতার মাঝে মনমানসিকতায় তাদের কারও কারও সংকীর্ণতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে মাঝে-মধ্যেই। ছোটর চেয়েও ছোট ছোট কাজে তাদের সংশ্লিষ্টতা হতবাক করে দেয়। যার সরাসরি শিকার প্রবাসীরা। বেশির ভাগ মিশনের ওপরই প্রবাসীরা বিরক্ত। বহু অভিযোগ প্রবাসীদের। বেশির ভাগ মিশনে টাকা ছাড়া প্রবাসীদের কোনো কাজই করে দেওয়া হয় না। তারা বিদেশে বিপদে পড়লে মিশনগুলোকে পাশে পায় না। বরং এ সুযোগে বিপদের সঙ্গে কিছু বাড়তি আপদ যোগে প্রবাসীদের হয়রান করেন মিশন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। করেন উপরি কামাই।

দেশের প্রতিনিধিত্ব ছাড়াও আদব, কায়দা, বিনয়, শিষ্টাচার বিষয়ে তাদের দেওয়া হয় বিশেষ তালিম। আর বিদেশে পোস্টিংয়ের আগে দেওয়া হয় বিশেষেরও বিশেষ ওরিয়েন্টেশন।  এর উদ্দেশ্য তাদের হাঁটা-চলা, কথা-বার্তাসহ যাবতীয় আচরণে যেন বিদেশে ফুটে ওঠে বাংলাদেশের রূপ-সৌন্দর্য। কিন্তু আদতে কী করছেন তারা?

লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর