বৃহস্পতিবার, ২৯ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

আওয়ামী লীগ কি বেপথু হচ্ছে?

বিভুরঞ্জন সরকার

আওয়ামী লীগ কি বেপথু হচ্ছে?

গত ২৩ জুন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বয়স ৬৮ পূর্ণ হয়েছে। ৬৯ বছরে পা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এটা আওয়ামী লীগের বড় গৌরবের বিষয়। এ দলের চেয়ে সিনিয়র দল বাংলাদেশে থাকলেও সেগুলো এখন রাজনীতিতে সেভাবে প্রাসঙ্গিক নেই। সবচেয়ে পুরনো দল মুসলিম লীগ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এই দল নেতৃত্ব দিলেও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ভরাডুবির মধ্য দিয়ে দলটি পিছু হঠতে থাকে।  একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা নিয়ে মুসলিম  লীগ আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। এখন দলটি নামে আছে। কাজে নেই। দলটি প্রায় বিলুপ্ত।

বয়সে সিনিয়র আরেকটি দল কমিউনিস্ট পার্টি। সাধারণ মানুষের লড়াই-সংগ্রামে এই পার্টির বিরাট অবদান আছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৬২ সালে তত্কালীন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কমিউনিস্ট নেতা মনি সিংহ ও খোকা রায়ের বৈঠকের ফলে রাজনীতির মূলধারায় শামিল হয়েছিল এই দলটি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও সিপিবি গণতন্ত্র, মানবমুক্তি তথা প্রগতিশীল সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শরিক থেকে রাজনীতিতে দৃশ্যমান শক্তি হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সোভিয়েত ব্যবস্থা পতনের পর সিপিবিতেও ভাঙন দেখা দেয়। এখন সিপিবি রাজনীতির এক বিলীয়মান শক্তি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সিপিবির ঐতিহ্যগত মৈত্রীর সম্পর্ক এখন নেই। বাম বিকল্প প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে দলটি। বিএনপি ক্ষমতায় এলে খারাপ আর আওয়ামী লীগ থাকলে আরও বেশি খারাপ নাকি আওয়ামী লীগ থাকলে খারাপ আর বিএনপি এলে আরও বেশি খারাপ এ বিতর্কের ফয়সালা করতে পারছে না সিপিবি।

আরেকটি পুরনো দল শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি এখন আর নেই।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন জন্ম নেওয়া আওয়ামী লীগ সেদিক থেকে সৌভাগ্যবান। জন্মের পর থেকে অনেক উত্থান-পতন ভাঙাগড়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ এখনো দেশের অন্যতম বড় এবং জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। পরে তার হাত ধরেই এই দল বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির দিশারী হয়ে ওঠে। বিশেষ করে শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণা এবং সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর শুরু হয় দলের উত্থান পর্ব। আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম নিয়ে। পরে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। শুরু হয় অসাম্প্রদায়িক ধারায় আওয়ামী লীগের যাত্রা। তবে দলের ভিতর প্রগতিশীলতা ও রক্ষণশীলতার দ্বন্দ্ব আগাগোড়াই ছিল। মুজিব নেতৃত্ব গ্রহণের পর দলের রক্ষণশীল অংশ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণার আগে থেকেই পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী শেখ মুজিবকে বিপজ্জনক মনে করত। ছয় দফা দেওয়ার পর শাসকদের গায়ের জ্বালা আরও বেড়ে যায়। মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলানোর ব্যবস্থা করে উলটো ফাঁদে পড়ে পাকি শাসকরা। প্রবল আন্দোলন শেখ মুজিবকে কারামুক্ত করে। তিনি হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। তারপরের ইতিহাস কেবলই মুজিবময়। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়। ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা। বাঙালি জাতির ওপর রাতের অন্ধকারে হামলা। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ। বিজয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার সংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দেশি-বিদেশিদের ষড়যন্ত্র। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা। আওয়ামী লীগের নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম শুরু। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখার ষড়যন্ত্র। দলের ঐক্য রক্ষার জন্য বিদেশে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে ১৯৮১ সালে দলের কাউন্সিলে সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়।

শেখ হাসিনা দায়িত্ব নিয়ে নানা বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে দীর্ঘদিন পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে জিতিয়ে ক্ষমতায় নেন। আওয়ামী লীগ এখনো শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই চলছে। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন ৯ বছর। আর শেখ হাসিনা ওই পদে আছেন তিন যুগ ধরে।

কারও কারও মতে, আওয়ামী লীগের জন্য শেখ হাসিনা এক জাদুকরী শক্তি। তিনি দুঃসাধ্য সাধন করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, জেলখানার ভিতর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে হত্যার পর এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে এই দল আবার দেশ শাসনের সুযোগ পাবে সেটা ছিল অনেকেরই ভাবনার বাইরে। কিন্তু শেখ হাসিনা দলের কাণ্ডারি হয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করলেন। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখার জন্য নানামুখী উদ্যোগ ছিল। ভিতরে বাইরে ষড়যন্ত্র ছিল।

বিশ্বাসঘাতক ও ষড়যন্ত্রকারীদের অবস্থান ভিতরে ছিল বলেই বাইরের ষড়যন্ত্রকারীরা সুযোগ পেয়েছিল। খন্দকার মোশতাকরা বহিরাগত বা অনুপ্রবেশকারী ছিলেন না। আওয়ামী লীগেই তাদের জন্ম অথবা বেড়ে ওঠা। তবে আওয়ামী লীগে ‘অনুপ্রবেশকারী’ সমস্যা আগেও ছিল এখনো আছে। কমিউনিস্ট পার্টি বা জামায়াতে ইসলামীর মতো একশিলা বা ক্যাডারভিত্তিক দল না হওয়ায় আওয়ামী লীগে এই সমস্যা থাকা স্বাভাবিক। এসব সমস্যা অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মোকাবিলা করে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন। এটা তার সাফল্য, কৃতিত্ব। সময় লেগেছে কিন্তু তিনি পেরেছেন। ফলে তার ওপর দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের আস্থা ও ভরসা অনেক বেড়েছে। বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা যেমন প্রশ্নাতীত ছিল, শেখ হাসিনাও নিজের নিষ্ঠা ও দৃঢ়তা দিয়ে নিজেকে সেই জায়গায় নিতে পেরেছেন। সব সময় তিনি কঠিন পথে হাঁটছেন। কখনো কখনো বিপরীত স্রোতের মধ্যে দাঁড় টেনেও নৌকাকে ঠিকই ঘাটে বাঁধতে পারছেন।

কারও কারও অভিযোগ, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ আর শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এক নেই। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকার জন্য নীতি ও আদর্শের সঙ্গে আপস করেননি। শেখ হাসিনা সেটা করছেন। সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ শক্তির সঙ্গে এখন আওয়ামী লীগ সমঝোতা করে চলছে। ভোটের রাজনীতিকে মাথায় রেখে শেখ হাসিনা হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতার পথে হাঁটছেন। এ নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, কৌশলগত অবস্থান। প্রশ্ন হচ্ছে, ভবি কি ভুলবে? হেফাজত কি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতি নমনীয় থাকবে? বিষয়টি এখনই স্পষ্ট নয়। হেফাজতকে কিছু ছাড় আওয়ামী লীগ দিয়েছে। হেফাজত কি তাতেই সন্তুষ্ট? নাকি তারা আওয়ামী লীগকে পর্যবেক্ষণে রাখবে, যেমন আওয়ামী লীগও রাখবে তাদের? তাই শেখ হাসিনা ঠিক পথে হাঁটছেন নাকি বেপথু হয়েছেন সে বিষয়ে চূড়ান্ত রায় দেওয়ার এখনই সময় নয়। বঙ্গবন্ধুর সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতি এক নয়। বিশ্বব্যাপী দক্ষিণপন্থার জয়জয়কার দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ভূমণ্ডলের বাইরে নয়। ক্ষমতার রাজনীতির জটিল হিসাব-নিকাশ শেষতক আওয়ামী লীগকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায় সেটাই এখন দেখার ব্যাপার। পরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি পুনরায় জিততে পারে তাহলে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশলকে ভুল বলে ফতোয়া দেওয়া যাবে কি?

রাজনৈতিক কৌশলে নমনীয়তা দেখানো রাজনীতিবিদ্যারই একটি স্বীকৃত পন্থা। কিন্তু নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে দৃঢ়তা না থাকাকে রাজনীতিবিদ্যা সমর্থন করে না। তবে এটাও ঠিক আমাদের দেশে ক্ষমতায় থাকা না থাকা একটি বড় ফ্যাক্টর। ক্ষমতায় যেতে পারলে যে কৌশল প্রশংসিত হয়, যেতে না পারলে তা নিয়েই সমালোচনার ঢেউ বয়ে যায়। শেখ হাসিনা যদি দলকে আরেক দফা ক্ষমতায় নিয়ে জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদের উত্থানের বিপদ মোকাবিলা করতে পারেন তাহলে এখন যারা সমালোচনা করছেন তারাই হয়তো ভিন্ন কথা বলবেন।  তবে এটা ঠিক যে দেশের রাজনীতি এখন এক জটিল হিসাব-নিকাশের মুখে পড়েছে।  উন্নত সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়ে তোলার সক্ষমতা শেখ হাসিনার আছে, তার ওপর এ আস্থা ও বিশ্বাস এখনো অনেকেরই অটুট রয়েছে।

 

লেখক : কলামিস্ট সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর