বৃহস্পতিবার, ২৯ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

রমজান এসেছিল শিক্ষক হয়ে

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

রমজান এসেছিল শিক্ষক হয়ে

মাহে রমজান আমাদের থেকে বিদায় নিয়েছে ঠিক, কিন্তু রমজানের সুর এখনো আমাদের হৃদয়ে বেজে চলেছে। দিন যত গড়াবে এ সুর ক্রমেই ক্ষীণ থেকে আরও ক্ষীণ হবে।  রমজানের নুর আমাদের দেশ ও সমাজ থেকে হারিয়ে যাবে। লীন হবে নিজের আত্মা থেকেও। কিন্তু কেন? এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না? সাহাবি-তাবেয়ীদের জীবনে তো এমনটি হয়নি। কোরআনও এমন সিয়ামের কথা বলেনি। কোরআন বলেছে— সিয়াম আসে তোমাকে তাকওয়ার প্রশিক্ষণ দিয়ে চির-মোত্তাকি বানাতে। যার সম্পর্ক কোনো দিন-মাস-বছরের সঙ্গে নয়। তুমি যত দিন বেঁচে থাকবে ততদিন তোমাকে এ সিয়ামের প্রশিক্ষণ অনুযায়ী-ই জীবন পরিচালনা করতে হবে। তবেই তুমি মোত্তাকি বান্দা হিসেবে আল্লাহর কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে পারবে।

মাহে রমজান। একটি মাস আমাদের জীবনচিত্র ও আমলে যে পরিবর্তন এনে দিয়েছে তা কিন্তু বাস্তব অর্থে পরিবর্তন নয়। আসলে আমাদের জীবন এভাবেই পরিচালনা করতে বলেছেন আল্লাহতায়ালা। কিন্তু আমরা শয়তানের ধোঁকায় পড়ে আল্লাহর নির্দেশ থেকে দূরে সরে থাকি। তখন আমাদের জীবনঘরে রমজান আসে শিক্ষক হয়ে। রোজা বলে দেয়— সাবধান! আল্লাহ দেখছেন। তুমি এখন খেতে পারবে না। তোমার চোখ এবং মন হেফাজত কর। তুমি এখন রোজাদার। হে মমিন! ওঠো! সাহরির আগে আল্লাহর দুয়ারে দুই হাত তোল। নিজের সব প্রয়োজন প্রভুকে বল। তিনিই তোমার মুক্তিদাতা, কল্যাণদাতা। এমনিভাবে রোজা আমাদের শিখিয়েছে অন্য ভাইয়ের প্রতি সহযোগিতা ও সমব্যথী বা সহমর্মিতার চর্চা করতে। অভুক্ত মানুষের দুঃখ বুঝে তার মুখে খাবার তুলে দিতে। এমন হাজারো শিক্ষা দিয়ে গেল রোজা।

এ যে জীবনযাত্রায় এক আমলি পরিবেশ সৃষ্টি করে গেছে— এর সমন্বিত রূপকেই কোরআনের ভাষায় তাকওয়া বলা হয়েছে। তো আপনি যদি রোজার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে জীবনে ধারণ করে রাখতে পারেন, তবে আল্লাহর বাণী ‘লাআল্লাকুম তাত্ত্বাকুন-আশা করা যায় তোমরা মোত্তাকি হবে’ এ আয়াতের আলোকে সফল সিয়াম সাধক হতে পারবেন। সফল সিয়াম সাধক হতে হলে রোজার শিক্ষাগুলো বছরব্যাপী চর্চা করতে হবে। রোজার সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো— মানুষের নফস তথা প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে রুহকে শক্তিশালী করা। মানুষের যখন প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণে আসে তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই রুহ শক্তিশালী হয়। আর রুহ যখন শক্তিশালী হয়, তখন সে আল্লাহর আদেশ মতো জীবন পরিচালনা করতে কোনো কষ্ট বা বাধা অনুভব করে না। মনে করে দেখুন তো, রোজার এক মাস নামাজ-রোজা, দান-সদকা এবং পাপ থেকে বিরত থাকতে আপনার তেমন কষ্ট হয়েছে কিনা? যদি তখন কষ্ট না হয় তাহলে এখন অর্থাৎ বাকি ১১টি মাস কেন আল্লাহর হুকুম পালনে আমাদের কষ্ট হবে? এর কারণ হলো রোজার শিক্ষা ও আমল আমরা রোজা গেলেই ভুলে যাই। আমরা ভাবি শুধু রমজান মাসেই পবিত্রতা রক্ষা করে চলতে হয়। আর অন্যসব মাসে আমাদের মনমতো চললেই হলো। আমি তো আরেকটু বাড়িয়েই বলি। মুসলমানদের আচরণ দেখলে মনে হয়, রমজান মাসে আল্লাহতায়ালা যত তৎপর থাকেন, অন্য মাসে আল্লাহ চোখ বুঝে থাকেন। নাউজুবিল্লাহ। যদি মুসলমান এমনটি নাই ভাবত তাহলে- যে মানুষটি রমজানে আল্লাহ দেখছেন মনে করে হালাল খাবার থেকেও বেঁচে থাকে, সে মানুষটিই রমজানের পরে কীভাবে সুদ-ঘুষের মতো হারামের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন? তাহলে কি রমজানে তার যে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তা কেন রমজানের পরে ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে? তার ইমান কি ক্রমেই কুফরের খাদে পড়ে যাচ্ছে?

আমি বলতে চাচ্ছি, রোজার এক মাস আমরা মোত্তাকি হওয়ার প্রশিক্ষণ নিয়েছি মাত্র। আমরা কে কতটুকু মোত্তাকি হতে পেরেছি তার প্রমাণ দিতে হবে এ ১১ মাসে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, সেনাবাহিনী যেমন যুদ্ধের কলাকৌশল শেখার জন্য ট্রেনিং নেয়, আমরাও শয়তানের বিরুদ্ধে নিজেদের বাঁচানোর ট্রেনিং নিয়েছি মাত্র। যুদ্ধের ময়দানে কোনো সৈনিক যদি বলে— আরে আমি তো খুব ভালো ট্রেনিং নিয়ে সেরা পুরস্কার পেয়েছি। এখন আর আমাকে যুদ্ধ করতে হবে না। আর এ ফাঁকে শত্রু এসে দেশ ধ্বংস করে ফেলল। আচ্ছা! আপনারাই বলুন, এ সৈনিক কি প্রকৃত অর্থেই সৈনিকের দায়িত্ব পালন করেছে? না, করেনি। সে ভালো ট্রেনিং নিয়েছে ঠিক, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে ওই ট্রেনিং মতো লড়াই না করার কারণে সে সৈনিক হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতাও হারিয়ে ফেলেছে।

হে আমার মুসলমান ভাই! আমাদের অবস্থা যেন ওই সৈনিকের মতো না হয়। ভালো ট্রেনিং নেওয়ার পর জীবনযুদ্ধে আমাদের চিরশত্রু শয়তানের বিরুদ্ধে নীরব যেন না থাকি। তাহলে আমাদের যত অর্জন তা তো নষ্ট হবেই, সঙ্গে আমাদের মুসলমানিত্ব নিয়েও প্রশ্ন দেখা দেবে। শেষ করছি পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত শুনিয়ে। ‘আমার আদরের বান্দারা শোন! তোমাদের অবস্থা যেন ওই মহিলার মতো না হয়ে যায়, যে নিজ পরিশ্রমে সুতা কাটে এবং তারপর নিজেই তা ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলে।’  (সূরা নাহল : ৯২)। মহান আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন। আবার রমজান আসা পর্যন্ত মোত্তাকি হিসেবে আমাদের জীবন পরিচালনার তাওফিক দান করুন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব

www.selimazadi.com

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর