শুক্রবার, ৩০ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

শান্তি অশান্তির মুখ ও মুখোশ

হানিফ সংকেত

শান্তি অশান্তির মুখ ও মুখোশ

শান্তি মানে প্রশান্তি, উৎকণ্ঠাশূন্যতা, আবার কারও কাছে শান্তির অর্থ বিঘ্নরহিত উদ্বেগশূন্য আনন্দময় জীবন। আর এই শান্তির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে আলফ্রেড নোবেলের নামানুসারে নোবেল শান্তি পুরস্কারের প্রবর্তনও করা হয়েছে। আসল কথা, সবাই শান্তি চায়। ইদানীং অনেককেই বলতে শোনা যায়, দেশটা বেশ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে ‘ঠাণ্ডা’ শব্দটির অন্য অর্থ শান্তি। অর্থাৎ দেশে এখন শান্তিময় পরিবেশ বিরাজ করছে।  আর এক পক্ষ বলে, কি যে অশান্তিতে আছি বলে বোঝানো যাবে না। চারদিকে চরম অশান্তি। আঞ্চলিক ভাষায় আবার কেউ কেউ বলেন, ‘শান্তির বাপ মইরা গ্যাছে’। এসব শুনলে বোঝা যায় দেশে এখন ‘শান্তি’ এবং ‘অশান্তি’র পক্ষে দুটি দল রয়েছে। অর্থাৎ শান্তির পক্ষে এবং বিপক্ষে। তবে এই দুই দলই খুব একটা সরব নয়। কেউ আবার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় নীরব। প্রথমেই শান্তির পক্ষের যুক্তিতে আসি। তাদের শান্তি হচ্ছে রাজনীতিনির্ভর। অর্থাৎ দেশ এখন শান্ত। কোথাও কোনো গণ্ডগোল নেই। রাজনৈতিক উত্তাপ নেই। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া নেই, অগ্নিসংযোগ নেই। নেই কোনো হরতাল, অবরোধ, ভাঙচুর, লাঠিচার্জ। সুতরাং এই শান্তি দৃশ্যমান। কারণ এখন রাজনৈতিক কারণে কোনো লাগাতার কর্মসূচি দেখা যায় না। যেটুকু হয় তাও মানববন্ধন পর্যন্ত সীমিত। তাই রাজনৈতিক উত্তাপ না থাকায় কারও কারও মুখে ‘বেশ শান্তিতে আছি’ কথাটি শোনা যায়। তবে রাজনৈতিক কারণে শান্তি-অশান্তির সঠিক বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারবেন রাজনীতিবিদরা। আমার এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা এবং উৎসাহ দুটিই কম। তবে রাজনীতির বাইরেও যারা অশান্তির কথা বলেন, তাদেরও রয়েছে অকাট্য যুক্তি। তাদের এই অশান্তির কারণ নানাবিধ আতঙ্ক। কিন্তু তা বোমাতঙ্ক নয়—খাদ্যাতঙ্ক, নতুন নতুন রোগাতঙ্ক, ভেজালাতঙ্ক, নকলাতঙ্ক—আতঙ্কের শেষ নেই। আসল-নকলের ধকল, জাল-ভেজালের জঞ্জাল নিয়ে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের নাভিশ্বাসে কেউ কাউকে আশ্বাসবাণী শোনাতে পারছে না। কারণ কথায় আছে, ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর’। ভেজালের কারণে হারানো বিশ্বাস ফেরানো কঠিন। নির্ভেজাল খাওয়া, নির্ভেজাল পাওয়া, নির্ভেজাল রাখা, নির্ভেজাল থাকা এখন দুরূহ।

ভেজাল নিয়ে অনেক লেখালেখি, অনেক টকশো, অনেক ধরপাকড় এবং অনেক ভেজাল পণ্য ডোবানো হয়েছে বুড়িগঙ্গায়। তারপরও কি ভেজাল কমেছে? কমেনি। কারণ ভেজালকারী অসত্জনেরা দমেনি। কোথায় ভেজাল নেই—জমিতে বীজ বপন থেকে শুরু করে ফসল তোলা, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিক্রি প্রতিটি স্তরে মেশানো হচ্ছে নানান ভেজালসামগ্রী। মাছে-ভাতে বাঙালি। মাছ হচ্ছে আমাদের পুষ্টি ও প্রোটিনের প্রধান উপকরণ, কিন্তু এই মাছ নিয়েও ইদানীং অনেকে চিন্তিত, শঙ্কিত, আতঙ্কিত। কারণ মাছেও দেওয়া হচ্ছে ফরমালিন। সবজিতে কীটনাশক, ফলে কার্বাইড, জিলাপি-চানাচুরে মবিল, বেকারি পণ্যে রাসায়নিক প্রয়োগ, হলুদ-মরিচে ইটের গুঁড়া, চালে ভেজাল-ডালে ভেজাল, দুধে পানি। তারপরও নিরুপায় হয়ে অশান্তচিত্তে আমরা এসব কিনে আনি। যা খেয়ে ঘটছে আমাদের স্বাস্থ্যহানি। শুধু আমরাই নয়, ভেজাল খাইয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি। এরপর আছে হোটেল-রেস্তোরাঁ ও হাসপাতালের নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, মেয়াদোত্তীর্ণ বিভিন্ন পণ্য, দূষিত পানির আইসক্রিম, বিয়ে বাড়ির বোরহানি। খাদ্যের এই ভেজাল তালিকা অনেক দীর্ঘ।

ইদানীং ভেজালেও ভেজাল ঢুকেছে। আসল রাসায়নিক দ্রব্য পাওয়া যাচ্ছে না। ফরমালিনেও ভেজাল। কারণ ফরমালিন অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা। সুতরাং এখানে ভেজাল দিলে লাভ বেশি। ভেজাল ঢুকেছে ঘুষেও। ঘুষ নিয়েও এখন অনেকে প্রতিশ্রুত কাজ করছে না। প্যাথলজির রিপোর্টে ভেজাল। এক এক জায়গায় এক এক ফল। বিভ্রান্ত রোগী। নীতিতে ভেজাল-বিধিতে ভেজাল। সরকারি অফিসের গত্বাঁধা লেখা, ‘বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিন’। এই বিধিও এখন মানা হয় না। এক একজনের ক্ষেত্রে বিধি এক এক রকম। আবার লাইন থাকলে বিধিবহির্ভূত কাজও হয়।

ভেজাল মূল্যহ্রাসেও। ৫০০ টাকার জিনিস ১০০০ টাকা লিখে পাশে লিখে রাখে মূল্যহ্রাস। ৫০% সেল। বিভ্রান্ত ক্রেতাও। ভেজাল গেট ওয়ান বাই ওয়ানেও। বাই ওয়ানের মধ্যেই ওই গেট ওয়ানের মূল্য থাকে। শিক্ষায় ভেজাল। অনেকগুলো ইউনিভার্সিটি বন্ধ হয়ে গেছে। প্রশ্নপত্রে ভেজাল। ক্ষণে ক্ষণে ফাঁস হচ্ছে প্রশ্নপত্র। ওষুধে ভেজাল। এই কারণে অনেকগুলো ওষুধ কোম্পানি এবং ওষুধ বাতিল হয়ে গেছে। বলাবাহুল্য কর্তৃপক্ষের টনক নড়ার আগ পর্যন্ত আমরা ওই বাতিল ওষুধই খেয়েছি। কোনো পুণ্যের কারণে হয়তো বেঁচে আছি। আজকাল পুরস্কারেও ভেজাল, সম্মাননায় ভেজাল। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রতিভাবান মানুষ এসব পুরস্কার পায় না। কারণ তারা ‘লাইন’টা জানে না। তাদের খোঁজও কেউ পায় না। এখানে তেলে মাথায় তেল দেওয়া হয়। চিহ্নিত মুখ, চিহ্নিত ব্যক্তি লাইনবাজরা হাতিয়ে নিচ্ছে এসব পুরস্কার। তাই ক্ষেত্রবিশেষে পুরস্কার এখন তিরস্কারে পরিণত হয়েছে।

সিসিইউতে ভেজাল, আইসিইউতেও ভেজাল। একবার সিসিইউতে ঢোকাতে পারলে সহজে মুক্তি মেলে না। যত দিন রাখা যায় ততই লাভ। লাইফসাপোর্টেও ভেজাল। লাইফের যখন সাপোর্ট দরকার নেই তখনো কিছু কিছু জায়গায় সাপোর্ট দিয়ে রাখে। লাইফহীন শরীরে সাপোর্ট। অনেকেই তা বুঝতে পারেন না। যত সাপোর্ট তত পয়সা। পৈশাচিক অর্থ কাঙাল। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে।

এখন ভেজাল শুধু খাদ্যে বা ওষুধপথ্যেই নয়—তথ্যে ভেজাল, সত্যে ভেজাল এবং কথ্যেও ভেজাল। অনেক ক্ষেত্রে টকশোর যুক্তি এখন সুবিধানির্ভর। অর্থাৎ এখানেও ভেজাল। সুতরাং ‘অশান্তি’ দলের অশান্তির একটি অন্যতম কারণ এই ভেজালাতঙ্ক। ফরমালিনমুক্ত, কার্বাইডমুক্ত, বিষমুক্ত, ভেজালমুক্ত, অনিয়ম-অসঙ্গতিমুক্তসহ অনেক সমস্যা থেকেই মুক্ত হতে চাই আমরা। তাই আমাদের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে ভেজাল ও বিষাক্ত খাবার থেকে রক্ষা করতে ভেজালবিরোধী আইনের কঠোর প্রয়োগ যেমন জরুরি, তেমনি যারা জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে তাদেরও আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন।

ইদানীং সাধারণ মানুষের অশান্তির আর একটি প্রধান কারণ হচ্ছে নানাবিধ নতুন নতুন রোগের উৎপাত। অদ্ভুত অদ্ভুত নামের অদ্ভুত সব রোগ। যা এর আগে কখনো দেখা যায়নি। হঠাৎ করেই এসব নতুন রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা মানুষকে আতঙ্কিত এবং অশান্ত করে তুলছে। এর মধ্যে অন্যতম ডেঙ্গু রোগ। অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক একটি রোগ। লক্ষণ-জ্বর, মাথাব্যথা, শরীরের বিভিন্ন সংযোগস্থলে ব্যথা, র‌্যাশ বা ফুসকুড়ি ওঠা। শুরুর দিকে এই রোগে কিছু প্রাণহানিও ঘটেছে। মারাত্মক এই রোগ শিশুদের অত্যন্ত কাবু করে ফেলে। এটি একটি মশাবাহিত রোগ। মশার নাম এডিস। এই রোগের উৎপত্তি হচ্ছে এই মশার কামড়ে। সুতরাং এই মশাকে নিধন করা অপরিহার্য।

আর এক নতুন রোগের নাম জিকা। সবার জন্য আতঙ্কের না হলেও এই রোগটি গর্ভবতী মা ও শিশুর ক্ষতিসাধন করতে পারে। এই রোগটিও এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়, তাই এ নিয়েও রয়েছে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক। তবে আতঙ্ক ছড়ালেও জানা গেছে আমাদের দেশে জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো রোগী পাওয়া যায়নি। মশাবাহিত আর একটি রোগের নাম ইয়োলো ফিভার। এই রোগটির লক্ষণ নাকি জন্ডিসের মতো। এই রোগ হলে সারা শরীর হলুদ হয়ে যায়। অতি সম্প্রতি আমাদের দেশে আর একটি ভয়ঙ্কর এবং যন্ত্রণাদায়ক রোগের আবির্ভাব ঘটেছে যার নাম চিকুনগুনিয়া। এটিও একটি ভাইরাসজনিত রোগ। ডেঙ্গুর সঙ্গে এই রোগের চরিত্রগত কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। ডেঙ্গুতে হাড়ে ব্যথা হলেও চিকুনগুনিয়ায় ব্যথার মাত্রা থাকে বেশি। যার এই রোগ হয়, তাকে অত্যন্ত দুর্বল করে ফেলে। বিছানা থেকে উঠে বসার শক্তিও লোপ পেয়ে যায়। জ্বর ১০৫ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায়।

খাওয়ায় অরুচি, শরীরে ব্যথা, চুলকানি, র‌্যাশ বা ফুসকুড়ি ওঠা ইত্যাদি নানান উপসর্গ দেখা দেয়। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে এই রোগের কোনো অ্যান্টিবায়োটিক নেই। অ্যান্টিবায়োটিক দিলে নাকি হিতে বিপরীত হতে পারে। আমার মেয়েটিও এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। ফলে ওই কদিন আমিও অশান্তির দলে ছিলাম। ওই কটা দিন আমার যে কি অশান্তিতে কেটেছে সেটা আমি জানি। একদিকে ঈদের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি, শুটিং, মহড়া। অন্যদিকে সন্তানের চিকুনগুনিয়া। সেলাইন ছাড়া কিছু খেতে পারছে না। তাও অরুচি। বিছানা থেকে উঠে বসার শক্তিটুকুও নেই। ব্যথার কারণে হাঁটতে পারে না বলে কেউ কেউ এটাকে ‘ল্যাংড়া জ্বর’ও বলে। ওকে রেখে কোথাও যেতেও পারছি না। সুতরাং চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর বাড়িতে কী অবস্থা হতে পারে তা আমি বুঝতে পেরেছি। হাসপাতালে গেলে আর এক রোগীর অভিভাবক আমাকে দেখে বললেন, ‘ভাই ভাগ্য ভালো রোগটার নাম চিকুনগুনিয়া, এইটা যদি মোটাগুনিয়া হইত তাইলে যে কি হইত কে জানে’? এই রোগের কারণও সেই মশা। অশান্তি যে কোন মাত্রায় যেতে পারে তার প্রমাণ এসব অদ্ভুত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ও তার পরিবার। এখন মনে হচ্ছে মশার বিরুদ্ধেই আমাদের আন্দোলন করতে হবে। কারণ রাজপথের আন্দোলনের জন্য রাস্তায় নামতে হয়, তখন টিয়ার গ্যাস, জলকামান, রাবার বুলেট বা আসল গুলিতে মৃত্যু হতে পারে, কিন্তু এই মশা তো আমাদের ঘরে এসে আক্রমণ করছে। নীরব ঘাতক। তার মানে মশার কারণে আমরা ঘরেও নিরাপদ নয়। গৃহ শান্তি আসবে কোত্থেকে? নগরপিতারা আসছেন-যাচ্ছেন কিন্তু মশা বাবাজি বহাল তবিয়তে আমাদের নিত্যনতুন রোগের জীবাণু ছড়াচ্ছে। নতুন নতুন রোগের জন্ম দিচ্ছে। ভোগান্তি বাড়ছে, আমরা ভুগছি। যা চিকিৎসকদেরও চিন্তায় ফেলছে। রোগের চরিত্র বুঝতেও কিছুটা সময় লাগছে। এর মধ্যে অজানা আতঙ্কে আক্রান্ত রোগী ও তার পরিবার চরম উদ্বেগ-অশান্তিতে ভুগছে। কারণ ঢাকা শহরে যে হারে চিকুনগুনিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে তাতে এই মশার সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়েও সবাই আতঙ্কিত। ঢাকা শহরকে সবুজ এবং দৃষ্টিনন্দন করতে যেভাবে ওভারব্রিজ এবং বিভিন্ন জায়গায় ফুলের টব ও ফুলের চারা বিতরণ করা হচ্ছে—সেটা প্রশংসনীয়, তবে পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের মশা নিধন প্রকল্পও যেন আরও জোরালোভাবে মশা নিধনে এগিয়ে আসে সে দাবিও অনেকের। ফুলের টবগুলো যেন মশা প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে না ওঠে। তাই প্রয়োজনে মশা মারতে কামান দাগুন। টবের ফুলের সুবাস যেন সবার আতঙ্কে পরিণত না হয়। তাহলে অশান্তি আরও বাড়বে।

এরপর আছে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তড়িৎ দূষণ। মোবাইলের ব্যাপক প্রসার এবং এর মাত্রাতিরিক্ত অনিয়মতান্ত্রিক ব্যবহার আমাদের উপহার দিচ্ছে ক্ষতিকর তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণ। স্কুল-কলেজ, হাসপাতালের ছাদে স্থাপিত বেইজ টাওয়ার ক্ষতি করছে শিশুদের, ক্ষতি করছে রোগীর। বিশেষজ্ঞদের মতে, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণের চেয়েও ক্ষতিকর হলো তড়িৎ দূষণ বা ইলেকট্রো পলিউশন। উন্নত দেশে এসব বেইজ টাওয়ার থাকে লোকালয় থেকে দূরে। এ ব্যাপারে আমরা ২০১২ সালের জুন মাসে প্রচারিত ইত্যাদিতে একটি প্রতিবেদন প্রচার করেছিলাম। এরপর এ নিয়ে অনেক লেখালেখি ও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তারপরও দু-একটি ছাড়া ওই বেইজ টাওয়ারের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি।

আরও আছে বর্ষায় বজ্রপাতজনিত তড়িৎ ঝুঁকি। ইদানীং দেশে বজ্রপাতের ঝুঁকি ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে ক্রমেই বজ্রপাতের ঘটনা বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুর হার। গত কয়েক বছরের তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, বাংলাদেশে গড়ে প্রতি বছর ১১৭ জন মানুষের মৃত্যু হয় বজ্রপাতে। কদিন আগে পত্রিকায় পড়লাম মানিকগঞ্জে বজ্রপাতে ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত শতাধিক। মারা গেছে অনেক গবাদিপশুও। স্থানীয়দের মতে, এলাকায় গাছপালা কমে যাওয়াই এর জন্য দায়ী। এই বজ্রপাতের ব্যাপারেও কোনো সতর্কতা নেই। বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে কিছু দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রাইভেট চ্যানেলগুলো বিটিভির মতো বজ্রপাত সম্পর্কিত সরকারি এসব সতর্কবার্তা ও বজ্রপাতে করণীয় বিষয়গুলো প্রচার করতে পারে। মুখে জনসেবা থাকলেও অনেকেরই কর্মে ব্যবসাটাই মুখ্য। তাই নিজ স্বার্থে জনস্বার্থ গৌণ। সুতরাং মোবাইল টাওয়ার এবং বজ্রপাতজনিত তড়িৎ দুর্যোগও মানুষের অশান্তির আর একটি কারণ। সম্প্রতি ঘটে গেল হাওর অঞ্চলে মহাদুর্যোগ। বিপন্ন চাষি ভাইদের করুণ চিত্র যে কোনো মানুষের হৃদয় আন্দোলিত করবে। এটাও চাষি ভাইদের জন্য বড় অশান্তির কারণ। যে আতঙ্কের রেশ এখনো কাটেনি।

এরপর আছে নকল আতঙ্ক। সভ্যতা মানুষকে ভালো হতে শেখায়, মূল্যবোধ জাগ্রত করে কিন্তু আমাদের হয়েছে উল্টো। আমরা কেন জানি কিছু কিছু ক্ষেত্রে সভ্য হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে পারিনি। ব্যক্তিগতভাবে লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠতে পারিনি। ব্যবসায়িক ফায়দা লোটার জন্য শুধু ভেজাল মেশানোই নয়, খাদ্যও নকল করা হচ্ছে। গত বছর পত্রিকায় পড়েছি রাজবাড়ীর পাংশা বাজারে চীনের তৈরি প্লাস্টিকের নকল চাল বিক্রি করছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই নকল চাল শরীরের জন্য মোটেও সুখকর নয়, বরং নিয়মিত খেলে প্রাণ সংশয় হতে পারে।

শুধু চালই নয়, আমাদের শরীরের পুষ্টির অন্যতম জোগানদাতা হাঁস বা মুরগির ডিম। এই ডিমও এখন নকল পাওয়া যাচ্ছে। কৃত্রিম উপায়ে তৈরি হচ্ছে এই ডিম। একশ্রেণির মুনাফালোভী ব্যবসায়ী এসব ডিম ছড়িয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন বাজারে। এসব ডিম কিনে শারীরিক ও মানসিক প্রতারণার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। কৃত্রিম উপায়ে তৈরি এসব ডিমে কোনো খাদ্যগুণ নেই, নেই কোনো প্রোটিনও। বরং এগুলো মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। মাঝখানে বাজারে নকল ফুলকপিও পাওয়া গিয়েছিল, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এরপর আছে বিভিন্ন ফল এবং খাদ্যদ্রব্যে নকল রং ও রাসায়নিক দ্রব্যের মিশ্রণ। যেমন মুড়িতে ইউরিয়া, হাইড্রোজ, মাছের পাশাপাশি দুধেও দেওয়া হচ্ছে ফরমালিন। ছোলা ও মুড়ি সাদা করতে মেশানো হয় হাইড্রোজ। কৃত্রিম রং মিশিয়ে নকল ঘি বানানো হয়। কাউন ও কাঠের গুঁড়া মিশিয়ে তৈরি হয় মসলা। প্রচণ্ড দাবদাহে একটুখানি তৃপ্তির আশায় অনেকে তরমুজ খান, সেই তরমুজেও দেওয়া হয় রং। যাতে ভিতরটা কাটলে টকটকে লাল দেখা যায়। আনারসে সিরিঞ্জ দিয়ে দেওয়া হয় স্যাকারিন। যাতে বেশি মিষ্টি হয়। ডাবের পানিতে মেশানো হয় চেতনানাশক ওষুধ। যা খেয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন যে কেউ। তারপর অজ্ঞান পার্টির দুর্বৃত্তরা সবকিছু ছিনিয়ে নেয়। রোজার মাসে বিভিন্ন পত্রিকায় নিরাপদ খাদ্যের জন্য ঝুঁকিসমূহ মোকাবিলায় সাধারণ মানুষের করণীয় সম্পর্কে সরকার থেকে বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছে। যাতে বিক্রেতারা নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ যথাযথভাবে অনুসরণ করে। আহ্বান জানিয়েছে অনিরাপদ খাদ্যকে ‘না’ বলতে। কথায় আছে, ‘সাবধানের মার নেই’। আমরা বিজ্ঞাপনে দেখি, ‘নকল হইতে সাবধান’। বাজারে যাওয়ার সময় সাবধান করি—‘ভেজাল থেকে সাবধান’। ব্যাংকে দেখি, ‘জাল টাকা থেকে সাবধান’। এমনি আরও অনেক সাবধান এবং সতর্কবাণী প্রতিনিয়ত আমাদের সতর্ক করছে, সাবধান করছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সব সময় কি আমরাই সাবধান হব? যারা এই ভেজাল-জাল-নকল প্রতারণার সঙ্গে জড়িত তাদের কেন আমরা আইনের আওতায় আনতে পারছি না? বিষমুক্ত খাদ্য যেমন আমাদের প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন বিষমুক্ত সমাজ। যে সমাজে সব সময় আমরা মাথা উঁচু করে চলব নিরাপদে, নিশ্চিন্তে, এক বুক সুখ নিয়ে থাকব শান্তিতে।  যে শান্তির অর্থ উৎকণ্ঠামুক্ত জীবন। যে জীবন আমরা সবাই পেতে চাই।

এই যে ঈদ এসেছে, এই ঈদে আনন্দে কিংবা সানন্দে কেনাকাটা করতে গিয়ে ইদানীং অনেকের মধ্যেই ঢুকেছে ঠকার ভয়—সব সময় একটা সংশয়।  যা কিনছি তা কি খাঁটি নাকি খাঁটি নয়। এর কারণও ওই একটি—উত্কৃষ্ট দ্রব্যের সঙ্গে নিকৃষ্ট দ্রব্যের মিশ্রণ অর্থাৎ ভেজাল। আর ভেজালের জালে নাজেহাল হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। দৃশ্যমান শান্তির মুখ দেখা গেলেও মুখোশের আড়ালে ঢাকা এই ‘অশান্তি’ আর নয়, এই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে সবাই মুক্তি চায়, শান্তি চায়।

শান্তি-শান্তি-শান্তি নয় বিদ্বেষ বিভ্রান্তি।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

সর্বশেষ খবর