শিরোনাম
শনিবার, ১ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

মাশরুম উৎপাদনে সফল উদ্যোগ

শাইখ শিরাজ

মাশরুম উৎপাদনে সফল উদ্যোগ

বাংলাদেশে মাশরুম উৎপাদনের তৎপরতার বয়স প্রায় তিন দশক হলেও এটি এখনো ভালোভাবে কৃষি-বাণিজ্য বা লাভজনক কৃষির গুরুত্ব পায়নি। এখনো মাশরুম রয়ে গেছে ক্ষুদ্র ও ঘরোয়া শিল্পের পর্যায়েই। চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই মাশরুম যে কোনো কৃষি ফসলের কাতারে পৌঁছে গেলেও আমাদের এখানে মাশরুম সম্পর্কে মানুষের এখনো পূর্ণ সচেতনতা আসেনি। তবে উদ্যোক্তারা বরাবরই এর সম্ভাবনা ও গুরুত্ব বোঝেন। কিন্তু সাধারণ ভোক্তা ও ক্রেতা চাহিদা বৃদ্ধি না পাওয়ায়, মাশরুম উৎপাদন ক্ষেত্রে সফলতা যেমন রয়েছে, রয়েছে কিছু ব্যর্থতার নজিরও। এ ক্ষেত্রে দেশের সর্ব উত্তরে মাশরুম উৎপাদনের ক্ষেত্রে এক বিশাল সাফল্যের সূচনা করেছেন আজিজুল হক। অবাক হতে হয় তার সাহসিকতায়। রীতিমতো ৮ হাজার ৮০০ বর্গফুট আয়তনের তিনটি শেডে ৫০ হাজার মাশরুম স্পন স্থাপন করেছেন।

পাঠক! নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার পলিটেকনিক্যাল কলেজ এলাকার আজিজুল হকের গল্পই শোনাব আজ আপনাদের। আপনারা যদি পলিটেকনিক্যাল কলেজ এলাকায় আজিজুল হকের খোঁজে যান, দেখবেন শেডের ঘর। হয়তো আপনাদের ধারণা হবে কেউ শেডে মুরগি লালন-পালন করছেন। কিন্তু না, আসলে সেই শেডগুলোই হচ্ছে মাশরুমের ঘর, ‘ফাতেমা মাশরুম’। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শেডে মাশরুম চাষ হয় এখানে। আপনাদের হয়তো মনে আছে বহু আগে থেকে মাশরুম চাষের গুরুত্বকে নানাভাবে তুলে ধরছি টেলিভিশনে। সবজি হিসেবে মাশরুম, মাশরুমের ঔষধি গুণ, অয়স্টার, বাটন, নানা ধরনের মাশরুমের চাষের ওপর প্রতিবেদন। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক বাংলাদেশে মাশরুম চাষ খুব একটা জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল না। এর একটা কারণ হচ্ছে সামাজিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি। প্রাকৃতিক মাশরুম জাতের কোনো কোনোটা বিষাক্ত, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু চাষ করা মাশরুম উপকারী, পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। সারা বিশ্বে মাশরুমের ব্যাপক চাহিদা। চীন, জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনামসহ অনেক দেশে মাশরুমের বড় বাজার তৈরি হয়েছে। ভালো বাজার রয়েছে ইউরোপেও। দীর্ঘদিনের ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক সময়ে মাশরুম ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। লোকজন এখন মাশরুমের গুণাগুণ সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। যেখানে টেলিভিশনে প্রচারিত ও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে বিশ্বাস করি।

ফিরে যাওয়া যাক আজিজুল হকের ‘ফাতেমা মাশরুম’-এ। আজিজুল হক মাশরুম চাষ করে অনেক পদক  পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার বহু পদকের মধ্যে অন্যতম। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে তিনিই বোধহয় বাংলাদেশের প্রথম ব্যক্তি যিনি এত বড় আকারে মাশরুম চাষ করে আসছেন। তিনটি শেডেই কয়েক গুণ বেশি ফলন নিশ্চিত করার জন্য ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ বা ভার্টিকাল এক্সপ্যানশন পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন আজিজুল। জানালেন এই পদ্ধতির পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত পুরোটাই তার নিজস্ব চিন্তার আলোকে। আজিজুল হক জানালেন তার মাশরুম চাষের শেডটি ৩১ শতক জমির ওপর। তিনি মাশরুম চাষের জন্য স্পনগুলো একটার ওপর আর একটা করে মোট আটটি স্পনের সারি তৈরি করেছেন। ফলে কম জমিতে বেশি মাশরুম চাষ করতে পারছেন এখন। আজিজুলের কৌশল আর সুদূরপ্রসারী চিন্তার সম্মিলন দেখে সত্যিই অবাক হতে হয়।

মাশরুমের স্পনে বীজ দেওয়ার ২৮ দিন পর থেকে মাশরুম পাওয়া যায়। তিন মাস ধরেই মিলবে এই মাশরুম। পলিথিন ব্যাগের ছিদ্র দিয়ে মাশরুম বের হয়ে আসে। মাশরুমগুলো যখন পরিপক্ব হয়ে ওঠে তখন সেগুলো কেটে নেন আজিজুল। মৌসুমে প্রতিদিন প্রায় এক টন মাশরুম হয়। আজিজুল হকের তিনটি শেডের প্রথমটিতে ৩০ হাজার, দ্বিতীয়টিতে ১০ হাজার এবং তৃতীয়টিতে ৫ হাজার স্পন রয়েছে। মোট ৪৫ হাজার স্পন থেকে ৩০-৩৫ টন মাশরুম আসবে বলে আশা করছেন আজিজুল। প্রিয় পাঠক! আজিজুল নতুন কোনো মাশরুম খামারি নন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত কৃষি দিবানিশি অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই আপনারা ২০১২ ও ২০১৩ সালে দেখেছেন আজিজুল তার নিজ বাড়িতে ছোট পরিসরে গ্যানো নামের ঔষধি মাশরুম উৎপাদন করেন। ঘরেই ঔষধি গুণসম্পন্ন ওই মাশরুমের ট্যাবলেট তৈরি করে এলাকায় সাড়া ফেলে দেন সে সময়। অনেকেই উপকার পান তার মাশরুম থেকে। মাশরুমের ট্যাবলেট  খেয়ে কারও ফ্যাট কমেছে আবার কেউ জানালেন তাদের হৃদরোগের অসুখটা এখন আর আগের মতো অনুভব করছেন না। কোরিয়া ও চীনে চালানো যৌথ একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যান্সার প্রতিরোধে মাশরুমের তুলনা নেই। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে গ্যানো মাশরুম অসাধারণ কার্যকর, বলছেন আজিজুল। এতে ভিটামিন ও মিনারেল আছে শতকরা ৭০ ভাগ, প্রোটিন শতকরা ৩৫ ভাগ।

ক্ষুদ্র উদ্যোগ থেকে আজিজুল হক আজ পৌঁছে গেছেন অনেক বড় পরিসরে। তার কাছে মাশরুম কোনো সাধারণ সবজি নয়, মাশরুম দারুণ উপকারী এক কৃষিজ খাদ্যপণ্য। মাশরুম ছাউনি থেকে আজিজুল হকের বাড়িতে গেলাম। পুরো বাড়িটিই এখন মাশরুম উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ খামারে পরিণত হয়েছে। এখানে অয়েস্টার ও গ্যানো মাশরুমের কয়েকটি জাতের উৎপাদন থেকে শুরু করে বিভিন্নমুখী প্রক্রিয়াজাতকরণ চলছে। কোনোটি কাঁচা, কোনোটি শুকিয়ে, কোনোটি অন্য কোনো প্রকারে চলছে বাজারজাতকরণের প্রস্তুতি। বাসার একটি কক্ষ ব্যবহার হচ্ছে শুকনো মাশরুমের মজুদের জায়গা হিসেবে। এখানে রয়েছে বস্তাভর্তি শুকনো অয়েস্টার মাশরুম। কিছু গ্যানো মাশরুমও রয়েছে সেখানে। পাশের আরেকটি কক্ষে ল্যাবরেটরি। মূলত এ ঘরেই নানা রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও মাশরুম থেকে ট্যাবলেট ও পাউডার তৈরি করা হয়। আজিজুল হক একাই তার খামারের পুরো কাজের নেতৃত্ব দেন। নিজেই করেন বেশ কয়েকজন শ্রমিকের কাজ। একজন উদ্যোক্তা হিসেবে তার খামার পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা কৌশল অনুসরণীয় হতে পারে যে কোনো নতুন উদ্যোক্তার জন্য। মাশরুম উদ্যোক্তা আজিজুলের উদ্যোগ নিয়ে কথা বলেছি জাতীয় মাশরুম উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক ড. নীরোধ চন্দ্র সরকারের সঙ্গে। ড. সরকার জানালেন বাংলাদেশে মাশরুম চাষ দ্রুত প্রসার লাভ করছে। এর প্রধান কারণ হিসেবে মাশরুম উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ কেন্দ্রের স্থানীয়-উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ভূমিকার কথা জানান তিনি। তার মতে, সাধারণ মানুষের পক্ষেই এখন মাশরুমের বীজ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। তাই আজিজুল হকের মতো অনেকেই এখন মাশরুম চাষে সফল হচ্ছেন।

আজিজুলের মাশরুম খামারের চিত্র ধারণ করে ফেরার সময় দুজন ভদ্রলোক আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। তাদের একজন সৈয়দপুরের নয়াটোলো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেজাউল করিম রাজু ও অন্যজন স্থানীয় হাজারিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক খন্দকার শহিদুজ্জামান। রেজাউল করিম জানান, তার শারীরিক দুর্বলতা ও শরীরে ব্যথা ছিল। এমনকি নামাজে দাঁড়ালে তিনি মাথা ঘুরে পড়েও যেতেন। ডাক্তার দেখিয়েও রোগ নিরাময় হচ্ছিল না। তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। তখন এক পরিচিতের মাধ্যমে জানতে পারেন মাশরুমের ঔষধি গুণের কথা। জানতে পারেন আজিজুলের কথা। মাশরুম মানে তিনি জানতেন ব্যাঙের ছাতা।  ভেবেছিলেন বিষয়টা হালাল হবে না। কিন্তু পরে তিনি নিজস্ব বোধ দিয়েই বুঝলেন মাশরুম হালাল। আর সেই মাশরুমেই হলো আরোগ্য লাভ।

প্রিয় পাঠক! বিশ্বব্যাপী পুষ্টিকর খাদ্য উপাদান হিসেবে মাশরুমের ব্যাপক ব্যবহার চালু রয়েছে। পুষ্টির পাশাপাশি এর ঔধষি গুণ নিয়েও কোনো সন্দেহ ও বিতর্ক নেই। কিন্তু আমাদের দেশে মাশরুম এখনো খাদ্য উপকরণে জায়গা করে নিতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে এক সম্ভাবনার কথা জানান দিচ্ছেন নীলফামারীর সৈয়দপুরের আজিজুল হক। উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি মাশরুম উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও এর উপকারিতা সম্পর্কে গভীরে গিয়ে ধারণা লাভ করেছেন। একরকমের বাজার-নিশ্চয়তা আছে বলেই তিনি বড় খামার গড়েছেন। এমনকি খামার আরও সম্প্রসারণের স্বপ্নও রয়েছে তার। তিনি চান, আরও বৃহৎ পরিসরে মাশরুমভিত্তিক খাদ্য উপকরণের একটি শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে। একজন কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে তার এ উদ্যোগ ও উত্তরোত্তর সাফল্য দেশের অনেক বেকার তরুণকে যেমন পথ দেখাবে, একইভাবে মাশরুমের বাজার সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

 

সর্বশেষ খবর