রবিবার, ২ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

এবার ভোটে নৌকা-ধানের শীষ ‘নিলামে’ তুলবেন না

কাজী সিরাজ

এবার ভোটে নৌকা-ধানের শীষ ‘নিলামে’ তুলবেন না

রমজান মাসে রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে ‘ইফতার জলসার’ আয়োজন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি অংশই বুঝি হয়ে গেল। প্রকাশ্যে বড় সভা-সমাবেশ করার সুযোগ-বঞ্চিত বিএনপি এবার এ সুযোগটি ষোলোআনার ওপর ‘বত্রিশআনা’ কাজে লাগিয়েছে। মূল দল, অঙ্গ-সহযোগী দল এবং ২০-দলীয় জোটের কোনো কোনো শরিক প্রায় প্রতিদিনই গড়ে প্রায় ১০ লাখ টাকার ওপর খরচ করে এই ‘ইমানি দায়িত্বটি’ পালন করেছে। জোট সঙ্গী জামায়াতে ইসলামী এবার নিজস্ব উদ্যোগে ইফতার আয়োজন না করলেও বিএনপি ও অন্যান্য জোট শরিকের অনুষ্ঠানে তাদের কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ নেতার উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। একটি কথা না বললেই নয়, কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বিএনপি ছেড়েছিলেন জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সখ্যের অভিযোগে। তার দুটি নির্বাচনী এলাকার একটি জামায়াতে ইসলামীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। আগেরবার তার ছেড়ে দেওয়া সে আসনে উপ-নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তার স্ত্রী। ক্ষোভে-ক্রোধে তিনি বিএনপি ছেড়ে গঠন করেছিলেন এলডিপি। বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ওপর নানা কারণে অসন্তুষ্ট দলের বেশ কজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা এলডিপিতে যোগ দিয়েছিলেন। তাদের অনেকেই এখন অবশ্য তার সঙ্গে নেই। যে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি নেতৃত্বের সখ্যের কারণে তিনি দলত্যাগ করে নতুন দল গঠন করেছিলেন, সে কারণের কি তবে অবসান হয়েছে? তখন জামায়াত ছিল খু-উ-ব ‘তেতো’, এখন কি তা ‘রসগোল্লার’ মতো? তা না হলে তার দলের ইফতার আয়োজনে হেড-টেবিলে একবারে তার অতি কাছে জামায়াত নেতাকে ‘আদর করে’ বসালেন কী করে? ক্ষমতার নেশা মানুষকে নীতি-আদর্শও ভুলিয়ে দেয়? কর্নেল (অব.) অলি আহমদ একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। তার কাছ থেকে অনেকেই এটা প্রত্যাশা করেননি। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু স্বার্থ কখনো কখনো ত্যাগ করতে হয় জানি। তাই বলে, আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের স্পন্দন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে? হ্যাঁ, এটা সত্য যে, একাত্তরে জামায়াতের যারা নেতৃত্বে ছিলেন, সংগঠক ছিলেন তারা এখন নেই-প্রায়। জামায়াতের নেতা-কর্মী-সংগঠকদের বয়স এখন অধিকাংশেরই ষাটের কম। কিন্তু উচ্চ আদালত কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধে দল হিসেবে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর একাত্তরের দায় তো অস্বীকার করছে না বর্তমান জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বও। বিএনপি বা কর্নেল (অব.) অলি সাহেবরা তো জামায়াতকে একাত্তরের বেসলাইনে দাঁড় করিয়ে আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতির মূল স্রোতধারায় আনতে পারছেন না। এমতাবস্থায় একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুসারীদের কী করে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে নিবিড় সখ্য হয়? অবশ্য ক্ষমতার রাজনীতি বলে কথা! এখন তো শোনা যাচ্ছে শাসক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গেও জামায়াতে ইসলামীর একটি ‘মধুময়’ সম্পর্কের ভিত তৈরি হচ্ছে। হাজার হাজার জামায়াত-শিবির নেতা-কর্মী ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রকাশ্যে ঘটা করে আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। ওই সব যোগদান অনুষ্ঠানে শাসক লীগের হোমরা-চোমরা কোনো কোনো নেতাও উপস্থিত ছিলেন। দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে একবার অসন্তোষ প্রকাশ করলেও যোগদানকারী জামায়াত-শিবির নেতা-কর্মীদের আওয়ামী লীগ থেকে বাদ দেওয়ার কোনো খবর আজ অবধি পাওয়া যায়নি। বরং আওয়ামী লীগের টিকিটে-সমর্থনে কেউ কেউ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে লীগ নেতার মর্যাদায় ভূষিত হয়েছেন। সেদিক থেকে বিএনপি ও কর্নেল (অব.) অলি সাহেবরা তো অনেক বেহেতর। জামায়াতিরা দল বেঁধে বিএনপিতে যোগদানের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য খবর এখনো পাওয়া যায়নি। বিএনপি এখন এ যুক্তি দেখাতেই পারে যে, ভোটের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনেকটা ‘সোল এজেন্সির’ দাবিদার আওয়ামী লীগ যদি জামায়াতকে নিয়ে এমন ‘খেলা’ প্রকাশ্যেই খেলতে পারে, বিএনপি ‘খেললে’ অসুবিধা কোথায়? মাঝখানে বিএনপি জামায়াত সম্পর্কের টানাপড়েনের একটা খবর রাজনৈতিক অঙ্গনে চাউর হয়েছিল। খোদ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেছেন সম্প্রতি।

২০-দলীয় জোটের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সভায় জামায়াত তাদের প্রতিনিধি পাঠানো স্থগিত রেখেছিল। ইফতার মাহফিলে হঠাৎ আবার তাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। সন্দেহ-অবিশ্বাসের কি তবে অবসান হয়েছে? পুনরায় সম্পর্কোন্নয়নের সূত্রটি কী? বলছিলাম ইফতার মাহফিলের কথা। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও ‘ইফতার পলিটিক্স’ বাদ দেয়নি। তারাও করেছে। ইফতার মাহফিল সম্পূর্ণরূপে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। গ্রামগঞ্জে এমনকি শহরাঞ্চলেও সামাজিকভাবে এমন কর্মসূচি পালনের রেওয়াজ প্রাচীনকাল থেকেই আছে; কিন্তু সেসব অনুষ্ঠান পরিপূর্ণভাবে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে পালন করা হয়। কোথাও কোথাও সারা দিন এ উপলক্ষে কোরআন খতম, ইবাদত-বন্দেগি শেষে ইফতারের আয়োজন করা হয়। সেখানে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ সম্পর্কিত আলোচনা হয়। রোজার ফজিলতের ওপর আলেম-ওলামাদের বক্তব্য শেষে মোনাজাতে দুনিয়ায় করা সব গোনাহ-খাতা থেকে মাফ ও আখিরাতের মুক্তি প্রার্থনা করা হয়। কিন্তু বিএনপি-আওয়ামী লীগের ‘ইফতার মাহফিলে’ কী হয়, কী হয়েছে? বিকাল থেকে দলীয় ক্যাডার-সমর্থক ও সুশোভিত নিমন্ত্রণপত্রের মাধ্যমে আমন্ত্রিত ‘অতিথিরা’ আসতে থাকেন। ‘মাহফিলের’ আকর্ষণ কোনো খ্যাতিমান আলেম-ওলামা-মাশায়েখ নন, প্রধান আকর্ষণ শেখ হাসিনা অথবা খালেদা জিয়া। ইফতারের ৮ থেকে ১০ মিনিট আগে তারা ঘটা করে সাজ সাজ রব তুলে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছেন এবং তাদের মূল্যবান ভাষণই অনুষ্ঠানের প্রধান বিষয়। ৫ থেকে ৭ মিনিট তারা বক্তৃতা করেন। তারপর হয় একজন জাতীয়তাবাদী হুজুর অথবা একজন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী হুজুর অতি সংক্ষেপে একটা মোনাজাত করে ধর্মীয় কাজটি সম্পন্ন করেন। দুই নেত্রী রমজানে একে অপরের গিবত গান, পারস্পরিক আক্রমণাত্মক ভাষণ দেন। কারও মুখে অপরের বদনাম ছাড়া সুনাম শোনা যায় না। এবারও তা-ই হয়েছে। বিএনপি ‘ইফতার মাহফিলের’ সুযোগ নেওয়ার কারণ কারও কাছে দুর্বোধ্য নয়। প্রথমত, বিএনপি ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দল হিসেবে এই ধরনের ধর্মভিত্তিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের ধর্মীয় অনুভূতির প্রকাশ করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সমর্থন আদায় করতে চায়। বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে তা মোটেও সাংঘর্ষিক কিছু নয়। তবে বড় বিষয় হচ্ছে, সরকারি দল তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালায় অবাধে। সরকারি সুযোগ-সুবিধাও তারা কাজে লাগাচ্ছে। সভা-সমাবেশ করা, সভা-সমাবেশে যোগদান করা জনগণের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের অন্তর্গত বিষয় হলেও বিএনপিকে সরকার নানা অজুহাতে সে অধিকার ভোগ করতে দিচ্ছে না। বিবৃতি আর প্রেস ব্রিফিং ছাড়া জনগণের কাছে বক্তব্য পৌঁছানো এবং নেতা-কর্মীদের একত্রিত করার কোনো পথ খুলতে পারছেন না তারা। তেমন সাহসও নেই। রমজান পুলিশি উপদ্রব ছাড়া হাজার হাজার কর্মীর সমাবেশ ঘটানোর একটা সুযোগ করে দিয়েছে ‘ইফতার মাহফিলের’ আবরণে। সুযোগটা যত বেশি সম্ভব কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন তারা। আওয়ামী লীগের তো সেই ধরনের কোনো সুযোগ গ্রহণের প্রয়োজন নেই। তারা কেন করে ‘ইফতার মাহফিল’? এখানেই আসে ধর্ম নিয়ে রাজনীতির কথা। বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের অভিযোগ, তারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে জোট করে। বিএনপি তা অস্বীকার করে না। তারা প্রকাশ্যেই বলে, বিএনপি ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী দল। অবশ্য কতটা সত্যি, তা প্রশ্নাতীত নয়। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে রাজনৈতিক সুবিধা লাভের কাজে লাগানোর চেষ্টা করার একটা ‘ঘোষিত লাইসেন্স’ তাদের আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাসী দল। ধর্ম তাদের কাছে ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও পালনের বিষয়। তারা কেন বিএনপির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ‘ইফতার মাহফিল’ করে দলীয় উদ্যোগে? আসলে ধর্মকে রাজনীতিতে তারাও ইদানীং বেশি করে ব্যবহারের কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে বলে মনে হয়।

রমজানে রাজনীতি হয়েছে নির্বাচনকেন্দ্রিক। দুই প্রধান দলই স্পষ্ট করেছে যে, তারা নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমে পড়েছে। এটা একটা স্বস্তিরও বিষয়। দেশ-বিদেশের সব গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের প্রত্যাশা যে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হোক। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের কলঙ্কের বোঝা যেন বাঙালি জাতিকে আর বইতে না হয়। আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় কাউন্সিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্পষ্ট ভাষণ এ ব্যাপারে মানুষের কানে আশা জাগানিয়া গানের সুর মূর্ছনার মতো বেজেছে। তিনি বলেছেন, আগামী নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হোক তা তিনি চান না। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন যে অমর্যাদার ও গ্লানির তা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। শঙ্কা ছিল বিএনপিকে নিয়ে— তারা কি নির্বাচনে আসবে? আপাতত সে শঙ্কা বোধহয় কেটেছে। নানা বিষয়ে দ্বিমত ও আপত্তি সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন গঠনের উদ্দেশ্যে সার্চ কমিটি গঠন এবং নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন সবকিছুই বিএনপি মেনে নিয়েছে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের নীতিগত সিদ্ধান্ত থেকে— এটা বোঝাই যাচ্ছে। ইফতার মাহফিলে ভোট প্রসঙ্গ এসেছে বেশ জোরালোভাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপিকে ভোট দিলে দেশের সর্বনাশ হবে, সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মসূচিগুলো সমাপ্ত করার সুযোগ দেওয়ার জন্য তিনি নৌকায় ভোট চেয়েছেন। পক্ষান্তরে গুম, হত্যা, লুণ্ঠন, লুটের টাকা বিদেশে পাচার রোধ এবং দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ধানের শীষে ভোট চেয়েছেন খালেদা জিয়া। ধারণা করা যায়, চলতি জুলাই থেকে ভোটের রাজনীতি আরও গতি পাবে। তবে এ গতিময়তা নির্ভর করছে শাসক দলের বিভিন্ন পদক্ষেপের ওপর। আওয়ামী লীগ শুধু ইফতার মাহফিলে নয়, প্রকাশ্যে বড় বড় জনসভা করেও নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছে। যেসব জনসভায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিয়েছেন। বিএনপিকে কিন্তু চার দেয়ালের মধ্যেই আটকে রাখা হয়েছে। হাজার হাজার নেতা-কর্মী অসংখ্য মামলা-মোকদ্দমায় বেহাল দশায় রয়েছেন। তাদের সময় কাটে হয় কোর্টের বারান্দায় অথবা পলাতক অবস্থায়। বড় সভা-সমাবেশের অনুমতি এখনো তারা পাচ্ছে না। এটা নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতকরণের লক্ষণ নয়। এখন থেকেই ফিল্ডটা লেভেল প্লেয়িং কন্ডিশনে রাখতে হবে। আশা করা যায়, সরকার এ ব্যাপারে অনুকূল সিদ্ধান্ত নেবে। খালেদা জিয়াসহ দলের সব নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলার ব্যাপারেও একটা রাজনৈতিক মীমাংসায় পৌঁছতে হবে সরকারকে। খালেদা জিয়া মুক্ত অবস্থায় স্বাধীনভাবে তার দল ও জোটের পক্ষে নির্বাচনী প্রচার অভিযানে নামতে না পারলে নির্বাচনের অনুকূলে বিএনপির বর্তমান সব পদক্ষেপ ও কর্মকাণ্ড থেমে যেতে পারে। খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচনে যাওয়ার সাংগঠনিক সক্ষমতা বিএনপির নেই। তেমন পরিস্থিতি নতুন সংকটের জন্ম দেবে। বিএনপির বর্তমান কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নানামুখী দুর্বলতা, আমলনামার অস্বচ্ছতার কারণে সাহসী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের অবস্থায় নেই। তবে বিএনপি নির্বাচনমুখী একটি দল হিসেবে উন্মুখ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য। উৎসাহী সম্ভাব্য প্রার্থীরা এরই মধ্যে টাকা-পয়সা খরচ করে নির্বাচনী এলাকায় ‘চাষবাস’ শুরু করেছেন। সরকার বা বিএনপি— কারও কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানকেই সংকটাপন্ন করে তুলবে, যা কাম্য নয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে যেসব কথাবার্তা গেল ২৭ জুনও বলেছেন তা অনেকটাই উসকানিমূলক বলা যেতে পারে। তবে তার এ কথাই শেষ কথা বলে ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেও দলের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একই কথা বলেছিলেন যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে সে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে হয়েছিল। প্রস্তাব এসেছিল সর্বদলীয় সরকারের। বিএনপিও এবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে এসেছে। তারা এখন নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার চায়। সরকারপক্ষ বলছে, সেবার তো বিএনপি সংসদে ছিল তাই সর্বদলীয় সরকারে যোগদানের সুযোগ ছিল। এখন তো বিএনপি সংসদে নেই। সহায়ক সরকার হলেও তাতে তো বিএনপিকে নেওয়ার সুযোগ নেই। খুবই হালকা যুক্তি। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণে একটি প্রশ্নবিদ্ধহীন নির্বাচন সরকার চায় কিনা। তাহলে একটা সমঝোতায় আসতেই হবে।

এরপরও কথা আছে। সব দলকে নিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বিএনপি-আওয়ামী লীগসহ গণসংশ্লিষ্ট সব দলের অশংগ্রহণে একটি নির্বাচন হলেই কি তা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়ে যাবে? একদিনের ভোটকাণ্ডই গণতন্ত্রের সব? ধরে নিলাম একটি সহনীয় নিরপেক্ষ নির্বাচন হলো। তাতে জনগণ ও দেশের লাভ হবে কি-না? দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে কি-না? উন্নয়ন ও সম্পদের সুষম বণ্টন হবে কিনা? একটা জাতীয় নির্বাচন যদি দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত না করে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে কী করে? প্রধান দুই দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পরস্পরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ করে চলেছে। দুই দলের ‘কীর্তিমানদের’ এ সংক্রান্ত ভূমিকা জনগণের সামনেও একেবারে পরিষ্কার। জাতীয় রাজনীতিতে লুটেরা সংস্কৃতির নোংরা চর্চা মানুষ দেখছে। এরশাদের জাপাসহ প্রধান দুই দলই এর অনুসারী। অভিযোগ আছে যে, দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি জাতিকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে। রাজনীতিতে একঝাঁক শিক্ষিত মেধাবী তরুণের অভ্যুদয় এ খারাপ পরিস্থিতি ও প্রবণতা রোধ করতে ও বদলে দিতে পারে। প্রধান দুই দল আগামী সংসদ নির্বাচনে যদি প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও সততার পরিচয় দেয় তাহলেই তা সম্ভব। দুই দলেই যারা দৌড়ঝাঁপ দিচ্ছেন তাদের অধিকাংশের ‘আমলনামা’ অস্বচ্ছ বলেই মনে করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। অথচ সবাই বিশ্বাস করে আওয়ামী লীগ-বিএনপিতে সৎ, শিক্ষিত, মেধাবী দেশপ্রেমিক তারুণ্যোদীপ্ত প্রার্থীর আকাল পড়েনি। কিন্তু তারা তো কোটি টাকা দিয়ে ‘নৌকা’-‘ধানের শীষ’ প্রতীক কিনতে পারবেন না। যদি সৎ, যোগ্য প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে সৎ ও যোগ্য লোকের একটি পার্লামেন্ট গঠিত না হয়, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলেই কি জনগণের স্বপ্ন পূরণ হবে? অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে, কোনো দল কালো টাকার মালিক, পেশিবাজ, অরাজনৈতিক গণবিরোধী ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেবে না। নির্বাচনে ভোটের খেলা চলুক, টাকা আর অস্ত্রের খেলা নয়। দুই দলের মালিকরা দয়া করে নৌকা আর ধানের শীষকে এ নির্বাচনে ‘নিলামে’ তুলবেন না। যে বেশি দাম হাঁকবে তাকেই মার্কাটি তুলে দেবেন না। ভালো মানুষদের নিয়ে একটা ভালো সংসদ গঠিত হতে দিন।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর