মঙ্গলবার, ৪ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিপুল সম্ভাবনাময় সমুদ্র সৈকত

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

বিপুল সম্ভাবনাময় সমুদ্র সৈকত

ঈদের পর প্রথম লেখা তাই পাঠকদের ঈদ মোবারক জানাচ্ছি। প্রায় এক যুগ পর কক্সবাজারে গিয়েছিলাম। এখন কক্সবাজার চেনা যায় না। শুধু মানুষ আর মানুষ, হোটেল-মোটেল ভরা। ’৭২-এ প্রথম যেদিন গিয়েছিলাম সেদিনের আর আজকের কক্সবাজার আকাশ-পাতাল ব্যবধান। ’৭২-সালে আমার একটা খয়েরি মাজদা ও দুটা টয়েটা জিপ ছিল। সি-বিচ দিয়ে প্রায় ৩০-৪০ কিলোমিটার প্রতিদিন এদিক-সেদিক করতাম। এখন সি-বিচে নড়াচড়া করার পথ নেই, মানুষ আর মানুষ। কিন্তু অনেকদিন পর গিয়েও খুব ভালো লেগেছে। মূলত এ যাত্রায় কক্সবাজার আর চট্টগ্রামে যাওয়ার কারণ ছিল দুটি। একটি আমার বুকের ধন কলিজার টুকরো কুশিমণির সমুদ্র দেখা। সমুদ্রে ঝাঁপাঝাঁপি করার তার খুব শখ, সে শখ সে পুরো করেছে। বিচ থেকে হিলটপ সার্কিট হাউসে ফিরেই লন্ডনে ছবি পাঠিয়েছে। দুবোনের সে কত কথা। সব শুনতে পারিনি। দূর থেকে যা শুনেছি তাতেই বুক ভরে গেছে।

অন্য কারণ, আমাদের ভাতিজি সখিপুর নলুয়ার এস এম আনোয়ার হোসেনের মেয়ে ঝর্ণার বিয়ে হয়েছে পেকুয়ার মেহেরনামায়। আজ যাই কাল যাই করে যাওয়া হয়নি। মেয়েটিকে আমরা অনেক আদরে লালন পালন করেছি। জামাই বাড়ি জানে আপন ভাতিজি। পরও যে আপন হয় মেয়েটি তাদের এক জ্বলন্ত প্রমাণ। তাই গিয়েছিলাম ঝর্ণার শ্বশুর বাড়ি। ঝর্ণার স্বামী রুবেল, ছোট ভাই জাহিদ, ছোট বোন সোনিয়া, ওদের মা-বাবা, চাচা-চাচিদের ভীষণ ভালো লেগেছে। এ কবছর তাদের নিয়ে যত ভেবেছি তার চাইতে তারা অনেক ভালো। বিখ্যাত মাতামুহুরী নদীর কথা কত পড়েছি, শুনেছি। সেই মাতামুহুরীর গা ঘেঁষে ওদের বাড়ি। বিকালে মাতামুহুরীর পাড়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম। নির্মল বাতাস বুকের সব দুয়ার খুলে দিয়েছিল। ঢাকা শহরের পরিবেশ দূষণে বাস করা কেউ এ রকম জায়গায় নদীর পাড়ে দু-এক মাস থাকলে মনের সমস্ত কালিমা প্রকৃতি নিয়ে নেবে। কোনো জটিলতা কুটিলতা ভর করতে পারবে না। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার। তাই ওদের তাড়া ছিল। আমরাও কক্সবাজার যেতে চেয়েছিলাম। তাই এক রাত কাটিয়ে কক্সবাজার গিয়েছিলাম। তবে ঝর্ণার বাড়িতে আমার জীবনের সব থেকে বড় তৃপ্তি প্রায় ৪-৫ বছর পর মা-বাবার মধ্যে কুশিমণি শুয়েছিল। বিদ্যুতের কোনো ভরসা ছিল না। তাই রুবেলরা জেনারেটর এনেছিল। সারা দিন সারা রাত চলে হয়তো জেনারেটরও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। রাত আড়াইটার দিকে বিদ্যুৎ ছিল না। মেয়ে-মা হাঁস-ফাঁস করছিল। আমারও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। কোনো হাত পাখা ছিল না। এত যত্ন করেছে যে হাত পাখা চাইলে হয়তো রুবেলদের বাড়ির কেউ সারা রাত শিথানে পাখা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। এক মানবাধিকার কর্মী রুবিনা শওকত উল্লাহ ‘মানবাধিকার খবর’ নামে আমাকে একটা ম্যাগাজিন দিয়েছিল। সেখানে আমার সম্পর্কেও দু-চার কথা ছিল। ম্যাগাজিনের অন্তরের বিষয় বা লেখা কার কতটা কাজে লেগেছে জানি না, কিন্তু ম্যাগাজিন আমায় বড় সাহায্য করেছে। কোনো কিছু না পেয়ে ২০-২৫ পৃষ্ঠার ম্যাগাজিন নিয়ে মামণিকে অনেকক্ষণ বাতাস দিয়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল অবহেলিত বেকার জীবনে একটা শিশু বাচ্চার নির্বিঘ্ন ঘুমে কিছুটা কাজে লাগালাম। কোনো কোনো সময় চরম ক্ষুধায় যেমন খাবারের মূল্য বোঝা যায়, ঠিক তেমনি ঘণ্টাখানিক পর আবার যখন বিদ্যুৎ এলো অমন স্বস্তি বা আনন্দ কখনো খুব বেশি পাইনি। সারা দিন ফ্যানের বাতাসে বিরক্ত ছিলাম, কিন্তু গভীর রাতে সেই বাতাস কি যে নির্মল ভুবন ভুলানো মন জুড়ানো ছিল আমার বিদ্যা-বুদ্ধি দিয়ে পাঠকদের তা বুঝাতে পারব না।

৩০ জুন মেহেরনামা থেকে বিকাল ৩টায় বেরিয়ে ছিলাম। আগের দিন রুবেলদের বাড়ি যাওয়ার পথে সাকোর পাড় পুলের ওপর অনেক লোক দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু গাড়ির কাচ নামাইনি, গাড়ি থেকেও নামিনি। আমার মনে হয়েছিল রুবেলদের বাড়ি ওখানেই কোথাও, সবাই হয়তো যাবে। কিন্তু আমার আন্দাজ ঠিক ছিল না। বাড়িটা ছিল ৪০০-৫০০ গজ দূরে। তাই ফেরার দিন নেমেছিলাম এবং অকপটে লোকজনদের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেছিলাম, বাড়িটা অত দূর এটা জানা থাকলে কালও আমি নামতাম। আপনারা আমায় ক্ষমা করবেন। আমার ভাতিজি আপনাদের গ্রামে এসেছে ওকে দোয়া করবেন, আগলে রাখবেন। প্রায় ২৪-২৫ ঘণ্টা পেকুয়া ইউনিয়নের মেহেরনামায় ছিলাম। ওই ইউনিয়নে বিএনপির প্রধান নেতা সালাউদ্দিন আহমেদের বাড়ি। মজার কথা পেকুয়ায় সালাউদ্দিন আহমেদকে কেউ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে চেনে না বা ডাকে না। সবাই তাকে এপিএস বলে। কারণ এক সময় সালাউদ্দিন আহমেদ প্রাক্তন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার এপিএস ছিলেন।

৫টা কয়েক মিনিটে কক্সবাজার হিলটপ সার্কিট হাউসে পৌঁছেছিলাম। সার্কিট হাউসটি আমার বহুদিনের পরিচিত। এনডিসি কয়েক মাস হয় এসেছে। ময়মনসিংহের খাগডহড়ের মানুষ। বসতে বসতে বলছিল, ‘এই ঘরে বঙ্গবন্ধু থেকেছেন।’ আমি আগেই জানি বঙ্গবন্ধু এই ঘরে থেকেছেন। কিন্তু এনডিসির মুখ থেকে বঙ্গবন্ধু এই ঘরে থেকেছেন শুনে শিহরণ জেগেছিল। বঙ্গবন্ধু নেই, আমরা আছি কেমন যে লাগে এ শুধু উপলব্ধি করা যায় লিখে প্রকাশ করা বা কাউকে বুঝানো যায় না। স্বাধীনতার পর ২৮ ডিসেম্বর ’৭১ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩ জেনারেল, ২ ব্রিগেডিয়ার তখনকার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গতাজ তাজউদ্দীনের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের মধ্যের ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে। সেটা অনেকটা দূরও হয়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বঙ্গভবনে গিয়েছিলাম দাদু সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। বন্ধু আশরাফের মা আমাকে তার সব কজন সন্তানের চাইতে বেশি ভালোবাসতেন। ৬ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা মানুষ আমি। দিদা বুকের কাছে পড়ে থাকতেন। কিন্তু তবু কাছে পেলেই ঝাপটে ধরতেন। আমি আমার নিজের দাদু-দিদা দেখিনি। সৈয়দ নজরুল ইসলামের স্ত্রীই আমার সে অভাব পূরণ করেছেন। সেখান থেকে পাকিস্তান নেভির বিশাল এক সাদা গাড়িতে সেন্ট্রাল সার্কিট হাউসে গিয়েছিলাম। সেন্ট্রাল সার্কিট হাউসের রুম খুলে দিয়ে হঠাৎই কেয়ারটেকার কেন যেন বলেছিলেন, ‘হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব ঢাকা এলে এই রুমে থাকতেন।’ শুনে সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। আল্লাহ কিনা পারেন। কোথায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা, আমার নেতারও নেতা, তার জন্য এক সময় বরাদ্দ রুমে আমার মতো নাদানের স্থান আল্লাহকে লক্ষ্য কোটিবার শুকরিয়া জানিয়েছিলাম। ঠিক তেমনি কক্সবাজার সার্কিট হাউসে এনডিসি তাহমিলুর রহমান যখন বলছিল ‘এই রুমে বঙ্গবন্ধু থাকতেন’ বুক ভারী হয়ে গিয়েছিল।

ঢাকায় থাকতেই শুনেছিলাম মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কক্সবাজারে প্রোগ্রাম আছে। তবে সেটা ১-২ তারিখ তা জানতাম না। আসাদুজ্জামান খান কামালও মনে হয় ৩০ তারিখে কক্সবাজার গিয়েছিলেন। কক্সবাজার পৌঁছে ফোন করেছিলাম। ছেলে-মেয়ে সঙ্গে সময় হলে দেখা করব। তিনি বলেছিলেন, ‘১ তারিখ একটা সময় করে নেব।’ ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী অন্যান্য লোকজন নিয়ে ১ তারিখ ১১টার দিকে সি-বিচে গিয়েছিলাম। সমুদ্রে নামবে তাই সবার হালকা পোশাক। আমার স্ত্রী এবং ছেলে দীপ সাঁতার জানে না, কুশি তো ১১ বছরের সেও জানে না। ওদেরকে নিয়ে বুক পানিতে ঢেউয়ের পর ঢেউ আসছিল। আমার স্ত্রী বছর বিশেক আগে একবার সমুদ্রে নেমেছিল। দীপ তখন ৮-১০ বছরের। কারও বোধহয় সমুদ্রের ঢেউয়ের অনুভূতি ছিল না। তবু বেশ আনন্দে গায়ে পানি লাগাচ্ছিলাম। ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী কেউ পানিতে ডুব দিতে জানে না। জোর করে কয়েকবার ডুব দেওয়াতে অনেকটা শিখে নিয়েছিল। আধা ঘণ্টা-চল্লিশ মিনিট ঝাঁপাঝাঁপি করে সবাই বেশ মজা পাচ্ছিল। আসলে সমুদ্র সমুদ্রই। তার অন্য কোনো ব্যাখ্যা বা তুলনা হয় না। সমুদ্রের পাড়ে এলে বোঝা যায় পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল। সব মানুষের অন্তত একবার সমুদ্র দেখা দরকার এবং তা জীবনের শুরুতেই দেখা দরকার। তাহলে সবাই না হোক কেউ কেউ সমুদ্রের মতো বিশাল হবে অনেকটা সংকীর্ণতা ভুলে যাবেন। বিচে তখন অনেক পুলিশ। প্রথম মনে করেছিলাম সব সময়ই অমন থাকে। কিন্তু পরে বুঝলাম না, কোথায় পুলিশ, ছিটেফোঁটা ২-১ জন। তবে তখন অত পুলিশ থাকার পেছনে কারণ ছিল সস্ত্রীক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেখানে গিয়েছিলেন সমুদ্রের গর্জন শুনতে, স্ত্রীকে নিয়ে সমুদ্রের বিশালতা দেখতে। আমরা চলে আসছিলাম। হঠাৎই সহকর্মী হাবিবুন নবী সোহেল বলছিল, ‘মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসেছেন।’ জিজ্ঞেস করেছিলাম, কোথায়? ‘ওই তো ওখানে ছাতার নিচে বসে আছেন।’ ছেলে-মেয়ে-স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলাম। একেবারে ভেজা কাপড়। জীবনে কারও সামনে অমন অবস্থায় খুব একটা যাইনি। আসাদুজ্জামান খান কামালের স্ত্রীকে বলেছিলাম, আপনি কি কখনো আমার মিষ্টি খেয়েছেন? দুজনই সমস্বরে বলেছিলেন, ‘ডায়াবেটিস থাকলেও অল্পবিস্তর খেয়েছি। সমুদ্রের পাড়ে দেখা হয়ে যাওয়ায় মাননীয় মন্ত্রীকে বলেছিলাম, আর আপনাকে বিব্রত করব না। দেখা তো হয়েই গেল। এক কাজে দুকাজ হয়ে গেল রথ দেখা, কলা বেচার মতো।’

ভেজা কাপড়ে গাড়িতে উঠে আমার স্ত্রী বলেছিল, ‘মনে হয় বউয়ের চাপে মাননীয় মন্ত্রী এখানে এসেছেন। মনে হয় স্ত্রীকে খুব বেশি সময় দিতে পারে না।’ বলেছিলাম, কথাটা মিথ্যে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনীতিতে তেমন প্রভাবশালী না হলেও লোকজনকে অসম্ভব সময় দেন। রাত দেড়টা-দুটো পর্যন্ত জাগেন। মাননীয় মন্ত্রীর পাশে এসপি ড. এ কে এম ইকবাল হোসেন ছিলেন। ২ তারিখ রাতে সার্কিট হাউসে গিয়েও অনেকক্ষণ কথা বলেছেন। ভদ্রলোককে বেশ ভালো লেগেছে। সেই তখনই এসপির সঙ্গে টাঙ্গাইল বাসাইলের আমার প্রিয় ফজু জমাদারের ছেলে এডিশনাল এসপি টুটুল এসেছিল। ছেলেটাকে আমি কোলে নিয়েছি। ওর সময় চট্টগ্রাম বোর্ডে এসএসসিতে প্রথম হয়েছিল। তাই ওকে সোনার মেডেল এবং একটা বাইসাইকেল দিয়েছিলাম। সেই ভাতিজা এখন একটা জেলার এডিশনাল এসপি। পরদিন আবার সমুদ্রে গিয়েছিলাম। কুশিমণির খুব ইচ্ছে সমুদ্রে যাওয়ার, সেখানে গোসল করার। ২ তারিখ তার সে আশা পূরণ হয়েছে। ঢেউ ছিল খুবই বেশি, গর্জন ছিল আরও বেশি। আমার এক ইঞ্জিনিয়ার চায়না মিস্ত্রি মজিবর খুব শখ করে আমাদের সঙ্গে গিয়েছিল। ঝাঁপাঝাঁপি করে ফেরার পথে মজিবরকে বলেছিলাম, শুধু কক্সবাজার সমুদ্রের যে ঢেউ আছড়ে পড়ে সেই ঢেউয়ের ঝুঁটি ধরে বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উত্পন্ন করা যেতে পারে। অবাক হয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। বলেছিলাম, এখানে শত শত বয়া বা বার্ডস এনে পাশাপাশি রাখলে রাতদিন যে উঠানামা করবে তাতে জেনারেটর বসিয়ে ওই উঠানামা থেকে যে বিদ্যুৎ তৈরি হবে তা বাংলাদেশে খরচ করার জায়গা পাবে না। শুনেছিলাম, আকাশে যে বিদ্যুৎ চমকায় তার একটার শত সহস্র ভাগের একভাগ কাজে লাগাতে পারলে দুনিয়ার পুরো বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ না হলেও একটা অংশের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। ছোট্ট ছেলে ১৮-১৯ বছর বয়স। চট করে বলেছিল, ‘এসব নিয়ে সরকারের কেউ চিন্তা করে না?’ চিন্তা নিশ্চয়ই করে। কিন্তু কাজ করে না। সমুদ্রের ঢেউয়ের ঝুঁটি ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে কার লাভ? নিশ্চয়ই দেশের লাভ। কিন্তু যারা করবে তাদের তো কোনো লাভ নেই। বছর বছর কমিশন পাবে না। একবার বার্ডস বসিয়ে যেভাবে বিদ্যুৎ উত্পন্ন হবে সেটা তো দীর্ঘ মেয়াদি হবে। বছর বছর নতুন নতুন বরাদ্দ পাওয়া যাবে না। তাই ওদিকে তেমন কারও আগ্রহ বা নজর নেই।

কক্সবাজার আমার খুবই প্রিয়। ’৭২-এর সেই আক্তার নেওয়াজ বাবুলকে পেয়েছিলাম। বড় ভালো মানুষ, পাগলের মতো আমায় ভালোবাসে। অ্যাডভোকেট জহুরুল ইসলাম কক্সবাজার আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে বিয়ের পর জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং ড. ওয়াজেদ মিয়া প্রথম কক্সবাজার এলে তাদেরকে বিয়ের উপহার হিসেবে দুই দরজার একটা মাজদা কার উপহার দিয়েছিলেন। ’৭৫-এ জহুরুল ইসলামের সঙ্গে গভর্নর ছিলাম। তাদের আমন্ত্রণে কক্সবাজার বিজয়মেলায় গেছি। কত কথা কত স্মৃতি। ’৭২-’৭৩ সালে আজকের মতো এত ঘর-বাড়ি ছিল না। সমুদ্রের একেবারে পাড়ে পর্যটনের দুটো মোটেল বা লজ শৈবাল, প্রবাল ছিল। এখন কত কী!

গতকাল ৩ তারিখ বৃষ্টি মাথায় করে রাতে ঢাকা রওনা হয়েছিলাম। সেই কক্সবাজার থেকেই বৃষ্টি আর বৃষ্টি। ঘণ্টা তিনের রাস্তা সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা লেগেছে। লেখা যখন বেরুবে আমি তখন ঢাকায়। আমার স্ত্রীর আবার স্যান্ডেল কিনার বাতিক। ছেলেমেয়ে নিয়ে বেগম বাজারে গিয়েছিল সেসব কিনতে। মনে হয় দু-একজন সরকারি লোক সঙ্গে ছিল। তারা গিয়ে যেই দোকানিকে বলেছে, ‘বঙ্গবীরের জন্য বাজার করতে এসেছি। তার ছেলেমেয়েরা কিছু কিনবে। একটু ভালো জিনিস দিন।’ স্ত্রী ফিরে এসে পাশে বসে বলেছিল, ‘সরকারি লোক তোমার কথা বলতেই দোকানি বলছিল, বঙ্গবীরের কথা আর বলবেন না। ভালো মানুষ আউট, খারাপ মানুষ ইন। বঙ্গবীরের কথা বলে মন খারাপ করে দিলেন। দেখেন কী কী নিবেন।’ দোকান থেকে ফিরে বেগম বারবার বলছিল, রাস্তাঘাটে মানুষ খুশি না। সবার মধ্যে কেমন যেন অস্বস্তি।

কক্সবাজার গিয়েছিলাম প্রায় ১২-১৩ বছর পর। এক ধনী বন্ধু প্লেনের টিকিটের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাকে বলেছিলাম, প্লেনে নয়, ট্রেনে যাব। প্রায় ১০ বছর পর রেলে যাব। তাই রেলের ডিজি মো. আমজাদ হোসেনকে চিটাগাং সফরের কথা বলতেই তিনি টিকিটের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাইওয়ানের নতুন গাড়ি বেশ ভালো লেগেছে। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে মিল রেখে চলেছিল এবং পৌঁছেছিল। ট্রেন জার্নি ভালো হলে মানুষের উপকার হবে। কমলাপুর এবং চট্টগ্রাম স্টেশনে রেলের লোকেরা অভাবনীয় যত্ন করেছেন। ট্রেন থেকে নেমে সার্কিট হাউসে উঠেছিলাম। এক সপ্তাহ আগে চট্টগ্রামের ডিসি মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরীকে চিঠি দিয়েছিলাম। রওনার আগে ফোন করে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলাম। এক-দুই রিংয়ের বেশি প্রয়োজন হয়নি, ডিসি ধরেছিলেন। নাম বলতেই তিনি বলেছিলেন, ‘আপনার চিঠি পেয়েছি। চলে আসুন স্যার, কোনো অসুবিধা হবে না। আপনি এলে সেবা করতে পারলে ধন্য হবো।’ কিছু সময় সেখানে বিশ্রাম করে ছেলে-মেয়ে নিয়ে পেকুয়ার পথ ধরেছিলাম। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের জন্যে গাড়ি দিয়েছিলেন পরম সুহৃদ মেজর (অব.) আবদুল মান্নান। সেই গাড়িতেই কক্সবাজার যাওয়া-আসা। ভাতিজির শ্বশুর বাড়ি পেকুয়া পৌঁছে কক্সবাজারের ডিসি মো. আলী হোসেনকে ফোন করেছিলাম। ডিসি বলেছিলেন, ‘স্যার, আপনার চিঠি পাইনি। কিন্তু আপনি আসুন। কক্সবাজারে আপনার জায়গা না হলে আমাদের মরে যাওয়া ভালো।’ ভদ্রলোক মাগরিবের আগে এসে কথা বলে গেছেন। কেরানীগঞ্জের মানুষ বেশ ভালো জানাশোনা মনে হলো। এ কদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কক্সবাজার ছিলেন। ছিলেন মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। ভদ্রলোক ’৯৬-এ টাঙ্গাইলে ছিলেন। কবি মানুষ। খুবই মিষ্টিভাষী সুন্দর চেহারা। গত বছর তার জন্মদিনে ফোনে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। এবার জন্মদিন পার হয়ে গেছে কিনা জানি না। মনে হয় তারা কক্সবাজারে ছিলেন বলে সরকারি কর্মচারীরা সবাই ভীষণ ব্যস্ত ছিল। তার মধ্যেও অভাবনীয় যত্ন পেয়েছি। আমরা খুব বেশি আর কী চাই। যতক্ষণ বেঁচে আছি যাতে মানসম্মানে চলতে পারি তার চাইতে বেশি কিছু আশা করি না। তবে এত বছর পর এদিকে এসে বড় বেশি হতাশ হলাম। কর্ণফুলীর পর এদিকে রাস্তাঘাটের কোনো উন্নতি হয়নি। যেমন হয়েছে বিএনপির সময় বগুড়ায়, আওয়ামী লীগের সময় গোপালগঞ্জ ফরিদপুরে।

     লেখক : রাজনীতিক।

সর্বশেষ খবর