বুধবার, ৫ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

রাজনীতিবিদ যান জেলখানায়, আমলা যান ক্ষমতায়

পীর হাবিবুর রহমান

রাজনীতিবিদ যান জেলখানায়, আমলা যান ক্ষমতায়

ঈদের ছুটিতে নাড়ির টানে এক কোটিরও বেশি মানুষ বাড়ি ছুটে গিয়েছিল। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর এবার উদযাপিত হয়েছে অনেক শান্তিপূর্ণ, আনন্দ, উৎসবমুখর পরিবেশে। ঈদের ফাঁকা ঢাকায় ঘুরে বেড়াতে গেলে মনে হয়েছে পশ্চিমা কোনো দেশের রাজধানীর বাইরের কোনো এলাকায় আছি। মাঝে মাঝে রক্তের সম্পর্কের চেয়েও আত্মার সম্পর্ক অনেক বড় হয়ে ওঠে।  তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান ও বরেণ্য রাজনীতিবিদ মরহুম মিজানুর রহমান চৌধুরী রসিকতা করে বলেছিলেন, আত্মীয়তা হলো শবযাত্রা ও বরযাত্রায়। মানে বিয়ের সময় এবং মৃত্যুর সময় সব আত্মীয়স্বজন এসে সমবেত হন। জীবনের পুরোটাই কাটে আত্মার বাঁধনে জড়ানো মানুষদের সঙ্গে।

মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, রক্ত সম্পর্কীয় এবং আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক যদি আত্মার না হয়, তাহলে সেই সম্পর্ক এক ধরনের আবেগহীন, মায়া-মমতাহীন, শিথিল সামাজিক বন্ধনে রূপ নেয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে বন্ধুবান্ধবের বাইরেও অনেকের সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এদের কেউ ছোট, কেউবা বড়। আমি দীর্ঘপথ হেঁটেছি যাদের সঙ্গে তাদের দুজন শিল্পী এসএম সুলতানের শহর চিত্রা নদীর তীরের নড়াইলের সাইফুর রহমান হিট্টু ও আকরাম খান দিলু আমার অন্যতম বন্ধু। এই দুই পরিবারেরই সদস্য আমি। তাদের পিতা-মাতার কাছে আমি পেয়েছি গভীর স্নেহ। এদের বাড়ির দরজা আমার জন্য সব সময় খোলা।

আমার বৃষ্টি-জোছনা ও জলের রাজধানী সুনামগঞ্জের পর যে শহর খুব প্রিয় সেটি নড়াইল। সুনামগঞ্জের মতোই নড়াইলের মানুষ অতিথিপরায়ণ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনে বাঁধা। সুনামগঞ্জে হাছন উৎসব হয়, লোকোৎসব হয়। ওখানে হয় সুলতান মেলা। সুলতান মেলায়ও দুবার তারা আমাকে অতিথি করে নিয়েছিল। পার্থক্য হলো এক সময় ওখানে চরমপন্থিদের তৎপরতা ছিল, আমাদের এখানে চরমপন্থিরা ঠাঁই পায়নি।

রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, অসুস্থ সংস্কৃতি বাংলাদেশের সব জেলায় যে উন্মত্ত আঁচড় বসিয়েছে তাতে সাদাকালো যুগের নির্মল পরিবেশ অনেকটাই ধূসর হয়ে গেছে। এই নড়াইলের প্রাণোচ্ছ্বল ছোট বোন কামরুন নাহার খুশি আইন বিভাগে পড়ত। সেই সময় থেকেই অত্যন্ত মিশুক, দিলখোলা, বড় মনের, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন খুশি আমার স্নেহ কুড়িয়েছিল। তাদের ডিপার্টমেন্টে এক বছর পর আমার ছোট ভাই মিসবাহ ভর্তি হলে তাদের দুজনের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল গভীর বন্ধন। সেই খুশির পরিবারের সঙ্গেও আমার পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নিউইয়র্ক প্রবাসী খুশির বর শাহাদাত হোসেন একজন শিক্ষক, মার্জিত, রাজনৈতিক সচেতন, প্রাণখোলা মানুষ। যতবার নিউইয়র্ক যাই, বোনের স্নেহ নিয়ে বাড়ির দরজা খুলে রাখে খুশি। সন্তানরাও তার মেধাবী। সেও শিক্ষকতা করে একটি স্কুলে। ঈদের দুদিন পর সে তার দুই বোন, তাদের সন্তান ও ভগ্নিপতি নিয়ে সুনামগঞ্জ বেড়াতে গিয়েছিল। বাড়ির সবাইকে আপন করে ফিরে এসেই মঙ্গলবার সকালে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে আকাশে উড়ছে। আমার ছেলেমেয়েরাও তাকে পেলে ফুপি, ফুপি বলতে পাগল হয়ে ওঠে।

ঢাকায় ফিরে প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ‘জাতীয় সংসদে শেখ সেলিমের ৩৪ বছর’ গ্রন্থটি হাতে পেয়েছি। ৫২০ পৃষ্ঠার গ্রন্থটিতে ১৯৭৯ সাল থেকে কখনো সর্বোচ্চ ভোটে কখনো বা বিপুল ভোটে গোপালগঞ্জ সদর থেকে টানা সাতবার বিজয়ী এই পার্লামেন্টারিয়ান সংসদে দেওয়া তার বক্তব্যগুলো নিয়ে এ বইটি প্রকাশ করেছেন। এমন প্রকাশনাকে ভবিষ্যৎ পার্লামেন্টারিয়ান বা রাজনীতিবিদদের জন্য এক শুভ উদ্যোগ। বর্তমান সংসদ মানুষের আগ্রহের জায়গায় না থাকলেও এবং নির্বাচিত সংসদ প্রশ্নবিদ্ধ হলেও আমাদের জনগণের আকুতির জায়গা সংসদীয় গণতন্ত্র। সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ও কার্যকর রূপটাই জনগণের প্রবল আকুতির জায়গা, সেটিই সত্য। আমাদের সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা দীর্ঘ সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের ফসল। জনগণ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য জীবন দিতে কখনো কার্পণ্য করেননি। কিন্তু একটি উদার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কার্যকর করতে সব শাসকই কার্পণ্য করেছেন।

আমাদের রাজনীতিবিদরা মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে সুমহান মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গৌরবময় নেতৃত্ব দিয়েছেন। রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। কিন্তু সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী না করতে পারা, সুশাসন ও জবাবদিহিমূলক সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে না পারার অভিযোগে বরাবর অভিযুক্ত হয়ে আসছেন।

প্রতিটি ক্ষমতার পালাবদলে রাজনীতিবিদরাই মামলায় পড়েছেন, জেল খেটেছেন, গণমুখী চরিত্র তবুও তারা হারাননি। মানুষের জন্য সকাল-রাত বাড়ির দরজা খুলে রাখার ধারাটি তারা অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু স্থানীয় সরকার থেকে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী না করার নেপথ্যে দলীয়করণের মনোভাব বেশি কাজ করেছে নাকি আমলাতন্ত্রের একচ্ছত্র ক্ষমতা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, সেটি তারা কখনো খতিয়ে দেখেন না। আমলারা দাপুটের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাঁধে ভর করে অগাধ ক্ষমতা ভোগ করে যান।

অবসরে গিয়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের নামে বাড়তি বোনাস জীবনযাপন করেন। সেটিও যদি শেষ হয়ে যায়, রাজনীতিবিদরা রাজনীতির ময়দানও তাদের জন্য খুলে দেন। তারা আসেন, রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন নেন, আমলাতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে রাজনৈতিক দলের প্রতি হৃদয় নিঃসৃত আবেগ-অনুভূতি থাক বা না থাক ছাত্রজীবনে ছাত্র রাজনীতির অভিজ্ঞতা না-ই থাকুক, তারা নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রী নেতাও হয়ে যান। সেনাশাসকরা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক আমলাদের জন্য রাজনীতিতে যে জায়গা করে দিয়েছিলেন, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোও সেই ধারা লালন করেছে।

যে কারও রাজনীতি করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে এসব আমলা বা ব্যবসায়ীরা উঠে না এলে তার নেতিবাচক প্রভাব রাজনীতির গৌরবের মহিমাকে ম্লান করে দেয়। রাজনীতিটা পরীক্ষিত, আদর্শিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ে না থাকলে রাজনীতির বদলে রাজদুর্নীতির যে উল্লাস চলে সেটিও তখন তারা আর সামাল দিতে পারেন না। কিন্তু সরকার বদলের সঙ্গে রাজনীতিবিদদেরই প্রতিহিংসার ছোবলটি খেতে হয়। বিষের তীরে তাদেরই ক্ষতবিক্ষত হতে হয়। সেই মামলা ও জেলযাত্রায় আমলারা আর সঙ্গী হন না।

শেখ ফজলুল করিম সেলিম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নেই নন, ষাটের ছাত্ররাজনীতির একজন সক্রিয় কর্মী। ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনের নেতা মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রধান, যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণির সহোদর। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে যে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল, সেই সময় তাদের বাড়িতেও খুনিরা আক্রমণ চালায়। শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণির সঙ্গে তাকেও দাঁড় করিয়ে খুনিরা গুলি করেছিল। অলৌকিকভাবে গায়ে গুলি না লাগায় তিনি বেঁচে যান। মেঝেতে পড়ে যাওয়ায় ঘাতকরা মনে করেছিল, তিনিও শেষ। ভাই-ভাবীদের নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছার আগেই তারা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সেই দুঃসময়ে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় ও পরে দেশে ফিরে এসে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে সক্রিয় করেন এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে দলের নেতৃত্বে অভিষিক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য অনেকের সঙ্গে ভূমিকা রাখেন।

১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের মোল্লা জালাল উদ্দিন আহমেদ ইন্তেকাল করলে ১৯৮০ সালের ১৩ মার্চ গোপালগঞ্জ সদর আসনের উপনির্বাচনে তৎকালীন সেনাশাসক জিয়াউর রহমানসহ বিএনপির মন্ত্রী নেতারা আসন দখলে মরিয়া হলেও শেখ সেলিম বিপুল ভোটে জয়লাভ করে আসেন। আওয়ামী লীগ রাজনীতির সেই দুঃসময়ে এবং স্বৈরশাসন কবলিত বাংলাদেশে ১৯৮০ সালের ২০ জুন শেখ ফজলুল করিম সেলিম সংসদে বাজেটের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে যে বক্তব্য দেন, সেটি সবাইকে আলোড়িত করেছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘এই বাজেট এমন সময় পেশ হয়েছে যখন দেশ মারাত্মক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটের ভিতর দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে।’ তিনি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর নেমে আসার চিত্র তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘আমরা সবাই রাজনীতি করি, রাজনীতি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু সেই রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর বা পটপরিবর্তনকে কেন্দ্র করে যদি রাজনৈতিক নেতাদের জীবনে নির্মম পরিণতি নেমে আসে, আত্মীয়স্বজন, সন্তানদের জীবন দিতে হয়, তাহলে সেই রাজনীতি দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না।’ তিনি ১৫ আগস্ট পরিবার-পরিজনসহ বঙ্গবন্ধুকে এবং ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের বেদনাবিধুর চিত্রপট তুলে ধরে বলেন, ‘জাতীয় জীবনে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মর্মান্তিক ঘটনা আর কী হতে পারে?’ তিনি পরিষ্কার বলেন, ‘দেশে সরকার আছে, প্রচলিত আইন আছে। দেশে সামান্য একটা খুন হলে তার তদন্ত হয়, তার বিচার হয়। কিন্তু জাতীয় জীবনের এমন একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল, আজ পর্যন্ত তার তদন্ত হলো না, তার বিচার হলো না, শুধু তাই নয়; যারা সেদিন এই হত্যার দায়দায়িত্ব স্বীকার করে নিয়েছিল, সেসব হত্যাকারীকে আজ বিদেশে বিভিন্ন দূতাবাসে সরকার চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছে।’

শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ‘গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল, মানবতার প্রতি বিবেকসম্পন্ন, ন্যায়-নিষ্ঠার প্রতি অনুগত, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল কোনো গণতান্ত্রিক সরকার জাতীয় জীবনে এমন একটি মর্মান্তিক ঘটনাকে এড়িয়ে যেতে পারে না।’ তিনি সেদিন পরিষ্কার বলেছিলেন, ‘আমি সরকারকে বলব, দায়দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়ে রক্ষা হবে না। ইতিহাস একদিন এই সত্যকে উদ্ধার করবে এবং বাংলার মাটিতে এই হত্যাকারীদের বিচার হবে।’

সেই সময় আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন আবদুল মালেক উকিল। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবদুর রাজ্জাক ও সাংগঠনিক সম্পাদক তোফায়েল আহমেদ। আওয়ামী লীগের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছিল আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদকে মধ্যমণি করে। দলের অভ্যন্তরে দুটি ধারা বইছিল। বড় ধারাটি ছিল আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে। সেই ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে সেনাশাসকদের ছকে নোয়াখালী থেকে আবদুল মালেক উকিল ও ভোলা থেকে তোফায়েল আহমেদকে জয়ী হয়ে আসতে দেওয়া হয়নি। আবদুর রাজ্জাক নির্বাচন করেননি। সংসদে বিরোধী দলের নেতা হয়েছিলেন মরহুম আসাদুজ্জামান খান ও বিরোধী দলের উপনেতা হয়েছিলেন মহিউদ্দিন আহমেদ। সেই সংসদে অনেক অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ানের উপস্থিতি ছিল অলঙ্কারশোভিত।

রাজনৈতিক দর্শন যাই থাক, শাহ আজিজুর রহমান, সবুর খান এবং মিজানুর রহমান চৌধুরীর মতো বরেণ্য পার্লামেন্টারিয়ানরা ছিলেন। তারুণ্যের শক্তি নিয়ে আলোকিত হয়েছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, রাশেদ খান মেনন ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। সেই সময় সংসদে নবীন সদস্য হয়ে শেখ ফজলুল করিম সেলিম ছিলেন সরব। আমাদের দেশে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে অনেক নেতা নায়কের ভূমিকায় আলোকিত হয়েছেন। সংসদ অনেক পার্লামেন্টারিয়ানের জন্ম দিয়েছে কিন্তু শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বইটি পাওয়ার পর আমার মনে হয়েছে, এদেশের রাজনীতির অনাগত প্রজন্মের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার জন্য পার্লামেন্টে যারা আসছেন তাদের যেমন সংসদ লাইব্রেরিতে নিয়মিত যাওয়া উচিত, তেমনি অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ানদের সংসদে রাখা বক্তব্য বই আকারে প্রকাশ করা উচিত। সংসদ নেতা, বিরোধী দলের নেতা, আলোচিত পার্লামেন্টারিয়ান ও স্পিকারদের অবশ্যই বই লিখে যাওয়া উচিত। এমনকি সংসদীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদেরও তা করা উচিত।

সুনামগঞ্জে এখন বর্ষায় নদী ও হাওরে যৌবনে স্রোত। সবাইকে নিয়ে জলাধারে ভাসতে ভাসতে আকাশের মেঘ ও কানলার হাওর পাড়ি দিতে দিতে পাহাড়ের হাতছানি মুগ্ধ করেছে। রাতের বারান্দায় তুলিকা, রঞ্জন ও পল্লবের গান; সেই সঙ্গে নেমে আসা মুষলধারে বৃষ্টি চিত্তের সুখ দিয়েছে। সে রাতেই শুনলাম, এবার হাওরের ফসলহানির ঘটনায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী, কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে দুদকের মামলায় অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন। এ ব্যবস্থা গ্রহণে মানুষ যেমন খুশি হয়েছে, তেমনি দুটি প্রশ্ন উঠেছে— অপরাধীদের সঙ্গে অনেক নিরপরাধ ঠিকাদারের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে ডাকাতের পাশে সাধুদের কেন কাতারবন্দী করা হয়েছে? অন্যদিকে, এমপিদের মনোনীত প্রতিনিধি যারা কাজ করেছিলেন, তাদের কারও বিরুদ্ধে কেন মামলা নেই?

ঢাকায় ফিরতেই খবর পেলাম সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীতে বিচারপতি অপসারণের যে ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল তা খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। সংসদ বলছে, ’৭২-এর সংবিধানের আলোকে তারা এটি এনেছিলেন। ১৯৭২ সালের সংবিধানে সংসদের হাতেই এ ক্ষমতা ছিল। যারা ’৭২-এর সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন এবং কথায় কথায় ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলেন, সেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামরা আদালতে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে সংসদ নয়, বিচার বিভাগের হাতেই এই ক্ষমতা রাখার পক্ষে মতামত দিয়েছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল ’৭২ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি স্বাধীন দেশে বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠান হিসেবে তখনো দাঁড়াতে পারেনি। আজকে সে অবস্থা নেই। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতেই আসবে।  কিন্তু সেই কাউন্সিল এখনো গঠিত হয়নি। সংসদ সদস্যরা যেমন দলের বাইরে যেতে পারেন না, তেমনি বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের চেয়ে যখন যারা ক্ষমতায় তাদের দলীয় হার্ডলাইনের আইনজীবীদেরই বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সংসদ থেকে বিচার বিভাগ কোনোটিই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। উচ্চ আদালতের এই রায়ে সরকার হোঁচট খেলেও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিচার বিভাগ যে স্বাধীন তার উত্কৃষ্ট উদাহরণ এই রায়। পর্যবেক্ষকরা বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।  সংসদের অধিবেশন বসলেই হয়তো এ বিষয়ে বিস্তর আলোচনা হতে পারে। তবে জনগণের আকাঙ্ক্ষার জায়গা হচ্ছে, শক্তিশালী,  জবাবদিহিমূলক, কার্যকর সংসদ এবং স্বাধীন-সাহসী বিচার বিভাগ।

 

     লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর