বুধবার, ৫ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

তৈমুরের মৃত্যুদণ্ড ও ব্লাসফেমি

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

সোশ্যাল সাইট ফেসবুকে ইসলাম ধর্মের সমালোচনা করায় তৈমুর নামক এক ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে পাকিস্তানের সন্ত্রাস দমন আদালত। পাকিস্তানের অপরাধ ইতিহাসে এই প্রথমবার কোনো ব্যক্তি ফেসবুকে ধর্ম নিয়ে মন্তব্য করার জন্য শাস্তি পেলেন, তাও মৃত্যুদণ্ড। গ্রিক শব্দ ‘ব্লাসফেমেন’ থেকে ব্লাসফেমি শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ ‘ধর্ম নিন্দা’ বা ‘ঈশ্বর নিন্দা’। এককথায় কারও ওপর অপবাদ বা কলঙ্ক আরোপ করা বা সম্মানে আঘাত করা। তবে ব্লাসফেমি বলতে প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি অসম্মান বোঝায়। কোনো ব্যক্তি এসব অপরাধ করলে যে আইনে তার বিচার করা হয়, সেটাকেই ব্লাসফেমি আইন বলে।

প্রাচীন ও মধ্যযুগে ইউরোপে ব্লাসফেমির উদ্ভব হয়েছিল। সে সময় রাজা-বাদশাদের বলা হতো ঈশ্বরের প্রতিনিধি, তাই রাজাদের বিরুদ্ধে কিছু বলা মানে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বলা, এভাবে রাজার অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলন যাতে গড়ে না উঠতে পারে সে জন্য ওই সময় ব্লাসফেমি নামের এ কালো আইন তৈরি হয়েছিল। ইউরোপে সর্বপ্রথম এ আইনের প্রবর্তন করা হয়। বর্তমানে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সোমালিয়া, মালয়েশিয়াতে ব্লাসফেমি আইন চালু রয়েছে।

ধর্ম অবমাননা কিংবা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অপরাধগুলো আমাদের বিদ্যমান আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে বহু আগে থেকেই। উনবিংশ শতকে প্রণীত দণ্ডবিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধির আইনের বিভিন্ন ধারায় ধর্ম অবমাননার যে শাস্তি ছিল ২০০৬ সালে এসে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে সেই সাজা বৃদ্ধিও করা হয়েছে।

বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনের ২৯৫ক ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অসদুদ্দেশ্যে লিখিত বা মৌখিক বক্তব্য দ্বারা কিংবা দৃশ্যমান অঙ্গভঙ্গি দ্বারা সংশ্লিষ্ট ধর্মটিকে বা কারও ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি অবমাননা করে বা অবমাননার চেষ্টা করে, সে ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তিকে দুই বছর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড কিংবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, ১৮৬০ সালের মূল আইনে এ ধারাটি ছিল না। পরবর্তীতে ১৯২৭ সালে এক সংশোধনীর মাধ্যমে এ ধারাটি যুক্ত করা হয়।

১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৯ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সংবাদপত্র যদি রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কিছু বা এমন কিছু প্রকাশ করে যা নাগরিকদের মধ্যে শত্রুতা ও ঘৃণা তৈরিতে উসকানি দেয় কিংবা ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত হানে, সে ক্ষেত্রে সরকার ইচ্ছা করলে ওই সংবাদপত্রের সংশ্লিষ্ট কপিগুলো বাজেয়াপ্ত করতে পারে। তবে সরকারি এ আদেশের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ইচ্ছা করলে হাই কোর্ট বিভাগে আবেদন করতে পারবেন।

২০০৬ সালে প্রণীত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় ইলেক্ট্রনিক ফরমে মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানিকর তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধ ও তার দণ্ড বলা হয়েছে। উল্লিখিত ধারা অনুসারে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করে, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি দান করা হয়, তাহলে তার এ কাজ হবে একটি অপরাধ। কোনো ব্যক্তি এ অপরাধ করলে অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।

১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ১৯তম ধারায় বাকস্বাধীনতার অধিকার দেওয়া হলেও ১২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘কাউকে তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, পরিবার, বসতবাড়ি বা চিঠিপত্রের ব্যাপারে খেয়ালখুশি মতো হস্তক্ষেপ অথবা সম্মান ও সুনামের ওপর আক্রমণ করা চলবে না। ২৯-এ বলা হয়েছে, ‘স্বীয় অধিকার ও স্বাধীনতাগুলো প্রয়োগকালে প্রত্যেকেরই শুধু ওই ধরনের সীমাবদ্ধতা থাকবে, যা কেবল অন্যের অধিকার ও স্বাধীনতাগুলোর যথার্থ স্বীকৃতি ও শ্রদ্ধা নিশ্চিত করে...।’

১৯৬১ সালের নভেম্বরে গৃহীত মানবাধিকার কনভেনশনের ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বাক ও চিন্তার স্বাধীনতাকে সমর্থন দেওয়ার পাশাপাশি বলা হয়েছে, ‘স্বাধীনতা নিঃশর্ত বা চূড়ান্ত নয়। বাকস্বাধীনতা ব্যক্তির মর্যাদা, জনগণের মূল্যবোধ ও শৃঙ্খলার প্রতি আক্রমণাত্মক হতে পারবে না। বাকস্বাধীনতা শর্তহীন নয় বলেই প্রতিটি দেশেই আদালত অবমাননা আইন প্রবর্তিত হয়েছে। এটা স্পষ্ট যে, যা ইচ্ছা তা-ই বলে যাওয়া, লিখে যাওয়া, দেখামাত্র কাউকে গালাগাল দেওয়া বাকস্বাধীনতা হতে পারে না। বাকস্বাধীনতা মানে মিথ্যাচার নয়, বিদ্বেষ ছড়ানো বাকস্বাধীনতা নয়। বাকস্বাধীনতা মানে সত্য বলার অধিকার।’

অথচ সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র, অনুচ্ছেদ-১৮তে বলা আছে, প্রত্যেকেরই চিন্তা, বিবেক ও ধর্মের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। নিজ ধর্ম অথবা বিশ্বাস পরিবর্তনের স্বাধীনতা এবং একাই অথবা অপরের সঙ্গে যোগসাজশে ও প্রকাশ্যে বা গোপনে নিজ ধর্ম বা বিশ্বাস শিক্ষাদান, প্রচার, উপাসনা ও পালনের মাধ্যমে প্রকাশ করার স্বাধীনতা এ অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও গবেষক।

Email:[email protected]

সর্বশেষ খবর