শুক্রবার, ৭ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

এখন থেকেই কি পারি না মৃত্যুর প্রস্তুতি নিতে

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

এখন থেকেই কি পারি না মৃত্যুর প্রস্তুতি নিতে

‘কুল্লুু নাফসিন জা ইকাতুল মাওত।’ ‘প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে।’ সৃষ্টির শুরু থেকেই আল্লাহতায়ালা এ নিয়মে বেঁধে রেখেছেন তার সব সৃষ্টিকে। মৃত্যুর সুধা প্রত্যেক মানুষকেই পান করে কবরঘরে প্রবেশ করতে হবে।

এ মৃত্যু থেকে বাঁচা বা পালানোর কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহ বলেন, কুল ইন্নাল মাওতাল্লাজি তাফিররুনা মিনহু, ফাইন্নাহু মুলাকিকুম। অর্থ, ‘হে নবী! মানুষকে জানিয়ে দাও যারা মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়ায়, একদিন মৃত্যু এসেই তাদের সঙ্গে মোলাকাত করবে।’ যখন কারও নির্ধারিত সময় এসে পড়বে তখন এক মুহূর্ত আগ-পিছ হবে না। নির্দিষ্ট সময়েই তাকে সাড়া দিতে হবে মৃত্যুর ডাকে।

আমরা যখন মায়ের পেটে ছিলাম তখন আমাদের ছোট্ট দেহে রুহু ফুঁকে দেওয়া হয়েছিল। এ রুহুই আসল জীবন। দেহ খাঁচা ছেড়ে যখন রুহু পাখি চলে যায় তার আপন দেশে তখনই আমরা বলি মানুষটি মরে গেছে। আসলে মানুষটি মরেনি। মরেছে তার মাটির দেহ। রুহু ছাড়া দেহের কীইবা মূল্য! তাই তো রুহুহীন দেহের নাম রাখা হয়েছে ‘লাশ’। আরবি লাশ শব্দটি ‘লা শাইউন’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এর অর্থ ‘কিছুই না’। রুহু ছাড়া দেহ যে আসলেই কিছু নয় বিষয়টি চমৎকারভাবে ছন্দের ফ্রেমে বন্দী করেছেন বিশিষ্ট ধর্মচিন্তাবিদ ও সুফি ছড়াকার হাফেজ আহমাদ উল্লাহ। ‘দেহ নৌকায়/রুহু ভাসে,/তাই তো মানুষ/কাঁদে হাসে।/দেহ নৌকায়/ রুহু নাই,/কারও আহা/উঁহু নাই।’

বলছিলাম, রুহুই আসল জীবন। রুহু চলে গেলে আমাদের এ ক্ষণস্থায়ী জীবন শেষ হয়ে যাবে। শুরু হবে অনন্ত আখিরাতের জীবন। এ কথা বোঝানোর জন্যই যুগে যগে লক্ষাধিক নবী-রসুল পাঠিয়েছেন আল্লাহ রব্বানা। সর্বশেষ আসমানি গ্রন্থ আল কোরআনের প্রায় এক তৃতীয়াংশজুড়েই আখিরাতের জীবনের আলোচনা করা হয়েছে খোলাখুলিভাবে। যুক্তিতর্কের মানদণ্ডে প্রমাণসহ বলে দেওয়া হয়েছে, একদিন এ পৃথিবী ছেড়ে সবাইকে চলে যেতে হবে আরেক পৃথিবীতে। যার শুরু আছে, শেষ নেই। সেই অনন্ত জীবনে সুখে-শান্তিতে থাকার জন্যই এই অল্প দিনের পৃথিবীতে আল্লাহর আদেশ মেনে চলতে হবে।

এ পৃথিবী ছেড়ে ওই পৃথিবীতে যাওয়ার জন্য আল্লাহতায়ালা একটি বাহনের ব্যবস্থা করেছেন। সেই বাহনটির নামই মৃত্যু। মৃত্যুর বাহনে চড়ে আমরা কবর হয়ে চলে যাব চিরশান্তিময় জান্নাতে। যারা দুনিয়ার জীবনে আল্লাহর আদেশমতো চলেনি তাদের জন্য কিন্তু বিষয়টি সহজ নয়। মৃত্যু থেকে শুরু করে কবর, হাশর, পুলসিরাতসহ প্রতিটি স্টেশন তাদের জন্য কঠিন থেকে কঠিন হতে থাকবে। বদনসিব যারা তারা জান্নাতের বদলে চির-আজাবের স্থান জাহান্নামে চলে যাবে।

আমরা যদি জাহান্নাম থেকে বাঁচতে চাই, চিরশান্তির জান্নাতে যেতে চাই তবে আমাদের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। মৃত্যুর পরের জীবনের কথা ভেবে প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলতে হবে। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘বুদ্ধিমান তো সে-ই, যে মৃত্যুর কথা ভাবে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য কাজ করে।’ এমন ব্যক্তি মৃত্যুতে বিচলিত হয় না, ভয় পায় না। বরং মৃত্যুকে মনে করে খোদার পক্ষ থেকে এক মহাপুরস্কার। কেননা মৃত্যুর বাহনে চড়েই তো সে তার প্রিয়তম আল্লাহর বাড়িতে যাবে, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে! মুসনাদে আহমাদে আল্লাহর বন্ধু হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর মৃত্যুর ঘটনা বলা হয়েছে। মৃত্যুর ফেরেশতা হজরত আজরাইল (আ.) তার রুহু কবজ করতে এলে তিনি বললেন, ‘তুমি কার নির্দেশে এসেছ?’

‘আল্লাহর নির্দেশে।’

‘আচ্ছা, বলো তো কোনো বন্ধু কি তার বন্ধুর রুহু কবজের নির্দেশ দিতে পারেন?’  ইবরাহিম নবীর প্রশ্ন শুনে আজরাইল ফেরেশতা ঘাবড়ে গেলেন। আল্লাহতায়ালা আজরাইলকে বললেন, ‘আমার বন্ধুকে জিজ্ঞাসা কর— কোনো বন্ধু কি তার বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে অপছন্দ করবে? মৃত্যু বাহনে না চড়ে তো ইবরাহিম আমার বাড়ি আসতে পারবে না।’ এবার ইবরাহিম (আ.)-এর হৃদয়ে আল্লাহ-প্রেমের ঢেউ জেগে উঠল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘ভাই আজরাইল! আর এক মুহূর্তও দেরি করো না। এক্ষুনি আমার রুহু পাখিকে দেহ খাঁচা থেকে মুক্ত করে প্রেমময় আল্লাহর বাড়ি নিয়ে চল।’ এই হলো মৃত্যুসচেতন মানুষের অবস্থা। আর যারা মরণকে ভুলে লাগামহীন জীবনযাপন করে বেড়ায় তাদের কোরআন বলে দিয়েছে, ‘হাত্তা ইজাজা আআহাদাহুমুল মাওতু, কালা রাব্বির জিউন। লাআল্লি আমালু সালিহান ফিমা তারাকতু। কাল্লা, ইন্নাহা কালিমাতুন হুয়া কা-ইলুহা।’ অর্থ, মরণভোলা মানুষের কাছে যখন মৃত্যু এসে পড়বে তখন সে বলবে, ‘হে আল্লাহ! মৃত্যুকে আমার থেকে ফিরিয়ে নিন। আমাকে আবার আমার জীবন-সময় ফিরিয়ে দিন। যাতে বেশি বেশি ভালো কাজ করে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিতে পারি। এত দিন আমি মরণকে ভুলে থেকে, মরণের প্রস্তুতি না নিয়ে কী ভুলই না করেছিলাম হে আল্লাহ!’ হে দুনিয়ার মানুষ শোনো! মরণভোলা মানুষটি এখন যা বলছে, এটা কখনই হওয়ার নয়। আর এক মুহূর্তও তাকে দেওয়া হবে না। মরণ তো একদিন আসবেই। যদি আমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিই তবে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর মতো হাসিমুখে মরণকে বরণ করতে পারব। আর যদি মৃত্যুকে ভুলে দুনিয়ার রঙে ডুবে থাকি তখন মরণ আসামাত্রই ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ আরজি জানাতে হবে আল্লাহর দরবারে। অথচ আমাদের সামনে কত অফুরান সময় পড়ে রয়েছে। আমরা কি পারি না এখন থেকেই মরণের প্রস্তুতি নিতে? আখিরাতমুখী জীবন গড়তে?

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর