সোমবার, ১০ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

রাজনীতিতে সংস্কৃতি

আবুল কাসেম ফজলুল হক

রাজনীতিতে সংস্কৃতি

ইউরোপে এবং বাংলায়ও রেনেসাঁসের বিকাশের একপর্যায়ে কালচারের বা কৃষ্টির বা সংস্কৃতির ধারণার উদ্ভব। সংস্কৃতি চিন্তায় আছে নানা ধারা-উপধারা। ব্রিটেনে, ফ্রান্সে, জার্মানিতে, যুক্তরাষ্ট্রে বিকশিত সংস্কৃতির ধারণা প্রথম পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল একদিকে শিল্পী-সাহিত্যিকদের ও দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকদের মহলে এবং অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক-নৃতাত্ত্বিকদের মহলে। দুই মহলের চিন্তা এক রকম ছিল না, তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টাও ছিল না। প্রথম ধারা সংস্কৃতিকে মনে করত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে সুরুচি ও সৌন্দর্য চর্চার এবং সাহিত্য, সংগীত ও চারুশিল্প চর্চার ব্যাপার; আর দ্বিতীয় ধারা মানুষের সব কাজকর্মকেই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত করত এবং মনে করত Culture is what man adds to nature. সংস্কৃতির বিবেচনায় সমাজতাত্ত্বিক-নৃতাত্ত্বিকেরা ধর্ম, সামাজিক রীতিনীতি, ব্যক্তিগত আচার-আচরণ, ভালো-মন্দবিষয়ক ধারণা, আইন ও শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছে। ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি থেকে সংস্কৃতির এসব ধারণা ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে অন্য সব দেশে। বৃহত্তর শিক্ষিত সমাজে ধারণাটি প্রথমেই বিস্তৃত হয়নি, আর তাতে রাজনীতি-সচেতনতাও ছিল না। প্রত্যেক জাতির সংস্কৃতি-চিন্তার ইতিহাস রচিত হলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানা যাবে।

সংস্কৃতির ধারণাটি রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছে লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা এবং মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা। মার্কসবাদের সঙ্গে ‘সংস্কৃতির মার্কসীয় ধারণা’ও ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রে। রুশ বিপ্লব (১৯১৭) ও নচী বিপ্লবের (১৯৪৯) পরে সংস্কৃতির ‘মানবতাবাদী ধারণা’ পাশ্চাত্য রাষ্ট্রসমূহের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকেও প্রভাবিত করে। এর মধ্যে কোনো কোনো জাতি কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা উদ্ভাবন ও অবলম্বন করে। মার্কস-এঙ্গেলস ইউরোপের রেনেসাঁসের ভাবধারা থেকেই সংস্কৃতির ধারণাটি লাভ করেছিলেন এবং শ্রেণি-সংগ্রামের বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী তাকে রূপ দিয়ে বিকশিত করেছিলেন।

বাংলা ভাষার দেশেও মার্কসবাদীরাই কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করতে গিয়ে তাদের রাজনীতির অনুষঙ্গ রূপে সংস্কৃতির শ্রেণিগত ধারণা বিকশিত করেছিলেন এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। আধুনিক রাজনীতি সূচিত হওয়ার আগের পর্যায়ে কলকাতায় ব্রাহ্মসমাজ, একাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন, তত্ত্ববোধিনী সভা প্রভৃতি প্রগতিশীল সংগঠন ধর্মসংস্কার ও সমাজ সংস্কারের জন্য কাজ করেছিল। পাশাপাশি রক্ষণশীল ধারারও কিছু সংগঠন ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঠিক পরে ঢাকার ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ পরিচালনা করেছিল বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন। তার আগেও কলকাতায় ও ঢাকায়, বাংলার মুসলমান সমাজে, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চর্চার কিছু সংগঠন ছিল। ব্রিটিশ-ভারতে, পাকিস্তানে এবং বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি ও বিভিন্ন কমিউনিস্ট গ্রুপ দ্বারা পরিচালিত সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ, ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন (আইপিটিএ), প্রগতি লেখক সংঘ, সংস্কৃতি সংসদ, সৃজনী, ক্রান্তি, উন্মেষ, উদীচী, সুকান্ত একাডেমি, গণসংস্কৃতি পরিষদ ইত্যাদি সংগঠন ছিল। পরে দেখা দেয় জাতীয় কবিতা উৎসব পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, ব্লগার অ্যান্ড অন লাইন অ্যাকটিভিস্টস ফোরাম (গণজাগরণ মঞ্চ) ইত্যাদি সংগঠন। সব এক চরিত্রের সংগঠন নয়। কোনো কোনোটি আদর্শনিষ্ঠ, কোনো কোনোটি কেবল সরকার উত্খাতের ও ক্ষমতা দখলের রাজনীতির অনুসারী। এগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি কখনো কখনো খুব সক্রিয় ও প্রভাবশালী হয়েছিল। এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে, বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গেও সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে। আর নানা উদ্দেশ্যে এনজিও এবং সিএসও রূপেও আছে অনেক সংগঠন। যারা কেবল সরকার উত্খাত ও ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে লিপ্ত আর যারা এনজিও এবং সিএসও রূপে তত্পর, তাদের সংস্কৃতিচেতনা বিকারপ্রাপ্ত-নিম্নগামী। আশির দশকের শুরু থেকে অনেক সংগঠন বিবিসি রেডিও কর্তৃক পরিচালিত মৌলবাদ-বিরোধী আন্দোলন ও নারীবাদী আন্দোলনে ভীষণভাবে সক্রিয়। এসব আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটছে না; বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এসব আন্দোলনের অভিঘাতে পুরাতন পরাজিত সব সংস্কার-বিশ্বাসের ও ধর্মীয় শক্তির পুনরুজ্জীবন। এই পরিস্থিতিতে অনেকে বলছেন, ইতিহাসের চাকা পেছন দিকে ঘুরছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইতিহাসের যে পশ্চাত্গতি দেখা দিয়েছে, জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে, তা থেকে উদ্ধার লাভের জন্য কিছু দল রাজনীতিতে সংস্কৃতির প্রয়োজনের কথা বলছে। যারা বলছেন তাদের সবার ধারণা ও উদ্দেশ্য এক নয়। আমি জাতীয় জীবনে সংস্কৃতি বিষয়ে সচেতনতার ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রয়োজনের কথা বলে আসছি ১৯৭৬ সাল থেকেই। এ অবস্থায় সংস্কৃতির স্বরূপ সম্পর্কে আমি আমার ধারণাটি ব্যক্ত করার তাগিদ বোধ করছি। এ থেকে এই লেখায় আমার উদ্দেশ্যও বোঝা যাবে।

দুই. কমিউনিস্ট ভাবধারা অনুযায়ী সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলো মার্কসীয় আদর্শের প্রতি নিষ্ঠ থেকে পর্যায়ক্রমে জনগণের চিন্তাধারা পরিবর্তনের আন্দোলন। এ উদ্দেশ্যে তারা গুরুত্ব দিয়েছেন তাদের আদর্শগত ধারায় পুস্তক-পুস্তিকা রচনা ও প্রচার, উদ্দেশ্যনিষ্ঠ সাহিত্য সৃষ্টি ও প্রচার, সংগীত নাটক ও চিত্রশিল্প সৃষ্টি ও প্রচার ইত্যাদিতে। তাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মর্মে ছিল মার্কসবাদ। দল গঠনের, দলের মধ্যে আত্মগঠনের ও জনজীবনের সমস্যাবলির পর্যায়ক্রমিক সমাধানের বিবেচনাও তাতে ছিল। তারা গুরুত্ব দিতেন শ্রেণি সংগ্রামে ও শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠায়। বিভিন্ন দেশে মার্কসবাদী রাজনীতির ভালো-মন্দ যে অবস্থা গিয়েছে, সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরও সেই অবস্থাই গিয়েছে। উল্লেখ্য যে, ছয় দফা আন্দোলনের কালে আওয়ামী লীগের সহযোগী কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল না।

অত্যুন্নত নতুন প্রযুক্তি নিয়ে গত চার দশকের মধ্যে মানুষের মন-মানসিকতা ও আচরণ বদলে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির (১৯৯১) কারণে এই পরিবর্তন খুব দ্রুত ব্যাপকতা ও গভীরতা লাভ করেছে। বুর্জোয়াদের ও শ্রমিকদের প্রবণতা ও আচরণ কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার প্রকাশের (১৮৪৮) সময়ের মতো নেই। শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে শ্রেণিচেতনা একেবারে কমে গেছে, মধ্যবিত্তদের মধ্যে সুবিধাবাদ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, আর উচ্চবিত্তরা নিজেদের স্বার্থে অনেক বেশি শ্রেণিসচেতন হয়েছে। শ্রেণিচরিত্র, শ্রেণিচ্যুতি, বুর্জোয়া চরিত্র, প্রলেতারীয় চরিত্র, শ্রেণিসংগ্রাম, আদর্শগত দৃঢ়তা ও সুবিদাবাদ ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণার পুনর্বিবেচনা ও পুনর্গঠন দরকার। মনোবিজ্ঞানের তথ্যাদি ও মানুষের মন-মানসিকতাকে বিবেচনায় ধরলে শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্বের ধারণাকে এখন আর প্রতিষ্ঠাযোগ্য মনে করা যায় না। উপনিবেশিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের ধারায় দেখা দিয়েছে বিশ্বায়ন। বিশ্বায়ন তো সাম্রাজ্যবাদেরই উচ্চতর স্তর!

গণতন্ত্রকে সফল করার জন্য রাজনৈতিক দলে ও জনজীবনে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অনুশীলন অপরিহার্য। আমরা ‘সর্বজনীন’ গণতন্ত্রের কথা বলছি, চলমান ‘উদার’ গণতন্ত্রের কথা নয়। উদার গণতন্ত্রের যে রূপ ও প্রকৃতি দেখা যাচ্ছে, তাতে এটাকে ‘গণতন্ত্র’ না বলে ‘ধনিক-বণিক-সাম্রাজ্যবাদীদের নির্বাচনতন্ত্র বলা সমীচীন। প্রায় দুনিয়াব্যাপী আশির দশকে এই নির্বাচনতন্ত্র কায়েম হয়েছে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও বিশ্বব্যাংক দ্বারা। চলমান  আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক গোটা ব্যবস্থাটির কর্মনীতিকে বলা হয় নব্য-উদারতাবাদ। বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ গঠন করার সামর্থ্যও অর্জন করেনি। সর্বজনীন গণতন্ত্রের অপরিহার্য পূর্বশর্ত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। তাতে জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হবে ‘আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নীতি’ অবলম্বন করে। দলকে রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে পর্যায়ক্রমে জনজীবনে সমাধানযোগ্য সমস্যাবলি সমাধানের এবং আর্থ-সামাজিক-সংস্কৃতির উন্নতির জন্য জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হবে। রাজনৈতিক দলকে প্রয়োজন মতো দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি কর্মসূচি প্রচার করে জনসমর্থন নিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে হবে। জনসমর্থনের মূলে থাকবে কর্মসূচি ও নেতৃত্ব। জনজীবনের উন্নতির জন্য রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি হবে সর্বজনীন গণতন্ত্রের অন্যতম অপরিহার্য অবলম্বন। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সরকার গঠন সম্ভব হবে উন্নত চরিত্রের রাজনৈতিক দল গঠন করা হলে। রাজনীতিতে সংস্কৃতিতে গ্রহণ করতে হবে সর্বজনীন গণতন্ত্রের মর্মবস্তু রূপে। বাংলাদেশের উপযোগী করে সর্বজনীন গণতন্ত্রের তত্ত্ব ও কর্মপদ্ধতি আমাদের উদ্ভাবন করে নিতে হবে। প্রত্যেক জাতিকেই নিজের কল্যাণে তা উদ্ভাবন করতে হবে। সর্বজনীন গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক দল ও কার্যক্রমের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক সংগঠনও কার্যক্রম রাখতে হবে। সর্বজনীন কল্যাণে সংস্কৃতির ধারণাকেও পুনর্গঠিত ও নবায়িত করে নিতে হবে।

নানা জাতির সংস্কৃতির ধারণায় বৈচিত্র্য ও বিকাশশীলতা আছে। সংস্কৃতিচিন্তার ইতিহাসে যুক্তরাজ্যে বেকনের এবং যুক্তরাষ্ট্রে ইমার্সনের নাম সবার আগে সামনে আসে। বাংলাভাষার সুধীব্যক্তিরা ইংরেজি কালচারের ধারণা আত্মস্থ করে এবং নিজেদের ঐতিহ্য ও জীবনধারা বিবেচনা করে সংস্কৃতির ধারণাটি সৃষ্টি করেছেন। গত সোয়াশো বছর ধরে বাংলা ভাষার চিন্তক ও আন্দোলনকারীরা সংস্কৃতির ধারণাটিকে নানা ধারায় বিকশিত করে চলছেন। আমি সব ধারার আন্তরিক ও স্বচ্ছ চিন্তাকেই মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। বাংলা ভাষায় বিভিন্ন ধারার সংস্কৃতিচিন্তায় বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, শ্রীঅরবিন্দ, গোপাল হালদার, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আবুল মনসুর আহমদ, নীহাররঞ্জন রায়, শিবনারায়ণ রায়, আবুল ফজল, আহমদ শরীফ, নাজমুল করিম, রঙ্গলাল সেন প্রমুখের নাম সবার আগে সামনে আসে। মার্কসীয় ধারণা অনুযায়ী সংস্কৃতির স্বরূপ কেউ কেউ সন্ধান করেছেন; যেমন— গোপাল হালদার, রণেশ দাশগুপ্ত, সরদার ফজলুল করিম, বদরুদ্দীন  উমর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, যতীন সরকার প্রমুখ। অতীতে সংস্কৃতির জন্য কালচার, অনুশীলন, কৃষ্টি, কর্ষণ, তমুদ্দুন ইত্যাদি শব্দ বাংলায় ব্যবহৃত হয়েছে। সংস্কৃতি কথাটি চালু করেন রবীন্দ্রনাথ ১৯২২ সালে।

সম্প্রতি প্রচারমাধ্যম সংস্কৃতির ধারণাটিকে বিনোদনের ধারণার সঙ্গে একাকার করে ফেলেছে। অনেকে নাচ-গান-বিনোদনকেই সংস্কৃতি মনে করেন। এসব দিয়ে জনসাধারণকে দলের প্রতি আকৃষ্ট রাখতে চান। সেটা আমাদের বিবেচ্য নয়। পূর্বোক্ত মনীষীদের চিন্তাসমূহকে সমন্বিত করে সংস্কৃতির একটি অবলম্বনযোগ্য ধারণা আমরা নির্ণয় করতে পারি। উন্নত চরিত্রের রাজনীতির জন্য, সর্বজনীন গণতন্ত্রের বা শতভাগ মানুষের গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক দলে ও জনসাধারণের মধ্যে এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনে সংস্কৃতির এই ধারণা অপরিহার্য। ইতিহাসের পশ্চাত্গতিকে সম্মুখগতিতে রূপান্তরিত করার কাজে সংস্কৃতির এখনকার গতানুগতিক ধারণায় কাজ হবে না। উৎসব, অনুষ্ঠান ও দিবস উদযাপন উপলক্ষে সংস্কৃতির নামে হুজুগ সৃষ্টি করে সাময়িক কোনো স্বার্থ হাসিল করা গেলেও তাতে জাতি ও রাষ্ট্রের ক্ষতি ছাড়া কোনো কল্যাণ হয় না।

তিন. সংস্কৃতি মানবীয় ব্যাপার। মানুষ ‘কৃষ্টিমান’ বা ‘সংস্কৃতিমান’ প্রাণী। মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীই কৃষ্টিমান বা সংস্কৃতিমান নয়। মানুষ কেবল বেঁচে থেকেই সন্তুষ্ট থাকে না, উন্নতি করতে চেষ্টা করে। এটাই কৃষ্টিমানতা বা সংস্কৃতিমানতা। বেঁচে থাকার ও উন্নতি করার জন্য মানুষকে চিন্তা ও কাজ করতে হয়। অনেক কাজই অন্যদের সঙ্গে মিলে করতে হয়, একা পারা যায় না। সংস্কৃতি হলো সেই শক্তি যা মানুষের চিন্তায় ও কাজে উন্নতিশীলতা, উৎকর্ষমানতা, সৌন্দর্যমানতা, উত্তরণশীলতা, প্রগতিশীলতা ও পূর্ণতাপ্রয়াস রূপে দেখা দেয়। সংস্কৃতি হলো ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত জীবনে সংস্কার প্রচেষ্টা। জীবনযাত্রার, শিক্ষার ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মানুষের নিজেকে এবং নিজের সমাজ ও পরিবেশকে উন্নত, সুন্দর ও সমৃদ্ধ করার যে প্রবণতা, চিন্তা ও চেষ্টা, তারই মধ্যে নিহিত থাকে তার সংস্কৃতি। সংস্কৃতিতে সর্বজনীন কল্যাণবোধ, ন্যায়-অন্যায়বোধ ও ন্যায়নিষ্ঠাও থাকে। শঠ, প্রতারক ও লোভীর প্রবণতা ও প্রচেষ্টা সংস্কৃতির পরিপন্থী। সংস্কৃতি যেমন ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপার, তেমনি যৌথ বা সমষ্টিগত জীবনেরও ব্যাপার। ‘সভ্যতা’ ও ‘জাতীয় সংস্কৃতি’ সমার্থক। জীবনযাত্রার আশা-আকাঙ্ক্ষার এবং চিন্তা ও চেষ্টার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় মানুষের সংস্কৃতির পরিচয়। যত মন্থর গতিতেই হোক সমাজ জীবনে পর্যায়ক্রমে অন্যায় কমানো ও ন্যায় বাড়ানো সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রগতিশীল জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের সাধনা ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, সেই সঙ্গে দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য, সংগীত, নাটক ও শিল্পকলা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে মানুষ তার সাংস্কৃতিক সামর্থ্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে। বিপ্লবে ও ন্যায়যুদ্ধে সংস্কৃতি থাকে, কিন্তু প্রতি বিপ্লবে অন্যায় যুদ্ধে সংস্কৃতি থাকে না— থাকে অপসংস্কৃতি।

সংস্কৃতি একদিকে আত্মগঠনের এবং অপরদিকে পরিবেশকে পুনর্গঠিত করার ব্যাপার। ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে সংস্কৃতির বিকাশমানতার মধ্য দিয়ে ব্যক্তির ও সমষ্টির কর্মেন্দ্রিয়, জ্ঞানেন্দ্রিয়, অন্তরিন্দ্রিয় ও পরিবেশের সংস্কার, রূপান্তর ও নবজন্ম ঘটে।

রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে, রাজনৈতিক দলে, রাজনৈতিক আন্দোলনে ও বুদ্ধিজীবীদের মহলে সংস্কৃতি জীবন্ত ও জাগ্রত থাকলে তা দ্বারা জনজীবনে অশেষ কল্যাণ সাধিত হয়। রাজনীতিবিদেরা এবং বুদ্ধিজীবীরাই তো সমাজের নেতা, পরিচালক। তারা দুর্নীতিমুক্ত ও সংস্কৃতিমান থাকার চেষ্টা করলে সমাজ দুর্নীতিমুক্ত ও সংস্কৃতিমান হতে থাকে। শ্রীঅরবিন্দ (১৮৭২-১৯৫০) ভারতীয় সংস্কৃতির ভিত্তি (বাংলা অনুবাদ ১৯৬৯, শ্রীঅরবিন্দ আশ্রম, পণ্ডিচেরি; মূল গ্রন্থ ইংরেজিতে The Foundations of Indian Culture, প্রথম প্রকাশ?) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্য স্থাপনই সংস্কৃতির জীবন্ত লক্ষ্য।’ অরবিন্দ প্রথমত মানুষের মনোদৈহিক উন্নতিতে— তারপর আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক উন্নতিতে গুরুত্ব দিয়েছেন। এর জন্য সমাজে প্রগতিশীল নেতৃত্ব অপরিহার্য। জনসাধারণকেই নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হয়, জনগণ নিষ্ক্রিয় থাকলে, জনগণের মধ্যে চাহিদা না থাকলে, কখনো জনকল্যাণের বা প্রগতিশীল নেতৃত্ব সৃষ্টি হয় না। যে জনসাধারণ যখন যেমন নেতৃত্বের যোগ্য হয়, সেই জনসাধারণ তখন সেই রকম নেতৃত্বই তৈরি করে। নেতৃত্বের মধ্যে জনচরিত্রের প্রকাশ থাকে এবং নেতৃত্বের দ্বারা জনচরিত্র গঠিত হয়।

যারা সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষাগত দিক দিয়ে পশ্চাত্বর্তী ও দরিদ্র, তাদেরও সংস্কৃতি আছে। জীবনযাত্রার মধ্য দিয়ে তারাও উন্নতি করতে চায়— তাদের মধ্যেও ন্যায়-অন্যায়বোধ, সৌন্দর্যবোধ ও সর্বজনীন কল্যাণবোধ আছে। ইচ্ছায় হোক কিংবা বাধ্য হয়ে হোক, অগ্রসর সংস্কৃতির প্রভাব গ্রহণের মধ্য দিয়ে তারা সংস্কৃতিমান থাকে। আত্মবিকাশের পথে তাদের অন্তরায় অনেক। ঐক্যবদ্ধ হয়ে, নিজেদের থেকে নিজেদের জন্য নিজেদের চেষ্টায় নেতৃত্ব সৃষ্টি করে তারা শক্তিশালী হতে পারে এবং অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। শক্তি ও অধিকার থাকলে তারা উন্নতির ও সমৃদ্ধি অর্জনের চেষ্টা করতে পারে। অনৈক্যের মধ্যে তারা দুর্বল ও বঞ্চিত থাকে। যারা সৃষ্টিশীল নয়, সাধারণ মানুষ, তারা তাদের ইচ্ছা ও সামর্থ্য অনুযায়ী ঐতিহ্য ও পরিবেশ থেকে প্রাপ্ত সংস্কৃতি নিয়ে চলে। সরকারের এবং সমাজের স্তরে স্তরে যারা নেতৃত্ব বা কর্তৃত্ব করেন, জনগণের জীবনধারায় ও সংস্কৃতিতে তাদের নানা রকম প্রভাব থাকে।

 

ব্যক্তির সংস্কৃতির পরিচয় থাকে তার কর্মে ও ব্যক্তিত্বে। জাতির সংস্কৃতির পরিচয় থাকে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষায়, চিন্তায় ও কর্মে। জাতীয় সংস্কৃতিকে বলা যায় জাতির অন্তর্গত জনগণের সমষ্টিগত ব্যক্তিত্ব। তাতে ভালো ও মন্দ দুই-ই থাকে। ভালো-মন্দ, সুন্দর-কুিসত, ন্যায়-অন্যায়, রীতি-নীতি, আইন, আচার-অনাচার, কর্তব্য-অকর্তব্য ইত্যাদি সম্পর্কে জাতির অন্তর্গত জনগণের স্বীকৃত ধারণার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে জাতীয় সংস্কৃতি বা সভ্যতা। তবে সর্বস্বীকৃত নয় এমন ধারণাও থাকে প্রত্যেক জাতির অন্তর্গত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ও চিন্তাশীল ব্যক্তিদের জীবনে। কোনো জাতির অন্তর্গত জনগণের সব চিন্তা ও কর্ম এবং উৎপাদন ও সৃষ্টিই সেই জাতির সংস্কৃতির বাহন। প্রত্যেক জাতির সংস্কৃতিতে বিশিষ্টতা ও স্বাতন্ত্র্য আছে। এক জাতির সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য জাতির সংস্কৃতির সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য—দুই-ই থাকে। এক জাতি অন্য জাতির সংস্কৃতি থেকে গ্রহণও করে। উন্নতির জন্য ভালোর প্রতি গ্রহিষ্ণুতা অপরিহার্য। ব্যক্তিগত কিংবা যৌথ জীবনে সংস্কৃতিচেতনা যখন লোভ, হিংসা, ভোগসর্বস্বতা, ক্ষমতালিপ্সা, সম্পত্তিলিপ্সা, কুশিক্ষা, অসততা ইত্যাদি দ্বারা বিকারপ্রাপ্ত হয় তখন দেখা দেয় অপসংস্কৃতি। প্রত্যেক জাতির মধ্যেই সংস্কৃতি বিকশিত হয় অপসংস্কৃতির সঙ্গে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে।

     লেখক : অনারারি অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর