সোমবার, ১০ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

চিকুনগুনিয়া নিয়ে মোটা মাথার লুকোচুরি

মোস্তফা কামাল

চিকুনগুনিয়া নিয়ে মোটা মাথার লুকোচুরি

সরকার গায়ে না মাখলেও দাপটের সঙ্গে রাজধানীর বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে চিকুনগুনিয়া। দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা-যন্ত্রণায় ভোগাচ্ছে অগুনতি আদম সন্তানকে। নাম এবং রোগ আফ্রিকা থেকে আমদানি। আফ্রিকান ভাষায় চিকুনগুনিয়ার অর্থ বাঁকা ধনুক। ব্যথায় শরীরের হাড়-মাংস ধনুকের মতো বাঁকা হওয়ার উপক্রম হয় বলেই না-কি এমন নামকরণ। ঘটনাচক্রে বাংলাদেশে চিকুনগুনিয়ার সঙ্গে ভিড়েছে এর জাতভাই ডেঙ্গুও।  সেই সঙ্গে সিলেট ও মৌলভীবাজারসহ কয়েকটি জেলায় বন্যাদুর্গত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত নানা রোগবালাই। ডায়রিয়া, আমাশয়, চর্মরোগ ও ভাইরাস জ্বরসহ নানা রোগে আক্রান্ত বানভাসিরা। বরাবরই বর্ষা মৌসুমে দেশে ডায়রিয়া দেখা দেয়। বন্যায় তাতে যোগ হয় নতুন মাত্রা। বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, এবার টানা তিন মাস ডায়রিয়ার সাথী হয়ে থাকতে পারে ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়া। প্রস্রাবের সংক্রমণ, নিউমোনিয়া, টাইফয়েডও হতে পারে।

এবার বর্ষা শুরুর আগেই রাজধানীতে হানা দেয় মশাবাহিত ভাইরাসজনিত রোগ চিকুনগুনিয়া। একপর্যায়ে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। তবে চিকুনগুনিয়ার দাপটে ডেঙ্গু আর ডায়রিয়ার খবর গণমাধ্যমেও দুর্বল। ভুক্তভোগীরাই সইছেন নীরবে। রাজধানীর আইসিডিডিআরবি হাসপাতালে ঘুরে এলে বোঝা যাবে ডায়রিয়া আক্রান্তের নমুনা। আর চিকুনগুনিয়া নিয়ে চলছে রহস্যজনক লুকোচুরি। তথ্য ধামাচাপার চেষ্টা। অথচ রাজধানীর এমন ঘর বা পরিবার নেই যেখানে এক বা একাধিক সদস্য চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত না হয়েছেন। এবার কোথাও কোথাও ঈদুল ফিতরের নামাজের মোনাজাতেও এই মহামারী থেকে নাজাত চেয়ে দোয়া করা হয়েছে।

গণমাধ্যমে কচলাকচলির একপর্যায়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, চিকুনগুনিয়ার ব্যাপারে সরকার সচেতন ও সতর্ক। জনগণকে আতঙ্কিত না হয়ে ঘরে-বাইরে পানি জমে যেন এডিস মশা জন্মাতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ৫১৩ জন শনাক্তের তথ্যও জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন জানিয়েছেন, আগামী চার থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে চলে আসার আশাবাদের কথা। আর চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সবাইকে সতর্ক থাকার বার্তা। এসব সতর্ক বার্তা কি সরকারের সচেতনতা বা দায়িত্বের নমুনা হিসেবে যথেষ্ট? যেখানে রাজধানীর ঘরে ঘরে এক বা একাধিক ব্যক্তি আক্রান্ত, সেখানে সচেতনতা বাড়াতে দুই মাস সময় লাগিয়ে দেওয়ার হিসাব-নিকাশ?

অথচ এখন পর্যন্ত সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের সূত্র মতে, চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগী দুই হাজারের বেশি। তবে বেসরকারি সূত্র মতে, ওই সংখ্যা লাখের ওপরে। আবার ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে যাওয়া কেউ কেউ একাধারে চিকুনগুনিয়া-ডেঙ্গুতেও আক্রান্ত। এসব তথ্য বা হিসাব লুকানোর চিকন চালাকিতে গৌরব বা অর্জনের কিছু থাকতে পারে না। বরং তা মোটা মাথার অপরিণামদর্শী পরিচয়ই ফুটিয়ে তোলে। 

লুকোচুরির ধারায় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কাছেও বাংলাদেশের চিকুনগুনিয়ার তথ্য ব্ল্যাক আউট। ২০০৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাবের তথ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে থাকলেও বাংলাদেশের ঘরটি তথ্যশূন্য। স্পেনে ২০১৫ সালে ৬০ বছর বয়সী একজনের চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের কথা বিস্তারিত থাকলেও নেই শুধু বাংলাদেশের তথ্য। এর আগে, বাংলাদেশে ২০০৮ ও ২০১১ সালে হানা দেওয়া চিকুনগুনিয়ার তথ্যও নেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হালখাতায়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে দেখা যায়, চিকুনগুনিয়ার সর্বশেষ প্রাদুর্ভাব হয় ২০১৬ সালে কেনিয়াতে। ২০১৫ সালে দেখা দেয় যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা, স্পেন ও সেনেগালে। ২০১৪ ও ২০১৩ সালে যথাক্রমে ফ্রান্স ও ক্যারিবীয় দ্বীপ সেন্টমার্টিনে। আর ২০০৬ সালে দেখা দেয় ভারত, ভারত মহাসাগরের দ্বীপ সিসিলিসহ কয়েকটি দ্বীপে এবং ফ্রান্সের দ্বীপ লা ইউনিয়নে। ২০০৬ সালে ভারতে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব ছিল ভয়াবহ। দেশটিতে কয়েক হাজার মানুষ আক্রান্ত হয় এ রোগে। বাংলাদেশে প্রথম ২০০৮ সালে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ ভাইরাসে একাধিকজন আক্রান্ত হন। ২০১১ সালে ঢাকার দোহার উপজেলায় এই রোগ দেখা দেওয়ার পর বিচ্ছিন্নভাবে আরও কেউ কেউ আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে ২০০৮ সালে চিকুনগুনিয়া ধরা পড়লেও ৯ বছরে স্বাস্থ্য বিভাগ বা সিটি করপোরেশন বিষয়টি আমলে নেয়নি। এই খামখেয়ালির সঙ্গে যোগ হলো তথ্য লুকোচুরি।

মশা দমন বা নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ভূমিকায় বছরজুড়েই বিরক্ত নগরবাসী। মশাবাহিত রোগ চিকুনগুনিয়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় বিরক্তির মাত্রাটা আরেকটু বেশি। এরই মধ্যে রাজধানীর ২৩টি এলাকাকে চিকুনগুনিয়ার জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে আইইডিসিআর। বছর কয়েক ধরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মশা মারার কামানের বেশ গর্জন। মশক নিধনে ক্রাশ প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ব্যানার নিয়ে নির্দিষ্ট দু-এক জায়গায় শোডাউন করেন। মাঝে-মধ্যে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়। ঢাকায় মশা মারার বাজেট কিন্তু কম নয়। মশা মারতে ঢাকার উত্তর-দক্ষিণ দুই সিটি করপোরেশন গত অর্থবছরে পেয়েছে প্রায় ৩৭ কোটি টাকা। এত টাকা গেল কোথায়? কত মশা মারা পড়ল? কেউ জানে না। জানায়ও না কেউ। তবে, নগরবাসী কোনো কোনো এলাকায় ফগার মেশিনসহ সিটি করপোরেশনের কর্মীদের মাঝে-মধ্যে দেখে। এলোমেলো বিক্ষিপ্ত কীটনাশক ছিটানোর গর্জনও শোনে। 

চিকুনগুনিয়া নিয়ে ভয়ের কিছু নেই, সরকারের এমন আশ্বাসে আশ্বস্ত নন আক্রান্তরা।  তাদের নিয়ে স্বজনরা ছুটছেন বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিকে। এমনিতে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলে হাসপাতালে এই রোগীদের শুইয়ে রেখে দেওয়ার বাইরে করার তেমন কিছু নেই। তারপরও রোগীদের কেউ কেউ, বিশেষ করে বৃদ্ধরা হাসপাতালে থেকেই চিকিৎসা নিতে গিয়ে আরও অসুস্থ হচ্ছেন।  চিকুনগুনিয়ায় কোনো ওষুধ বা প্রতিষেধক নেই।  এখন পর্যন্ত সচেতনতা এবং আল্লাহই একমাত্র ভরসা।

লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর