মঙ্গলবার, ১১ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

নৌপরিবহনমন্ত্রীর সঙ্গে দুই দিন

মলয় চন্দন মুখোপাধ্যায়

নৌপরিবহনমন্ত্রীর সঙ্গে দুই দিন

মুর্শিদাবাদে নবাব সিরাজউদ্দৌলার ভাস্কর্যের পাশে নৌপরিবহনমন্ত্রী

বাংলাদেশের নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, এমপি সম্প্রতি কলকাতায় এসেছিলেন। ২২ থেকে ২৬ মে পর্যন্ত এ দেশে অবস্থানকালে তার সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হয় আমার, সুযোগ হয় তার মতো একজন সত্যিকার সহৃদয় মানুষের মন-মানসিকতা উপলব্ধির, যে মানুষটির সহজতা-সরলতায় মুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না আমার।

এই মুগ্ধতাবোধের সূচনা আমার সাম্প্রতিক ঢাকা ভ্রমণের সময়। আমার দীর্ঘদিনের কবিবন্ধু অসীম সাহার আমন্ত্রণে তাদের বঙ্গীয় সংস্কৃতি সংসদের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলাম। সংস্থাটির প্রথম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন সেলিনা হোসেন, নির্মলেন্দু গুণ, মুহম্মদ নূরুল হুদার মতো বিশিষ্টজনেরা। ছিলেন মহুয়া মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা, যার গভীর গবেষণায় গৌড়ীয় নৃত্য অন্যান্য ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যের মতোই সমীহ আদায় করছে। ড. মুখোপাধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে রয়েছেন সেখানে। সমগ্র অনুষ্ঠানটির সম্ভ্রান্ত মেজাজটি ধরা পড়ছিল সঞ্চালিকার ভূমিকায় ড. রূপা চক্রবর্তীর দায়িত্ব পালনে। ড. চক্রবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশ থেকে আগত বাংলা ভাষা শিক্ষার্থীদের বাংলা পড়ান।

এমন একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথিরূপে যোগ দিতে এসেছিলেন শাজাহান খান, এমপি। দীর্ঘদেহী সুপুরুষ মানুষটির সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেহারার মিল প্রথম দর্শনেই কারও মনে না হয়ে পারে না। বক্তৃতার সাবলীল ভঙ্গি সহজেই শ্রোতার মন আকৃষ্ট না করে পারে না। তবে আমাকে আশ্চর্য করল বক্তৃতার শেষে যখন তিনি সুকান্তের কবিতা তার বক্তৃতার অনুষঙ্গেই আবৃত্তি করলেন। মুগ্ধ হয়েছিলাম এত দীর্ঘ কবিতা তিনি স্মৃতিধার্য করেছিলেন শুনে এবং আরও মুগ্ধ হয়েছিলাম তার পরিবেশনায় একজন যথার্থ আবৃত্তিকারের মুনশিয়ানা লক্ষ্য করে। ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী আরিফ বা জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের আবৃত্তির ভক্ত আমার পুলকিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল জনাব খানের আবৃত্তি শ্রবণে, যা আমাকে প্ররোচিত করল তার সঙ্গে আলাপিত হতে। সেই আলাপটিই ছিল আমাদের উভয়ের প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের সূচনাক্ষণ।

আলাপের একটি পর্বে যখন জানলাম তিনি মাদারীপুরের ভূমিপুত্র, বললাম তাকে, তিনি প্রয়াত ব্যবহারজীবী এবং মাদারীপুরের বিশিষ্ট মানুষ গোপাল চন্দ্র দে-কে চেনেন কিনা। তার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল আমার মুখে গোপাল চন্দ্রের নাম শুনে। জনাব খানের পিতা মরহুম মৌলভী আছমত আলী খানও ছিলেন অ্যাডভোকেট এবং তিনি ও গোপাল চন্দ্র একই সঙ্গে মাদারীপুর কোর্টে প্র্যাকটিস করতেন। এর পরই তিনি আমাকে দাওয়াত দিয়ে বসলেন তার দফতরে। পরস্পর ভিজিটিং কার্ড বিনিময় হলো। সে রাতে বেশিক্ষণ কথা হতে পারেনি, যেহেতু অন্যত্র আমাকে যেতে হয়েছিল দাওয়াত পেয়ে।

ভেবেছিলাম তার আমন্ত্রণ নিতান্তই সৌজন্যমূলক। কিন্তু যেদিন যাওয়ার কথা বলেছিলেন, সেদিন সকালে যখন ফোন করে জানতে চাইলেন কখন গাড়ি পাঠাবেন, আমি তার এহেন আন্তরিকতায় বিমুগ্ধ না হয়ে পারিনি। জানি, বাংলাদেশের মানুষ অসম্ভব, কিংবা বলা চলে অসম্ভবেরও বেশি অতিথিপরায়ণ। কিন্তু তাই বলে একজন মন্ত্রী তার প্রটোকলের লেবাস ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এভাবে আমাকে আপ্যায়িত করতে চাইছেন, এই অভাবিত আতিথেয়তা আমাকে আপ্লুত করবে না! জানালাম, গাড়ির দরকার নেই, আমি যাদের বাসায় অতিথি, তাদের গাড়িতেই যাব। আপনি কেবল পথনির্দেশনাটি দিন। ৬টা নাগাদ তার দফতরে পৌঁছতেই তার আপ্ত সহায়কের উষ্ণ আপ্যায়ন। আমার সঙ্গে ছিলেন আমার ঢাকার বন্ধু এনায়েত কবীরের স্ত্রী নাহিদ কাইজার তমা। খানিক বাদেই এলেন শাজাহান খান। সাদা পাঞ্জাবিতে তাকে রাজপুরুষের মতো লাগছিল। পরে যতবার দেখা হয়েছে, দেখেছি এবং প্রশ্ন করে জেনেছি, তিনি সাদা পাঞ্জাবি ছাড়া পরেন না।

সেদিন আমাদের সংলাপ বিনিময়ে কখন যে একটি ঘণ্টা পেরিয়ে গেল ঠাহর পেলাম না। আলাপের মধ্যপর্বে থরে থরে সাজানো ফলের এমন বিপুল পরিমাণ নাস্তা আসতে লাগল যে আমরা ফলভারে চাপা পড়ার জোগাড়। কথা প্রসঙ্গে তার কাছ থেকে জানলাম মুক্তিযুদ্ধে তার যোগদানের কথা, দেরাদুনে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স অর্থাৎ মুজিব বাহিনীতে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে যোগদান করে বৈলগ্রাম ব্রিজের সমরে তার অসমসাহসিক অবদানের কথা। বাংলাদেশের বর্তমান সংকট এবং তার মোকাবিলায় শেখ হাসিনার ভূমিকার কথাও উঠে আসে তার কথায়। শেখ হাসিনার দুই পর্বের শাসনামলে যে অভাবিত উন্নতি ঘটেছে বাংলাদেশে, তার বিশদ বিবরণ তিনি তুলে ধরলেন। জানালেন, ভারতের বহু স্থান ভ্রমণ করলেও এ পর্যন্ত মুর্শিদাবাদ যাওয়া হয়নি তার। আগামী মাসে কলকাতা যাবেন যখন, সে সময় তার ইচ্ছা মুর্শিদাবাদ ঘুরে আসা। আমি ইতিহাসের ছাত্র এবং কলেজে ইতিহাস পড়িয়েছি। তাকে তাই আশ্বস্ত করলাম, তাকে মুর্শিদাবাদ ঘোরানোর দায়িত্ব আমার। শুনে আশ্বস্ত হলেন। শুনে তার পার্শ্বচর সোহাগ তালুকদার, যিনি আগাগোড়া আমাদের যত্নআত্তিতে ব্যস্ত ছিলেন, বলে উঠলেন, তিনিও যাবেন তাহলে।

অতএব ২২ মে যখন তার ফোন পেলাম যে তিনি কলকাতায় এসে পৌঁছেছেন এবং পরদিন তার সঙ্গী করতে চান আমাকে দমদমে এক সংবর্ধনা সভায়, সোৎসাহে রাজি হই যেতে। ২৩ তারিখ ৪টা নাগাদ কলকাতার তাজ বেঙ্গল হোটেলে দেখা করি তার সঙ্গে। হোটেলে ঢুকতেই দেখি লাউঞ্জে রয়েছেন বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের উপহাইকমিশনার জকি আহাদ। ঢাকাস্থ আমার অনুজপ্রতিম বন্ধু, তথ্যচিত্র নির্মাতা মাসুদ করিম আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল, যখন জকি আহাদের সঙ্গে ওকে আলাপ করতে নিয়ে যাওয়ার সময় জকি যখন পা ছুঁয়ে আমায় শ্রদ্ধা জানাতে যাচ্ছিলেন, সিগারেট খেতে গিয়ে আমার অনুমতি চাইছিলেন। সেই জকি আহাদ এবং তার সঙ্গে কলকাতাসহ বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি (বাণিজ্য) আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ মোহাম্মদ সাইফুল আমাকে দেখে উল্লসিত। কিছুক্ষণ আগেই জকি আহাদের সঙ্গে নাকি শাজাহান খানের আমাকে নিয়ে কথা হয়েছে। আমার ছবিও দেখিয়েছেন ওকে আর বলেছেন বাংলাদেশের প্রতি আমার প্রগাঢ় ভালোবাসার কথা। ৩১৭ নম্বর ঘরে গিয়ে দেখি, মনোযোগ দিয়ে প্রুফ দেখছেন। ওর বাবাকে নিয়ে বই লিখেছেন, সে বইয়েরই প্রুপ। তার দফতরে দেখা হওয়ার দিন তিনি একাধিক বই উপহার দিয়েছিলেন আমাকে। তার লেখক উনি ছিলেন না। তাজ বেঙ্গলে গিয়ে তার লেখকসত্তার পরিচয় পেলাম। এত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি নিজে প্রুফ দেখেন, এতে আশ্চর্য হতে হলো। নিজে প্রুফ না দেখলে স্বস্তি পাওয়া যায় না, তার প্রত্যয়। অনতিবিলম্বে আমরা দমদমে রওনা হলাম। দেখা হওয়ার পর হোটেলে সামান্য আলাপে আমার কুশল সংবাদ নিয়েছেন, আগন্তুক আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন, তার সঙ্গে ঢাকা থেকে আগত সরকারি কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গেও কথা বলেছেন।

আমরা যাচ্ছি শতাব্দীপ্রাচীন দমদম গ্রন্থাগারে, যেখানে ওকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। আসলে দমদম ওর অত্যন্ত পরিচিত জায়গা, সেখানে বাস করেন নারায়ণ বাবু, শাজাহান খানের মাদারীপুরস্থ বাল্যসখা। নারায়ণ বাবু ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত মাদারীপুরে ছিলেন। সাতাত্তর-পরবর্তীকালে বহুবার জনাব খান নারায়ণ বাবুর বাসায় এসেছেন, খেয়েছেন, থেকেছেন। এখন তিনি মন্ত্রী, অতএব বাল্যসখার গৃহে রাত্রিবাস প্রটোকলে আটকায়, আক্ষেপ নিয়ে জানালেন। সেসব অবিশ্যি অনুষ্ঠানে সংবর্ধনার জবাবে বলতে গিয়ে।

উষ্ণ অভ্যর্থনা ও প্রচুর মিষ্টি আর পানীয় পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হলো সংবর্ধনা পর্ব। জনাব খান, জকি আহাদ এবং মোহাম্মদ সাইফুলকে মাল্যভূষিত করা হলো। গ্রন্থাগারের তরফ থেকে কিছু স্মারক উপহার তুলে দেওয়া হলো। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হওয়ার পর একে একে জকি আহাদ, সাইফুলের বক্তৃতা। অবশেষে শাজাহান খান। বক্তৃতায় তিনি দমদমের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা বিশদ জানালেন। বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নিয়ে বললেন, বললেন মৌলবাদ ও মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে তাদের লাগাতার সংগ্রামের কথা। বক্তৃতার মধ্যে দু-তিন বার আমার নাম ধরে প্রশান্তি উচ্চারণে বিব্রত হতে হয়েছিল আমাকে। বেশকিছু বই তিনি উপহার দিলেন গ্রন্থাগারটিতে। বক্তৃতা শেষে পরিবেশিত হলো ভারতের জাতীয় সংগীত। অনুষ্ঠান শেষ। এরপর গ্রন্থাগার ঘুরে দেখার পালা। ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগারটি বহু দুর্মূল্য গ্রন্থে পূর্ণ, সাড়ে তিনশো গ্রাহক। সরকারি সাহায্য ছাড়াই চলছে। এ অঞ্চলের অহংকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গ্রন্থাগারটি। দমদম পর্ব শেষ করে আমরা অতঃপর পার্কস্ট্রিট, ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সে। সেখানে শাজাহান খানকে অভ্যর্থনা করলেন চেম্বার অব কমার্সের উপদেষ্টা নকিব আহমেদ। ভারত ও বহির্ভারতের ৫৩০ জন নৌবাণিজ্য ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার এ বৈঠকে অন্য আর এক শাজাহান খানকে প্রত্যক্ষ করলাম, যিনি অসীম ধৈর্য নিয়ে অন্যের কথা শোনেন এবং খুব ধীরেসুস্থে মন্তব্য করেন, রায় দেন।

অতঃপর ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের দেওয়া নৈশভোজে শামিল হওয়ার পরই জনাব খানের কাছ থেকে বিদায়। যাওয়ার সময় তিনি মনে করিয়ে দিলেন, পরশু অর্থাৎ ২৫ মে মুর্শিদাবাদ যাত্রা নির্ধারিত।

২৫ তারিখ রওনা দিতে একটু দেরিই হলো। তাজ বেঙ্গলে রাজকীয় নাস্তা সেরে রওনা দিতে দিতে ১০টা প্রায়। সাইফুল এসেছেন আজও। তিনি অবিশ্যি সফরসঙ্গী হবেন না, কেননা সেদিন তারা কলামন্দিরে রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী পালন করছেন। আমি সেখানে উপস্থিত থাকব না, সাইফুল আক্ষেপ জানালেও (বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের আয়োজিত যে কোনো অনুষ্ঠানে আমার অবধারিত উপস্থিতি ঘটে থাকে) পরে জানালেন, আপনার এই ভ্রমণসূচি তো এক মাস আগে থেকেই নির্ধারিত। অতএব... আমাদের যাত্রা হলো শুরু। ৪টি গাড়িতে মন্ত্রীর সহযাত্রী ১৫-১৬ জন। আমি এবং নারায়ণ বাবু ছাড়া বাকি সবাই বাংলাদেশের। তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক এসপি মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম। রয়েছেন আমলা আর রাজনৈতিক সহকারী। আর ছিল পুলিশের ভ্যান, পুরো পথ নিরাপদে পৌঁছে দিতে। জেলা থেকে জেলান্তরে যেতে ভ্যানও পরিবর্তিত হচ্ছিল। প্রথম যাত্রাবিরতি কালনায়। ওখানকার বিদ্যাসাগর টিচার্স ট্রেনিং কলেজে আমাদের সম্মাননা জ্ঞাপন। উপলক্ষ অবশ্যই জনাব খান। ওখানকার শিক্ষিকারা পুষ্পস্তবক দিয়ে, কপালে চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে আবাহন করে অতিথি নিবাসে বসালেন। তারপর প্রচুর ফল ও মিষ্টি দিয়ে অতিথি সেবা এবং তৎসহ মিষ্টি পানীয়। প্রতিষ্ঠানের সভাপতি শ্রীযুক্ত মাধব চন্দ্র ঘোষ প্রতিষ্ঠানটি ঘুরিয়ে দেখালেন। ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজটি এর মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এখানে ঈইঝঊ মাধ্যমে একটি বিদ্যালয়ও গড়ে তুলেছেন এরা।

এখানে সম্মাননা প্রদানের মূলে শ্রীযুক্ত সুব্রত পাল। মাদারীপুরের ভূমিপুত্র সুব্রত বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের একজন শিল্পপতি। এই প্রতিষ্ঠানটিরও যৌথ মালিকানা তার। এজন্যই আমাদের এখানে যাত্রাবিরতি এবং তারপর সুব্রত বাবুর কালনার বাসায় দ্বি-প্রাহরিক রাজকীয় আহার। অতঃপর মুর্শিদাবাদ রওনা। পথে যেতে পলাশীতে থেমে পলাশীযুদ্ধের স্মারক দেখে নেওয়া। সবাই নীরব। যেন ১৭৫৭-এর ২৩ জুনের সেই অরুন্তুদ দিনটির যাবতীয় বেদনা ও হাহাকার বয়ে বেড়াচ্ছিলাম সবাই। স্বভাবত খোশমেজাজি খান সাহেবের মুখও থমথমে। স্থান ছেড়ে বেরিয়ে আসছি যখন, সবারই মনে হচ্ছিল, স্থানটিকে আরও একটু যত্ন নিয়ে সাজানো উচিত ছিল। বড় দায়সারাভাবে স্মৃতিসৌধটি গড়ে উঠেছে। ভারত-ইতিহাসের যুগান্ত রচিত হয়েছিল যে স্থানটিতে, সেখানে অন্তত একটি প্রদর্শনশালা প্রত্যাশিত ছিল, দরকার ছিল সিরাজউদ্দৌলার মূর্তি স্থাপন।

বহরমপুর পৌঁঁছতে সন্ধে হয়ে গেল। সেখানে আমাদের রাত্রিবাসের জন্য সার্কিট হাউস নির্দিষ্ট ছিল। খানিক বিশ্রাম নিয়ে রওনা দেওয়া গেল নতুন বিন্যাসে গড়ে ওঠা মোতিঝিল দেখতে। অশ্বখুরাকৃতি এই ঝিলটি ঘিরে প্রায় সাড়ে তিন শ একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে অভিনব প্রমোদ উদ্যান। রয়েছে ভ্রমণার্থীদের থাকার জন্য কটেজ। লাইট অ্যান্ড সাউন্ডের মাধ্যমে পলাশীর যুদ্ধকাহিনী ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সমগ্র এলাকাটি ঘুরে দেখতে প্রায় এক ঘণ্টা লাগল। লাইট অ্যান্ড সাউন্ডে মূর্ত হয়ে উঠল মুর্শিদ কুলি খাঁ, আলীবর্দী, সিরাজউদ্দৌলা, জগেশঠ, মীর মদন, ঘসেটি বেগম, মীর জাফরদের একদিকে; অন্যদিকে ক্লাইভ, ওয়াটসন প্রমুখের কীর্তিসমূহ। দর্শকের দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া উপায় থাকে না।

শাজাহান খান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন সব, আর প্রয়োজনে নানা প্রশ্ন করে জেনেও নিচ্ছিলেন। ঘসেটি বেগম এবং তার বোন সিরাজমাতা আমিনা বেগমকে পলাশীর যুদ্ধের পর ঢাকায় নির্বাসন দেওয়া হয়। সেখানে মীর জাফরের পুত্র মীরনের পরামর্শে বুড়িগঙ্গার মাঝখানে নৌকো করে নিয়ে যাওয়া হয়। অতঃপর সলিলসমাধি দেওয়া হয় দুজনকে। কাহিনী শুনে জনাব খান বলে ওঠেন, ‘মর্মান্তিক!’

আমরা মোতিঝিলের রিসোর্টসংলগ্ন আলোকিত উদ্যানে চেয়ার পেতে বসে, চা পানে ব্যস্ত, সান্ধ্য বাতাস বাজন করে যাচ্ছিল আমাদের। মেঘলা আকাশ, পায়ের নিচে ভিজে ঘাস, যত দূরে চোখ যায় আলোকমালায় সজ্জিত, এক মনোহর পরিবেশ। এর মধ্যেই যখন পলাশীর কুশীলবদের মনে পড়ে যাচ্ছিল, মুর্শিদ কুলির রাজধানী স্থাপন, আলীবর্দীর মারাঠাদের বিরুদ্ধে লড়াই, সিরাজের মসনদে বসা, ঘসেটি বেগম-মীরজাফর-উমিচাঁদের ষড়যন্ত্র, দানশা ফকিরের সিরাজকে ধরিয়ে দেওয়া, লুত্ফুন্নেসার সিরাজপ্রীতি, এসব মনে জেগে উঠে মেদুর করে দিচ্ছিল মনকে।

ফিরে এসে আহার, নিদ্রা। পরদিন সকালে আবার বেরিয়ে পড়া প্রাতরাশ খেয়ে। কর্তৃপক্ষকে বলেছিলাম, এখানকার বিখ্যাত মিষ্টি ছানাবড়ার স্বাদ অতিথিদের পাইয়ে দিতে। সেজন্য নাস্তায় লুচি আর মুরগির মাংসের সঙ্গে ছানাবড়াও ছিল। রাজসিক খাওয়া-দাওয়া, বলতেই হবে। আমরা আর সার্কিট হাউসে ফিরব না। মুর্শিদাবাদের যতখানি সম্ভব দেখে কলকাতা রওনা দেব। আজই মন্ত্রী ঢাকা চলে যাবেন।

বিদায় মুহূর্তটি অবিস্মরণীয়। সার্কিট হাউসে দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার থেকে সাধারণ কর্মচারী, বাবুর্চি, বেয়ারাদের সবার সঙ্গে করমর্দন করলেন জনাব খান, ছবি তুললেন সবার সঙ্গে। এ দৃশ্য অভিভূত করল আমাকে। সাধারণতম মানুষের সঙ্গে তার আন্তরিক ও অকৃত্রিম সম্পর্ক স্থাপনে কোনো অভিনয় ছিল না।

আমাদের প্রথম গন্তব্য কাশিমবাজার রাজবাড়ি। বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এই বংশের অবিস্মরণীয় ভূমিকা রয়েছে। বিশাল প্রাসাদ, অসংখ্য কক্ষ ও কক্ষান্তর। অতীত এখানে মৌন থেকে তার আভিজাত্যকে জানান দিচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন এ প্রাসাদে।

অতঃপর খোশবাগ নদ পেরোতে হলো নৌকো করে। জনাব খানের অস্বস্তি নেই কিছুতে। সাঁতারে দক্ষ তিনি, নৌ চালনায়ও। তদুপরি নৌপরিবহনমন্ত্রী।

খোশবাগে সিরাজ, আলীবর্দী, লুত্ফুন্নেসার সমাধি আমাদের স্তব্ধ করেছিল। আমাদের সফরের অন্যতম সদস্য ফুয়াদ কবর জিয়ারত করলেন দেখলাম। কারও মুখে কোনো কথা নেই। ফিরে আসার সময় নদী পেরোতে পেরোতে মনে মনে আওড়াচ্ছিলাম, এই গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর। এবার কলকাতা রওনা। পথে সাধারণ এক রেস্তোরাঁয় মন্ত্রী যেভাবে চা-বিস্কুট খেলেন, এয়ারপোর্টের কাছে ‘পি এ ক্যাফে’-তে আহার পর্বে জীবনে প্রথম ফিস কবিরাজির স্বাদ নিয়ে বাহ্বা দিলেন, শৈশব-কৈশোরের খাওয়া-দাওয়ার গল্পে মশগুল হলেন, তাতে মানুষটিকে গভীর ভালো না বেসে পারলাম না। বিদায়, জনাব খান! যাওন নাই!

লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ, প্রাবন্ধিক ও কবি এবং সাংবাদিক পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর