শিরোনাম
বুধবার, ১২ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

‘চলুন মাতৃভূমিকে গড়ে তুলি’

আবু হেনা

‘চলুন মাতৃভূমিকে গড়ে তুলি’

৬ জুলাই, বাজেট পরবর্তী ছয় দিনের মাথায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দফতরের সচিবদের সঙ্গে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি ২০১৭-১৮ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ আহ্বান জানিয়ে বলেন, দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রত্যয় এবং দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা তখনই দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হব, যখন আপনারা জনগণের সেবক হিসেবে সঠিকভাবে কাজ করবেন।  বাজেট অর্জনে সক্ষম হব, যখন আপনারা জনগণের সেবক হিসেবে ঠিকমতো কাজ করবেন।... এ বাজেট এবং আমাদের যে উন্নয়ন প্রকল্প কোনো রকম কালক্ষেপণ না করে এটাও যেন দ্রুত সম্পন্ন হয়।’ তিনি বলেন, ‘বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি হচ্ছে সিভিল প্রশাসনের একটি অভ্যন্তরীণ কর্মকৌশল। এটি জনগণের কল্যাণে তৃণমূল পর্যন্ত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে নিয়ে যেতে সরকারি কর্মচারীদের জন্য দাফতরিক দায়বদ্ধতার স্মারক। এর মাধ্যমে জনগণের কাছে সরকারের স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়।’

আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হলেন আপনারা, সরকারি কর্মচারীরা। এখানে কিন্তু কর্মচারী বলা আছে। সে ক্ষেত্রে আপনাদেরও দায়বদ্ধতা রয়েছে। দায়বদ্ধতা রয়েছে সংবিধানের কাছে, দায়বদ্ধতা রয়েছে জনগণের কাছে। কারণ জনগণ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যা কামাই করে তা দিয়েই আজকে বেতন-ভাতা। জনগণের শ্রমেরই এ ফসল।’

‘আমাদের এ উন্নয়নের বড় লক্ষ্য আয় বৈষম্য দূর করা। ধনী ও গরিবের বৈষম্য দূর করা। উন্নয়নটা শুধু শহরে হবে না। উন্নয়নটা একেবারে গ্রাম থেকে উঠে আসবে। গ্রামের সাধারণ মানুষ যাতে সব রকম নাগিরক সুবিধা পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলোর মধ্যে গ্রামে বসবাসকারী শতকরা ৮০% ভাগ মানুষের সংবিধান প্রদত্ত নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তির আশ্বাস আছে। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টভাবে ঘোষণা করলেন গ্রামের সাধারণ মানুষকে একই নাগরিক সুবিধা দিতে হবে। দায়বদ্ধতা শুধু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরই নয়, সংবিধান অনুযায়ী এ দায়বদ্ধতা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও।

‘প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে গণতন্ত্রকে সামগ্রিকভাবে দেখার এবং উপলব্ধি করার সচেষ্ট প্রয়াস রয়েছে। সমাজতাত্ত্বিক কার্ল ম্যানহাইমের বিশ্লেষণে গণতন্ত্র প্রকৃতপক্ষে সাধারণ রাজনীতির পরিধির বাইরে বিস্তৃত এক বিশাল প্রক্রিয়া। তিনি যথার্থই বলেন, ‘রাজনৈতিক গণতন্ত্র এক পরিব্যাপ্ত সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার একটি অংশের প্রকাশ মাত্র। এর ভিত্তিমূলে রয়েছে সরকারে ক্ষমতায় সবার সমান অংশ নেওয়ার রাজনীতি। কারণ গণতন্ত্রের মূলে রয়েছে সব মানুষের সমতায় স্থির বিশ্বাস। এ ব্যবস্থা সমাজে উচ্চ-নীচের ভেদাভেদ স্বীকার করে না। সব মানুষের অনস্বীকার্য এ সাম্যে বিশ্বাস গণতন্ত্রের প্রথম ও মৌলিক শর্ত।’ এর জন্য প্রয়োজন সুস্থ রাজনীতি যা সমাজের বিভিন্ন শক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থের সমন্বয় ঘটিয়ে সর্বসম্মত জননীতি ও উন্নয়নে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। মুক্ত হতে হবে ব্যক্তিনির্ভর, গোষ্ঠীকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত ও শাসনের হাত থেকে। আর তার জন্য প্রয়োজন আইনকে এবং সবার মঙ্গলের জন্য প্রযুক্ত নীতি, বিধি, রীতিকে সবকিছুর উপরে স্থান দেওয়া।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পূর্বকালে রাজনীতি দূষিত হয়ে ওঠে। এদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক কাঠামো নির্জীব হয়ে ওঠে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়, প্রশাসনে আসে দুর্বলতা, অদক্ষতা এবং শৈথিল্য। সংঘর্ষ ও সহিষ্ণুতা সাধারণ মানুষের জীবনে অশান্তি এবং অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করে। ফলে ১১ জানুয়ারির অরাজনৈতিক সরকার। এরপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ৬ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণ করে। এর ফলে শুরু হয় সংসদীয় গণতন্ত্রের নতুন অধ্যায়। কিন্তু অতীতের বাধাবিপত্তির অনেকগুলোই এখনো জাতির অগ্রযাত্রার পথ সংকীর্ণ করে রেখেছে।

বাংলাদেশে ১৯৭১ এর আগে থেকেই এক সুবিন্যস্ত প্রশাসনিক কাঠামো বিদ্যমান ছিল। এর নেতৃত্বে ছিল উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা পরীক্ষার মাধ্যমে নিযুক্ত ও সুপ্রশিক্ষিত কর্মকর্তাবৃন্দ যারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ভিত্তিক ক্যাডারসমূহের নেতৃত্ব দিতেন। মেধা, যোগ্যতা এবং উত্কৃষ্ট প্রশিক্ষণের অভিযাত্রা পুরো প্রশাসন ব্যবস্থাকে বৈশিষ্ট্য দিত। এদের ছিল নিরপেক্ষতা, সততা, বিশ্বস্ততা এবং দক্ষতা। এক বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত হওয়ার কারণে তারা দুর্নীতিমুক্ত ছিলেন। আজ সে অবস্থা নেই, সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির প্রসার ঘটেছে। দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে জনজীবন বিঘ্নিত এবং মানবিক নিরাপত্তা সংকটাপন্ন। রাষ্ট্র সম্পদ হরণ এবং অননুমোদিত পথে ব্যয় করা, এদেশের সম্পদ বিদেশে পাচার— এসবই দুর্নীতি। ২০০০ সালের বিশ্বব্যাংকের এক দলিলে বলা হয়— ‘দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের মোট বার্ষিক উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার আরও ২.৯ ভাগ বৃদ্ধি পেত এবং মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় দ্বিগুণে দাঁড়াত। দুর্নীতি শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ব্যাহত করে না, সুশাসন এবং সুষ্ঠু গণতন্ত্রকেও মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করে। সঠিক কারণেই প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।

আজ শেখ হাসিনা সরকারের শেষ পর্যায়ে সামনে রয়েছে বিরাট চ্যালেঞ্জ। সরকার এবং দেশবাসীর এ মুহূর্তের সবচেয়ে বড় কাজ গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা ও কার্যকর প্রশাসন দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করা। বর্তমানে যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিকায়ন এবং দ্রুত উন্নয়ন বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে নিরন্তর নতুন রূপে সাজিয়ে চলেছে। এতে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন সজীব ওয়াজেদ জয়। বর্তমান বিশ্বে বিশাল আর্থসামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির, দ্রুততর বিস্ময়কর প্রসার ঘটেছে। কম্পিউটার প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তার বাংলাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। গণমাধ্যমকে করেছে আরও শক্তিশালী। স্যাটেলাইট উপগ্রহনির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থা ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে সমৃদ্ধ করেছে। ইন্টারনেট খুলে দিয়েছে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার। নতুন প্রযুক্তি সংকট মোচন এবং সুষম উন্নয়নের দিক নির্দেশ করছে।

২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন জোটের জয়লাভের মাধ্যমে পুনর্বার, গণতন্ত্রে উত্তরণের যে সুযোগ সৃষ্টি হয় তারও মূলে ছিল শেখ হাসিনার এক দূরদর্শী স্বাপ্নিকতা। বিশালাকার বাজেটের আঙ্গিকে এবারের স্বপ্ন এক সম্ভাবনার অর্থবহ জীবনের স্বপ্ন, সার্বিক অর্থনৈতিক মুক্তি ও সমৃদ্ধির স্বপ্ন। সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, কৃষি সমৃদ্ধি, পল্লী উন্নয়ন, প্রগতিশীল ও সুষম শিল্পায়ন, বেকারত্ব নিরসন এবং আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যাপক ও যুগোপযোগী ব্যবহার ও বিস্তারের মাধ্যমে দেশে একটি অর্থবহ ও তথ্যভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলাই এ বাজেটের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

কিন্তু শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষে এ বিশাল বাজেট বাস্তবায়ন করে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ এককভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। জাতির অন্যান্য শক্তিসমূহ, বিশেষ করে প্রশাসন, বেসরকারি বাণিজ্যিক ও শিল্পক্ষেত্রের নেতৃবৃন্দ, সুশীল ও নাগরিক সমাজ এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। এদের কাজে লাগানোর দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের।  এ দায়িত্ব সার্বিকভাবে পালিত হলে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথ সুপ্রশস্ত ও সুগম হবে।

     লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর