বৃহস্পতিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

মশা যে কত শক্তিশালী নমরুদের চেয়ে কেউ ভালো জানে না

এ কে এম মাঈদুল ইসলাম, এমপি

মশা যে কত শক্তিশালী নমরুদের চেয়ে কেউ ভালো জানে না

যখন আমরা বিপদে পড়ি তখন হঠাৎ করে তাড়াহুড়া করে কাজগুলো করে থাকি। ফলে সঠিকভাবে কাজগুলো সামাল দিতে পারি না। সরকারের টাকারও অপচয় হয়। এখন দেশব্যাপী ‘চিকুনগুনিয়া’ সংক্রমণ চলছে। এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশের দুই থেকে চার দিনের মধ্যে আকস্মিক জ্বর শুরু হয় এবং এর সঙ্গে অস্থি সন্ধিতে ব্যথা থাকে যা কয়েক সপ্তাহ, মাস বা বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এই ভাইরাসটি মশার কামড়ের মাধ্যমে মানব শরীরে প্রবেশ করে। আগে থেকেই আবহাওয়াজনিত কারণে আসাম-বেঙ্গল এলাকাটি মশার জন্য বিখ্যাত। সর্বত্র ম্যালেরিয়ার জ্বরে আক্রান্ত ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ঐতিহ্যগতভাবেই আমরা মশার অত্যাচারে অত্যাচারিত হয়ে আসছিলাম এবং এখনো হয়ে আসছি। মশা আগেও ছিল এখনো আছে।

আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি যে, নমরুদ ভীষণ শক্তিশালী ছিল। নমরুদ ছিল হামের বংশধর কুশের সন্তান। তার রাজত্ব প্রথমে শুরু হয়েছিল বাবেল থেকে। নমরুদ দুনিয়াতে একজন ক্ষমতাশালী পুরুষ হয়ে উঠেছিল। বেবিলন দেশের বেবিলন শহরে এরক, অক্কাদ, কলনি নামে জায়গাগুলো তিনি রাজত্ব করতে শুরু করেন। তিনি সেখান থেকে বের হয়ে তার রাজ্য বাড়াতে বাড়াতে আশেরিয়া দেশ পর্যন্ত গেলেন। সেখানকার নিনেভ, রাহোবোত ও রেশন নামে শহরগুলো তারই তৈরি। এর মধ্যে রেশন ছিল নিনেভ ও কেলহের মাঝামাঝি জায়গায়। এগুলো একসঙ্গে মিলে একটা বড় শহর তৈরি হয়েছিল।

একটি ল্যাংড়া মশা নমরুদের নাক দিয়ে মগজে প্রবেশ করে। এর পর তার নিরাপত্তা কর্মীরা চব্বিশ ঘণ্টা তার মাথায় আঘাত করতে থাকে। তাতে সে একটু আরাম বোধ করে। এভাবে করতে করতে বেশ কিছুদিন হয়ে গেল। হঠাৎ একদিন তার একজন নিরাপত্তা কর্মী রাগ করে তার মাথায় সজোরে আঘাত করে এবং সে মারা যায়। গল্পটা যেহেতু ইরাকের এবং সেখানে ভালো ভালো পুরনো সভ্যতা আছে, আশপাশের এলাকায় প্রচুর ঐতিহাসিক স্থাপনা ও এলাকা আছে; তাই ভাবলাম, জায়গাটি ঘুরে দেখে আসি। সে উদ্দেশ্যে প্রাক্তন সাংবাদিক মরহুম মাওলানা জহির সাহেবকে নিয়ে ইরাকে গেলাম। আমাদের সঙ্গে ইরাকের এক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুও ছিলেন।

বিশ্বখ্যাত বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ভারতবর্ষে এসেছিলেন, ভারতবর্ষের অনেকাংশ জয়ও করেছিলেন। আলেকজান্ডার সুদূর গ্রিস থেকে একের পর এক রাজ্য জয় করে ইরান আফগানিস্তান হয়ে ভারতের পাঞ্জাবে পৌঁছে যায়। সুদর্শন তরুণ সম্রাটের চোখে সারা পৃথিবী জয়ের স্বপ্ন। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিশালী সেনাবাহিনীর অধিকারী তিনি। বিখ্যাত ইরান সম্রাট দারায়ুস থেকে শুরু করে উত্তর-পশ্চিম ভারতের পরাক্রমশালী রাজা পুরু পর্যন্ত কেউ তার সামনে দাঁড়াতে পারেনি। গ্রিক দেশের ম্যাসিডোনিয়ার রাজা আলেকজান্ডার তার ১২ বছরব্যাপী সাম্রাজ্য বিস্তারের শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেন ভারত বর্ষের দোরগোড়ায়, সিন্ধু নদীর তীরে। তিনি ভাবতেন পৃথিবীর শেষপ্রান্ত অবধি জয় করবেন। মনে করতেন ভারতের পরেই পৃথিবীর শেষ। মহা বীর আলেকজান্ডারকেও মশার কামড়ে মরতে হয়েছে। পাকিস্তানের তক্ষশীলা থেকে মশার কামড়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং পরে ব্যাবিলনে গিয়ে জ্বরে ভুগে তিনি ৩২৩ অব্দে জুন মাসের ১১ অথবা ১২ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন।

এবার আসা যাক, আমাদের দেশের ব্যাপারে। এখন দেশব্যাপী চিকুনগুনিয়া জ্বর দেখা দিয়েছে। চিকুনগুনিয়া আবার কী জিনিস বুঝতে চাইলাম। ভাবলাম, বেতবুনিয়ার মশা এতদিনে চিকুন হয়ে চিকুনগুনিয়া হয়ে এসেছে কি না? পাকিস্তান আমলে পার্বত্য অঞ্চলে একটি ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র বসানোর পরিকল্পনা ছিল। সে সময়কার নিয়ম ছিল যে, কোনো স্যাটেলাইট স্টেশন করতে হলে তা ফাঁকা জায়গায় করতে হবে যাতে করে গাড়ি বা অন্য কোনো শব্দ ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে। সে অনুযায়ী আমাদের বেতবুনিয়া স্যাটেলাইট স্টেশন স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু এর মধ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এর কিছু যন্ত্রপাতি মিয়ানমারে, কিছু যন্ত্রপাতি শ্রীলঙ্কায় পড়ে রয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এগুলো সংগ্রহ করে এবং বিভিন্ন জায়গায় অনেক চেষ্টা-তদবির করে জোড়াতালি দিয়ে কোনোরকমে এটা চালু রেখেছিলেন। কয়েক বছর পর আমি টেলিফোন মন্ত্রী হিসেবে প্রতি মাসেই বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রটি পরিদর্শনে যেতাম। প্রিন্সিপাল রেজাউল করিম সাহেব আমাদের আত্মীয় হন। তিনি আমাকে বললেন যে, বাবা, তুমি বেতবুনিয়ায় ঘন ঘন এস কেন? আমি বললাম, এখানে আমাদের যে স্যাটেলাইট স্টেশনটি আছে, সেটা দেখে যেতে হয় মাঝে মাঝে। পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে কোনোমতে স্টেশনটি চলছিল। তিনি বললেন, সেখানে তো কোনো লোক থাকে না। এত অস্বাস্থ্যকর জায়গা যে, মশার ভয়ে, সাপের ভয়ে কোনো লোক সেখানে থাকে না। পরবর্তীতে আমরা বিকল্প ব্যবস্থা করার চিন্তাভাবনা শুরু করি এবং গাজীপুরের কালিয়াকৈরে তালিবাবাদ ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপনের কার্যক্রম হাতে নেই। তাই মনে পড়ল, বেতবুনিয়ার মশাই এখন চিকুন হয়ে ‘চিকুনগুনিয়া’ মশায় রূপান্তরিত হয়েছে কি না?

আমি একজন ডাক্তার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, চিকুনগুনিয়া মানে কী? বেতবুনিয়া ভুল করে চিকুনগুনিয়া লিখেছে কি না? তিনি বললেন, না, চিকুনগুনিয়া আছে। চিকুনগুনিয়া হলো একটি রোগ। এটা গ্রিক শব্দ। মশা যাকে কামড়াবে সে কোঁকরিয়ে যাবে, হাতে পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা হবে। এর ভালো কোনো ওষুধ নেই। তবে দু-তিন দিন জ্বর থাকে। পরে আর জ্বর থাকে না।

আমার অফিসের একজন এটেনডেন্টকে আমি বললাম, আমার রুমে যেন কোনো মশা ঢুকতে না পারে। এরপর হঠাৎ আমার জ্বর এলো। যা হোক, ভাবলাম তিন দিন তো থাকবেই। তিন দিন পর ঠিকই জ্বর চলে গেল। ভাবলাম, বেঁচে গেলাম। কিন্তু আমি দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমাদের জাতীয় সংসদের হাসপাতালে নতুন ডিজিটাল        এক্স-রে মেশিন দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে এক্স-রে করে রিপোর্টটি আমার মেয়েকে দিয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে ডাক্তার নজরুল ইসলাম সাহেবের কাছে পাঠিয়ে দিলাম দেখার জন্য। তিনি আমার বন্ধু মানুষ। তিনি আমাকে ফোন করে বললেন, আপনি কোথায় আছেন, কী অবস্থায় আছেন? আমি বললাম, লুঙ্গি পরা অবস্থায় আছি। তিনি বললেন, এ অবস্থায়ই চলে আসেন। হাসপাতালে ভর্তি হন। তারপর গুলশানের উদ্দেশে রওনা দিলাম। গুলশানে গিয়ে দেখি, গোটা এলাকা কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। মনে হলো যেন নাগাসিকো বোমায় পুড়ছে। যা হোক, তিনি রিপোর্ট দেখে বললেন, এক্ষনি আপনি স্পেশাল কেয়ার ইমার্জেন্সিতে ভর্তি হন। চিকুনগুনিয়া জ্বর চলে যাওয়ার পর আপনি যত্ন নেননি। যার ফলে আপনার নিউমোনিয়া হয়েছে। আমার যে নিউমোনিয়া হয়েছে সেটা এত বিপজ্জনক যে, আমাকে ইমার্জেন্সিতে ভর্তি হতে হবে। এরপর তিনি আরও কয়েকজন ডাক্তারকে ডেকে আমাকে ভর্তি করে দিলেন। আসলে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলে শুধু যে জ্বর আসবে তা নয়। এর অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। যার ভুক্তভোগী আমি নিজে। এর পর ৭-৮ দিন চিকিৎসা নিয়ে বাসায় চলে আসি। উল্লেখ্য, সৌভাগ্যবশত আমি এক্স-রে করেছিলাম।

১৯৬২ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ‘Malaria Eradication Program’ নামে একটি প্রকল্প করা হয়েছিল। বৈদেশিক সাহায্য ও সরকারি অর্থায়নের মাধ্যমে এ প্রকল্পটি করা হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল এ প্রকল্পের মাধ্যমে গাড়ি কেনা ছাড়া আর কোনো কাজ হয়নি। কয়েকশ গাড়ি কেনা হয়েছিল যা দিয়ে কর্মকর্তারা ঘুরে বেড়াতেন। আমি একদিন একজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনারা তো শুধু গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ান, কিন্তু মশা মারেন কী করে? আমাকে বললেন, কোথায় কোথায় মশা আছে আমরা তা সার্ভে করছি। আমি বললাম, দু-একটি মশা আপনাদের গাড়ির নিচে পড়ে মারা গেলেও তো কমত। তিনি বললেন, গাড়ির নিচে মশা পড়লে তো আমরা দেখি না, তবে গাড়িগুলো যখন দূরে যায় তখন দু-একটি মশা মরলে গাড়ির গ্লাসের ওপর পড়ে। 

তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি কনফারেন্স হয়েছিল। সেখানে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি বলেছিলেন, East Pakistan is mosquito free. তখন সবাই হেসে ফেললেন। তারা বলেছিলেন, এটা কীভাবে করলেন? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একজন সিনিয়র অফিসার জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনারা কী ধরনের নেটের ব্যবস্থা করেছেন যে, বার্মার মশা এখানে ঢুকতে পারে না! জানালে আমরা বিশ্বজুড়ে এ ব্যবস্থা নিতে পারি। এরপর উক্ত প্রতিনিধি আর কোনো কথা বলেননি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯৪৭ এর পর থেকে এ পর্যন্ত একমাত্র হাবিবুল্লাহ বাহার সাহেব, যিনি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, এখনো প্রবাদ আছে যে— ‘বাহার-নাহার এক বৃন্তে দুটি ফুল’, ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি ব্যতীত আর কারও রেকর্ড নেই যে ঢাকাবাসীকে মশার মহাবিপদ থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রত্যেক বছরই আমাদের এরকম এক একটি মহামারী এসে হাজির হয়। আগে থেকে প্রস্তুতি না নিলে এর মোকাবিলা করা যায় না। মানুষের জীবন নিয়ে টানাটানি লেগে যায়। হাসপাতাল থেকে বাসায় আসার পর আমার দুই বন্ধু এলেন। তারা বললেন, সিটি করপোরেশন, মিউনিসিপ্যালিটির তেল ক্রয়, ওষুধ ক্রয়, ইত্যাদি বিষয়ে বহু কারসাজি আছে। অন্যদিকে দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো এ সুযোগে ভালো ব্যবসা করে নিচ্ছে। ওষুধের দাম বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিচ্ছে। তাছাড়া ব্র্যান্ডের ওপর ব্র্যান্ড পরিবর্তন করছে। আমি বললাম, আপনারা তাহলে কী করছেন? তারা বললেন, আমরাও লিখে দেই। রোগী আসলে তো লিখতে হবেই। সবশেষে নিজের কথায় আসি। ১৯৬২ সালে ছাত্র আন্দোলনের কারণে রাজশাহী কলেজ থেকে আমাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বুঝলাম, পুলিশ কেইস করেই কর্তৃপক্ষ ক্ষান্ত হয়নি। আমাকে শায়েস্তা করার সব ব্যবস্থাই তারা নিয়েছে। তারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্সের ১৭ ধারায় আমাকে forced transfer certificate দিয়ে বহিষ্কার আদেশ দেয়। এ আদেশের বলে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের কোনো কলেজেই আমার আর ভর্তির সুযোগ রইল না। আমার উচ্চশিক্ষার পথ একেবারেই রুদ্ধ হয়ে গেল। যাই হোক, চিঠি পেয়ে ঢাকা এলাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে গেলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন, সন্ধ্যার পর এসো। এরপর তিনি আমাকে এসআর পাল ও সুধাংশু শেখর হালদারের কাছে নিয়ে গেলেন। তারা বললেন, এ বিষয়ে তো মামলা করা যাবে না। একটি রিট করা যেতে পারে। সুধাংশু শেখর হালদারকে তিনি কিছু ধারণা দিলেন কীভাবে কী করতে হবে। পরে তিনি একটি ড্রাফট তৈরি করলেন। ড্রাফটি তিনি আতাউর রহমান খান, নূরুল আমিন, শাহ আজিজুর রহমান, হামিদুল হক চৌধুরীসহ তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের খ্যাতনামা আইনজীবীদের দেখালেন। পরবর্তীতে ড্রাফটি মোটামোটিভাবে চূড়ান্ত হয়ে গেল। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব করাচির প্রখ্যাত আইনজীবী মাহমুদ আলী কাসুরীকে ঢাকায় আসার অনুরোধ জানান। উল্লেখ্য, ১৯৬২ সালের আইয়ুব খান যে শাসনতন্ত্র গঠন করেন সে শাসনতন্ত্রে Fundamental Rights এর ওপর এটাই ছিল পাকিস্তানের প্রথম মামলা। মাহমুদ আলী কাসুরীসহ প্রায় ৪০-৫০ জন বিখ্যাত আইনজীবী একটি টেস্ট কেস হিসেবে এ মামলাটি দায়ের করেন। অতঃপর সেই রিটে আমরা জয়ী হই। পরে এস আর পালের কাছে গেলাম। এস আর পাল বললেন, মামলায় তো জিতিয়ে দিলাম। এখন মোনায়েম খান যদি ভাইস চ্যান্সেলরকে বলে দেন যে, তাকে পরীক্ষায় পাস করাবেন না; তাহলে তো আমার করার কিছু থাকবে না। অতএব বাইরে কোনোখানে চলে যাও। এ ব্যাপারে অ্যাডভোকেট এস আর পাল আমাকে অনেক বুঝালেন।

আমার ভবিষ্যৎ জীবনের কর্মপন্থা ঠিক করার বিষয়ে বেগম রোকেয়া আনোয়ার তার বাসায় বঙ্গবন্ধু ও আমার বাবাকে একসঙ্গে দাওয়াত করলেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় আমাকে করাচি যেতে হবে। করাচি ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর আইএইচ কোরেশি আব্বার বন্ধু ছিলেন। করাচি যাওয়ার এটা ছিল আর একটি কারণ। বঙ্গবন্ধুর সাহায্য না পেলে হয়তো আমার লেখাপড়াই হতো না। বঙ্গবন্ধুর সেদিনের পরামর্শ ও সিদ্ধান্তের জন্যই হয়তো আমি করাচিতে লেখাপড়া করে মাস্টার ডিগ্রি লাভ করতে সক্ষম হয়েছি। ছাত্রজীবনে আমার মামলা মোকদ্দমা ও অত্যন্ত কঠিন কঠিন সময়ে বঙ্গবন্ধু আমার পাশে ছিলেন। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ ও সিদ্ধান্তের জন্য অনেক মিল কারখানা করার সুযোগ পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুর অফুরন্ত স্নেহ, মহানুভবতার জন্য আমি তাঁর কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ। প্রতিদিন যখন আমার বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনদের জন্য দোয়া করি তখন বঙ্গবন্ধুর জন্যও মহান আল্লাহপাকের কাছে তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

করাচিতে গিয়ে আব্বা তার বন্ধু হাসিম গাজদারের সঙ্গে কথা বললেন। হাসিম গাজদার সিন্ধু প্রদেশের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। আমি তখন করাচি কাসরনাস গেস্ট হাউসে ছিলাম। সে সময় ড. জাকির হোসেন ভারতের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তার ছোট ভাই ড. মাহমুদুল হাসান ঢাকা ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। তাকে ছাত্রদের বিরুদ্ধে পুলিশি ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল। তিনি ঢাকা থেকে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ও am not a police man, I cannot do it. তিনি ঢাকা থেকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে করাচি ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলেন। তিনি আমাদের ইতিহাস বিভাগের প্রধান ছিলেন। খুব সুন্দর চেহারা, দেবতার মতো মানুষ।

পরের দিন আব্বা আমাকে নিয়ে বিছানাপত্র যা যা প্রয়োজন কিনে দিলেন। সন্ধ্যার পর হাসিম গাজদার আব্বাকে ও আমাকে দাওয়াত করে করাচির দামি মেট্রোপলিটন হোটেলে খাওয়ালেন। পরে তিনি গাড়িতে করে আব্বাকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে করাচি ইউনিভার্সিটি হোস্টেলে রেখে চলে আসেন। তখনকার করাচি হোস্টেল এখন দেখলে চেনাই যাবে না। করাচি জেলখানা যারা দেখেছেন তারা হয়তো জানেন। করাচি জেলখানা থেকে ১০ মাইল দূরে এ হোস্টেল। আশপাশে খালি জায়গা ছাড়া কিছু নেই।

কিন্তু আমি হোস্টেলে সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। মশারি নেই। মশায় ভর্তি রুম। খুব দুরবস্থা। সাড়া রাত জেগে থাকারও উপায় নেই। শরীরের এমন কোনো জায়গা খালি নেই যেখানে মশার কামড় পড়েনি। এরকম বড় বড় মশা আমি শুধু শান্তিনিকেতনেই দেখেছি। তখন হোস্টেলে কাউকে চিনিও না যে ডেকে আনি। এভাবে সাড়া রাত কেটে গেল। পরের দিন আমার বন্ধু আবদুল্লাহ হারুন সকাল ৭টার সময় এলো। সে এখন টরেন্টোতে আছে। আমেরিকানও বিয়ে করেছে। খুব ভালো অবস্থানে আছে। সে এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ (অব.), নুরুদ্দিন কামাল ও চ্যানেল আইয়ের পরিচালক মামুনের ভাই। খুবই উচ্চশিক্ষিত পরিবারের সন্তান। সে তখন সেখানে বাঙালিদের নেতা। সে এসে বলল, আমি রাতেই আসতাম। কিন্তু তোর চাচারা ও ভিআইপিরা এসেছিলেন, এ জন্য তোর সঙ্গে দেখা করিনি। তোর তো কোনো অসুবিধে হয়নি? আমি বললাম, এই দেখ আমার সারা গায়ে মশার কামড়। ঢাকার মশার চেয়ে করাচির মশার সাইজ ডাবল, পাঠানদের মতো। তখন বন্ধু আমাকে বলল, তুই হাত-মুখ ধুয়ে নে। এখন বাস আসবে। আমরা শহরে গিয়ে মশারি কিনে নিয়ে আসব।  ইউনিভার্সিটির বাসে শহরে গেলাম। বাজারে গিয়ে হারুন বলল, তুই এখানে একটু দাঁড়া, আমি আসছি। এদিকে আমি দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই। হারুন আর আসছে না। অতঃপর আমি নিজে গিয়ে বৌরি বাজার পেলেস সিনেমা হলের পাশে দোকানদারকে বললাম, ভাই, আমাকে একটি মশারি দেন। যাকে জিজ্ঞেস করি সে-ই বলছে, নেই। এভাবে ১৫-২০টি দোকানে যাই। হারুন আমাকে যেখানে থাকতে বলেছিল সেখানে গিয়ে আবার দাঁড়ালাম। এরপর হারুন এলো। মশারি কেনার কথা শুনে সে হাসল। পরে সে দোকানদারের কাছে গিয়ে বলল, একটা ‘মচ্ছদ্যান’ দেন। দোকানদার সঙ্গে সঙ্গে মশারি বের করে দিল। মশারিকে যে তারা ‘মচ্ছদ্যান’ বলে সেটা তো আর আমি জানি না। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ঢুকলে যাত্রী সাধারণকে প্রথম অভ্যর্থনা জানানো হয় মশার কামড় দিয়ে। মশার কামড়ে যাত্রীরা অতিষ্ঠ। তাই স্বভাবত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, যে বিমান অথরিটি এয়ারপোর্টের মশা মারতে পারে না, সে অথরিটি বিমান চালাবে কী করে? বিমানবন্দরে মশার উপদ্রব বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে কয়েক মাস আগে আমি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রীকে বলেছিলাম। মন্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, ‘এটা তো সিটি করপোরেশনের অধীনে নয়, তাই এখানে মশা মারার কেউ নেই।’ কিন্তু এয়ারপোর্টের তো নিজস্ব একটি অথরিটি আছে। তারা কি মশাগুলো মারতে পারে না? তাদের কি মশা মারার ক্ষমতাও নেই?।

আমার আরেকটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলছি। গত ৬ মার্চ ২০১৬ খ্রি. তারিখে সিঙ্গাপুর থেকে আসছিলাম। বিমানে ওঠে দেখি মশা। বিমান ক্রুদের জিজ্ঞেস করলাম, বিমানে মশা কী করে এলো? তারা বলল, ‘স্যার, তাদের তো পাসপোর্ট লাগে না, ইমিগ্রেশন চেক নেই, ভিসা নেই, টিকিটও করেনি, বিনা পয়সায় চড়ছে।’ বললাম, সিঙ্গাপুর বিমান অথরিটি যদি দেখে যে, ‘বিমানের মশা সিঙ্গাপুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাহলে তো আপনাদের সেখানে আর নামতে দিবে না।’ আপনারা জানেন, সিঙ্গাপুর একটি সিটি স্টেট। সবকিছুই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, সাজানো গোছানো। সেখানে মশা মাছির কোনো কারবার নেই। যাই হোক, আমি বললাম, ‘মশাগুলো মারার ব্যবস্থা নেন।’

এখন যেহেতু রাজধানী ঢাকা বিশাল শহরে বিস্তৃত হয়েছে। তাই মশা নিধনের জন্য শুধু মেয়রদের দায়িত্ব না দিয়ে প্রতিটি ওয়ার্ডভিত্তিক কাউন্সিলরদের এ দায়িত্ব দিতে হবে। এতে করে স্থানীয়ভাবে জনগণের জবাবদিহিতা থাকবে। তাছাড়া একমাত্র তথাকথিত ম্যাজিক মশারি দিয়ে গোটা দেশকে ঢেকে দেওয়া যায় কিনা তা-ও ভেবে দেখতে হবে!

লেখক : সাবেক মন্ত্রী।

সর্বশেষ খবর