শুক্রবার, ১৪ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

সুখে-দুঃখে দীনের ওপর অটল থাকতে হবে

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

সুখে-দুঃখে দীনের ওপর অটল থাকতে হবে

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, মানুষের মধ্যে কেউ কেউ দ্বিধাদ্বন্দ্বে জড়িত হয়ে আল্লাহর ইবাদত করে। যদি সে কল্যাণপ্রাপ্ত হয় তবে ইবাদতের ওপর অটল থাকে এবং যদি সে কোনো পরীক্ষায় পড়ে তবে পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। সে ইহকাল ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত। (সূরা হজ : ১১)। আলোচ্য আয়াতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে বা বিপদাপদে দীন থেকে ছিটকে পড়া লোকদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে। মানুষ দীন থেকে কেন ছিকটে পড়ে?  মৌলিকভাবে মানুষ দীন থেকে ছিটকে পড়ে অনেক কারণে। যেমন কেউ কেউ সামাজিক লজ্জায় পড়ে দীন থেকে সরে পড়ে। কেউ কেউ পরস্পর সম্পর্কের কারণে দীন থেকে সরে পড়ে। কেউ কেউ অতি সুখের কারণে দীন থেকে সরে পড়ে। কেউ কেউ অতি দুঃখের কারণে দীন থেকে সরে পড়ে। মোটকথা এ ধরনের বিভিন্ন কারণে মানুষ দীন-ইসলাম থেকে ছিটকে পড়ে। তবে অনেকে উল্লিখিত অবস্থার সম্মুখীন হয়েও নিজেদের দীনের ওপর অটল রাখতে সক্ষম হয় এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। কারণ ইসলামের বিধান হলো সুখে-দুঃখে এক কথায় সর্বাবস্থায় নিজেকে দীনের ওপর অটল রাখতে হবে। আমার খালিক মহান রব্বুল আলামিন। তিনি আমাকে যেভাবে রাখতে পছন্দ করেন তার ওপরই আমি সন্তুষ্ট আছি। তিনি যদি সুখে রাখেন তাও আলহামদুলিল্লাহ। আর যদি দুঃখে রাখেন তাও আলহামদুলিল্লাহ। সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণ বা জিকিরে ফিকিরে থাকতে হবে। আল্লাহর ইবাদত করতে হবে একমাত্র আল্লাহকে রাজিখুশি করার জন্যই, কোনো আরাম-আয়েশের ভিত্তিতে নয়।

তবে আল্লাহর কাছে সব সময় এ দোয়া করতে হবে— ‘হে আল্লাহ আমাদের ইমান দুর্বল, আমাদের শক্তিশালী ইমানদার বানান। হে আল্লাহ আপনার নেয়ামত দ্বারা আমাদের সব সময় ভরপুর করে রাখুন। সব সময় ইহ ও পরকালের বালা-মসিবত থেকে মুক্ত রাখুন’। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে— ‘তাদেরকে এ ছাড়া কোনো নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, নামাজ আদায় করবে এবং জাকাত দেবে। এটাই সঠিক ধর্ম’। (সূরা বাইয়্যেনা : ৫)। আলোচ্য আয়াতে একমাত্র আল্লাহ রব্বুল আলামিনের জন্যই ইবাদতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মহান রব্বুল আলামিনের ইবাদত হবে সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে। সুখে থাকলে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হওয়া আর দুঃখে থাকলে ইবাদত ছেড়ে দেওয়া বা বিপদে পড়লে আল্লাহকে ডাকা আর বিপদ দূর হয়ে গেলে আল্লাহর ডাক ছেড়ে দেওয়া কোনো ইমানদারের কাজ হতে পারে না। সূরা হজের ১১নং আলোচ্য আয়াতে যারা আরাম ও কল্যাণের সময় আল্লাহর ইবাদত করে তাদের পরিচয় দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তারা ভালো অবস্থায় থাকলে আল্লাহকে ডাকে। আর যখনই কোনো ধরনের বালামসিবতে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকে ডাকা ছেড়ে দেয়। তাদের ইহ ও পরকাল উভয়ই বরবাদ হয়ে গেল। দুনিয়া বরবাদ হলো এভাবে যে, সে তো বালামসিবতে পড়েই আছে। আর পরকাল বরবাদ হলো এভাবে যে, সে আল্লাহকে ডাকা ছেড়ে দিয়ে আখেরাতকে বরবাদ করে দিল। যারা সুসময়ের বন্ধু, বসন্তের কোকিল, আর বিপদের সময় কেটে পড়ে এই স্বার্থপর লোকটিকে মানুষও পছন্দ করে না। সে আল্লাহ রব্বুল আলামিনের কাছে কীভাবে পছন্দনীয় বান্দা হবে? প্রিয় পাঠক! একটু চিন্তা করুন। বরং আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে হলে সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণ থাকতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে মসিবত বড় বা ছোট হোক তা দূর করার মালিক একমাত্র আল্লাহ রব্বুল আলামিন। আল্লাহপাক মানুষকে বালামসিবত দিয়ে অনেক সময় পরীক্ষা করেন। বান্দা সে সুখের সময় আল্লাহর ইবাদত করে ঠিক কিন্তু দুঃখের সময় বা বালামসিবতের সময় আল্লাহর ইবাদত করে কিনা বা আল্লাহকে ডাকে কিনা আল্লাহপাক তা দেখতে চান। যদি বান্দা সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণ বা জিকির থেকে গাফেল না হয়, তখন আল্লাহপাক তার ওপর সন্তুষ্ট হয়ে তাকে পূর্বের থেকেও নেয়ামত দ্বিগুণ বা বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেন। নবী-রসুল, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন, তাবেতাবেয়িন, আইম্মায়ে মুজতাহেদিন ও হক্কানি পীর আউলিয়াদের জীবনীতে এর বহু প্রমাণ রয়েছে। সিরাতে মোস্তাকিম নামক কিতাবে একটি ঘটনা বর্ণিত রয়েছে। হজরত জায়েদ বিন ছাবেত (রা.) একবার তায়েফ নামক শহরে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেরার পথে তিনি একজন ডাকাতের খপ্পরে পড়েন। ডাকাত যখন তাকে মারতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন হজরত জায়েদ বিন ছাবেত (রা.) ‘ইয়া রাহমানুর রাহিম’ বলে আল্লাহকে ডাক দিয়েছিলেন। এমন সময় একটা গায়েবি আওয়াজ এসেছিল এই মর্মে ‘তাকে মারিও না’। আওয়াজ শুনে ডাকাতটি কিছুটা ভয় পেয়ে একটু পেছনে হটে গেল। ডাকাত চিন্তা করল এই আওয়াজ কোথা হতে এলো। সে এদিক-সেদিক তাকিয়ে কাউকে না দেখে সাহস করে হজরত জায়েদ বিন ছাবেত (রা.)কে আবার মারার জন্য উদ্যত হলো। তিনি আবার ‘ইয়া রাহমানুর রাহিম’ বলে আল্লাহকে ডাকলেন। সঙ্গে সঙ্গে গায়েব থেকে আবার বিকট আওয়াজ এলো ‘সাবধান তাকে মেরো না’। ডাকাতটি আবার কিছুটা ইতস্তত করল এবং সঙ্গে সঙ্গে এদিক-ওদিক সতর্কতার সঙ্গে তাকাল কেউ আছে কিনা? কাউকে না দেখে আবার সে হজরতকে মারতে উদ্যত হলো। হজরত আবার উক্ত নামে আল্লাহকে ডাকলেন। এভাবে আল্লাহর রহমান নাম ধরে তিনবার ডাকার পর দেখা গেল একজন লোক স্বশরীরে তাদের কাছে এলো। তার হাতে বড় একটি তীর। তীরের অগ্রভাগে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আগন্তুক তীরটি ডাকাতের গায়ে নিক্ষেপ করল। তীরটি ডাকাতের গায়ে এক পাশ দিয়ে ঢুকে অপর পাশ দিয়ে বের হলো। ডাকাতটি সেখানে খতম হয়ে গেল। তারপর সে হজরত জায়েদ বিন ছাবেত (রা.)-কে লক্ষ করে বলল, যাও তোমার কোনো ভয় নেই। তুমি যে নামে আল্লাহকে ডেকেছ আমি ওই নামের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা। বিপদে পড়ে যখন কোনো বান্দা আল্লাহকে এ নামে ডাকে যে নামে তুমি ডেকেছ, আমি সঙ্গে সঙ্গে তার সাহায্যে এগিয়ে আসি। প্রথমবার যখন তুমি এ নামে আল্লাহকে ডাক দিয়েছিলে তখন আমি সপ্তম আকাশে ছিলাম। সেখান থেকে আমি চিৎকার দিয়েছিলাম। দ্বিতীয়বার যখন তুমি আল্লাহকে ওই নামে ডাক দিয়েছিলে তখন আমি প্রথম আকাশে ছিলাম। সেখান থেকে আমি চিৎকার দিয়েছিলাম। তৃতীয়বার যখন তুমি ওই নামে ডাক দিয়েছিলে তখন আমি এখানে উপস্থিত হয়েছি। (এবং আমি আমার কার্য সমাধা করেছি)। প্রিয় পাঠক! একটু লক্ষ করুন। বান্দা যখন আল্লাহর প্রিয় পাত্র হয়ে যায় তখন আল্লাহপাক তার যাবতীয় জিম্মাদারি নিয়ে নেন। তার হায়াত থাকতে কেউ তার কোনোই ক্ষতি করতে পারে না। আল্লাহর প্রিয় বান্দা যখনই আল্লাহকে ডাকে তখনই আল্লাহর সাহায্য অতি তাড়াতাড়ি তার কাছে পৌঁছে যায়। আলোচ্য ঘটনায় দেখুন সপ্তম আকাশ থেকে ফেরেশতা কত তাড়াতাড়ি আল্লাহর প্রিয় বান্দার সাহায্য করার জন্য চলে এসেছেন। তাই আসুন, আমরা সুখে ও দুঃখে সর্বাবস্থায় আমাদের রব আল্লাহর স্মরণ বা জিকিরে ফিকিরে থাকি এবং ইমানের ওপর অটল থাকি। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে সুখে ও দুঃখে সর্বাবস্থায় আল্লাহ রব্বুল আলামিনকে বেশি বেশি করে স্মরণ করার তৌফিক দান করুন।  আমিন।

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব বারিধারা, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর