শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

প্রাপ্য সুবিধা আদায়ের শক্তি কি বিএনপির আছে?

কাজী সিরাজ

প্রাপ্য সুবিধা আদায়ের শক্তি কি বিএনপির আছে?

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সাফল্য ও বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত দেশ-বিদেশের সব গণতান্ত্রিক মহলে প্রশংসিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের পর সমগ্র জাতির ভিতর একটা দৃঢ় আশাবাদ জেগেছিল যে, দেশে ভবিষ্যতে এভাবেই সংবিধানসম্মতভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ পন্থায় ক্ষমতার হস্তান্তর হবে, দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচনও পরাজিত দলের মৃদু সমালোচনা সত্ত্বেও সব মহলে প্রশংসিত হয়েছিল। এরপর নবম ও দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়। দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক এখনো চলছে। এ সংসদে ৩০০ সরাসরি আসনের ১৫৩টিতে কোনো নির্বাচন-ভোটাভুটিই হয়নি। এটা সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। গণতান্ত্রিক বিশ্বেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। একাদশ সংসদ নির্বাচনটি কেমন হবে? সব গণসংশ্লিষ্ট দলের অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে একাদশ সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও সবার কাছে সমাদৃত হোক— এ প্রত্যাশা গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের।

নির্বাচনের এখনো দেড় বছরের মতো বাকি, তা মনেই হচ্ছে না প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের তত্পরতায়। পার্থক্য এখানে যে, শাসক লীগ কাজ করছে মাঠে-ময়দানে, বড় বড় সমাবেশে, জনসভায়; কিন্তু তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ চার দেয়ালের মধ্যে। সরকারের নানা কৌশলের কাছে বার বার পরাস্ত হচ্ছে দলটি। আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের ‘আশঙ্কাকে’ ‘পুঁজি’ করে প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশ করার জন্য বিএনপিকে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। এজন্য বিএনপি ‘নাকি-কান্না কাঁদছে’; কিন্তু সৎসাহসী কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটা নির্বাচনী আবহ তৈরি হলেও নির্বাচনটি সবার প্রত্যাশা অনুযায়ী অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হবে কিনা তা নিয়েও ঘোর সংশয় কাজ করছে। দেশে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা জামায়াতকে বাদ দিয়ে ৪০টি। শোনা যাচ্ছে আরও কিছু নতুন দলকে নিবন্ধন দেওয়া হবে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন সরকার সমর্থক কিছু দলকেই নিবন্ধন দেওয়া হবে— এর মধ্যে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার দল একটি। উদ্দেশ্য, কোনো জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হলে আবারও বিএনপি জোটসহ সুপরিচিত নেতাদের নেতৃত্বাধীন দলগুলো নির্বাচন বর্জন করলেও যাতে দুনিয়াকে এটা দেখানো যায় যে, কমিশনে নিবন্ধিত ‘অধিকাংশ’ রাজনৈতিক দলই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে।

২০১৪ সালের নির্বাচনে এ ব্যাপারে লীগ সরকার বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিল। ৪১টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে মাত্র ১২টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। তাও কয়েকটি প্রায় কাগুজে সংগঠন। বিএনপি এবং গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন জাতীয় ব্যক্তিত্বের ৪-৫টি দল ছাড়া অন্যসব দলও যদি সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করত তাতেও কি তা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতো? নিবন্ধিত দলগুলোর দিকে তাকালেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। দলগুলো হচ্ছে— ১. বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২. বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি ৩. জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ৪. বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ৫. লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ৬. জাতীয় পার্টি-জেপি ৭. বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল ৮. কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ৯. বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ১০. গণতন্ত্রী পার্টি ১১. বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ ১২. বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ১৩. বিকল্পধারা বাংলাদেশ ১৪. জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ১৫. জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি ১৬. জাকের পার্টি ১৭. বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ ১৮. বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি ১৯. বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন ২০. বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ২১. বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ২২. ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপি ২৩. জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ২৪. গণফোরাম ২৫. গণফ্রন্ট ২৬. প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল-পিজিডি ২৭. বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ, ২৮. বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ২৯. ঐক্যবদ্ধ প্রগতি আন্দোলন ৩০. ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ ৩১. বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ৩২. ইসলামী ঐক্যজোট ৩৩. বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ ৩৪. ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ৩৫. বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ৩৬. জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) ৩৭. বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ৩৮. খেলাফত মজলিস ৩৯. বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ৪০. বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট-মুক্তিজোট ও ৪১. বাংলাদেশ ন্যাশনাল ফ্রন্ট। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন নির্বাচন কমিশন বাতিল করেছে। স্বীকার করতে হবে যে, জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বের দিক থেকে দলটি দেশের চতুর্থ বৃহৎ রাজনৈতিক দল। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন বাতিল হলেও দলটি এখনো একটি বৈধ রাজনৈতিক দল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ‘অপরাধী রাজনৈতিক দল’ হিসেবে চিহ্নিতকরণের পরও সরকার দলটিকে নিষিদ্ধ করেনি। এর একটা বাস্তব ভিত্তিও আছে। দলটি সারা দেশে বিস্তৃত। সংগঠন শক্তিশালী। নেতা-কর্মী এমনকি সমর্থকরাও কমিটেড। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.) এটিএন নিউজের এক টকশোয় বলেছিলেন, জামায়াতের ‘কোর’ ভোট ২ শতাংশ। ‘কোর’ ভোটের বাইরের ভোট বাদ দিলেও এ সংখ্যা ২০ লাখ। তাদের ২০ লাখ ভোট মানে তো ২০ লাখ ক্যাডার, যারা আদর্শের জন্য যে কোনো ঝুঁকি নিতে পারে— যা অন্য কোনো দলের নেতা-কর্মীরা পারে না। দল নিষিদ্ধ করলে এরা তো নিষিদ্ধ হবে না। তারা এতই সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত যে, সিদ্ধান্ত নিয়ে রাতারাতি একটি শক্তিশালী নতুন দল করে ফেলতে সক্ষম। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সরকার জামায়াতের সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে কী করবে, সে ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। বিএনপি থেকে বিযুক্ত করে পরোক্ষভাবে তাদের ভোট-সমর্থন আদায়ের চিন্তাভাবনা থেকে আগামী নির্বাচনের আগে জামায়াতে ইসলামীকে সরকার নিষিদ্ধ করবে না বলেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা। জামায়াত যে কটি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, প্রতিটিতেই তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এ ছাড়া নিবন্ধিত ৪১টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ আর মাত্র ১১টি দলের (সর্বমোট ১২টি দলের) বাইরে আর কারও প্রতিনিধিত্ব ছিল না। প্রিয় পাঠক! যে ৪১টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নাম আপনারা পড়লেন তার মধ্যে হাতে গোনা ৮-১০টি দলের বাইরে অন্যদের নাম কি কখনো শুনেছেন? আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত ছাড়া অন্যদের নামও কি বাংলাদেশের সব ভোটার জানে? যেসব যোগ্যতার মাপকাঠিতে একটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন দেওয়ার বিধান আছে, নিবন্ধিত সব দল কি সব শর্ত পূরণ করতে পেরেছে? অনেকের ৩০-৩৫ জেলা এবং শখানেক উপজেলায় কমিটি ও অফিস তো দূরের কথা, দেখানোর মতো কেন্দ্রীয় অফিসও নেই। কারও অফিস নিজের বাসার ঠিকানায়, কারও নাকি ব্রিফকেসে। কারা, কেন, কীভাবে এসব দলকে নিবন্ধন দিয়েছিলেন তা বোঝার জন্য মাথা ঘামিয়ে গবেষণার প্রয়োজন নেই। নতুন করে এ ধরনের আরও কিছু রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দিয়ে কী লাভ, যাদের জনগণের মধ্যে কোনো ভিত্তি নেই। এ ধরনের প্যাড ও বিবৃতিসর্বস্ব দলকে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন দেওয়ার পাঁয়তারার পেছনে কী মতলব থাকতে পারে তা কারও কাছেই দুর্বোধ্য নয়। একটি জাতীয় নির্বাচনে বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি-আওয়ামী লীগের কোনো একটি দল সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগের ভিত্তিতে যদি নির্বাচন বর্জন করে, প্যাড-বিবৃতিসর্বস্ব ১০০ দলও সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে তাকে কি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলা যাবে?

একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে এত শোরগোলের মধ্যেও একটা সংশয় আছে যে, ক্ষমতাসীন সরকার তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে সমান সুযোগ না দিয়েই নির্বাচন সম্পন্ন করতে চায়। বিএনপি নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের ওপর খুব জোর দিচ্ছে। তারা বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না এবং যদি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচন সরকার করতে চায় তারা সে নির্বাচন হতে দেবে না। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার শতভাগ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরও তাদের শর্ত পূরণ না হলে আবারও বিএনপির নির্বাচন বর্জনের একটি কড়া বার্তা এতে আছে। আর এও সত্য, বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে আরও কিছু পরিচিত দল একই পথে হাঁটতে পারে, যদি বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে অর্থবহ কোনো গণআন্দোলনের সূচনা করতে পারে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না। বিষয়টি উভয় পক্ষের জন্যই কঠিন ও জটিল। আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের ঝুঁকি নিলে গতবারের মতো এবার আর সরকার পার নাও পেতে পারে। গণতান্ত্রিক বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে সরকার। এবার আর ভারত থেকে কোনো ‘সুজাতা সিংয়ের’ আগমন ঘটবে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন না। অন্যদিকে ২০১৪ সালে লীগ সরকারের পক্ষ থেকে সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি দলটির ইতিহাসে যে সবচেয়ে বড় ভুল করেছিল তার খেসারত দিচ্ছে গত সাড়ে তিন বছর। ভুলের পুনরাবৃত্তি করেছিল পরের বছর ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাস। ব্যর্থ অসহযোগ আন্দোলন দলটিকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। হাজার হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা। তাদের সময় কাটে কোর্ট-কাচারির বারান্দায় অথবা ফেরারি অবস্থায়। দলটির ‘খাসলত’ এত খারাপ যে, দলের জন্য কাজ করতে গিয়ে আদর্শবাদী নিবেদিতপ্রাণ অগণিত যেসব নেতা-কর্মী আজ মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত, যারা নিজের ঘরে রাতে ঘুমাতে পারেন না, এলাকায় যেতে পারেন না, তারা কী করে মামলা চালান, জেলে কেমন আছেন, ফেরারি মুখগুলোর কীভাবে দিন কাটে, সে খবরও ‘বড় বাবুরা’ রাখেন না। বলা যায়, তাদের কত লোকের বিরুদ্ধে কত মামলা আছে সারা দেশে, তা কেন্দ্রের ‘কর্তাদের’ জানাই নেই। এ রকম সঠিক কোনো পরিসংখ্যানই নেই তাদের হাতে। ফলে ক্ষোভের ও ক্রোধের আগুনে জ্বলছেন অনেকে। আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতি প্রত্যাশা করছেন ভুক্তভোগী নেতা-কর্মীরা। এ অবস্থায় আবার নির্বাচন বর্জনের হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তা দলের অস্তিত্বই বিপন্ন করতে পারে। দলটি মুসলিম লীগের পরিণতিও লাভ করতে পারে আবার ভুল করলে। তবে ‘দৌড় প্রতিযোগিতা’ শুরুর আগেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিযোগীকে ‘ল্যাংড়া-খোঁড়া’ করে দিয়ে পরে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আদুরে আহ্বানই বা মেনে নিতে হবে কেন? প্রতিযোগিতায় সমানতালে অংশগ্রহণের পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব শুধু নির্বাচন কমিশনের নয়, সরকারেরও। সরকারের বরং বেশি। নির্বাচন কমিশন ৯০ দিনের বা শিডিউল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচন পর্যন্ত সময়ের দায়িত্ব নিতে পারে; কিন্তু তার আগের দায়িত্ব তো সরকারের। যেমন— এখন সরকারি দল যেভাবে নির্বাচনের পক্ষে কাজ করতে পারছে, বিএনপি তো তা পারছে না। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে। কিন্তু তারা তুমুল আন্দোলন করে সরকারকে তাদের শর্ত মানতে বাধ্য করেছিল। বিএনপি তেমন কিছু করতে পারছে কই? না পারার কারণ মানুষ জানে। দলটির বিপুল জনসমর্থন থাকলেও সংগঠনের ভিত্তি বড় দুর্বল, অধিকাংশ জেলায়ই পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই, উপজেলায় তো নেই-ই। নেতৃত্ব আরও দুর্বল। অনেকের ‘আমলনামাই’ খারাপ। দল চালায় কর্মচারীরা। ক্যারিয়ার রাজনীতিবিদদের কোনো মূল্য নেই। এই নেতৃত্বে, এ সংগঠন নিয়ে বিএনপির পক্ষে আওয়ামী লীগের মতো চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছে না দেখে সরকার যদি সুযোগ নিতে চায়, তাহলে একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সব সম্ভাবনাই বিনাশ হয়ে যেতে পারে। তাতে সরকারি দলেরও যে খুব বেশি লাভ হবে এবার তা বলা যায় না। সংসদ, সংবিধানের ভয় না দেখিয়ে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে একটি নিবিড় রাজনৈতিক সমঝোতাই এখন সময়ের দাবি। এ ব্যাপারে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। একসময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাও সংবিধানে ছিল না; কিন্তু কালের চাহিদায় রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে তা সংবিধানে সংযোজিত হয়েছিল। পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ প্রধান বিচারপতি পদে বহাল থেকেই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান থাকতে পারবেন এবং নির্বাচন শেষে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে আবার প্রধান বিচারপতি পদে ফিরে যাবেন, তা সংবিধানে ছিল না। রাজনৈতিক পরিস্থিতির দাবিতে তিন জোটের সমঝোতার ভিত্তিতে তাও সম্ভব হয়েছিল। নির্বাচিত সংসদের প্রথম অধিবেশনে সবাই মিলে তা অনুমোদন করে দিয়েছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতেও তেমন একটি রাজনৈতিক সমঝোতাই অংশগ্রহণমূলক ও অর্থবহ একটি সংসদ নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে। প্রধান দুই দলের সদিচ্ছা, আন্তরিকতাই এজন্য যথেষ্ট।

নির্বাচন কমিশন কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছে ভালো কথা। এগুলো তাদের রুটিন কাজ। সব জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে সব নির্বাচন কমিশনই এ কাজগুলো করেছে। এ কাজে মূল স্টেকহোল্ডার প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা অপরিহার্য ঠিক, কিন্তু সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে নির্বাচন কমিশনের একক চেষ্টায় একটি অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা অসম্ভব। কেননা বর্তমান প্রশাসনিক সেটআপের ওপর সরকারের প্রভাব খুবই দৃঢ়। নির্বাচনকালে পুরো প্রশাসনও যদি নির্বাচন কমিশনের অধীন ন্যস্ত করা হয়, সরকারের সুইট ডিজায়ারের বাইরে তারা কাজ করবে বলে মনে হয় না।

সরকারকে এ ব্যাপারে নিবৃত করার জন্য বিরোধী দলের পক্ষ থেকে যে রাজনৈতিক গণশক্তির চাপ সৃষ্টি প্রয়োজন বিএনপি তা কতটুকু পারবে তার ওপরও নির্ভর করছে অনেক কিছু। বিএনপি কি পারবে নির্বাচনকালে সরকারকে সংযত আচরণে বাধ্য করতে? সে সাংগঠনিক শক্তি কি তাদের আছে?

     লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর