শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

নোয়াখালী উপকূলে নতুন সম্ভাবনা সূর্যমুখী

শাইখ সিরাজ

নোয়াখালী উপকূলে নতুন সম্ভাবনা সূর্যমুখী

আজ আপনাদের বলতে চাই সূর্যমুখীর কথা। সূর্যমুখী, অর্থাৎ সানফ্লাওয়ার মনে করিয়ে দেয় ভিনসেন্ট ভ্যানগঘের বিখ্যাত চিত্রকর্ম Sunflowers -এর কথা। আমাদের অনেকেই হয়তোবা দেখেছেন জিওভানা চরিত্রে সোফিয়া লরেন অভিনীত কালজয়ী চলচ্চিত্র Sunflower। এ তো গেল চলচ্চিত্র আর শিল্পকর্মের কথা। ইতিহাস আর কৃষ্টির কথা। যেখানে সূর্যমুখীকে আমরা দেখেছি বিষাদের সুরে বা রঙিন সম্ভাবনায় দোল খেতে। কিন্তু সূর্যমুখী শুধু ফুল নয়, ফসলও। পাঠক! আপনাদের সূর্যমুখীর অমিত এক সম্ভাবনার গল্পই শোনাতে চাই আজ। নোয়াখালীর সুবর্ণচরে আবাদ হচ্ছে সূর্যমুখীর। এর আগে সেই আশির দশকেও একবার চেষ্টা চালানো হয়েছিল সূর্যমুখী চাষের। তখন রংপুরে দেখেছিলাম সূর্যমুখীর চাষ। সূর্যমুখীর চাষ বাড়ানোর সে প্রচেষ্টা তখন সফল হয়নি। এবার নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গ্লোব অ্যাগ্রো লিমিটেডের চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশিদ হাতে নিয়েছেন সূর্যমুখী চাষের এক বিশাল প্রকল্প। সূর্যমুখী তেলকে ভোজ্যতেল হিসেবে মানুষের হাতে তুলে দিতেই তার এ প্রচেষ্টা। দেশের মানুষও সচেতন হয়েছে, জানতে শিখেছে। তারা জানে সূর্যমুখীর তেল ভোজ্যতেল হিসেবে উত্কৃষ্টমানের। সে ভাবনা থেকেই সুবর্ণচরের কয়েকটি এলাকার প্রায় ১৫৬ একর জমিতে আবাদ করেছেন সূর্যমুখী। তিনি ভাবছেন এতে আমাদের আমদানিনির্ভর ভোজ্যতেলের কিছুটা চাহিদা মিটবে। আর কৃষকও এগিয়ে আসবেন সূর্যমুখী চাষে এবং সূর্যমুখী হয়ে উঠবে কৃষকের জন্য দারুণ এক অর্থকরী ফসল।

একসময় এ দেশে সূর্যমুখীর চাষ হয়েছে অনেকটা শখের বশে। তারপর বাণিজ্যিক চিন্তা থেকে কেউ কেউ সূর্যমুখী চাষ শুরু করেছেন। উপকূলীয় অঞ্চলে সূর্যমুখী চাষ যে অন্য যে কোনো ফসলের চেয়ে লাভজনক হয়ে উঠবে এই চিন্তাটি ভালোমতো করা হয়নি। সিডর ও আইলা-পরবর্তী সময়ে উপকূলীয় অঞ্চলে যখন লবণাক্ততার প্রভাব বেড়ে যায় তখন সূর্যমুখীর আবাদ সময়োপযোগী হলেও বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি ভাবা হয়নি। অথচ এ বিষয়ে অগ্রসর হয় আমাদের পাশের দেশ ভারত। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে হাইড্রোপনিক কৃষি বিষয়ে কাজ করতে গেলে সেখানে কথা হয় পশ্চিমবঙ্গের বিধানচন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. আনন্দময় পুস্তের সঙ্গে। তিনি বলেছিলেন, লবণাক্ত এলাকায় সূর্যমুখী চাষের উপযোগিতা প্রসঙ্গে। তিনি জানান, সূর্যমুখী এমন একটা শস্য যা পিএইচ ৮.৫ পর্যন্ত চাষ করা যেতে পারে। খুব অল্প দিনে অর্থাৎ ৮৫ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে বীজ থেকে বীজ উৎপাদন সম্ভব। বীজে তেল যেমন পাওয়া যায় ভালো, তেমন ভালো তেলের মান। সবচেয়ে বড় কথা তেলের বাজার ভালো। তিনি অবশ্য বিশ্ববাজার ও ভারতের বাজারের দিকটাই ইঙ্গিত করছিলেন। তিনি আরও বলেন, সূর্যমুখী লবণসহিষ্ণু জমিতে হতে পারে, আবার অন্যান্য জমিতেও হতে পারে। বলছিলেন সিডর ও আইলা-পরবর্তী সময়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন এলাকার লোনা জমিতে সূর্যমুখীর চাষ বেশ সম্প্রসারিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ায় ব্যাপক চাষ হচ্ছে সূর্যমুখীর। বাংলাদেশের জমিও সূর্যমুখী চাষের জন্য বেশ উপযুক্ত। তবে সূর্যমুখী চাষের সাফল্য আনতে প্রয়োজন বীজ থেকে তেল আহরণের সহজলভ্য প্রযুক্তি।

সত্যি কথা বলতে, সিডর-আইলা পরবর্তী সময়ে উপকূলীয় জেলাগুলোয় সূর্যমুখী চাষের তেমন একটা প্রসার এখন পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়নি। এই প্রথমবারের মতো এ ক্ষেত্রে নতুন একটি সম্ভাবনা জেগেছে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে। সুবর্ণচরের চর বজলুল করীম, চর আমানুল্লাহ ও পশ্চিম চরভাটার প্রায় ১৫৪ একরে এবার সূর্যমুখীর চাষ হয়েছে। দু-তিন বছর আগেও এসব চরাঞ্চল একেবারে পতিত পড়ে থাকত। পরিত্যক্ত এসব জমিতে ফসল ফলানোর উদ্দেশ্যে ২০১৬ সালে প্রথম পরীক্ষামূলক ৩৫ একরে সূর্যমুখী চাষের উদ্যোগ নেয় গ্লোব অ্যাগ্রো লিমিটেড। এ বছর এসে বেশ সাফল্য পেয়েছে তারা। ১৫৪ একর জমিতে সূর্যমুখী চাষ করতে খরচ হয় ৩৫-৪০ লাখ টাকা। এ থেকে লাভ হয় ১০-১৫ লাখ টাকা। সূর্যমুখী চাষ করায় ৮৫ থেকে ৯০ দিনে পাওয়া যাচ্ছে ফসল। সব খরচ বাদে এই লাভও কম নয়।

এক মাঠ সূর্যমুখী মানে অদ্ভুত এক সৌন্দর্যের আধার। এ সৌন্দর্য এলাকার দৃশ্যপট যেমন পাল্টে দেয়, একইভাবে পাল্টে দেয় কৃষকের চিন্তাও। সূর্যমুখী হয়ে উঠতেই পারে এ এলাকার সবচেয়ে লাভজনক ফসল। চরাঞ্চলের পরিত্যক্ত সব চরেই সূর্যমুখী চাষের দারুণ সম্ভাবনার কথা জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। কৃষক সূর্যমুখীর ফলন দেখে উৎসাহী হয়ে উঠছেন। কেউ কেউ বললেন, এ মৌসুমে সয়াবিন চাষ করলে বৃষ্টির পানি জমে ফসলের ক্ষতি হয়। কিন্তু সূর্যমুখীর তেমন ক্ষতিই হয় না। অনেকেই ভাবছেন সূর্যমুখীর ফলন বাড়ানোর কথা। নতুন অনেক কৃষকও উৎসাহী হচ্ছেন পুরনোদের দেখে। তবে সূর্যমুখী বাজারজাত করা এখনো সহজ হয়ে ওঠেনি। এখানেই আটকে আছেন কৃষক। কৃষকের অভিযোগ, বাজারজাতকরণে এখনো নানামুখী সমস্যা রয়ে গেছে। স্থানীয়ভাবে তৈরি হয়নি বাজার। অন্যদিকে, সূর্যমুখী চাষ সম্পর্কে অর্থাৎ এর পূর্ণ চাষ পদ্ধতি, প্রযুক্তি সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই কৃষকের। যতটুকুই তারা করছেন তা তাদের নিজস্ব মেধা দিয়েই। বহু কৃষক সূর্যমুখী চাষে প্রশিক্ষণ চান। অন্যরা জানান, সূর্যমুখী বীজ কীভাবে সংগ্রহ করতে হয়, কী তার সংরক্ষণ কৌশল এসব জানতে পারলে আরও বেশিসংখ্যক কৃষক সূর্যমুখী চাষে আগ্রহী হতেন। এসব সুবিধা যদি কৃষক পান, তাহলে সূর্যমুখী চাষে এক বিপ্লব ঘটে যেতে পারে। যেমনটি ঘটেছে ভুট্টার ক্ষেত্রে। কার্যকর সহযোগিতায় এগিয়ে যেতে পারে সূর্যমুখী চাষ, এমনটাই বলছেন কৃষক। সূর্যমুখী থেকে তেলের পাশাপাশি মৌচাষেরও সম্ভাবনা রয়েছে। সূর্যমুখীর ফুল বড় বলে প্রচুর মধু আহরণ সম্ভব। আবার মৌচাষে প্রাকৃতিক পরাগায়নের জন্য সূর্যমুখীর ফলনও হয় বেশি।

কৃষকের চোখে নতুন এই স্বপ্ন জাগানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রয়েছে গ্লোব অ্যাগ্রো লিমিটেডের চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশিদের। নোয়াখালী উপকূলে সূর্যমুখী আবাদ ও তা প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজটি তার কাছে বড় এক চ্যালেঞ্জ। এ যাত্রায় তিনি সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে। হারুন-অর-রশিদ চান বাংলাদেশের মানুষ যেন স্বাস্থ্যসম্মত তেল খেতে পারে। বাংলাদেশে যারা বিত্তশালী এবং স্বাস্থ্যসচেতন তারা এখন বেশি দামে কিনে খাচ্ছেন সূর্যমুখী তেল। বাংলাদেশে সূর্যমুখী চাষ যেমন সম্ভব তেমনি সম্ভব বীজ থেকে তেল উৎপাদন; যা আমাদের দেশের তেলের চাহিদা মেটাবে। আবার এটা নতুন এক ব্যবসার উজ্জ্বল সম্ভাবনাও। কেননা এদিকে কেউ এখনো ব্যবসায়িক মনোযোগ দেননি। সূর্যমুখীর অর্থকরী সম্ভাবনার দিকটি দেখে নিশ্চয়ই অনেকেই তাদের মনোযোগ বাড়াবেন বিনিয়োগে।

প্রিয় পাঠক! বাংলাদেশে ২১ লাখ টন তেল আমদানি করতে বছরে খরচ হয় প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। সূর্যমুখী তেল এ খরচের পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারে। কারণ সূর্যমুখী বীজে তেল থাকে শতকরা ৪০ ভাগ, যেখানে সয়াবিন তেলে থাকে মাত্র ১৬ ভাগ। হারুন-অর-রশিদ সূর্যমুখী থেকে তেল উৎপাদনের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন কারখানা। বছরে ৬ লাখ টন বীজ থেকে তেল উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে তার কারখানার। প্রথম অবস্থায় তিনি ৬ হাজার টন বীজ উৎপাদন করতে পেরেছেন, বাকিটা আমদানি করতে হবে। দেশের কৃষক উদ্যোগী হলে তাও দেশেই আবাদ সম্ভব। হারুন-অর-রশিদ সূর্যমুখী চাষ নিয়ে একটি হিসাব দেখালেন— ১ একর চাষ করতে খরচ হয় সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা। ১ টন ফলন হলে ৯০-১০০ দিন পরই ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে ১৫ হাজার টাকা লাভ হবে। আর সূর্যমুখী যে কোনো জমিতেই চাষ করা যায়। শুধু সূর্যমুখী উৎপাদন নয়, এর প্রক্রিয়াজাতকরণ নিয়ে কৃষক যেখানে চিন্তিত সেখানেও নতুন এক বার্তা জানান দিচ্ছেন হারুন-অর-রশিদ। ইতিমধ্যে তিনি গড়ে তুলেছেন দেশের প্রথম বৃহৎ পর্যায়ে সূর্যমুখী বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। চরাঞ্চলের গুরুত্ব বিবেচনা করে স্থানীয় কৃষককে সূর্যমুখী চাষে উদ্বুদ্ধ করতে বিএডিসি একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। কৃষকও যাতে সঠিক সময়ে সূর্যমুখী বিক্রি করতে এবং ভালোমানের বীজ সংগ্রহ করতে পারেন সে উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যে বিএডিসি সুবর্ণচরে সূর্যমুখী বীজ, সয়াবিনসহ অন্যান্য ডাল এবং তেলবীজ বর্ধন খামার স্থাপন করেছে, জানালেন বিএডিসির উপপরিচালক মাহমুদুল আলম।

সব মিলিয়ে সূর্যমুখী নোয়াখালীর সুবর্ণচরের কৃষকের জন্য নতুন এক সূর্যের সন্ধান দেবে, এই প্রশ্নে এলাকার মানুষের মনে নতুন আশা জাগিয়েছেন এ এলাকার সন্তান হারুন-অর-রশিদ। প্রিয় পাঠক! কৃষি এখন অত্যন্ত পরিকল্পিত ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব নিয়ে এগিয়ে চলেছে। শুধু উৎপাদন নয়, তার প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজার ও ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত হিসাব এখন কৃষককেই রাখতে হয়। একই সঙ্গে রয়েছে বৈরী জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলা করে টিকে থাকার বিষয়। এসব বিষয় বিবেচনায় নোয়াখালী উপকূলে সূর্যমুখী চাষ এবং তা প্রক্রিয়াজাতকরণ চালু করার উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যে শুভবার্তা এখানে সূচিত হয়েছে, অল্প দিনেই তা দারুণ সাফল্যে পৌঁছে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

            [email protected]

সর্বশেষ খবর