রবিবার, ১৬ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

জঙ্গি দমনে বিশ্ব হিমশিম খাচ্ছে আর আমরা সাফল্য পাচ্ছি

বিশেষ সাক্ষাৎকারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল

জঙ্গি দমনে বিশ্ব হিমশিম খাচ্ছে আর আমরা সাফল্য পাচ্ছি

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূলে সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। জঙ্গিবাদ দমনে বিশ্ব হিমশিম খাচ্ছে আর আমরা সেখানে সাফল্য পাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘দেশে সামাজিক অপরাধ কমে এসেছে। সুশাসন বাড়ছে।’ মাদক নিয়ন্ত্রণে সামাজিক প্রতিরোধের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। তিনি জানান, ‘মিয়ানমার ইয়াবা প্রসারে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করছে। আমাদের অনুরোধে ভারত সীমান্ত এলাকা থেকে ফেনসিডিলের কারখানা সরিয়ে নিচ্ছে।’ মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এআরপি) প্রবর্তনকে বড় সাফল্য হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সময়মতো এটা করতে না পারলে আমাদের অসংখ্য প্রবাসীকে দেশে ফিরে আসতে হতো। আমরা ১ কোটি ৮০ লাখ এমআরপি দিয়েছি।’ সোমবার দুপুরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন— শিমুল মাহমুদ ও শাবান মাহমুদ

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল হয়নি। এ ধারার কারণে গণমাধ্যমকর্মীরা মিথ্যা মামলায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন। গত তিন মাসে ২২ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এর পরিবর্তে একই আদলে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হচ্ছে।

আসাদুজ্জামান খান কামাল : তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আরও পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যেহেতু আইনটি রিভিউ করার প্রশ্ন আসছে তাই তা কার্যকর থাকার কারণে থানায় মামলা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। খুব বেশি জড়িয়ে না পড়লে কিছু করছে না পুলিশ। সাংবাদিকদের যাতে হয়রানির শিকার হতে না হয় আমরা সব সময় সেটা দেখি। আমাদের নির্দেশনা আছে, সাংবাদিকরা যখন এ ধরনের মামলার সম্মুখীন হন তখন শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে অভিযোগপত্র দেওয়া হয় না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : পুলিশের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। তল্লাশির নামে পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে হয়রানি করার অভিযোগ আসছে। রাজধানীর একটি ইংরেজি দৈনিকের একজন ফটোসাংবাদিক আশিক মোহাম্মদকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

আসাদুজ্জামান খান কামাল : এ রকম অভিযোগ আমরাও শুনি। ইয়াবা এখন এত বেশি মানুষের কাছে চলে এসেছে এ জন্য পুলিশও হিমশিম খাচ্ছে। দু-এক জায়গায় এ ধরনের ঘটনা যে ঘটে না এমন নয়। যারা ঘটাচ্ছে যখনই আমাদের নজরে আসে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশনে যাই। আমরা তাকে ক্লোজ করি, সাসপেন্ড করি। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বিচারের ব্যবস্থা করি। পুলিশ হোক আর যেই হোক আমরা ছাড় দিই না। দোষী সাব্যস্ত হলে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যে ঘটনাটি বললেন, তা বর্তমানে আদালতে চলে গেছে। এ ব্যাপারে আদালতই সিদ্ধান্ত নেবে, জামিন দেবে কিনা। এসব কেসের ক্ষেত্রে আদালত সব সময় জামিন দিয়ে থাকে। আদালতে নিশ্চয়ই তার জামিন হবে। এটা যদি ভুলবশত ধরা হয়ে থাকে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হয়ে থাকে, তদন্তের মাধ্যমে ভুল ধরা পড়লে তাকে রিলিজ করে দেওয়া হবে। নিশ্চয়ই আমাদের তদন্ত কর্মকর্তা বিষয়টি দেখবেন। বিষয়টি আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে দেখব।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : দেশব্যাপী মাদকের বিস্তার রোধে আপনারা কী করছেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর জনবল সংকটে ভুগছে। দেশে মাদক প্রবেশের গুরুত্বপূর্ণ রুট টেকনাফে মাত্র দুজন কর্মী নিয়ে কাজ করছে অধিদফতর।

আসাদুজ্জামান খান কামাল : আমরা যখন ক্ষমতায় আসি তখন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ছিল ঠুঁটো জগন্নাথ। তিন জেলা মিলিয়ে একজন অফিসার কাজ করতেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীর চরম ঘাটতি ছিল। সেই জায়গা থেকে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় এখন প্রতি জেলায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অফিসার রয়েছেন। সমাজে মাদকের ভয়াবহতা ব্যাপক। তবে আমরা বসে নেই। আমাদের পাশের দেশ ভারত ও মিয়ানমার থেকে এ দেশে মাদক আসছে। বাংলাদেশ মাদক উৎপাদন করে না। দুই ধরনের মাদক আমাদের এখানে আসে। যেমন লিকুইড ফেনসিডিল আসছে ভারত থেকে। ইয়াবা আসছে মিয়ানমার থেকে। মিয়ানমার রাষ্ট্রীয়ভাবে ইয়াবার পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এগুলোর বিপণন তাদের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। মাদক নিয়ন্ত্রণে ভারত সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অনেক কাজ করছি আমরা। ভারত সরকার আমাদের সঙ্গে একমত হয়েছে, তারা সীমান্ত এলাকায় ফেনসিডিলের কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছে। আমাদের দাবির কারণে ভারত সীমান্ত এলাকা থেকে ফিনসিডিলের কারখানা সরিয়ে নিচ্ছে। শুধু ফেনসিডিল নয়, আরও যেসব এলাকা দিয়ে মাদক আসত সেগুলো তারা বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের ডিসি, তাদের ডিএম (ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট) পর্যায়ে নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে। মাদক চোরাচালান, সীমান্ত পাচারসহ বিভিন্ন বিষয় তারা সমাধান করেন। তার পরও বিজিবি-বিএসএফ পর্যায়ে নিয়মিত পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সীমান্তের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। আমরা তাদের সহযোগিতা করি, তারাও আমাদের সহযোগিতা করেন। সমন্বয়ের মাধ্যমে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। আমাদের দুর্গম এলাকাগুলোয় যেখানে আমাদের অফিসাররা রাস্তা দিয়ে যেতে পারেন না, তখন ভারতের রাস্তা দিয়ে যাতায়াতে তারা আমাদের সহায়তা করেন। এর ফলে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেনসিডিল আসা কমে গেছে। তবে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসা বেড়েছে। আমাদের সীমান্ত ছাড়াও মিয়ানমারের অনেক জায়গায় ইয়াবা তৈরি হয়। ইয়াবা তৈরিতে তাদের সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। এরা শুধু আমাদের দেশই নয়, অন্য জায়গায়ও ইয়াবা সরবরাহ করে। আমাদের দেশের একেবারে বর্ডারসংলগ্ন এলাকায় তাদের ইয়াবার ফ্যাক্টরি রয়েছে। আমাদের এখানে যেসব রোহিঙ্গা আসে তারাই মূলত ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারাই ইয়াবা নিয়ে আসে। টেকনাফ থেকে কক্সবাজার, তারপর চট্টগ্রাম সেখান থেকে ঢাকায় আনা হয়। ইয়াবাগুলো এতই ছোট যে সেগুলো বহন করতে কোনো সমস্যা হয় না। যে কোনোভাবেই ইয়াবা নিয়ে আসা যায়। ইয়াবা চোরাচালান প্রতিরোধে আমাদের বর্ডার গার্ড, কোস্টগার্ড, র‌্যাব, পুলিশ সর্বক্ষণ কাজ করছে। নাফ নদ এবং আরও কিছু সীমান্ত রয়েছে যেগুলো দিয়ে ইয়াবা চলে আসছে। আমরা মিয়ানমারের নারকোটিক্স বিভাগের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা অনেক কিছু স্বীকার করেছেন, তবে কার্যকর ফলপ্রসূ কিছু এখনো হয়নি। আমরা আশা করছি, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ যে আলোচনা শুরু করেছেন, সেই আলোচনার মাধ্যমে ভারতের মতো ফলপ্রসূ কিছু হবে। আর মিয়ানমারে মাদকের যারা ব্যবসা করছেন তাদের আমাদের লোকেরা সহযোগিতা না করলে তারা বিক্রি করবেন কোথায়? আমাদের লোকেরাই মাদক বিক্রির সহযোগী। মাদকের ব্যবসায় লাভ এত বেশি যে, সবাই চিন্তা করে এটা করলে দ্রুত দৃশ্যপট পাল্টে ফেলা যায়। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে এত বেশি অত্যাচারিত হয়েছে, তাদের মহিলারা অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন, ছেলেমেয়েদের মেরে ফেলা হচ্ছে, পুরুষদের শেষ করে দিচ্ছে। এ জন্য তারা আমাদের এখানে চলে আসছেন। চলে আসার সময় তাদের মাধ্যমে ইয়াবা আসছে। তারা রুটটা সচল রাখছেন। এ ছাড়া যারা মাছ ধরেন, সেই মাছ ধরার নৌকাগুলোর মাধ্যমে আসে। সবকিছুই আমাদের নজরদারির মধ্যে আছে। আমাদের বিজিবি এ ক্ষেত্রে কাজ করছে। পাশাপাশি তামাক নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমরা বলেছিলাম, তামাক হলো বিষ। তামাকে লাভের কিছু নেই। সবকিছুই লোকসান, স্বাস্থ্যহানি। এটা নিয়ে আমরা সামাজিক আন্দোলন করছি। এখন তামাকের ব্যবহার কমে গেছে। সে জন্য আমরা স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসায় কাজ করছি। মসজিদের ইমামদের বলছি, নামাজের আগে আপনারা মাদক, তামাকের ক্ষতিকর দিক নিয়ে এক মিনিট কথা বলুন। স্কুলের টিচারদের বলেছি, আপনারা শিক্ষার্থীদের বলেন, মাদক, তামাক খেলে অবধারিতভাবে মেধা নষ্ট হয়, এর কোনো উপকারিতা নেই। আমরা সামাজিক আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে চাই। সেই জায়গাটিতে কাজ করছি, আমাদের জনপ্রতিনিধিরাও কাজ করছেন। ঐশীর কথা আমাদের সবারই মনে আছে। যে তার বাবা-মাকে হত্যা করেছে। আমরা সেই জায়গাটিতে সবাই কাজ করলে মাদকের অভিশাপ থেকে নিষ্কৃতি পাব। সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি আমাদের র‌্যাব, পুলিশও ভালো কাজ করছে। তারা লাখ লাখ পিস ইয়াবা ধরছেন, ধ্বংস করছেন। ইয়াবার ব্যবসায়ীদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সাজা দেওয়া হচ্ছে। অনেক সময় সাক্ষীর অভাবে সাজা দেওয়া যাচ্ছে না। মাদক ব্যবসায়ীদের জন্য ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট রয়েছে। বর্তমানে আমাদের কারাগারগুলোয় ৩৫ হাজার বন্দীর ধারণক্ষমতা থাকলেও এখন বন্দী আছেন প্রায় ৭৮ হাজার। এর মধ্যে মাদক মামলার অপরাধী প্রায় ২০ শতাংশ। কাজেই আমরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিচ্ছি। আমরা ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার যে স্বপ্ন দেখছি, সে জায়গায় যেতে পারব না যদি মাদককে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারি।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় সরকার কী করছে? একের পর এক জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় সামাজিক প্রতিরোধের বিষয়টি উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে।

আসাদুজ্জামান খান কামাল : না, এটা সঠিক নয়। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে আমাদের জনগণ সহযোগিতা করছে বলেই আমরা জঙ্গি দমন করতে পারছি। আমাদের পুলিশ বাহিনী অত্যন্ত তত্পর। তারা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। দক্ষতার পাশাপাশি তাদের সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সমাজকে যে ডাক দিয়েছিলেন সর্বস্তরের মানুষকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য, সবাইকে বলেছিলেন, ঘুরে দাঁড়ান। জঙ্গিবাদ কোনো ধর্মের বিষয় নয়। কোনো ধর্মেই মানুষ হত্যার স্থান নেই। আজ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার ছাত্ররাও প্রতিবাদ করছেন। তারা সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ চান না। জঙ্গিবাদকে ঘৃণা করেন। সমাজ কিন্তু বুঝতে পারছে, এই জায়গাটি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আমরা শেষ হয়ে যাব। সে জন্যই আমরা জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আটক জঙ্গিরা একের পর এক জামিনে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ চায় জঙ্গি নির্মূল হোক। সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে বলপ্রয়োগ করে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।

আসাদুজ্জামান খান কামাল : আমি তো বলেছি, সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। সমাজ কিন্তু আজ এগিয়ে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সারা দেশে জঙ্গিবিরোধী কমিটি হয়েছে। জেলা, উপজেলা/থানা, ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি হয়েছে। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দাদের তত্পরতায় যাদের আমরা ধরছি, তাদের আইনের কাছে সোপর্দ করলে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে তারা অনেকে জামিন পেয়ে যাচ্ছে। আবার এমন ঘটনাও আছে, জঙ্গিদের বাবা-মায়েরা তাদের ধরিয়ে দিচ্ছেন। এটাই প্রমাণ করে যে, আমাদের সমাজ তাদের ঘৃণা করে। সমাজ তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। যারা অভিযানের সময় মারা গেছে, তাদের লাশ নিচ্ছে না পরিবার। সমাজ তাদের গ্রহণ করছে না। সমাজ তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সরকার ভিন্নমত সহ্য করছে না। তারা সভা-সমাবেশ করতে পারছে না। বিরোধী নেতা-কর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে।

আসাদুজ্জামান খান কামাল : বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে তাদের অত্যাচারের মাত্রা ছিল অনেক বেশি। আমাদের হাজার হাজার কর্মীর নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। জেল-জুলুম করা হয়েছে। সেই সময়ের অত্যাচার আপনারা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ওয়াদা করেছিলেন, তিনি দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন। তার নির্দেশনায় আজ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আপনারা দেখেছেন, আমাদের দলীয় কোনো নেতা অন্যায় করলে তাকেও ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। কাজেই কে বিএনপি করল, কে জামায়াত করল, কে আওয়ামী লীগ করল তা বিবেচনা করা হচ্ছে না। মুখ্য বিষয় হলো যারা অপরাধ করছে, তারা শাস্তি পাচ্ছে। অপরাধীরাই শাস্তি পাচ্ছে, দলীয় বিবেচনায় কারও শাস্তি হচ্ছে না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচার হলো না দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ বছরেও। এ হত্যা মামলাটি বর্তমানে কোন পর্যায়ে আছে?

আসাদুজ্জামান খান কামাল : এটা হাই কোর্টের নির্দেশনায় এখনো তদন্ত পর্যায়ে। পুলিশ বাহিনীর একটি অংশ এটা তদন্ত করছে। আমি আশাবাদী তারা যে কোনো সময় রিপোর্ট দেবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : এক বছর পর দেশে সাধারণ নির্বাচন। এখনো অসংখ্য মানুষের হাতে অবৈধ অস্ত্র। পার্বত্য তিন জেলায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বাড়ছে। এ ব্যাপারে সরকারের চিন্তাভাবনা কী?

আসাদুজ্জামান খান কামাল : প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। তিনি আমাদের সেভাবেই নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা প্রায়ই চিরুনি অভিযান চালাচ্ছি। যে জায়গায় সন্দেহ হয়, সেখানে ক্যাম্প বসিয়ে চেক করা হচ্ছে। অস্ত্র উদ্ধারের প্রচেষ্টা নেওয়া হচ্ছে। নিয়মিত এটা চলছে। আমাদের গোয়েন্দারা কাজ করছেন। যথেষ্ট অস্ত্র আমরা উদ্ধার করেছি। সুন্দরবনের অর্ধশত জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছে। সন্ত্রাসী, জঙ্গিরা আত্মসমর্পণ করছে। এদিকে রোহিঙ্গারা অত্যাচারিত হয়ে মাঝে মাঝেই আমাদের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় এসে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়। যখন যে খবর আসছে আমরা প্রতিরোধ করছি। আপনারা দেখেছেন, কয়েক বছর আগে আমরা সীমান্ত এলাকায় বিপুল অস্ত্র উদ্ধার করেছি। যেগুলো আমরা মনে করি, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সেখানে রেখে গিয়েছিল। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর স্পষ্ট বক্তব্য, আমাদের দেশের এক ইঞ্চি ভূমিও কোনো বিদেশি সন্ত্রাসীকে ব্যবহার করতে দেব না। সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী নেতা-কর্মীদের গুমের অভিযোগ রয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এ ব্যাপারে সরকারকে অভিযুক্ত করছে।

আসাদুজ্জামান খান কামাল : গুম সম্পর্কে আমি সব সময় বলে থাকি, যাদের গুম করা হয়েছে বলা হয়, তাদের অনেককে পরে খুঁজে পাওয়া যায়। অনেক কারণে মানুষ আত্মগোপনে যায়। ব্যবসায় যখন লসের সীমা থাকে না, পাওনাদারের ভয়েও অনেকে আত্মগোপনে যায়। তখন তার স্ত্রী এসে গুমের অভিযোগ করেন। অবৈধ সম্পর্কের কারণেও অনেকে গুম হন। তখন মেয়েটি বা ছেলেটির অভিভাবকরা গুমের অভিযোগ করেন। পুলিশের টার্গেট অনেক ক্রিমিনাল নিজেরা আত্মগোপনে যায়, গা ঢাকা দেয়। ক্রাইম করে, ব্যবসায় লস করে, সামাজিক প্রেক্ষাপট তাদের অনুকূলে না থাকলে অনেকে আত্মগোপনে যায়। পুলিশ যদি কোনো অভিযোগে কাউকে ধরে তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে সোপর্দ করতে হয়। আদালতের মাধ্যমেই তাদের রিমান্ডে নিয়ে আসা হয়। বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিনকে গুম করা হয়েছে বলা হয়, তিনি কোন ফাঁকে ভারতে চলে গিয়েছেন তাকেও যদি গুম বলা হয় সেটা তো গুম         হলো না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : কোনো বড় ঘটনা ঘটলে দেখা যায় পুলিশ প্রথম দিকে তত্পর থাকে। পরে স্তিমিত হয়ে যায়। কেন?

আসাদুজ্জামান খান কামাল : এটা ঠিক নয়। প্রথম অবস্থায় আমাদের তাত্ক্ষণিক একটা ব্যবস্থা নিতেই হয়। তার পরও আমাদের গোয়েন্দা, তদন্ত কর্মকর্তারা শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে চার্জশিট দেন না। আমাদের তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রতি নির্দেশ রয়েছে তিনি সবকিছু নিশ্চিত না হয়ে চার্জশিট দিলে আসামি আদালত থেকে ছাড়া পেয়ে যায়। আমাদের বিচারকরা মাঝে মাঝেই বলেন, আপনাদের চার্জশিটে দুর্বলতা থাকায় আমরা অনেক সময় শাস্তি দিতে পারি না। অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়। তাদের শাস্তি কমে যায় বা বেকসুর খালাস পেয়ে যায়।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : দেশে সামাজিক অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। সামাজিক অপরাধও বাড়ছে। সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য সরকার কী করছে?

আসাদুজ্জামান খান কামাল : এ ক্ষেত্রে আমি দ্বিমত প্রকাশ করছি। আমি নিয়মিতই কোনো না কোনো জেলায় যাচ্ছি, আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক সভায় বসছি। আমি তো দেখছি, জেলা পর্যায়ে মামলার সংখ্যা প্রতি বছরই কমে যাচ্ছে। আমাদের সামাজিক সুশাসন বাড়ছে। কমিউনিটি পুলিশ কাজ করছে। কাজেই অপরাধ তুলনামূলকভাবে কমছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে যাত্রী হয়রানির ঘটনা বাড়ছে। এ ব্যাপারে আপনার মন্ত্রণালয় কী করছে?

আসাদুজ্জামান খান কামাল : বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনটা আমাদের মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। আমাদের দেশ থেকে ভুয়া পাসপোর্ট, জাল ভিসা নিয়ে বিদেশ গিয়ে অনেকে অমানবিক জীবনযাপন করছেন। নানা ধরনের অভিযোগ আসছে। এ জন্য ইমিগ্রেশনে ভিসাটা ঠিক আছে কিনা, পাসপোর্ট ঠিক আছে কিনা চেক করাতেই হচ্ছে। এই চেক করার জন্যই কিছুটা সময় ক্ষেপণ হতে পারে। এর মানে এই নয় যে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : পাসপোর্টপ্রাপ্তিতে ভোগান্তি কি কিছুটা কমেছে?

আসাদুজ্জামান খান কামাল : পাসপোর্ট বিভাগে আমাদের সফলতা রয়েছে। আমরা যদি সময়মতো মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) দিতে না পারতাম তাহলে আমাদের অনেক প্রবাসীকে দেশে ফিরে আসতে হতো। আমরা ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষকে এমআরপি দিয়েছি। এটা আমাদের একটি বড় সাফল্য। এখন খুব সহজেই মানুষ এমআরপি করতে পারছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : বিমানবন্দরে সোনা চোরাচালান এখন নিয়মিত ঘটনা। এটি কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না।

আসাদুজ্জামান খান কামাল : বিমানবন্দরে সোনা চোরাচালান আগের তুলনায় কমে এসেছে। এটা আজকের সমস্যা নয়। অসাধু ব্যবসায়ীরা এই অপচেষ্টায় জড়িত। বিমানবন্দরে এসে বেরোতে পারেন না। গত পাঁচ বছরের গড় দেখলে বোঝা যাবে সোনা চোরাচালানের ঘটনা কমছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনার মন্ত্রণালয় দুই ভাগ হওয়ার কি সুফল পাচ্ছেন?

আসাদুজ্জামান খান কামাল : প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এটা দুই ভাগ করা হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে আমরা মন্ত্রণালয় দুই ভাগ হওয়ার সুফল পাব। মন্ত্রণালয়ের কাজে গতিশীলতা আসবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : মামলা তদন্তে পুলিশের পাশাপাশি কোনো মনিটরিং সেল হচ্ছে কিনা?

আসাদুজ্জামান খান কামাল : স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে জেলায়, থানায় পুলিশ থাকবে। প্রাথমিক কাজটা তারাই করবে। তবে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) আমরা শক্তিশালী করছি। মামলার তদন্ত এলে পর্যায়ক্রমে তাদের কাছেই চলে যাবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনার সময়কালে কোন বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য বলে মনে করছেন।

আসাদুজ্জামান খান কামাল : আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনেক সাফল্য রয়েছে। সারা বিশ্ব যে জিনিসটার জন্য হিমশিম খাচ্ছে, জঙ্গি দমন নিয়ে, সেখানে আমাদের সাফল্য রয়েছে। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দারা ভালো কাজ করছেন। র‌্যাব তৈরি হয়েছে এলিট ফোর্স হিসেবে। তারা জঙ্গি দমন থেকে শুরু করে মাদক নিয়ন্ত্রণ, ভেজাল প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কোস্টগার্ডকে আমরা কয়েক বছরে যথেষ্ট শক্তিশালী করেছি। সমুদ্র পাহারা দিতে তাদের জন্য আমরা সমুদ্রগামী জাহাজ নিয়ে এসেছি। স্পিড বোট নিয়ে এসেছি। পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড সবার দক্ষতা, সক্ষমতা আমরা বাড়িয়েছি। আমার সময়কালে ৫০ হাজার পুলিশ সদস্য নিয়োগ করা হয়েছে। আমার আগে ৩০ হাজার পুলিশ নিয়োগ হয়েছে। আমাদের গত আট বছরে ৮০ হাজার পুলিশ সদস্য নিয়োগ হয়েছে। বিজিবির সদস্য সংখ্যা বেড়েছে, কোস্টগার্ডের সদস্য সংখ্যা বেড়েছে। আগে ফায়ার সার্ভিসের অনেক দুর্নাম ছিল। বলা হতো, ফায়ার সার্ভিস যায় আগুন নিভে যাওয়ার পর। তারা এখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের জীবন, সম্পদ রক্ষা করে। গত কয়েক বছরে তাদের গুণগতমান, সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। তাদের জন্য আমরা সরঞ্জাম কিনে দিয়েছি। অলিগলিতে যাওয়ার জন্য মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছি।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সামাজিক সুস্থিতি বিষয়ে আপনার কী ধারণা?

আসাদুজ্জামান খান কামাল : আমাদের প্রধানমন্ত্রী সরকার গঠনের সময় নির্দেশনা দিয়েছিলেন, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন। তিনি বলেছিলেন, সন্ত্রাস-নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করবেন। আমরা সেই জায়গায় কাজ করছি। আজ দেশে অপরাধ কমে গেছে। চুরি-ডাকাতি কমে গেছে। সামাজিক স্থিতিশীলতা আসছে। আমরা কাজ করছি বলেই সে জায়গায় যেতে পারছি।

সর্বশেষ খবর