রবিবার, ১৬ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

বৃহত্তর চট্টগ্রামে পাহাড়ধস : বিপন্ন মানবতা, ভবিষ্যৎ করণীয়

প্রকৌশলী জাহিদ আবছার চৌধুরী

বৃহত্তর চট্টগ্রামে পাহাড়ধস : বিপন্ন মানবতা, ভবিষ্যৎ করণীয়

সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় পাহাড়ধসের ঘটনা আমাদের ভাবিয়ে তোলে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় এ পর্যন্ত ১৫০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন। এখানকার মানুষের মধ্যে ভয়, আতঙ্ক কাজ করছে। যে কোনো সময় আবারও ভারি বৃষ্টি হতে পারে। আবারও এ ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটছে? এটা কি শুধুই বৃষ্টিপাতের ফলাফল নাকি অন্য কারণ আছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির ধরন, পানির প্রবাহ ও আবহাওয়াকে বিবেচনায় না নিয়ে নানা ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প ও বসতি হয়েছে। এর ফলাফল হিসেবে বনভূমি ও পানির উৎসগুলো ধ্বংস হয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে এমন আর না ঘটে, তিন পার্বত্য জেলা, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের ভৌগোলিক গঠনের কোনো পরিবর্তন হয়ে গেল কিনা, সামনের আরও কোনো বড় বিপর্যয় ঘটার শঙ্কা আছে কিনা, তা দ্রুত সমীক্ষা চালিয়ে বের করতে হবে।

পার্বত্য জেলাগুলোর মাটির গঠন বিন্যাসের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার সঙ্গে যোগ হয়েছে নির্বিচার পাহাড় কাটা। এসব কারণে পাহাড়গুলো শুকনো ও ঝরঝরে হয়ে উঠছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অতিবৃষ্টির চাপ। এতে পাহাড়ের উপরের অংশের শক্ত মাটির স্তর বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের মধ্যে ফাটল তৈরি হয়েছে।

যেখানে পাহাড় আছে, সাধারণত সেখানে ভূমিধস হবে। সেটা আগ্নেয় শিলা, রূপান্তর শিলা বা পাললিক শিলা, যেটাই হোক না কেন সব ক্ষেত্রেই পাহাড়ধস হবে।

আমেরিকার মতো উন্নত দেশেও ভূমিধস হচ্ছে।  আমাদের দেশের অধিকাংশ পাহাড় পাললিক শিলা দিয়ে গঠিত। এখানে ভূমিধস বেশি হবে। কয়েক দশক আগেও ভূমিধস হতো। কিন্তু তখন এভাবে মানুষের মৃত্যু হতো না বলে মানুষ এ বিষয়টি জানতে পারত না। বর্তমানে পাহাড়ধস আগের থেকে বেড়ে গেছে। সিলেট থেকে টেকনাফ পর্যন্ত পাহাড়ের বিন্যাস হলো উত্তর-দক্ষিণ বিস্তৃত। আমাদের দেশের পূর্বে ভারতের মণিপুর, মিজোরাম, এর পূর্বে মিয়ানমারের পাহাড়গুলো একই রকম। এর মধ্যে কিছু পাহাড় উচ্চতা ও কিছু পাহাড় ভ্যালি তৈরি করে।

পাহাড়গুলোর মধ্যে তিন ধরনের ভূতাত্ত্বিক গঠন রয়েছে। এগুলো হলো বালুপ্রধান, স্যান্ডশেল অল্টারনেশনস (বালু-মাটির স্তরবিশিষ্ট) ও কাদাপ্রধান পাহাড়। স্যান্ডশেল অল্টারনেশনস পাহাড়গুলো ভূমিধসের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

অন্য পাহাড়েও ভূমিধস হতে পারে। আমাদের পাহাড়গুলোর পূর্বে ও পশ্চিমে ঢাল রয়েছে। যেসব পাহাড়ের ঢাল ও ভিতরের ভূতাত্ত্বিক স্তর যখন একই দিকে থাকবে, সে পাহাড়গুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। আবার যেসব পাহাড়ের ঢাল ও এর ভূতাত্ত্বিক স্তর বিপরীতমুখী সেগুলো কম ঝুঁকিপূর্ণ।   

আমার ছাত্রজীবনে ঘন বনায়নের জন্য এসব পাহাড়ে ঢুকতে পারতাম না। এখন সে অবস্থা নেই, বৃষ্টিপাত যে এখন বেশি হচ্ছে তা নয়। আগেও ভারি বৃষ্টিপাত হতো। কিন্তু তখন ঘন বনায়নের জন্য বৃষ্টিপাত পাহাড়ের শিলাস্তরে ঢুকতে পারত না। বৃষ্টির পানি পাহাড়ের ওপর দিয়ে গড়িয়ে নিচে চলে আসত। এ জন্য পাহাড়ের ভিতরের মাটির গঠন ঠিক থাকত।

পাহাড় ন্যাড়া হয়ে গেছে। পাহাড়ে ঘন বনায়ন নেই। এ জন্য বৃষ্টির পানি সরাসরি পাহাড়ের শিলাস্তরে প্রবেশ করে পাহাড়কে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। শুধু ভারি বৃষ্টির জন্যই পাহাড়ধস হচ্ছে না। আরও অনেক কারণ রয়েছে।

ভূমিকম্প, পাহাড় কাটা, বন উজাড় করা, প্রতিনিয়ত ভারী যানবাহনের ঝাঁকুনি— এমন বিভিন্ন কারণে পাহাড়ধস হতে পারে। এবার পাহাড়ধসে বেশি মানুষ মৃত্যুর জন্য এটা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে ভবিষ্যতে হয়তো মৃত্যু কমে যাবে। কিন্তু পাহাড়ধসের প্রকৃত কারণ যদি চিহ্নিত করতে না পারি তাহলে এ ধরনের মৃত্যু হতে থাকবে।

পাহাড় রক্ষার অনেক ধরনের উদ্যোগ আছে। পাহাড়ে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার জন্য, ঝরনাগুলো সচল রাখার জন্য ও পাহাড় নিরাপদ রাখার জন্য পাহাড়ের গাছ যেন কাটা না হয় এমন একটা উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

ফার্নিচারের ব্যবসা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। এটা ভীষণ রকমের অনিয়ম। এত কিছুর পরও খুব আশাবাদী হতে পারছি না যে এসব বন্ধ হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের খুব বড় সর্বনাশ হচ্ছে বাঁশ উজাড় করা। বাঁশ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের জীবন কল্পনাই করা যায় না। বাঁশ কিন্তু শেষ হয়ে গেছে। বাঁশ শেষ হওয়ার পর এখানে বিশাল এলাকা নিয়ে পাল্পউড প্ল্যান্টেশন হচ্ছে। এটার ব্যাপারে কেউ কিন্তু তেমন কথা বলেন না।

পাহাড়ি অঞ্চলকে সংরক্ষিত ঘোষণা করে গাছকাটা বন্ধ করা। পাহাড় পাহাড়িরা ভালো চেনে। বাঙালিরা পাহাড় ততটা ভালো চিনবে না বা পাহাড়ের সঙ্গে বসবাস করতে পারবে না। এ কারণেই হয়তো যারা বাইরে থেকে গিয়ে পাহাড়ে বসবাস করছে তারা পাহাড়ের মাটিকে সমতলের মাটি হিসেবেই ভাবে। আর সে কারণেই দুর্যোগের সময় তাদের ক্ষতিটাও বেশি হয়।

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— পাহাড়ে যখন প্রকৌশলীরা রাস্তা বানাচ্ছেন, তখন আমাদের ভূতাত্ত্বিকদের সঙ্গে সমন্বয় করে পাহাড়ের বিন্যাসকে মাথায় রেখে রাস্তা বানানো উচিত। পাহাড়ের কোনো রাস্তাই যেন ভূতাত্ত্বিকদের পরামর্শ ছাড়া না বানানো হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।

এবার যতগুলো স্থানে ধস নেমেছে, সবই ছিল পাহাড়ের উত্তর-দক্ষিণমুখী রাস্তার পাশে। এটা থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায় যে পাহাড়ের কোথায় সমস্যা আছে। এ পাহাড়ের সমস্যা না বুঝতে পারলে পাহাড় ডিঙানো যাবে না, যেটা আমরা করতে যাচ্ছি।

এ ধরনের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী ছিল। কেননা সেখানে যেভাবে উন্নয়নের নামে সড়ক নির্মাণ, বসতি স্থাপন, বন ধ্বংস ও ঝরনা শুকিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে, তার পুঞ্জীভূত বহিঃপ্রকাশ আমরা এবারের ধসের মাধ্যমে দেখলাম। এ থেকে যদি আমরা শিক্ষা না নিই, পাহাড়ে আমাদের উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গি যদি না বদলাই, তাহলে সামনে আরও বড় বিপদ-বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।

 

লেখক : নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলী সংগঠক।

সর্বশেষ খবর