সোমবার, ১৭ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়ার চেষ্টা

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়ার চেষ্টা

ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে জাতীয় নির্বাচন কাছে এলেই আলাপ-আলোচনা, সংলাপ, সমঝোতা কথাগুলো সব সময় রাজনীতিতে বেশ চাঙ্গা হয়ে ওঠে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, এ কথাটিও ইতিমধ্যে বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠছে। ওয়েস্টমিনস্টার স্টাইলের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতির প্রধান অবলম্বন হওয়ার কথা রাষ্ট্র পরিচালনা, অর্থাৎ রাষ্ট্রের রাজস্ব, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, শিল্পসহ অর্থ ও কর্মসংস্থানের নীতিমালা নিয়ে এবং এসব ইস্যুতে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর পারফরমেন্সের তুলনামূলক বিশ্লেষণই হয়ে ওঠার কথা মিডিয়াসহ সব স্থানের আলোচনার বিষয়বস্তু, যা প্রকৃতপক্ষে সরাসরি জনগণের কল্যাণ-অকল্যাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৬ বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা সেই রাজনৈতিক কালচার তৈরি করতে পারিনি। এ ব্যর্থতা সবার। আলোচনা হয় শুধু ক্ষমতায় ওঠা, টিকে থাকার কথা ও কৌশল নিয়ে। অনেক সময় দেখি রাজনীতিবিদদের লাগামহীন কথাবার্তা নিয়ে লক্ষ্যহীন দীর্ঘ আলোচনা হয়, বাকবিতণ্ডা হয় টকশোতে, যার সঙ্গে জনগণের ভালো-মন্দের কোনো সম্পর্ক নেই। তথ্য-উপাত্ত, বিগত দিনের উদাহরণ এবং ইতিহাসের কোনো শিক্ষার স্থান সেখানে থাকে না। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও জাতিগত সংস্কৃতির আলোকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ও সুপারিশমালা কখনো শুনি না। একটি জাতি রাষ্ট্রের জন্মের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে কখনোই টেকসই রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি হতে পারে না। বিশ্বে কোথাও হয়নি। আমাদের সমস্যাটির শেকড় এখানেই প্রোথিত। দুই সামরিক শাসকের দীর্ঘ ১৫ বছরে  প্রবর্তিত সামরিক রাজনৈতিক কালচার থেকে আমরা এখনো বের হতে পারছি না, আবার বড় একাংশ বের হতে চাইছেও না। সামরিক শাসকদের স্বৈরাচারী শাসনকালের কথা বাদ দিলাম। তারপর গত শতকের নব্বই দশকের শুরু থেকে বিগত ২৭ বছর জাতীয় নির্বাচন এলেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার কথা ওঠে। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো আলাপ-আলোচনা কি ফলপ্রসূ হয়েছে, কোনো সমঝোতা হয়েছে? হয়নি। এ কথা বলায় কেউ যেন না ভাবেন যে, আমি আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার বিরুদ্ধে। আমি বলতে চাইছি, ফলপ্রসূ না হওয়ার কারণগুলো আমাদের অনুসন্ধান করা উচিত। ফলপ্রসূ না হওয়ার প্রধান কারণ আমরা সব সময় ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। প্রথমেই বলতে হয় রাজনীতির দুই বড় পক্ষের মধ্যে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা একেবারে শূন্য। এর প্রধান ও এক নম্বর কারণ ১৯৭৫ সালের রক্তাক্ত অধ্যায়ের পথ ধরে ক্ষমতায় আসা সামরিক শাসক ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান বাঙালি জাতির সব গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা এবং তার থেকে আহরিত আদর্শ, দর্শন সবকিছু সংবিধানসহ রাষ্ট্রের সব জায়গা থেকে বাদ দিয়ে দেন, যা আমরা অর্জন ও প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। ফলে অফুরন্ত চেতনা ও অনুপ্রেরণার উৎসস্থলগুলো ঢাকা পড়ে যায়। বলতে হবে ঢেকে দেওয়া হয়। যার কারণে রাজনীতিতে চরম বিভাজন ও অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মান রাজনীতি থেকে চিরবিদায় নেয়। সারা বিশ্বের ইতিহাসে এমন উদাহরণ নেই। ফলে বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের যে কালচার সেটি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি গত ৩৫ বছরে জিয়াউর রহমান কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধের দর্শনকে বিদায় করার পথ থেকে একবিন্দুও সরে আসেনি এবং কোনো সংশোধনও করেনি। মিডিয়ার সাংবাদিকরা কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর যদি বিএনপির কাছ থেকে নিতে পারতেন তাহলে সাধারণ মানুষ অন্তত বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি পেতেন। এক. পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের সংগ্রামের পথে ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের ২৫ মার্চের আগ পর্যন্ত অভূতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলনের ঘটনাবলিকে তারা যথার্থ মর্যাদা দেবে কিনা? কারণ এসব ঘটনাবলির মধ্য থেকেই উৎপত্তি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদর্শ ও দর্শন। শেকড় কেটে দিয়ে অন্য কথা বললে তার মধ্যে কোনো তাৎপর্য থাকে না।

দুই. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তারা জাতির পিতা হিসেবে মেনে নেবে কিনা এবং তার সঙ্গে অন্য কারও তুলনা হবে না, এই জায়গায় বিএনপি একমত কিনা? তিন. ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রতি বিএনপি পরিপূর্ণ আনুগত্য দেখাবে কিনা? চার. একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকার ও তার নেতৃত্বের প্রতি বিএনপি পরিপূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করবে কিনা? পাঁচ. ২৩ বছরের সংগ্রাম ও একাত্তরে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের প্রত্যক্ষ ফসল বাহাত্তরের সংবিধানের মূল স্তম্ভের অন্যতম বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে তারা মেনে নেবে কিনা? উপরোক্ত পাঁচটি প্রশ্নের মাধ্যমে উত্থাপিত বিষয়গুলো কোনো একক দলের বিষয় নয়। এগুলো সমগ্র বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বিষয়। এ বিষয়গুলো নিয়ে কোনো আলাপ-আলোচনা বা সমঝোতার সুযোগ নেই। এদেশের লক্ষ কোটি মানুষ ও তরুণ প্রজন্ম তা মেনে নেবে না। এটাই হলো বাংলাদেশ নামক জাতি রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় সহজাত শক্তি। এটা অফুরান্ত। সে কারণেই ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াত-বিএনপি সরকার এ সহজাত শক্তির সব উৎসমূল উপড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। যার কারণেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়, এস এ এম এস কিবরিয়ার মতো অভাবনীয় মেধাবী মানুষকে গ্রেনেড হামলার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়। রাষ্ট্রের মৌলিক বিষয়গুলোকে অমান্য করে বিশ্বের কোনো দেশেই কেউ রাজনীতি করতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে সবই সম্ভব হচ্ছে। যার ফলে আগের ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও মৌলিক প্রশ্নের সমাধানে না গিয়ে বিএনপি ও তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার কথা বলছেন। শুনতে ভালো শোনায়। কিন্তু আগে কেন ফলপ্রসূ হয়নি, সেদিকে তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা বলছেন নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হওয়ার জন্য আলাপ-আলোচনা দরকার। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সবাই চায়। এটা তো এখন সবাই জানেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিয়ে সহিংসতার পথে প্রতিহত করার চেষ্টা করায় সেটি একটি ভালো নির্বাচন হতে পারেনি। সে সময়ের প্রেক্ষাপট, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক সরাসরি বেগম খালেদা জিয়াকে টেলিফোন, আলোচনায় বসার অনুরোধ, গুরুত্বপূর্ণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ তাদের চাহিদা মতো মন্ত্রণালয় দিয়ে সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব ইত্যাদি পর্যালোচনা করলে কি মনে হয় না যে, তখন সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল একটা অংশগ্রহণমূলক ভালো নির্বাচন করার জন্য। কিন্তু বিএনপি একেবারে একগুঁয়েমি অবস্থান নেয়। নির্বাচন প্রতিহত করার নামে পাঁচশর অধিক নির্বাচন কেন্দ্র পুড়িয়ে দেয় এবং তাতে নির্বাচন কর্মকর্তাসহ প্রায় দেড়শ নিরীহ মানুষের প্রাণ যায়। সুতরাং ভালো নির্বাচন না হওয়ার জন্য যারা শুধু সরকারকে দোষারোপ করছেন তারা কি প্রকারান্তরে এ কথাই বলছেন না যে, তখন বিএনপির কথামতো সবকিছু আওয়ামী লীগ সরকারের মেনে নেওয়া উচিত ছিল। অর্থাৎ বিএনপি যা যা বলেছিল সবকিছু সেরকমই হওয়া উচিত ছিল। এটাকেই কি তারা সমঝোতা ও আপস বলতে চান। এখন বিএনপি ও তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনার সে সময়ের প্রস্তাবকে এবারের জন্য ফিরিয়ে আনার পক্ষে কথা বলার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয় তারা তখন ভুল করেছেন, রাজনৈতিক ব্লান্ডার করেছেন। বিএনপির একগুঁয়েমিজনিত ভুলের জন্য রাষ্ট্রের যে ক্ষতি হয়েছে তার জন্য তো তাদেরই জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টেলিফোন পেয়ে বেগম খালেদা জিয়ার আচরণ, ভাষা, কথা বলার ভঙ্গি ও বডি ল্যাংগুয়েজের রাগান্বিত বহির্প্রকাশ বাংলাদেশের সব মানুষসহ সারা বিশ্ব দেখেছে। সেই আচরণের মাধ্যমে সেদিন তিনি নিজের রাজনৈতিক পরাজয় নিজেই নিশ্চিত করেছেন। রাজনীতি ও কূটনীতিতে চরম শত্রুর সঙ্গে সরাসরি কথা বলার সময় প্রশান্তিময় বডি ল্যাংগুয়েজ ও মর্যাদাপূর্ণ ভাষার ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কথায়ই আছে আপনি রেগে গেলেন, তো হেরে গেলেন। নিজেদের রাজনৈতিক ব্লান্ডার ও নেতৃত্বের রাজনৈতিক পরাজয়ের দায় এখন চাপানো হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার ওপর। বিএনপির রাজনৈতিক ভুলের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে আওয়ামী লীগ সরকারকে। তা না হলে তারা নির্বাচনে যাবে না এবং তাতে বিএনপি-জামায়াত মিলে গেলবারের মতো জ্বালাও পোড়াও এবং নিরীহ মানুষ হত্যার লাইসেন্স পাবে। আগামী নির্বাচনের সময় বর্তমান সরকারই চলমান থাকবে, এই ইস্যুতে সাংবিধানিক ও আইনি বৈধতার প্রশ্নে তাদের কাছে রসদ থাকলে বিএনপি এতদিনে আদালতে যেতে পারত। এখনো সময় আছে। সর্বোচ্চ আদালত ন্যায্য বিচার করবেন সেটি তো বিএনপিও এখন নিশ্চিত হয়েছে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সম্পর্কে রায়ের মাধ্যমে। ওই রায়ের পর বিএনপির একজন আইনজীবী নেতা দুই মণ মিষ্টি বিতরণ করেছেন বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। আইন ও সংবিধানের বাইরের বিষয়টি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক খেলার বিষয়। প্রতিপক্ষ কীভাবে খেলবে, কাকে নিয়ে খেলবে তা নিয়ে অন্যপক্ষের দাবি কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। খেলার রুলস কেউ ভঙ্গ করলে রেফারি আছে, আইন আদালত আছে। নিরীহ মানুষকে জিম্মি করে কেউ রাজনীতি করতে চাইলে তার ফল কখনো ভালো হয় না। যারা এটা করতে চেয়েছে শেষ বিচারে তারাই ডুবেছে। ইতিহাসই তার সাক্ষী। আলাপ-আলোচনা, সমঝোতা হতে হলে বিএনপিকে মুক্তিযুদ্ধের দর্শনের মৌলিক জায়গায় এসে দাঁড়াতে হবে। অন্যথায় আলাপ-আলোচনা হলেও তার ফল হবে আগের মতোই শূন্য। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা ফলপ্রসূ হবে না।

 

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর