সোমবার, ১৭ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

৫৭-তে সাইজ ১২-তে বরখাস্ত বিশ্বরেকর্ডের হাতছানি

মোস্তফা কামাল

৫৭-তে সাইজ ১২-তে বরখাস্ত বিশ্বরেকর্ডের হাতছানি

তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ আর স্থানীয় সরকারের ১২ ধারার অ্যাকশনের রেকর্ড গড়ার পথে বাংলাদেশ। একটিতে সাইজ হচ্ছেন সাংবাদিকরা। আরেকটিতে সমানে বরখাস্ত স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। এ সাইজ আর বরখাস্তে এরই মধ্যে সরকারের দক্ষতা প্রশ্নাতীত। নজিরবিহীনও।

বাঙালিকে হাই কোর্ট দেখিয়ে লাভ নেই বলা হলেও স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯-এর ১২(১) ধারার হানায় হাই কোর্ট দেখতে দেখতে টায়ার্ড স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা। আইনটিতে বলা হয়েছে— ‘কোন মেয়র অথবা কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় অভিযোগপত্র আদালতে গৃহীত হইলে সরকার লিখিত আদেশের মাধ্যমে সেই মেয়র বা কাউন্সিলরকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করিতে পারিবে’। ব্যস। এর ষোলোআনা অপব্যবহারের পথটাই ধরেছে সরকার। নির্বাচিতকে বরখাস্তের ঘোষণার চিঠি মন্ত্রণালয় থেকে যেতে না যেতেই দলীয় পছন্দের ব্যক্তিকে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে ভারপ্রাপ্ত করে। পরে হাই কোর্ট থেকে বরখাস্তাদেশ তুলে এনে চেয়ার পেলেও তেমন বরাদ্দ পান না তারা। তদ্দিনে আবারও বরখাস্তাদেশ জারি।

অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইনটির পয়দা ওয়ান-ইলেভেনের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জমানায়। তবে এর যথেচ্ছ অপব্যবহার রুখতে কোনো জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্তের আগে নির্বাচন কমিশনের অভিমত নেওয়ার শর্ত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসা মহাজোট সরকার সংসদে জুত মতো পাস করিয়ে নেয় আইনটি। এ হাতিয়ারে গত কয়েক বছরে বরখাস্ত করা হয়েছে চারশতের কাছাকাছি জনপ্রতিনিধিকে। চার সিটি মেয়র ছাড়াও তাদের মধ্যে রয়েছেন ৩৬ জন পৌর মেয়র, ৫৬ কাউন্সিলর, ৫২ উপজেলা চেয়ারম্যান, ৬৭ ভাইস চেয়ারম্যান, ৯২ ইউপি চেয়ারম্যান এবং ৭৪ জন মেম্বার। লাজ-শরমে শব্দ করে কাঁদার অবস্থাও নেই তাদের। বছর চারেক আগে ২০১৩ সালের ১৫ জুন পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জিতে হিরো বনে যাওয়ার পর মামলা, অবজ্ঞা, জেল বরখাস্তের তোড়ে নাস্তানাবুদ নগরপিতাদের কারও কারও ব্যক্তিগত-সাংসারিক জীবনও বরবাদ। পাঁচ বছর মেয়াদের চার বছরই দফায় দফায় বরখাস্ত এবং কোর্ট-কাছারির বারান্দাই তাদের ঠিকানা। এমন আজাব ভোগের টপ লিস্টে গাজীপুরের এম এ মান্নান বরখাস্ত হয়েছেন একে একে তিন দফায়। কারাবাস ২৩ মাস ১০ দিন। বরখাস্ত ছিলেন প্রায় ২৩ মাসের মতো। বিভিন্ন পর্বে মোটমাট ১৮ মাস চেয়ারে বসার সৌভাগ্য হয়েছে ৩০ মামলার আসামি এই পিতার।

কাকতালীয়ভাবে তার নির্বাচিত হওয়ার তারিখ গত ৬ জুলাইতে আবার বরখাস্ত হয়েছেন। যথারীতি আবারও হাই কোর্ট থেকে বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার। সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জয়ের পর থেকে বেশি দিন কাটিয়েছেন জেলে বা ফেরারে। বিভিন্ন দফায় ২৬ মাস ২৭ দিন বরখাস্ত হওয়া আরিফ জেল খেটেছেন ২৩ মাস ২০ দিন। চেয়ারে বসার ভাগ্য হয়েছে বছর দেড়েক। আর রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল তো দায়িত্ব নেওয়ার পর ৪৫ মাসের মধ্যে ২৩ মাসই ছিলেন বরখাস্ত। জেলের ঘানি টেনেছেন এক বছরেরও বেশি। তিনি প্রথম বরখাস্ত হন ২০১৫ সালের ৭ মে। ২ এপ্রিল আদালতের রায়ে পদ ফিরে পেয়ে চেয়ারে বসার আট মিনিটের মাথায় দ্বিতীয়বারের মতো বরখাস্ত। দুই দিন পর আবার আদালতের রায়ে পদ ফিরে পেলেও মান-মর্যাদা বলতে কিচ্ছু অবশিষ্ট নেই তার। অন্যদের মাত্রায় জেল বা বরখাস্তের নাহালত না পোহালেও স্বস্তিতে নেই খুলনার নগরবাবা মনিরুজ্জামান মনি। গাড়ি পোড়ানোর মামলায় ২০১৫ সালের ২ নভেম্বর বরখাস্ত ছাড়াও জেল খাটেন ২৮ দিন। পরে হাই কোর্টের মাধ্যমে গত বছরের ২১ নভেম্বর দায়িত্ব ফিরে পেলেও রয়েছেন অন্তহীন ভোগান্তিতে। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ভাজেভুজে টিকে আছেন বরিশালের মেয়র আহসান হাবিব কামাল। এখন পর্যন্ত বরখাস্ত বা জেলে যেতে না হলেও কোনোমতে টিকে আছেন দম-নিঃশ্বাস নিয়ে। টুকটাক বরাদ্দ যা পান তাতেই তুষ্ট তিনি। নানানজনকে কচলিয়ে তাল মিলিয়ে টিকে আছেন কুমিল্লায় বিএনপি থেকে নির্বাচিত নগরবাবা মনিরুল হক শাক্কু। মামলাগুলো তিনি সামলে নিচ্ছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে খায়-খাতিরে। নগরপিতাদের মধ্যে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের আ জ ম নাছির ছাড়া সবাই আছেন প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীর পদমর্যাদায়। মান মতো সম্মান আর বরাদ্দ কোনোটাই পেলেন না দলের কারও কারোর বিরাগভাজন আজম নাছির। পিতাদেরই যখন এ দশা তখন নগরীর ছাওয়ালদের কী অবস্থা হয় তা কে না বোঝে?

নাহালতের এমন রেকর্ড নিয়ে রসিকতা অনেকদিন ধরেই। নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের ডা. আইভি জেতার পর অনেকে রসিকতাচ্ছলে বলেছিলেন, কারাবাসসহ বহু ছিদ্দত থেকে বিএনপি প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াতকে আল্লাহ নিজ হাতে বাঁচিয়েছেন। কোন দেশে একই দিনে তিন মেয়র বরখাস্ত হয়েছিলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ছাড়া ভুলেও অন্য কোনো দেশের নাম আসবে না। সেই হিসেবে বিষয়টি গুণে-মানে গিনেস বুকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মতো। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের এভাবে খেদানোর অপসংস্কৃতির চর্চা কোন ভয়াবহ পরিণামকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে আল্লাহ মালুম। পুলিশের অভিযোগপত্রে নাম থাকলেই বরখাস্তের এ বিধান মতো ভবিষ্যতে এমপিদের তাড়িয়ে সেখানে দলীয় কাউকে ভারপ্রাপ্ত এমপি করার সংস্কৃতি চালু হওয়া তো একেবারে অমূলক নয়। মন্দ চর্চার নজিরই তো দেশে বেশি।

এদিকে সারা দেশে সাংবাদিকদের গ্রেফতারসহ হয়রান করা হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারার ধারে। বিশ্ব মানবাধিকার সনদ মতো বাংলাদেশও তার প্রতিটি নাগরিককে ‘freedom of speech, freedom of expression, freedom of thought’ অধিকার দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে কথা বলা, ভাব প্রকাশ, চিন্তার অধিকার চর্চার অবস্থা বড় করুণ। তার ওপর ২০০৬ সালে প্রণয়ন হয় এ আইনটি। উপরন্তু আইনটি ২০০৯ ও ২০১৩ সালে দুই দফা সংশোধন করে শাস্তির ব্যবস্থা আরও পোক্ত করে নেয় সরকার। সর্বশেষ সংশোধনে সাজা বাড়িয়ে ১০ থেকে ১৪ বছর কারাদণ্ডের বিধান করা হয়। আর ৫৭ ধারার অপরাধকে করা হয় অজামিনযোগ্য। একজন লেখক কিংবা সাংবাদিকের লেখা বা তার দেওয়া তথ্যে কোনো আইন লঙ্ঘন হয়েছে কিনা সে বিচার বিশ্লেষণের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেওয়া হলো পুলিশকে। যথেচ্ছ ব্যবহারের এ পর্বে সম্প্রতি আরও মাত্রা যোগ হয়েছে। এ বছরের প্রথম ছয় মাসেই ৫৭ ধারায় দেশের বিভিন্ন জেলায় ২০টির বেশি মামলা হয়েছে। শুধু সাংবাদিক নয়, শিক্ষকসহ অন্যান্য পেশার মানুষও এতে আক্রান্ত। ৫৭ ধারার ধারে সবচেয়ে কাহিল সাংবাদিকদের পাশাপাশি এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র-শিক্ষকেরা মানববন্ধন করেছেন। ওই বিভাগ থেকে সদ্য পাস করা এক সাংবাদিকের ফেসবুকের এক ছবি ও মন্তব্যের কারণে তার বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদেই অনুষ্ঠিত হয় কর্মসূচিটি। ছাত্রছাত্রীদের চাপে এ কর্মসূচিতে সরকারের ঘনিষ্ঠ (সরকার-সমর্থক নীল দলের নেতা) শিক্ষক নেতাও কড়া বক্তৃতা করেছেন। এতে ওই শিক্ষক নেতা ৫৭ ধারাকে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর উল্লেখ করে বলেছেন, এই ধারায় বেশিরভাগ মামলাই হচ্ছে হয়রানির উদ্দেশ্যে। বছর তিনেক আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক অস্ট্রেলিয়ায় বসে ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করায় রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে দণ্ডিত হয়েছিলেন। প্রায় একই সময়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককেও জেলের ভাত খেতে হয়েছে ফেসবুকে সরকারবিরোধী মন্তব্যের অপরাধে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আশ্বাস দিয়েছেন আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা থাকবে না। নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের কাজ চলছে। কিন্তু এ রকম আশ্বাসে যারপরনাই উদ্বেলিত হওয়ার অবস্থা নেই। কারণ এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ার ১৯ ধারায় সাজা কিছুটা কমিয়ে ৫৭ ধারার বিষয়বস্তুই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি থাকবে আরও কিছু ধারা। অর্থাৎ যাহা ৫৭ তাহাই ১৯। যেই লাউ সেই কদু।

 

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর