বুধবার, ১৯ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

জামায়াতের সঙ্গে মমতার সম্পর্ক!

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

জামায়াতের সঙ্গে মমতার সম্পর্ক!

নিজের গদি বাঁচাতে ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী একের পর এক বিনা প্ররোচনায় বিদেশনীতিতে হস্তক্ষেপ করে চলেছেন। ইতিমধ্যে দার্জিলিং ও বসিরহাট কাণ্ড নিয়ে তিনি সরাসরি সার্ক সদস্যভুক্ত বাংলাদেশ, ভুটান এবং নেপালকে আক্রমণ করেছেন।  যা তার এখতিয়ার-বহির্ভূত। শুধু এই প্রথম নয়, বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি নিয়ে সাত বছর ধরে ভারতের বিদেশনীতির ওপর মমতা খড়গহস্ত। আর দার্জিলিং কাণ্ড নিয়ে তিনি নেপাল-ভুটানের ষড়যন্ত্র বলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। কোথাও বাঙালি চায় না, দার্জিলিং পশ্চিমবঙ্গ থেকে বেরিয়ে যাক। কিন্তু প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে আক্রমণ করলে পরিণাম যে কী মারাত্মক হতে পারে, তিনি তো বটেই, তার উপদেষ্টারাও কল্পনা করতে পারছেন না। একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী তিনটি দেশের বিরুদ্ধে কোন সাহসে তিনি অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। আর বসিরহাটে হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষের নেপথ্যে বিশেষজ্ঞ ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো উল্লেখ করেছে, ২০১১ সালে মমতা ব্যানার্জির মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই বাংলাদেশের উগ্রবাদী সংগঠন জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। ভারত সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এ ব্যাপারে সরাসরি অভিযোগ করেছে। বসিরহাটসহ গোটা উত্তর ২৪ পরগনা এবং কলকাতার আশপাশে জামায়াতিদের আশ্রয় দিয়ে চলেছেন তিনি। তবে তিনি খালি হাতে আশ্রয় দিচ্ছেন না। পাঠক একবার ভেবে দেখুন, কোথাও দাঙ্গা হলে পুলিশ কি লাঠি-বন্দুক হাতে নিয়ে তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে? নাকি সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়? কলকাতা হাই কোর্ট মঙ্গলবার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে রাজ্য সরকারের কাছে কৈফিয়ৎ চেয়েছে, কেন পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল? কার হুকুমে, কেন দাঙ্গাকে বাড়তে দেওয়া হলো?

নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের একটা ঐতিহ্য ছিল হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে থাকার। রাজনৈতিক নেতাদের হঠকারিতার ফলে তা ভাঙছে। তবে তা ভাঙতে দেওয়া যাবে না। ২০ জুন আমেরিকা থেকে ফিরে তিনি বলেন, বসিরহাটের ঘটনা আমি জানি। বিজেপি ও তৃণমূল উভয় সরকারেরই তীব্র নিন্দা করছি। বাংলার মানুষ এসব বেশি দিন সহ্য করবে না। অধ্যাপক সেন অতীতের কথা উল্লেখ করে বলেন, অতীতের মুখ্যমন্ত্রীরা দাঙ্গা হলে পুলিশকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলতেন না। বলতেন, কড়া হাতে দমন করুন। যে যত সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াবে, তাকে ততটা ফল ভোগ করতেই হবে। এই অভিমত পশ্চিমবঙ্গের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপকদের। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক তো বলেই বসলেন, একটি ভোটের জন্য এক বালতি রক্ত দেওয়া যায় না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী দুজনই সংবিধানের প্রতি আনুগত্য জানিয়ে শপথ নিয়েছেন। আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আমি নিজেই একজন শিকার পূর্ব পাকিস্তানে। বয়স তখন আমার খুবই কম। আর চাকরি জীবনে সাংবাদিক হিসেবে একাধিক দাঙ্গা কভার করতে গিয়ে দেখেছি, কী বীভৎস নারকীয় কাণ্ড ঘটেছিল। তারপর তিনজন মুখ্যমন্ত্রীকে দেখেছি, তাদের নির্দেশই থাকত— শুট টু কিল। আর মমতা সরকার পুলিশকে বলল, তোমরা নজর রাখ। গুলি চালাতে হবে কিনা তা পরে বলব। কী ভয়ঙ্কর কাণ্ড।

বসিরহাট কাণ্ডের পর সেখানকার হিন্দু-মুসলমান হাতে হাতে ধরে স্লোগান তুলেছেন, দাঙ্গা চাই না, শান্তি চাই। এখন প্রশ্ন উঠেছে। মমতা দেবী কী একটা ভোটের জন্য এত রক্ত ঝরিয়ে দিলেন? এ প্রশ্ন বিদ্বজ্জনদের মহলে। সব মিলিয়ে সাম্প্রতিককালের ঘটনা পশ্চিমবঙ্গবাসীকে গভীর চিন্তায় ফেলেছে। আমার মতো বহু প্রবীণ সাংবাদিক প্রশ্ন তুলেছেন, এবার আমরা কোথায় যাব? এর একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার। পশ্চিমবঙ্গে দুই সম্প্রদায়ের বিভেদ সৃষ্টির প্ররোচনা চলছে। তা উসকে দিয়ে তেলেঙ্গানার এক বিজেপি বিধায়ক মন্তব্য করেছেন। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার মতো পরিস্থিতি তারা করবে। সেদিন গুজরাট দাঙ্গায় ২০০০ লোকের মৃত্যু হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদি তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। তাকে সেদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ি রাজধর্ম পালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তার ওই পরামর্শ বর্তমান বিজেপি নেতাদের কাছে পৌঁছেছিল কিনা বলা শক্ত। সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি এখন মমতার হাতের বাইরে। দার্জিলিং থেকে বসিরহাট কী ঘটেছে তা দেখা যাক।

গোয়ার্তুমি আর ভ্রান্ত রাজনীতির পথ ধরে রাজ্যের দুই প্রান্তে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে রেখেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। উত্তরের দার্জিলিং আর দক্ষিণের বসিরহাট। দুটি ক্ষেত্রেই উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবিলায় উপযুক্ত প্রশাসনিক ভূমিকা না নিয়ে মমতা দেবী দিল্লির শাসক দল বিজেপির সঙ্গে ইগোর লড়াইয়ে নামলেন। আর তার ফলেই ক্রমশ অগ্নিগর্ভ হতে হতে বর্তমানে প্রায় হাতের বাইরে চলে গিয়েছে দার্জিলিং আর বসিরহাট। তার এই বিচিত্র রাজনীতির ফলে দুই প্রান্তে বেশ কয়েকটি প্রাণহানিও হয়ে গিয়েছে। এমনকি কলকাতা হাই কোর্টও মন্তব্য করেছে, পর্যাপ্ত পুলিশ ও নিরাপত্তা রক্ষীবাহিনী থাকা সত্ত্বেও দার্জিলিং পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ হয়েছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। বাহিনীকে ব্যবহারই করেনি সরকার।

মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন পাহাড় হাসছে, কিন্তু ছয় বছর যেতে না যেতে বিমল গুরুংয়ের দল তাকে কাঁদিয়ে ছেড়েছে। এক সময় তার কাছের লোক হিসেবে পরিচিত বিমল গুরুং তাকে এখন কাঁদিয়ে ছেড়েছেন। এ পরিস্থিতিতে পাহাড়ের সাধারণ মানুষের ওপরই বদলা নিতে চাইছে নবান্ন। অন্যদিকে, উত্তরবঙ্গের সমতলে চলছে বাঙালি, অবাঙালি বিভাজন। শিলিগুড়িতে তৃণমূল ঘনিষ্ঠ আদিবাসী পরিষদের নেতারা দলীয় বৈঠক করে বলেছেন, তরাই ও ডুয়ার্সে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চাকে প্রতিহত করা হবে। শিলিগুড়িতে স্টেট গেস্ট হাউসে অখিল ভারতীয় আদিবাসী বিকাশ পরিষদের রাজ্য সভাপতি বিরসা তিরকে পাহাড়ে ও সমতলে বিভাজনের রাজনীতি খেলার ব্যাপারে কী করতে হবে তা নিয়ে দলীয় নেতাদের নির্দেশ দেন। পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, তরাই ও ডুয়ার্স নিয়ে গোর্খাল্যান্ড করার চেষ্টা হলে তা সর্বোতভাবে প্রতিহত করা হবে। এভাবে বিভাজনের রাজনীতি ছড়ালে তার পরিণাম কী হবে তা বেশ বোঝা গিয়েছে কামতাপুরীদের কার্যকলাপে। কামতাপুর রাজ্যের দাবিতে তারা দফায় দফায় রেল অবরোধ করে। এর ফলে লোয়ার অসম পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

এদিকে, রাজ্য সরকারও শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিংয়ে রসদ নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সমানতালে অসহযোগিতা করে চলেছে। বনধের জেরে দোকান-বাজার বন্ধ থাকলেও পাহাড়বাসী এতদিন চেয়েচিন্তে কোনোভাবে চালিয়ে নিচ্ছিলেন। এবার সব কিছু ফুরিয়ে যাওয়ায় তারা রেশনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। কোনো লরিকে পাহাড়ে উঠতে দেওয়া হচ্ছে না। মাঝ রাস্তায় তৃণমূলি গুণ্ডারা সেসব লরি আটকে দিচ্ছে। প্রশাসনের মদদ না পেলে যে এ ধরনের কীর্তি সম্ভব নয় সেটা পাহাড়বাসী মর্মে মর্মে বুঝছেন। পাহাড়ে খাদ্য আটকানোর ব্যাপারে পর্যটনমন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, পাহাড়ে সরকারি সম্পত্তি নষ্ট হচ্ছে, রাস্তা অবরোধ করা হচ্ছে, গাড়ি যাবে কী করে? বনধ প্রত্যাহার করে এসে খাবার নিয়ে যাক।

এদিকে, এখন এটা সম্পূর্ণ জলের মতো পরিষ্কার, বসিরহাটের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা থামাতে কোনো না কোনো অদৃশ্য শক্তির পক্ষ থেকে লাগাম টেনে ধরা হয়েছিল পুলিশের। শুধু পুলিশ নয়, ঘটনার দ্বিতীয়, তৃতীয় দিনেও কলকাতা থেকে যে সমস্ত আধা সেনা ও র‍্যাফ বাহিনী গিয়েছিল, তাদেরও নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল। পুলিশের এই নিষ্ক্রিয় ভূমিকার অভিযোগ উঠতে শুরু করেছিল সপ্তাহের শুরু থেকেই। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ প্রথম শুরু হয় বাদুড়িয়া অঞ্চলে। সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা প্রথমেই থানায় যোগাযোগ করেন। কিন্তু তাদের অভিযোগ থানা থেকে তারা সে রকম সাড়া পাননি। আর তার পরে আতঙ্ক আরও ছড়িয়ে পড়ে। বাদুড়িয়া থানার ওসিকে একাধিক ব্যক্তি ফোন করেন। অনেক ক্ষেত্রে তিনি ফোন ধরেননি, যদিওবা কখনো ধরেছেন, ফোনের উত্তরে বলছেন— আমি এখন অশোকনগরে রয়েছি।

এরপরই সন্ত্রাস ছড়ায় বসিরহাটের দিকে। দাঙ্গার পরপরই তা দমনে বসিরহাট থানার সামনে ছিল পুলিশের বিরাট প্রস্তুতি। মহকুমার পুলিশ তো ছিলই, সেই সঙ্গে থানার সামনে দেখা যায় র‍্যাফ এবং কমব্যাট ফোর্সের জওয়ানদেরও। তাদের আসতে দেখে খানিকটা ভরসা পেয়েছিলেন বসিরহাটের বাসিন্দারা। কিন্তু ওই পর্যন্ত। এলাকায় টহল দেওয়া বা হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে তাদের দেখা যায়নি। বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তারা থানা চত্বরের বাইরেই বেরোননি। উল্টে থানা থেকে বলা হয়, এখনো অ্যাকশন নেওয়ার কোনো নির্দেশ নেই। থানার পুলিশ কর্মীরা এও বলেন— আপনারা উদ্বিগ্ন হবেন না। কলকাতা থেকে আরও ফোর্স আসছে। সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর বিষয় হলো, উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপারের গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার পরেও পুলিশ বসেছিল হাত-পা গুটিয়েই।

লালবাজার থেকে আরও অতিরিক্ত পুলিশ বাহিনী এবং আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানরা পৌঁছে যান বসিরহাটে। তাদেরও থানায় বসিয়ে রাখা হয়। বসিরহাট থানা থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের পরামর্শ দেওয়া হয়, আপনারা বাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখুন। খুব প্রয়োজন না হলে বাইরে বের হবেন না। দোতলা বাড়ি হলে পরিবারের সবাইকে নিয়ে দোতলাতেই থাকুন। এদিকে, বসিরহাট মহকুমা পুলিশের এক অফিসার জানিয়েছেন, আধা সেনার দরকার ছিল না, ঠিক সময় সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্দেশ দিলে র‍্যাফের সাহায্য নিয়ে আমরাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতাম।  কিন্তু রহস্য তো সেখানেই। কোনো অজ্ঞাত কারণে সেই নির্দেশটাই পৌঁছায়নি।

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর