শুক্রবার, ২১ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

রসুল (সা.)-এর প্রেম মদিনায় টানে

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

রসুল (সা.)-এর প্রেম মদিনায় টানে

বোখারি শরিফের ১৪ নং হাদিস, ‘রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ, শপথ তাঁর, তোমাদের কারও কাছে যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার বাবা ও সন্তানের চেয়ে বেশি প্রিয় না হই, ততক্ষণ সে মুমিন হতে পারবে না।’  বোখারি শরিফের ১৫ নং হাদিস, রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার বাবা, তার সন্তান এবং অন্য সব মানুষের চেয়ে অধিক প্রিয় না হই।’ উল্লিখিত হাদিস দুটির ভাষ্য দ্বারা বোঝা গেল, নবী (সা.)-এর প্রতি প্রেম-ভালোবাসা ইমানের অংশ। মানুষ বাবা-মা আর সন্তান-সন্ততিকে ভালোবাসে স্বভাবজাত স্বভাবের কারণে। আর সন্তান-সন্ততি ভালোবাসে মা-বাবাকে। এই ভালোবাসা অকৃত্রিম। যার মধ্যে কোনো স্বার্থ থাকে না। এই ভালোবাসার আকর্ষণ এতটাই গভীর বা তীব্র যে, বাবা-মা নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে গড়তে চায় একজন সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য দুনিয়ার আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে এবং সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে তারা রাত-দিন একাকার করে খাটা-খাটুনি করে। নাড়ির টান বলে আমাদের সমাজে একটি প্রচলন আছে। নাড়ির টানে মানুষ অনেক কঠিন কাজকে বাস্তবে বাস্তবায়িত করে। আবার যারা সুসন্তান, তারা বাবা-মায়ের সেবা করার জন্য নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে দিতে একটুও চিন্তা করে না। বাবা-মা যেমনই হোক সন্তানের ভালোবাসা তাদের প্রতি সব সময় অটুট থাকে। কোনো অবস্থাতেই তাদের ভালোবাসার মধ্যে সামান্যতম চির ধরে না। ঠিক তেমনিভাবে পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি— এক কথায় সব কিছু থেকে নবী কারিম (সা.)-এর প্রতি মুমিনের ভালোবাসা থাকতে হবে সীমাহীন। কোনো ব্যক্তি নিজেকে ইমানদার দাবি করে কিন্তু তার মধ্যে নবীজীর প্রেম-মহব্বত থাকবে না— তা কোনো মুমিন কল্পনাই করতে পারে না। উপরোক্ত হাদিস দুটির ভাষা অতি সুস্পষ্ট। মানুষের স্বভাবজাত ভালোবাসা যতই থাকুক না কেন পূর্ণ ইমানদার হতে হলে নবী কারিম (সা.)-এর প্রেম সব কিছুর ঊর্ধ্বে থাকতে হবে। তাই তো পূর্ণ ইমানদাররা নবী কারিম (সা.)-কে ভালোবাসে সবটুকু আন্তরিকতা দিয়ে। নবী (সা.)-এর নাম যখনই কোনো মুমিন বান্দার কানে আসে, সঙ্গে সঙ্গে মুমিন বান্দা চরম আবেগ প্রেম-ভালোবাসায় আপন জবান দিয়ে উচ্চারণ করে ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’। ‘নবী কারিম (সা.)-এর ওপর বর্ষিত হোক আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাত ও সালাম। নবীজীর নাম যতবার উচ্চারিত হয় ততবার মুমিন বান্দারা নবীজীর ওপর দরুদ পড়তে একটুও ক্লান্তিবোধ করে না। দরুদ সম্পর্কে বিশ্ববরেণ্য কবি শেখ সাদি (র.) বলেন, আল্লাহর বিধি-বিধান পালন করার পর ‘যে ব্যক্তি দরুদ পড়ার অভ্যাস করে, তার ওপর জাহান্নামের আগুন হারাম হয়ে যায়’। নবীজীর সিরাত ও সুরাতের আলোচনা মুমিন বান্দা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করে উপদেশ হাসিল করে এবং হৃদয়ে তৃপ্তির খোরাক জোগায়। কোনো কোনো মানুষ মনে করতে পারে, নবীজীকে সব কিছু থেকে বেশি ভালোবাসব ঠিক, তবে নিজের জান থেকে বেশি নয়। এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় নিম্নের হাদিস থেকে। রসুল (সা.)-এর প্রিয় সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে হিশাম (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, একদিন তারা হজরত রসুলে আরাবি (সা.)-এর সঙ্গে ছিলেন। তখন রসুলে করিম (সা.) প্রিয় সাহাবি হজরত উমর (রা.)-এর হাত ধরে ছিলেন। হজরত উমর (রা.) রসুল (সা.)-কে লক্ষ করে বললেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! আপনি আমার কাছে আমার নিজ জান থেকে বেশি প্রিয় নয়। অর্থাৎ আপনাকে আমি দুনিয়ার সব কিছু থেকে বেশি মহব্বত করি, তবে আমার নিজ সত্তা থেকে বেশি মহব্বত করি না। নবী কারিম (সা.) হজরত উমর (রা.)-এর এ কথা শুনে বললেন। ‘নাহ! যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ, তাঁর শপথ, যতক্ষণ আমি তোমার কাছে তোমার নিজের চেয়েও বেশি প্রিয় না হই (ততক্ষণ তুমি পূর্ণ মুমিন নও)। এরপর হজরত উমর (রা.) বললেন, আল্লাহর কসম, এখন আপনি আমার কাছে আমার নিজের চেয়েও অধিক প্রিয়। তখন রসুল (সা.) বললেন, (আল আন ইয়া ওমর) হে উমর এখন হয়েছে। (বোখারি শরিফ হাদিস নং ৩২)। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, সাহাবায়ে কেরামরা কত সহজ-সরল ছিলেন। তাদের ভিতরে-বাইরে একরকম ছিল। ভিতরে যা থাকত তা অকপটে বলে দিতেন। আমাদের বর্তমান সমাজের লোকদের মতো তারা ছিলেন না। বর্তমানে অনেক মানুষ এমন আছে, যারা নিজেদের ভালো প্রমাণ করার জন্য এবং মানুষকে খুশি করার জন্য অহরহ মিথ্যা বলে থাকে। প্রিয় পাঠক! বিচক্ষণ সাহাবি হজরত উমর (রা.) অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, অন্য সবকিছু থেকে মানুষের নিজের প্রতি ভালোবাসাই অধিক। তাই তো তিনি নবীজীকে সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত কথা বলেছিলেন। নবী (সা.) যখন তাকে বললেন, হে ওমর তুমি যদি পূর্ণ ইমানদার হতে চাও তাহলে অবশ্যই তোমার ভিতরে তোমার নবীর ভালোবাসা তোমার জান থেকেও অধিক থাকতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বুঝে নিলেন, দুনিয়ার জীবন মাত্র কয়েক দিনের। দুনিয়ার হায়াত একদিন শেষ হয়ে যাবে। বরং মানব সৃষ্টির একমাত্র মাকসাদ হলো এক আল্লাহর ওপর ইমান আনা। আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত রসুলদের বিশ্বাস করা এবং তাঁদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা তৈরি করা। তাই তো তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলে দিলেন। ইয়া রসুলুল্লাহ! আপনাকে আমি আমার জান থেকেও বেশি ভালোবাসি। প্রিয় পাঠক! নবীজীর প্রতি প্রতিটি মুমিনের এমনই ভালোবাসা থাকা চাই। পবিত্র হজের মাস আমাদের খুব কাছে। আর কয়েক দিন পরই শুরু হবে পবিত্র হজ। বিশ্বের আনাচ-কানাচে থেকে আল্লাহ ও রসুল প্রেমিক বান্দারা পবিত্র মক্কা ও মদিনার উদ্দেশ্যে ছুটে যাবেন। কা’বাতুল্লাহ-এর তাওয়াফ করবে। পবিত্র রওজা মোবারকে গিয়ে হায়াতুন্নবী (সা.)-কে সালাম জানাবে।  কতই না ধন্য সে অন্তর, যে অন্তর সোনালি মদিনার মাটির টানে ব্যাকুল হয়ে ছুটে যায়।

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব বারিধারা, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর