শিরোনাম
শনিবার, ২২ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড অত্যাবশ্যক

নূরে আলম সিদ্দিকী

লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড অত্যাবশ্যক

ইদানীং সংবাদপত্রসমূহ ও বৈদ্যুতিক মাধ্যমে আগামী নির্বাচন নিয়ে সংবাদ, সংবাদ পর্যালোচনা, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়— কিছু না কিছু থাকছেই। নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদাকেও যথেষ্ট তৎপর প্রতীয়মান হচ্ছে। আগামী নির্বাচনটি সব রাজনৈতিক দলের অংশীদারিত্বে, বিশেষ করে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে একটা ন্যূনতম ও দৃষ্টিগ্রাহ্য সমঝোতার ভিত্তিতে করতে পারলে এটা নির্বাচন কমিশন ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারের জন্য এতটাই গৌরবদীপ্ত হবে যে, নূরুল হুদার নাম ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার টি এন সেশনের গৌরবদীপ্ত অর্জনের সমকক্ষতায় পৌঁছে যাবে। কোনো ব্যক্তি ন্যূনতম নিরপেক্ষতা ও সততা চিত্তের গভীরে লালন করলে তিনি এ ধরনের সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইবেন না, এটাই স্বাভাবিক। ‘মুখে শেখ ফরিদ, বগল মে ইট’ হলে হবে না। চিন্তাচেতনা, মননশীলতা, মানসিকতা, প্রত্যয় ও প্রতীতিতে উদ্ভাসিত একটি মানুষ চেষ্টা করলে প্রান্তিক জনতার কাছে তিনি অকল্পনীয় শ্রদ্ধা ও সম্মান লাভ করবেন, তা আমি শতভাগ নিশ্চিত। কিন্তু আমার সংশয়, দ্বিধাদ্বন্দ্ব, নিরাশা ও হতাশা দুটি কারণে। আমাদের দেশের রাজনীতি ও নির্বাচন বাইরে থেকে যেভাবেই দেখা যাক না কেন, এর আসল চেহারা ভিন্ন। এ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গণতন্ত্রের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি না থাকার কারণেই দেশটি ‘জননেত্রী’ ও ‘দেশনেত্রী’র কাছে একেবারেই জিম্মি হয়ে গেছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও দেশটা আজকে দুটি মেরুতে বিভক্ত হয়ে গেছে। ফলে এ দুই ভদ্রমহিলা মানসিকতা, মননশীলতা ও চিন্তাচেতনায় এতখানিই দাম্ভিক ও অন্ধ যে, প্রান্তিক জনতার কাছে তারা কোনো দায়বদ্ধতা তো বোধ করেনই না, বরং গোটা দেশটাই তাদের মনগড়া পদ্ধতিতেই চলতে হবে— এটিই তাদের চাওয়া ও প্রত্যাশা। দেশটি তাদের কাছে তাদের এজমালি সম্পত্তি। নিজ নিজ সংগঠনের ভিতরে তো বটেই, গোটা দেশটাকেই কেবল তাদের অঙ্গুলি হেলনে এবং স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হয়ে চলতে হবে— এ মানসিকতা ও মননশীলতার একচুল বাইরে তারা আসতে চান না। তারা বেমালুম বিস্মৃত হয়ে বসে আছেন, পাকিস্তান আমলে ২৩টি বছর এ দেশের জাগ্রত জনতা কত কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করেছে, একেকটি আন্দোলনের সোপান উত্তরণের মধ্য দিয়ে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সামরিক শাসনের আবর্তে থেকেও ’৭০-এর নির্বাচনে পৃথিবীর ইতিহাসে কী অভূতপূর্ব ও অবিস্মরণীয় গণতান্ত্রিক বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। সমগ্র চেতনার একক মূর্তপ্রতীক ছিলেন মানুষের হৃদয়ের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত মুকুটহীন সম্রাট বঙ্গবন্ধু, আমাদের প্রাণের মুজিব ভাই। এ দীর্ঘ সংগ্রামের পথ-পরিক্রমণে বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে সেই অভিযাত্রার পূর্ণ নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রলীগ। সন্দেহাতীতভাবে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার স্থপতি; কিন্তু ছাত্রলীগই সব আন্দোলনের অন্তর্নিহিত শক্তি। প্রান্তিক জনতার স্বার্থ হৃদয়ে উপলব্ধি না করলে তাদের (দুই নেত্রী) অনভিপ্রেত অহমিকার পরিসমাপ্তি ঘটবে না। অথচ নিজ নিজ আঙ্গিকে তাদের দাম্ভিকতা গণতন্ত্রকে তো নিষ্ক্রিয় করেছেই, আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে গণতান্ত্রিক কর্মপদ্ধতি থেকে সরিয়ে এনে সবকিছুকেই সমূলে গ্রাস করে মূলত সংগঠন দুটিকে নিষ্প্রভ ও কর্মবিমুখতাকে উদগ্র ও নগ্নভাবে প্রতিভাত করা হয়েছে। তৃণমূলের কিছু আত্মত্যাগী কর্মী বাদে পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যকে ছিনিয়ে আনার গৌরবদীপ্ত সংগঠন আওয়ামী লীগেরও ভুঁইফোড় আতিপাতি নেতারা রাজনীতির মূল শক্তি মাটি ও মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রাখার আজ আর তেমন কোনো তাগিদ অনুভব করেন না। কারণ তারাও সুনিশ্চিত হয়ে গেছেন যে, সংগঠনের পদ-পদবি পেতে; এমনকি দলীয় মনোনয়ন পেতে আজকে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও সমর্থন, প্রার্থীর যোগ্যতা, প্রতিভা, কর্মদক্ষতা এবং জনসম্পৃক্ততার কোনো মূল্যই নেই। অর্থ ও তোষামোদী— এ দুটিই পদ-পদবি ও মনোনয়ন পাওয়ার মূল নিয়ামক। জনপ্রিয়তাবিবর্জিত কিছু কাগুজে নেতা অজ্ঞাত কারণে দুই নেত্রীর আস্থাভাজন হিসেবে নিজেদের জাহির করে পরিস্থিতিটাকে আজন্মের এ ভয়াবহ পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছেন। আমি শতভাগ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, ‘জননেত্রী’ ও ‘দেশনেত্রী’ যে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত নন, এমনটি নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, কি সাংগঠনিকভাবে, কি দুর্নীতির ক্ষেত্রে তাদের দৃশ্যমান কোনো শাস্তির ব্যবস্থা হয় না। যার নিশ্চিত ফল হচ্ছে রাজনৈতিক অবক্ষয়, দুর্নীতি ও দুর্বিচারের অপ্রতিরোধ্য বিস্তার। স্বাধীনতার পূর্বকালে যে কোনো নেতা ও কর্মীর কাছে এটা পাঁজরভাঙা বেদনার মতো মর্মান্তিক ও পীড়াদায়ক। সমাজের সর্বস্তরে আজ মূল্যবোধের অবক্ষয় ও দুর্নীতির দুর্বিনীত বিস্তারের মূল কারণ হলো, সব ক্ষেত্রেই ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার নির্লজ্জ লালসা। আমাদের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জ্ঞানপ্রদীপ্ত ছিলেন। শিক্ষা প্রদানকেই তারা জীবনের গৌরবান্বিত সাফল্য মনে করতেন। তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. ওসমান গনি মোনায়েম খানের আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন। সরকারি ছাত্র সংগঠন এনএসএফের প্রতি তার কিছুটা দুর্বলতাও ছিল। কিন্তু সার্বিক অর্থে এনএসএফ তো নয়ই, স্বয়ং মোনায়েম খানও তাকে ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসেবে ব্যবহার করা দূরে থাক, কল্পনাও করতে পারেননি। পারলে ছাত্র সংগঠনগুলোর দ্বারা বিশাল রাজনৈতিক পথ-পরিক্রমণ সম্ভব হতো না। ওসমান গনি সরকারঘেঁষা হলেও নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দিতেন। ফলে সব ছাত্র সংগঠন, বিশেষ করে ছাত্রলীগ সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তাদের পক্ষে সমর্থন আদায়ের খাতিরেই দায়বদ্ধ থাকতে বাধ্য হতো। এ দায়বদ্ধতাই ছাত্রব্যক্তিত্ব, বিশেষ করে ছাত্রলীগের মধ্যে নেতৃত্ব ও প্রতিভা বিকাশের পথ প্রশস্ত করে দেয়।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর জাস্টিস আবু সাঈদ চৌধুরী যখন উপাচার্য হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব নেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিবেশ যেন রাতারাতি বদলে যায়। তার মধ্যে এমন একটা সম্মোহনী শক্তি ছিল, ব্যক্তিত্বের এমন প্রোজ্জ্বল জ্যোতি ছিল যে, ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে তো বটেই, শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের মানসিকতায় একটা আমূল পরিবর্তন এনে দেয়। এখানে জনান্তিকে জানিয়ে রাখি, এনএসএফ ছাড়া অন্য কোনো ছাত্র সংগঠন রাজনৈতিক সংগঠনের অঙ্গসংগঠন ছিল না। রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল কিন্তু নেতৃত্বের বিকাশে প্রতিযোগিতা ছিল, যোগ্যতার মূল্যায়ন ছিল। কোনো সংগঠনে, বিশেষ করে ছাত্রলীগে নেতৃত্ব রাজনৈতিক সংগঠন থেকে আরোপিত হতো না। আমাদের ছাত্রলীগের পূর্বসূরি সব ছাত্রনেতৃত্ব এবং আমি বঙ্গবন্ধুকে আমাদের চেতনার প্রতীক ভাবতাম, আজও ভাবী। তিনি আমাদের চেতনায় প্রদীপ্ত সূর্যরশ্মির মতো প্রেরণা জোগাতেন, নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনে পরামর্শ দিতেন কিন্তু নেতৃত্বকে স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হওয়ার অবারিত সুযোগ দিতেন। নিজের মনঃপূত নেতৃত্বকে জোর করে চাপিয়ে দিতেন না। এটিই ছাত্রলীগকে অন্য সব ছাত্র সংগঠনকে পেছনে ফেলে বাঙালি জাতির চেতনার উন্মেষ, বিকাশ, ব্যাপ্তি ও সফলতার সৈকতে পৌঁছে দেয়। সব ছাত্র সংগঠনের অগ্রভাগে দাঁড় করিয়ে দেয়।

রাজনীতির মূলধারায় ফিরে আসা যাক। আমি অনুধাবন করছি, ইতিমধ্যেই দেশে নির্বাচনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক নিজ নিজ আঙ্গিকে প্রচারণাও শুরু হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা দৃশ্যত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিরও চেষ্টা করছেন। কিন্তু তার সফলতা নির্ভর করছে দুই নেত্রীর সদিচ্ছা ও মানসিকতার ওপর। যিনি ক্ষমতায় আছেন, প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রেখে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু সমগ্র প্রশাসনকে যেহেতু তিনি গ্রাস করে ফেলেছেন, সেখান থেকে প্রশাসনকে নিষ্কৃতি না দিলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব হয়ে উঠবে। শেখ হাসিনাকে এটি উপলব্ধি করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্যদিকে নির্বাচনটি সফল করার জন্য খোলা মন নিয়ে দাম্ভিক ও ক্ষমতালোভী বেগম খালেদা জিয়াকে শুধু ক্ষমতা দখলের জন্য নয়, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য অবশ্যই নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতার পালাবদল হয়। কিন্তু নির্বাচন যখন শুধু ক্ষমতা দখলের অভিপ্রায়ের শিকার হয়ে যায়, ছলেবলে কলে-কৌশলে ক্ষমতা দখলই যখন রাজনৈতিক দর্শনে পরিণত হয়, তখন নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করতে পারে না। আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংকটের মূল কারণ দুই নেত্রীর অসহনীয় দাম্ভিকতা। একজন আরেকজনের প্রতি শুধু বীতশ্রদ্ধই নন, প্রতিহিংসাপরায়ণও। ফলে গণতন্ত্র ও দেশের কতটুকু ক্ষতি হলো, তা আমলে না এনে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা জান কবুল; একে অন্যকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া বা ক্ষমতায় থাকা সহ্য করতে পারেন না।

এ দুই নেত্রীর ক্ষমতালিপ্সার অক্টোপাস থেকে বেরিয়ে আসতে জাতি উদ্গ্রীব। কিন্তু বেদনাদায়ক হলেও বাস্তব যে, বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে ওঠার কোনো বাস্তব সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। সম্প্রতি বন্ধুবর আ স ম রবের বাসায় অনুষ্ঠিত আলোচনা বৈঠকে পুলিশি হস্তক্ষেপের বিষয়টি গণতন্ত্রের প্রতি প্রচণ্ড আঘাত এবং নিন্দনীয়। তা সত্ত্বেও সেদিনের সেই বৈঠকে অংশগ্রহণকারী প্রায় সবারই অতীত কার্যকলাপ এতটাই প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত যে, সাধারণ মানুষ তাদের পেছনে ঐক্যবদ্ধ হবে, এমন কোনো সম্ভাবনা আদৌ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তবুও আমি প্রত্যাশা ছাড়ব না। একটা নতুন নেতৃত্ব বেরিয়ে আসতেই হবে, যিনি বা যারা এ দুই নেত্রীর কুক্ষিগত নেতৃত্বের কবল থেকে গণতন্ত্রকে নিষ্কণ্টক করবেন, প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবেন। পৃথিবীতে এর ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত রয়েছে। আমেরিকার বারাক ওবামা নিছক একজন সিনেটর হিসেবে এরূপ দৃষ্টান্ত রেখেছেন। অতুল্য ঘোষ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি থাকাকালে সেখানে কংগ্রেসের কোনো সাংগঠনিক জোর তৎপরতা ছিল না। কংগ্রেস সেখানে অতুল্য ঘোষের এককাধিপত্য বিস্তারের একটা নিষ্ক্রিয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে অজয় রায় বাংলা কংগ্রেস গঠন করে মুখ্যমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন।

ছয় দফা দেওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের মুজিব ভাই পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং খোদ পূর্ব পাকিস্তানে তিনি অনেক নেতার মধ্যে একজন ছিলেন। ছয় দফা প্রদানের পর ছাত্রলীগই কর্মসূচিকে বাংলার মুক্তিসনদ হিসেবে গ্রহণ করে তাকে কেন্দ্র করে প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মুখে একটা অভিন্ন ও অনন্য সাধারণ বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তির ওপর নির্ভর করে তাকে ভিন্নমাত্রায় নিয়ে যায় এবং মুজিব ভাইকে বাংলার অনন্য সাধারণ একক নেতৃত্বের আসনে প্রতিস্থাপিত করে।

পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস সিপিএমকে কোনোভাবেই যখন ক্ষমতা থেকে সরাতে পারছিল না, কংগ্রেস থেকে বিদ্রোহ করে বেরিয়ে এসে মমতা ব্যানার্জি তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করেন এবং পশ্চিমবঙ্গে জগদ্দল পাথরের মতো ক্ষমতায় বসে থাকা সিপিএমকে শুধু সরাতে সক্ষমই হননি, তিনি সেখানে সরকার গঠন করেন এবং নিজে মুুখ্যমন্ত্রী হয়ে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অঙ্গনকে তাক লাগিয়ে দেন। এর মধ্য দিয়ে সারা ভারতেই তিনি একটি অনুপ্রেরণার দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিভাত হয়েছেন। অথচ তিনি যে সেখানকার আর সব নেতৃত্বের তুলনায় অনন্যসাধারণ প্রতিভার অধিকারী, তাও বলা যাবে না। দিল্লির কেজরিওয়ালকেও এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসেবে আনা যায়। আন্তরিক সততা নিয়ে উদ্যোগ অব্যাহত রাখলে নিশ্চয়ই নতুন নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে, ইনশা আল্লাহ।

বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণও করেনি, প্রতিহতও করতে পারেনি। এ বাস্তবতা সামনে রেখে বিএনপি যদি আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে নির্বাচনটিকে ভণ্ডুল বা বর্জন করার চেষ্টা করে তাহলে তাদের রাজনৈতিক বিপর্যয় তো আসবেই, বিএনপিও আকাশ থেকে বিচ্যুত নিষ্প্রভ নক্ষত্রের মতো ম্রিয়মাণ হবে এবং নিজেদের অস্তিত্ব টেকানোই তাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে যাবে। বিএনপিকে দলের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, প্রান্তিক জনতার স্বার্থে সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে অবশ্যই নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। শেখ হাসিনাকেও ভাবতে হবে ২০১৪ ও ২০১৯-এ তফাত অনেক। পদ্মা-মেঘনা-যমুনার পানি অনেক গড়িয়েছে। এ নির্বাচনটিকে নিরপেক্ষ ও সর্বজনস্বীকৃত করতে না পারলে তার সব অর্জন নিষ্ফল তো হবেই, ইতিহাসের আদালতে তাকে এর দায়ভার মাথায় নিয়ে দাঁড়াতে হবে। মৌলিক অধিকারবিবর্জিত কোনো উন্নয়নই দুর্নীতিবিমুক্ত হয় না, টেকসই হয় না। ক্ষমতাসীনদের বিশ্বাস করা উচিত, উন্নয়ন মৌলিক অধিকারবিবর্জিত হলে দেশের বিপর্যয়ও ঠেকানো যায় না। আমার মনে হয়, শেখ হাসিনা এ সত্যটি কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে শুরু করেছেন। তাই তার মুখ্য দায়িত্ব হিসেবে সব রাজনৈতিক দলের, বিশেষ করে বিএনপির অংশীদারিত্বের নির্বাচনটি সংঘটিত করতে পারলে তিনি শুধু একটা বিরাট সফলতাই অর্জন করবেন না, বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অনন্যসাধারণ উচ্চতায় অবস্থান পাবেন। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রাণ হিসেবে জীবনসায়াহ্নে তার কাছে এতটুকু আশা করা অমূলক নয় বলে মনে করি।

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

সর্বশেষ খবর