শনিবার, ২২ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার পেয়ারা বাজার

শাইখ সিরাজ

বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার পেয়ারা বাজার

প্রিয় পাঠক! ইতিমধ্যে লক্ষ্য করেছেন সারা দেশেই কৃষিতে অভাবনীয় সাফল্যের দৃষ্টান্ত গড়ছেন তরুণ উদ্যোক্তারা। যারা শিক্ষিত, সচেতন ও জেনে-বুঝে কৃষিতে বিনিয়োগ করছেন তাদের লোকসান সংখ্যায় কম। তারা দ্রুতই এক ফসল থেকে আরেক ফসলে যাচ্ছেন এবং আর্থিক লাভ নিশ্চিত করছেন। আমার কাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জায়গা সারা দেশের তরুণ কৃষকদের সাফল্যগুলো তুলে ধরা আর তরুণ প্রজন্মকে কৃষিতে আকৃষ্ট করা। দেশের বিভিন্ন এলাকায় এমন কিছু সফল যুবকের সন্ধান পেয়েছি এবং কাজ করেছি। নাটোরের পেয়ারা চাষি আতিক, ময়মনসিংহের ভালুকার হাতিবেড় গ্রামের লাউ চাষি বাবুল, ফুলবাড়িয়ার সমন্বিত খামারি আবুবকর সিদ্দিক প্রিন্স, নওগাঁ শহরের বরুণকান্দি গ্রামের সমন্বিত খামারি সালাহ উদ্দিন উজ্জ্বলের মতো সফল কৃষক এখন দেশজুড়ে। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে তাদের সাফল্যের বার্তা। এমনই একজন তরুণ কৃষকের দেখা মিলল দেবীগঞ্জের মলিচণ্ডী গজপুরী গ্রামে কাজ করতে গিয়ে।

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার গজপুরী গ্রামের তরুণ কৃষক শরাফত আলী। পেয়ারা চাষে সফলতার এক অনন্য নজির গড়েছেন। শরাফত আগে নানা ধরনের ছোটখাটো কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এরপর একসময় ব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত হন। কিন্তু ভিতরে রয়ে গেছে মাটি আর কৃষির প্রতি টান। তাই ব্যবসা থেকে আয় করা অর্থ দিয়েই শুরু করেন নতুন কৃষি উদ্যোগ। জমি কিনে লিজ নিয়ে শুরু করেন পেয়ারা চাষ। অল্প অল্প করে এখন বড় হয়ে উঠেছে সেই উদ্যোগ। ২০ একর জমিতে বিশাল তার পেয়ারাবাগান। পেয়ারা গাছের মাঝে মাঝে বপন করেছেন তেজপাতা গাছ। আছে মিষ্টিকুমড়ার চাষও। এই শরাফত যতটা সফল ঠিক ততটাই সাহসী। সাহসের সঙ্গে তিনি এমন চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন যে, পুরো এলাকায় সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। শুরুটা খুব বেশি দিন আগের নয়। আগে ছিলেন আদা ব্যবসায়ী। আমরা যাকে মজা করে বলি, ‘আদার ব্যাপারি’। এরপর পৈতৃক ১০ কাঠা জমিতে শুরু করেন আদা চাষ। সেই আদার ব্যাপারি শরাফত এখন জাহাজের খবর নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। তরতরিয়ে বেড়ে উঠেছেন অর্থ ও যশে। এখন তার মুঠোভরা সাফল্য।

শরাফত জানালেন দু-তিন বছর ধরে ধীরে ধীরে তিনি গড়ে তুলেছেন বিশাল এই পেয়ারাবাগান। শুরুটা আদা, হলুদ, আলু আর ভুট্টা চাষ দিয়ে। ৩০০ বিঘা জমিতে আলু চাষ করে একবার সফল হয়েছিলেন। এরপর স্থানীয় কৃষি অফিসারের নজরে পড়েন। তার পরামর্শে শুরু করেন পেয়ারা চাষ। শরাফত আরও বলছেন, শুধু পেয়ারা নয়, সঙ্গে তেজপাতা চাষেও ভালো লাভ পাচ্ছেন। শরাফতের কৃষি উদ্যোগের মূলে ছিল টেলিভিশন অনুষ্ঠান ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’। টেলিভিশনে কৃষি অনুষ্ঠান দেখে তার মনে হয়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসা থেকে কৃষিতে গেলে দ্রুতই আর্থিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন তিনি। ‘হুট করেই পেয়ারা চাষ শুরু করিনি’, বলছিলেন শরাফত। বললেন, চাষ শুরু করার আগে ঘুরে দেখেছেন দেশের বিভিন্ন পেয়ারাবাগান। আর ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে প্রচারিত প্রতিবেদনের দেশের সফল পেয়ারা চাষিদের সঙ্গেও দেখা করেন। তখনই ঠিক ঠিক ধরতে পেরেছেন পেয়ারা চাষের লাভ-ক্ষতির হিসাব আর কৌশলগুলোও দ্রুত রপ্ত করেছেন যাতে সফলতার শিখরে পৌঁছানো যায়।

২০ একর জমিতে ৮ হাজার পেয়ারা গাছ লাগিয়েছেন শরাফত। খরচ হয়েছে এখন পর্যন্ত ৩৫ লাখ টাকা। প্রথম ফলনেই তিনি বিক্রি করতে পেরেছেন প্রায় ২৫ লাখ টাকার পেয়ারা। সারা বছরই পাওয়া যাবে পেয়ারার ফলন। এ ছাড়া একই জমি থেকে সাথী ফসল হিসেবে পেঁপে ও মিষ্টিকুমড়া থেকেও পেয়েছেন অতিরিক্ত লাভ। জমিতে করেছেন বাঙ্গির চাষ। লাভ মিলেছে বাঙ্গি থেকেও। মেধা আর পরিশ্রমের এক অনন্য সমন্বয় এই শরাফত। যাকে দেখলে অনুপ্রাণিত ও ঈর্ষান্বিত হতে হয় যে কোনো কৃষককে।

শরাফত এখন হিসাব কষেন কোটি টাকার। জমি যেমন সারা বছর ফসলপূর্ণ থাকছে, একইভাবে সারাটি বছরই অর্থবিত্তে দারুণ এগিয়ে চলেছেন শরাফত। শরাফত আলীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ৩৫ লাখ টাকা খরচ করে কী পরিমাণ লাভ আশা করছেন তিনি। জানালেন এক বিশাল হিসাব। এক বছরের জন্য কোনো এক ক্রেতা ১ কোটি টাকায় অগ্রিম কিনে নিতে চাচ্ছেন শরাফতের পেয়ারা। পাঁচ বছরের জন্য সেই ক্রেতা সাড়ে ৪ কোটি টাকা দিতেও এক পায়ে খাড়া। কিন্তু এতেও রাজি নন শরাফত। তার বাগানে ৪০ জন কর্মী রয়েছেন। তারা দীর্ঘদিন দিনরাত তার সঙ্গে ছায়ার মতো আছেন। তাদের কর্মহীন করে অতিরিক্ত কোনো লাভ তিনি পেতে চান না। তবে তিনি আশা করছেন, সব খরচ বাদে পাঁচ বছরে ৫ কোটি টাকা তিনি লাভ করতে পারবেন শুধু পেয়ারা থেকেই। প্রিয় পাঠক! এখানে একটি তথ্য জানিয়ে রাখছি। সারা দেশে পেয়ারা চাষের পরিধি বেড়েছে। এখন প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে পেয়ারা চাষ হয় এবং বছরে পেয়ারা বাজার হচ্ছে আনুমানিক ১০ হাজার কোটি টাকার। পেয়ারাবাগানের ব্যবস্থাপক তুহুরুল ইসলাম জানান, এই পেয়ারাবাগান থেকে কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে বেশি ফলন পাওয়া যাবে।

আর তখন পেয়ারার বাজার দরও থাকবে বেশি। এখনো পেয়ারা বাজার যে মন্দ তা বলা যাবে না। কারণ প্রতি মণ বড় পেয়ারা তিনি বিক্রি করছেন ৩০০০ টাকায় আর তুলনামূলক ছোটটা বিক্রি করছেন ২৫০০ টাকায়। এ বাগান গড়ে তোলা ও এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে নিবিড়ভাবে সহযোগিতা করেছেন দেবীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন। কথা হলো তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কৃষি এখন বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে। শরাফতের কৃষির প্রতি আগ্রহ দেখেই তাকে পেয়ারা চাষের পরামর্শ দিই। থাই পেয়ারার পাশাপাশি তাকে সাথী ফসল হিসেবে আরও ফসল ফলাতেও পরামর্শ দিই।’ শরাফত আলীর এই বিনিয়োগ কতটা নিরাপদ? উন্নত দেশগুলো যেখানে শস্যবীমা নিয়ে সচেতন সেখানে জলবায়ু পরিবর্তন, উষ্ণতা বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে যে কোনো দুর্যোগে আমাদেরও শস্যবীমা চালুকরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন কিনা— জানতে চেয়েছিলাম মাঠ পর্যায়ে কাজ করা এই কৃষি কর্মকর্তার কাছে। তিনি জানালেন, শস্যবীমা কৃষকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি। এখানে এসে ভালো লাগল, এই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ফিরুজুল ইসলামও কৃষির ব্যাপারে বেশ আগ্রহী। তিনি এ এলাকায় ভিন্ন ধরনের ফসল বৈচিত্র্য সৃষ্টির ব্যাপারে ইতিমধ্যে নিয়েছেন নানা উদ্যোগ। তিনি জানান, এ এলাকায় কৃষিবৈচিত্র্য নিশ্চিত করতে তিনি নানা উদ্যোগ হাতে নিয়েছেন। কৃষিবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে আয়োজন করেছেন নানা সভা-সেমিনারের। কৃষকের সব তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে নতুন কী কী ফসলের চাষ করা সম্ভব, তাও তলিয়ে দেখার নির্দেশনা তিনি দিয়েছেন। শরাফত যে পুরো এলাকার কৃষকের কাছে একজন দৃষ্টান্ত, তা গৌরবের সঙ্গে বললেন ফিরুজুল ইসলাম।

বাউকুলকে আমি আপেলের ওপর স্থান দিয়েছিলাম। বাউকুল আপেলের চেয়ে সুস্বাদু, উপাদেয় বলেছিলাম। পেয়ারাও এখন ঠাঁই করে নিচ্ছে আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায়। আমি দেখেছি অনেক করপোরেট অফিসে ইদানীং অতিথি আপ্যায়নে পেয়ারাসহ দেশি মৌসুমি ফল জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আসছে বছরগুলোয় হয়তো নতুন নতুন ফল আমাদের খাদ্য তালিকায় যুক্ত হবে। আমাদের কৃষক এখন অ্যাভোকেডো চাষ করছে, মাল্টা চাষ করছে, চাষ করছে থাই নারিকেল আরও কত কি! আগামী দু-চার বছরের মধ্যে আমাদের ফলের বাজারে আসতে শুরু করবে আরও নতুন নতুন ফল, যা ইতিমধ্যে আমাদের তরুণ উদ্যোগী কৃষকদের মাঠে পরীক্ষামূলক চাষ চলছে। যেমন রাম্বুটান, লঙ্গান, পার্সিমন, থাই শরিফা, জাবাটিকা ইত্যাদি।

প্রিয় পাঠক! উচ্চমূল্যের ফল উৎপাদন এখন স্বপ্নের মতো এক কৃষি। পরিকল্পিত ফলের বাগান গড়ে যেখানে অল্প দিনেই অর্জন করা সম্ভব কাঙ্ক্ষিত বাণিজ্যিক সাফল্য। শরাফতের মতো কৃষি উদ্যোক্তারা নিজ প্রচেষ্টায় ফলবাগান গড়ে অল্প দিনেই দেখা পাচ্ছেন সাফল্যের। এরাই অন্যদের জন্য হয়ে উঠছেন পথপ্রদর্শক। আমার ঐকান্তিক চাওয়া, এসব শরাফত আলীর মতো এমন স্বপ্নচারী উদ্যোক্তার সব স্বপ্ন ও আশা পর্যায়ক্রমে পূরণ হোক। শরাফতদের হাত দিয়েই এগিয়ে যাক দেশের আগামীর কৃষি।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর