রবিবার, ২৩ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

খালেদা জিয়ার লন্ডন মিশনের অন্তরালে কী?

কাজী সিরাজ

খালেদা জিয়ার লন্ডন মিশনের অন্তরালে কী?

শিডিউল ঘোষণার আগে একাদশ সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক বাগযুদ্ধ বেশ জমে উঠেছে এবং মানুষ তা উপভোগ করছে। প্রধান দুই পক্ষ যেভাবে কথাবার্তা বলছেন, তাতে যদি তারা অটল থাকেন তাহলে একটি অংশগ্রহণমূলক ও সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় ঘনীভূত হতে থাকবে। কিন্তু ক্ষমতাসীন লীগ সরকার কি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনের মতো আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের ঝুঁকি নিতে পারে? আবার সরকারি দলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ও মাঠের প্রকৃত বিরোধী দল বিএনপিও কী গত নির্বাচনের মতো আগামী নির্বাচনও বর্জন করার সর্বনাশা পক্ষে পা দিতে পারে? প্রধান দুই দলের কেউই বিগত নির্বাচনে যে ভুল করেছে, আবারও সে ভুল করবে বলে মনে হয় না। এটা সবারই জানা যে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ৩০০ সরাসরি আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে কোনো নির্বাচন-ভোটাভুটিই হয়নি। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে যে, ‘একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিনশত সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের (৩) দফার কার্যকরতাকালে উক্ত দফায় বর্ণিত সদস্যদিগকে (সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য) লইয়া সংসদ গঠিত হইবে; সদস্যগণ সংসদ-সদস্য বলিয়া অভিহিত হইবেন।’ কিন্তু আমরা দেখলাম, ১৫৩ আসনে কোনো নির্বাচনই হয়নি। অত্যাশ্চর্য এক ‘সমঝোতার গণতন্ত্র’ দেখলাম আমরা, দেখলো দেশবাসী। জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসনগুলো সমঝোতার মাধ্যমে ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়। এমনও বলা হয়েছিল, বিএনপি সমঝোতায় এলে তাদেরও কিছু আসন ছেড়ে দেওয়া হতো। ভাগ্যিস বিএনপি সম্মত হয়নি, তাহলে তো ৩০০ আসনে সবাই বিনাভোটে ‘অটো’ এমপি হয়ে যেতেন। ব্যবস্থাটি অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশে ইহজিন্দেগিতে আর নির্বাচন হতো না এবং বাংলাদেশ বিশ্বে ‘সমঝোতার ভোটবিহীন সংসদের’ রোল মডেল হয়ে যেত। বলা হয়েছে (অবশ্যই ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে) নির্বাচনে আসা না আসা যে কোনো দলের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। কেউ নির্বাচনে না এলে তো জোর করে আনা যায় না। তাছাড়া বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে সংবিধানে কোনো বাধা নেই। এর আগেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনেকের নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড আছে। কিন্তু কত? ৩০০ আসনের মধ্যে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৫১ আসনের বেশি কবে বিনাভোটে ‘নির্বাচিত’ হয়েছেন? শাসক লীগ এক্ষেত্রে একটি ‘বিশ্বরেকর্ড’ করে ফেলেছে, যে রেকর্ড কেউ কখনো ভঙ্গ করতে পারবে না। নির্বাচন ছাড়াই যে ১৫৩টি আসন ভাগাভাগি করে নেওয়া হলো, ‘আমরা আর আমাদের মামুদের’ মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমেই যদি আপসে তা করা হতো তাহলেও সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদ মানা হয়েছে বলে দাবি করা যেত। সে ধৈর্যও ছিল না ক্ষমতাসীনদের। নির্বাচনটি যদি সম্পন্ন করা না যেত তাহলে সাংবিধানিক শাসনের ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হতো বলে আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য দেন সরকারি দলের লোকেরা, মন্ত্রী-মিনিস্টাররা। কিন্তু নির্বাচন বর্জনকারীদের নির্বাচনে আনার দুটি সুযোগ তো ছিল; ১. নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় ও নির্বাচনের তারিখ কিছুটা পিছিয়ে দিয়ে বর্জনকারীদের ফিরে আসার সুযোগ দেওয়া, অন্তত দুই সপ্তাহ সময় নির্বাচন কমিশনের হাতে ছিল, ২. সংবিধান নির্দেশিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন সবাইকে নিয়ে করা না গেলে করণীয় সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা চাওয়া। টাঙ্গাইলে লতিফ সিদ্দিকীর শূন্য আসনে সংবিধান নির্দেশিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে না পেরে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা প্রার্থনা করা হয়েছিল এবং আদালতের নির্দেশে সেই উপ-নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে ঘোষিত তারিখের প্রায় এক বছর পর। গোটা সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি তো ছিল আরও গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু কায়েমি স্বার্থে সে ব্যাপারে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা চাওয়া হয়নি। চাইলে সেই নির্বাচনও অংশগ্রহণমূলক করার একটা আলোর সন্ধান হয়তো পাওয়া যেত। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে শুদ্ধ করার সুযোগ নেই। তবে তা থেকে প্রধান দুই পক্ষেরই শিক্ষা নেওয়ার আছে। গত বছর অক্টোবর মাসে আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় কাউন্সিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি কৌতুক করে বা কথার ছলে বলেছিলেন যে, ‘আগামী নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ হোক তা আমি চাই না? নিশ্চয়ই না। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন’ তাকে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা দিয়েছে, কিন্তু একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ ও সেই সংসদের নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে, গণতান্ত্রিক বিশ্বে তাকে তেমন গৌরবদীপ্ত ও মহিমান্বিত করছে না। ওই নির্বাচনের পর পৃথিবীর সব রাষ্ট্রই বাংলাদেশের সঙ্গে রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে সম্পর্ক বজায় রাখছে সরকারের লোকজন মনের সুখে এ কথা প্রচার করছেন। তারা কি জানেন না, সামরিক সরকারের আমলেও বিশ্ব এমন রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক (স্টেট টু স্টেট) বজায় রাখে। কিন্তু সে সম্পর্ক যদি আন্তরিক  হৃদ্যিক ও কার্যকর লেনদেনভিত্তিক অর্থাৎ উন্নয়নে, অগ্রগতিতে অংশগ্রহণমূলক না হয়, তাহলে ওপরে ওপরে রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক, রাষ্ট্রীয় বা সরকারি সফর আমাদের মতো দেশের কল্যাণে আসে না। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই তা উপলব্ধি করেছেন গত সাড়ে তিন বছরে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে বিশ্বে তিনি নিজের মাথা উঁচু করে চলতে চান, বাংলাদেশকেও গৌরবদীপ্ত করতে চান বলেই আগামী নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হোক তা চান না। গত নির্বাচন থেকে এটা তার শিক্ষা বলেই মনে হয়। আগামী নির্বাচনও যদি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো প্রশ্নবিদ্ধ হয় তাহলে পরিস্থিতি বদলে যাওয়ার আশঙ্কা অমূলক নয়। ৬৮ বছরের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ তাতে তার ঐতিহ্য ও গৌরব হারাতে পারে। গণতান্ত্রিক বিশ্ব থেকে একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হতে পারে বাংলাদেশ। সে ঝুঁকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ কি নেবে? মাঝখানে কোনো ‘বিরতি’ ছাড়াই টানা প্রায় সাড়ে আট বছরের লীগ শাসনে দল, অঙ্গ দল, সহযোগী দলসহ নানা ধরনের স্বীকৃত-অস্বীকৃত ‘আওয়ামী দোকানের’ ক্যাডার-কর্মীরা অবাধ্য-নিয়ন্ত্রণহীন যে সব কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে বলে প্রায় প্রতিদিনই মিডিয়ায় খবর আসছে তাদের দুর্বিনীত আচরণে জনগণ যেভাবে ক্ষুব্ধ, আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এলে এসব ‘আবর্জনার’ স্তূপে তলিয়ে যাবে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের নেতারা, বিশেষ করে কেরিয়ার রাজনীতিবিদরা যে তা উপলব্ধি করছেন বোঝা যায় দলের সাধারণ সম্পাদক ও আপাদমস্তক একজন রাজনীতিবিদ ওবায়দুল কাদেরের বক্তৃতা-বিবৃতিতে। কাজেই যেনতেনভাবে আগামী নির্বাচন সেরে নেওয়ার কোনো প্রয়াস আওয়ামী লীগের জন্য হবে আত্মঘাতী।

বিএনপিরও কি একাদশ সংসদ নির্বাচন যে কোনো ছুতোয়, অজুহাতে বর্জন করার কোনো সুযোগ আছে? মনে হয় নেই। দশম সংসদ নির্বাচন তারা বর্জন করেছিল নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে। উল্লেখ্য, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, বাম জোট ও জামায়াতে ইসলামীর যুগপৎ আপসহীন রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে। বিএনপি তখন এর ঘোর বিরোধী ছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, শিশু ও পাগল ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়। শেখ হাসিনা সত্যি সত্যিই ‘ঝাঁকুনি দিয়ে’ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন শিশু ও পাগল ছাড়াও নিরপেক্ষ মানুষ হয়। ২০১৩ সালে সংসদে বাতিল করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান। সরকার তার সুবিধার জন্যই যে তা করেছে এটা সবাই বোঝে যদিও উচ্চ আদালতের নির্দেশনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সংসদের অনুমোদন সাপেক্ষে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় যে আরও দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন করা যায় বলে উচ্চ আদালত একই রায়ে উল্লেখ করেছেন তার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বিএনপিও আওয়ামী লীগের মতো রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমে ব্যবস্থাটি ফিরিয়ে আনতে পারেনি। বিএনপি ভঙ্গুর সংগঠন ও নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে নির্বাচনহীন পার্লামেন্ট, ভোটারবিহীন নির্বাচন রোধ করতে পারেনি। তারপরও আন্তর্জাতিক চাপ দেশের জনমতের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় অবস্থান থেকে সরে এসে নির্বাচনকালে সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু মন্ত্রণালয় অফার করেছিলেন বিএনপিকে। রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহলের মতে, তখন জামায়াতে ইসলামীর প্রবল চাপ ও প্রতিরোধের কারণে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের অধিকাংশ নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে নমনীয় হলেও অনুকূল সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। এ মহল এমনও বলে যে, শেষ মুহূর্তে জামায়াতের মতামত অগ্রাহ্য করে বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু তখন ৩০০ আসনে মনোনয়ন ঠিক করা ও জমা দেওয়ার সময় ছিল না। তদবিরও নাকি করেছিলেন অন্য দলের এক নেত্রীর মাধ্যমে। কিন্তু ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে। নানা মাধ্যমে সরকার প্রায় নিশ্চিত হয় যে, বিএনপি নির্বাচনে এলে তা এনিবডির গেইম’ হয়ে যাবে। তাই সরকার কোনো ঝুঁকিতে যায়নি। ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন বাবলুর মাধ্যমে রওশন এরশাদকে ম্যানেজ করে তাদের নিয়ে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়ে তাতেই শেষ পর্যন্ত অটল থাকে। বিএনপি ও ২০-দলীয় জোট নির্বাচন হতে দেবে না বলেছিল। কিন্তু ১৪৭ সিটের নির্বাচনও ঠেকাতে পারেনি। সেই নির্বাচন বর্জনের খেসারত বিএনপি এখনো দিয়ে যাচ্ছে। সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ায় ভুল সিদ্ধান্তের পর আবারও তারা ভুল করে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসের ব্যর্থ অবরোধ কর্মসূচি পালনের মধ্যদিয়ে। ওই তিন মাসের সব তাণ্ডবের দায় এখন বিএনপির কাঁধে।

হাজার হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে লক্ষাধিক মামলা। অনেকে জেলে। পুলিশের মার খেয়ে অনেকে পঙ্গুপ্রায়। দলের অধিকাংশ জেলা কমিটি কার্যত নেই। আহ্বায়ক কমিটি আর সাংগঠনিক কমিটি দিয়ে দায়সারা কাজ চলছে। উপজেলা, থানার অবস্থা আরও খারাপ। দলের নেতৃত্ব ও কমিটি বেচাকেনার পাইকারি হাটে এসে যার যেমন খুশি নেতৃত্ব ও কমিটি বাগিয়ে নেয়। দলের কোনো কর্মসূচি অধিকাংশ জেলা ও থানায় বাস্তবায়িত হয় না। কোথাও কোথাও গ্রুপিং এত প্রকট যে, কেউ কারও মুখ দেখে না, কর্মসূচি পালন করে পৃথকভাবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধেও অভিযোগের অন্ত নেই। বেগম জিয়ার ঘোষিত কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়ে কেউ সে দায়িত্ব পালন করেননি, পথে নামেননি, পালিয়ে বেড়িয়েছেন। কারও বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও আছে যে, সরকারি দলের প্রভাবশালী কোনো বন্ধুর বাড়িতে ঘুমিয়েছেন। কর্মীমহলেও এসব প্রচার আছে। এমতাবস্থায় এবারও যদি বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে তাহলে বিপর্যস্ত সংগঠন অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যাবে। বিপদগ্রস্ত নেতা-কর্মীরা আর কত ধকল সইবে? তারা বাঁচার জন্য নিরাপদ আশ্রয় খুঁজবে। বিপুল সমর্থক গোষ্ঠীও কতকাল দলের ভুলের জন্য সাফার করবে। মুসলিম লীগেরও একসময় বিপুল সমর্থক ছিল। এমনও বলা হতো মুসলিম লীগের বিরোধিতা করলে বউ তালাক হয়ে যাবে। সেই মুসলিম লীগকে এখন বাতি দিয়েও খুঁজতে হয়। কাজেই তেমন করুণ পরিণতির দিকে দলটি ধাবিত না হোক শুভানুধ্যায়ীরা এখনো তা চায়। ধারণা করা যায় বিএনপি এবার ভুল করবে না।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে? নির্বাচন কমিশন আগামী নির্বাচন সামনে রেখে একটা রোডম্যাপ দিয়েছে। এ নিয়ে প্রধান দুই দলে বাদানুবাদ হচ্ছে— রোড আগে না ম্যাপ আগে? বাংলাদেশে নির্বাচন নতুন হচ্ছে না। দশটি নির্বাচন তো হয়েছে। রোড না থাকলে এতগুলো নির্বাচন হলো কী করে? নতুন রোড করার জন্য আগে ম্যাপ লাগে পরে রোড হয়। রোড থাকতে সঠিক পথচিহ্ন এঁকে দেওয়ার জন্য নকশা বা ম্যাপ পরেই হয়। এক্ষেত্রে ম্যাপ পরে। আবার রোডে সঠিক নির্দেশনায় গন্তব্যে পৌঁছার জন্যই তো ম্যাপ বা নকশা আঁকা হয়। নতুন কোনো রোড তৈরির তো কোনো প্রয়োজন নেই। রোড তো আছেই। আসলে এসব অহেতুক বিতর্ক। নির্বাচনের আগে এমন অনেক বিতর্কেরই হেতু খুঁজে পাওয়া যাবে না। আসলে এসব পথনকশা নির্বাচনের মূল কোনো বিষয় নয়। মূল বিষয় একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে নিবিড় বোঝাপড়া বা রাজনৈতিক সমঝোতা। অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে মূল বাধা দুটি— ১. নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থ ও ২. সবার জন্য সমান সুযোগের ব্যবস্থা। প্রথম বাধা অপসারণ হলে অন্য কোনো বাধাই বড় হয়ে দেখা দেবে না। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টার ও নেতা-নেত্রীরা অনড় অবস্থানে থাকলেও তা পরিবর্তন হতে পারে না তা নয়। তারা সংবিধানের কথা বলছেন, বলছেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। গণতান্ত্রিক দুনিয়ার এটাই নিয়ম। কিন্তু আমাদের দেশের পরিস্থিতি সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুসারী দেশের উদাহরণ দিয়ে লাভ নেই। নির্বাচনে সীমাহীন কারচুপি, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সরকারি ও কমিশন কর্মকর্তাদের ভোট জালিয়াতিতে অংশগ্রহণ, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ভোটকেন্দ্র দখল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষপাতিত্ব ও আরও নানা অনিয়ম কালো টাকার ও পেশিশক্তির ব্যবহার আমাদের দেশের মতো মাত্রাতিরিক্ত কোথাও নেই। তাই নির্বাচনকালীন একটি সর্বজনগ্রাহ্য সরকার জরুরি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই প্রতিনিধিমূলক একটি স্বল্পকালীন সরকার হতে পারে। সংবিধানের বাইরে যেতে হলে সংসদে এখনই সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। আবার সমঝোতার মাধ্যমেও তেমন একটি সরকার গঠিত হতে পারে যা নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশনে সবাই মিলে অনুমোদন করে দেবেন। এটা নব্বইর ঐতিহাসিক নির্বাচনে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন নির্দলীয় সরকার গঠন ও নির্বাচন শেষে তার প্রধান বিচারপতি পদে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে এ ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতা হয়েছিল সময় ও পরিস্থিতির দাবিতে। বিএনপি শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে এসেছে এতদিন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ছেড়ে এখন তারা সহায়ক সরকারের কথা বলছে। বেগম জিয়া লন্ডন থেকে ফিরেই সেই সরকারের রূপরেখা দেবেন বলে বলা হয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে। কী তাতে থাকতে পারে তার একটা আভাস পাওয়া গেছে গত ২১ জুলাই দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, সরকারের ক্ষমতা না কমিয়ে নির্বাচন করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। সমাধানের একটা সূত্র এখানে পাওয়া যায়। এখানে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখেই নির্বাচনকালীন সীমিত ক্ষমতার স্বল্পকালীন একটা সরকার প্রধান বিরোধী দলকে নিয়ে গঠনের ইঙ্গিতময় প্রস্তাব আছে। সেরকম একটি সরকার গঠনের লক্ষ্যে সংসদে সিদ্ধান্ত হতে পারে অথবা আগামী সংসদের প্রথম অধিবেশনে ব্যবস্থাটি অনুমোদন করে দেওয়া হবে বলে লীগ-বিএনপির মধ্যে একটি ‘হোলি’ রাজনৈতিক সমঝোতা হতে পারে একানব্বইর পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের সময়ের মতো। এটা এখনকার সময়-কালের অমোঘ দাবি। উভয়ের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতাটাই আসল। সমঝোতা হয়ে গেলে নির্বাচন কমিশনের সব কর্মসূচিই তরতর করে এগিয়ে যাবে। দুই পক্ষেরই খোলা মন নিয়ে পারস্পরিক ছাড় দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারে মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে। বিএনপিকে বুঝতে হবে ক্ষমতাসীন দল কতটুকু ছাড়তে পারে, আবার সরকারপক্ষকেও বিবেচনা করতে হবে বিএনপির ওপর কতটা চাপ দেওয়া যাবে। উভয়পক্ষ সমস্যাগুলো জানেন, বোঝেন এবং সমাধানের পথও তারা চেনেন। প্রয়োজন পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস। এখন যেসব বাকবিতণ্ডা হচ্ছে তা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্বাচনপূর্ব তৎপরতারই অংশ। অনেক কথাই শোনা যাবে যা অর্থহীন। যেমন অর্থহীন একটি কথা বলেছেন একজন মন্ত্রী।  তিনি গত ২১ জুলাই এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘জেলের ভয়ে বেগম জিয়া লন্ডনে পালিয়েছেন’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন,  ২২.০৭.২০১৭)। বেগম জিয়ার লন্ডন মিশন সরকারি মহলে বেশ আতঙ্ক ছড়িয়েছে বলেই মনে হয়, কেউ কেউ তিনি আর ফিরবেন না বলেও মন্তব্য করেছেন। জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কৌশল ছাড়া এসব আর কিছু নয়। বেগম জিয়া চিকিৎসা, দলের ভবিষ্যৎ কর্ণধারের সঙ্গে রাজনৈতিক-সাংগঠনিক ও মনোনয়ন সংক্রান্ত পরামর্শ ছাড়াও আরেকটা উদ্দেশ্য নিয়ে লন্ডন গেছেন। সে মিশন কূটনৈতিক। সম্ভবত ভারতের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করে আসতে চান তিনি। তারেক রহমান এর কিছুটা এগিয়ে রেখেছেন বলে বিভিন্ন সূত্র বলছে। সরকারের আতঙ্কটা এখানেই বলে মনে হয়। বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র্রের সঙ্গে ভারতও যদি সমমত পোষণ করে তাহলে তা বাংলাদেশে একটি ভালো নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে অবশ্যই সহায়ক হবে। বেগম জিয়া সে কূটনৈতিক চেষ্টা করতেই পারেন। হয়তো এটাই তার লন্ডন সফরের অন্তরালের কথা। তিনি নিশ্চয়ই চাইবেন বাংলাদেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার জন্য এবার যাতে কোনো ‘সুজাতা সিং’ বাংলাদেশে না আসেন। এতে দোষের কী আছে? ভারতের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ও ঐতিহাসিক। তাদের এতে ভয় পাওয়ার কী আছে?

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর