রবিবার, ২৩ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

হালাল রুজির উপকারিতা

মুফতি মাওলানা মুহাম্মদ এহছানুল হক মুজাদ্দেদী

শ্রমার্জিত হালাল রুজি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য যেমন উপকারী তেমনি এতে তার মন-মানসিকতা ও চরিত্রও হয় উন্নত। সে হয় কর্তব্যপরায়ণ ও দায়িত্বশীল। তার  হৃদয় হয় উদার এবং বাহ্যিক আচার-আচরণ হয় মার্জিত ও প্রশংসিত সে হয়। হিতাকাঙ্ক্ষী ও পরোপকারী। পক্ষান্তরে অবৈধ উপায়ে রুজি করে তার স্বাস্থ্য, মন-মানসিকতা ও চরিত্র সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যায়। হালাল রুজির অধিকারী ব্যক্তির উন্নত ও প্রশংসনীয় চরিত্র দ্বারা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আয় উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এতে সমাজ ও রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। বিপরীতে হারাম রুজি বা অবৈধ পন্থায় রুজি রোজগার সমাজ ও রাষ্ট্রের অকল্পনীয় ক্ষতি হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায় সমাজ ও রাষ্ট্র।

ব্যক্তি ও সমাজের জন্য হালাল রুজি যেমন উপকারী ও কল্যাণকর তেমনি ইবাদত বন্দেগি, দোয়া প্রার্থনার জন্যও হালাল রুজি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইবাদত বন্দেগি আল্লাহতায়ালার কাছে গ্রহণীয় হওয়ার জন্য হালাল উপার্জন করা অবশ্য কর্তব্য। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন— ‘হে রসুল বা মুমিনগণ! তোমরা হালাল রিজিক গ্রহণ করা এবং নেক আমল কর।’ এ আয়াতের মধ্যে দুটো কথা বলা হয়েছে। একটা হলো হালাল রিজিক গ্রহণ করা। দ্বিতীয় হলো নেক আমল করা তথা ইবাদত করা। এখানে প্রথমে হালাল রুজি গ্রহণের কথা বলা হয়েছে, তারপর ইবাদতের কথা বলা হয়েছে। মুফাসসিরিনে কেরাম বলেছেন, এই আয়াতে প্রথমে হালাল রুজির কথা, তারপর নেক আমল বা ইবাদতের কথা বলে বোঝানো হয়েছে যে, ইবাদত বা নেক আমল কবুল হওয়ার জন্য হালাল রুজি শত শত আগে থাকে, তাই হালাল রুজির কথা আগে বলে বোঝানো হয়েছে, এটা হলো শর্ত। হালাল রিজিক বা রুজি এত মৌলিক বিষয় যে, এক হাদিসে রুজি হালাল না হলে জান্নাতে যাওয়া যাবে না এমন কঠোর কথাও বলা হয়েছে। রসুল (সা.) বলেন, ‘হারাম রিজিক দ্বারা লালিত-পালিত দেহ জান্নাতে যেতে পারবে না। হালাল রিজিক যেহেতু ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য একটা শর্ত অতএব হারাম রিজিক গ্রহণ করলে ইবাদত কবুল হবে না আর ইবাদত কবুল না হলে কীভাবে জান্নাতে যাওয়া যাবে।

হারাম রুজির আরও অনেক রকম ক্ষতি আছে। হারাম রিজিক গ্রহণ করলে ইবাদত তো কবুল হবেই না এমনকি ইবাদত বন্দেগি করার জজবা বা আগ্রহও সৃষ্টি হয় না। আমরা মুসলমান হিসেবে বুঝিয়ে, ইবাদত করা দরকার জীবনের সব ক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালার হুকুম মান দরকার। কিন্তু মানার জজবা আমাদের মধ্যে আসে না। এটা হয় রিজিক হারাম হওয়ার কারণে। এর বিপরীতে হালাল রিজিক গ্রহণ করলে ইবাদতের জজবা পয়দা হয়। ইবাদত করতে ভালো লাগে আর হারাম রিজিক দ্বারা দিল শক্ত হয়ে যায় কলব গাফেল হয়ে যায়। ইবাদতে মন বসে না। ইবাদত করতে ভালো লাগে না। কলবে নূর পয়দা হয় না। আখিরাতের দিলে মন রুজু হয় না। হারাম উপার্জন দ্বারা মানুষের কলব অন্ধকার হয়ে যায়। আর কলব অন্ধকার হয়ে গেলে দ্বীনের কথা বুঝে আসে না। সহিহ ইলম আসে না। আমরা অনেক সময় দ্বীনের কথা শুনি, কিন্তু মনে ধরে না। যুক্তিতে আসে না বিবেচনায় ধরে না, মনের অস্পতা কাটে না। এটাই যে, সঠিক কথা এবং ভালো কথা মনের ভিতরে এরকম পরিষ্কার ধারণা আসে না। এটা হয় হারাম রিজিকের কারণে। হালাল রিজিক গ্রহণ করা হলে, দীনের কথা শুনলে ভালো বুঝে আসবে, কলবে নূর পয়দা হবে, যার ফলে যা শুনব মনের ভিতরে তা পরিষ্কার হয়ে উঠবে। দিলের মধ্যে ইতমিনান এসে যাবে যে, এটাই সঠিক এটাই যথার্থ। এরকম দিলের ইতমিনান নিয়ে ইবাদত করলে ইবাদত মজা লাগবে। কলবে আল্লাহর এশক মারেফাত পয়দা মজা হবে। এভাবে হালাল রিজিকের অনেক ভালো প্রভাব আর হারাম রিজিকের অনেক খারাপ প্রভাব রয়েছে।

প্রতিটা খাদ্য খাবারে আসর আছে। কিছু আসর হয় দেহের ক্ষেত্রে। যেমন এক এক ধরনের খাদ্য খাবারে দেহের এক এক ধরনের উপকার হয়। এমনিভাবে খাদ্যের ভিতরে রুহানি প্রভাবও রয়েছে। এক এক খাদ্য খেলে রুহের ভিতরে এক এক রকমের আসর হয়। শরিয়তে যত খাদ্য খাবার হারাম করা হয়েছে তা এ কারণে হারাম করা হয়েছে যে, সেগুলো গ্রহণ করলে মানুষের আত্মার ভিতরে খারাপ প্রভাব পড়বে। তাদের চরিত্রের ভিতরে খারাপ প্রভাব পড়বে। ইসলাম যেসব খাদ্য খাবার হারাম করেছে যেমন শূকরকে হারাম করেছে। এই শূকরের গোস্ত খেলে মানুষের দৈহিক-আত্মিক নানা ধরনের রোগ-ব্যাধি দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরাও এটা স্বীকার করেছে। শূকর নির্লজ্জ প্রাণী, তাই যারা শূকরের গোস্ত খায় তারাও নির্লজ্জ হয়ে যায়। শূকর ভোজীরা এমনই নির্লজ্জ হয় যে, বিশেষ প্রাণী (কুকুর) রাস্তাঘাটে মানুষের সামনে তাদের যৌনাচার যেমন লিপ্ত হয় ঠিক তেমনই এই শূকরভোজীরাও মহিলাদের সঙ্গে বেশরম, নির্লজ্জ ও বেহায়ার মতো কাম চরিতার্থ করে। এতে তাদের শরম হয় না। এভাবে যতগুলোর ভিতরে কোনো না কোনো স্বভাবগত খারাপ আসর রয়েছে।

যে সমস্ত রিজিক মানুষ হারাম পদ্ধতিতে উপার্জন করে, যেমন সুদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষের মাধ্যমে উপার্জন করে এখানে তো শুরু থেকেই মানুষের স্বভাবই খারাবি এসে যায়। একজন মানুষকে বেকায়দায় ফেলে বা তার অসহায়ত্বকে পুঁজি করেই সুদ-ঘুষ নেওয়া হয়। একান্ত ঠেকায় পড়েই এগুলো দেয়। তাই তখনই সুদ-ঘুষ গ্রহণকারীর অন্তর থেকে সহানুভূতি সমবেদনা দূর হয়ে যায়। এভাবে যত উপার্জনগত হারাম পদ্ধতি রয়েছে সবটার ক্ষেত্রেই শুরু থেকে মানুষের স্বভাব খারাপ হয়ে যায়। শুরু থেকেই স্বভাবে খারাপ প্রভাব এসে যায়। যেমন—মানুষের প্রতি অবিচারের মনোভাব মানুষের প্রতি জুলুমের মনোভাব, নির্দয়তার মনোভাব ইত্যাদি খারাবি এসে যায়। এভাবে শরিয়ত যত জিনিসকে হারাম করেছে তার ভিতরে চরম খারাবি রয়ে গেছে। আমাদের বুঝে আসুক বা না আসুক। বুঝে না আসলেও আমাদের মানতে হবে। যা হোক যা বলা হচ্ছিল যে, হারাম রিজিক গ্রহণ করলে ইবাদত কবুল হয় না। হালাল রিজিক গ্রহণ করা ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য পূর্ব শর্ত।

লেখক : পেশ ইমাম, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর