মঙ্গলবার, ২৫ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

প্রণব মুখার্জির রাজসিক বিদায়

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

প্রণব মুখার্জির রাজসিক বিদায়

গত পরশু লেখা শেষ করে ফেলেছিলাম, ‘একজন ইউএনও নিয়ে এত মাতামাতি কেন?’ কিন্তু গত রাতে যখন ভারতের বিদায়ী রাষ্ট্রপতি প্রণবদার সঙ্গে কথা হলো, তখন মনে হলো কাকতালীয়ভাবে তার বিদায়ের দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনে আমার লেখা যখন পড়েছে তখন তাকে নিয়ে দু কলম লিখি। ভারতের একজন স্বনামধন্য সাংবাদিক গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের খোলা কলামে ‘গুডবাই প্রণব মুখার্জি’ লিখতে গিয়ে লিখেছেন, ‘আগামীকাল ২৫ জুলাই শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, বাংলাদেশ এবং গোটা বিশ্বে বসবাসকারী বাঙালিদের কাছে এক বেদনার দিন হিসেবে দেখা দিতে চলেছে। ঠিক পাঁচ বছর আগে এই জুলাই মাসের ২৫ তারিখ বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি দায়িত্বভার নিয়েছিলেন। এই দায়িত্ব নেওয়ায় গোটা বিশ্বের বাঙালি সেদিন গর্বিত হয়েছিল। বাঙালি গর্বিত বলে স্লোগানও দিয়েছিল তারা।’ এ ক্ষেত্রে আমার প্রিয় লেখক সুখরঞ্জন দাশগুপ্তের সঙ্গে একমত হতে পারলাম না। বরং পাঁচ বছর আগে আমরা যারা আনন্দিত হয়েছিলাম অমন ত্রিশঙ্কু অবস্থার মধ্যেও সফলভাবে দায়িত্বভার পালন করে পরম সফলতার সঙ্গে বিদায় নেওয়ায় আমরা আজ মহা আনন্দিত। বাঘের পিঠে চড়া যত কঠিন, পিঠ থেকে নামা তার চেয়েও কঠিন। সেই কঠিন কাজটি শ্রী প্রণব মুখার্জি সফলতার সঙ্গে করছেন। সেজন্য তার রাষ্ট্রপতি হওয়ায় আমরা যতটা আনন্দিত হয়েছিলাম, একজন বাঙালি সফলভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করে অবসরে যাওয়ায় তার চেয়ে লাখো-কোটি গুণ বেশি আনন্দিত ও গর্বিত। এর আগে কোনো বাঙালি দিল্লির অত উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হননি। আগামীতে কেউ হবেন কিনা জানি না। সাত-আট বছর যাবৎ প্রতি মঙ্গলবার বাংলাদেশ প্রতিদিনে লিখি। আমার জীবনের অনেক ঘটনা মঙ্গলবারের পর্বে আসে। ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জির বিদায় দিনও আমার পর্ব পড়েছে। শ্রী প্রণব মুখার্জির সঙ্গে কত কথা, কত স্মৃতি। তাই এ পর্ব তাকে নিয়েই লিখছি।

অনেকের ধারণা শ্রী প্রণব মুখার্জিকে আমি বহু আগে থেকেই চিনি। কিন্তু তা সত্য নয়। বঙ্গবন্ধু থাকতে শ্রী প্রণব মুখার্জির সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় ছিল না। পরিচিত ছিলাম শ্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের সঙ্গে, বিখ্যাত আইনবিদ অশোকবাবুর সঙ্গে, একসময় ভারতের সব থেকে জনপ্রিয় যুবনেতা প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী, সুব্রত মুখার্জি, সোমেন মিত্র, নুরুল ইসলামসহ আরও অনেক উঠতি নেতার সঙ্গে। স্বাধীনতার পরপর এপ্রিলে পশ্চিমবঙ্গ গিয়েছিলাম। মেঘালয়ের তুরা, আসামের ধুবড়ি, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, মালদা, মুর্শিদাবাদ, আলীপুর দুয়ার হয়ে প্রায় এক শ কয়েকজন কলকাতায় গিয়েছিলাম। সেবার ভারত-বাংলা মৈত্রী সমিতির পক্ষ থেকে আমাকে সংবর্ধনা জানিয়েছিলেন কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি নেত্রকোনার গৌরব শঙ্কর প্রসাদ মিত্র আর যার কণ্ঠ মুক্তিযুদ্ধে আমাদের আলোড়িত করেছে, কামানের সামনে ধাবিত করেছে সেই দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তারা দুজন পাশাপাশি যখন ষাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করেছিলেন আমি অন্য জগতে চলে গিয়েছিলাম। কারণ এর আগে কখনো ষাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম পাইনি। ভারত নিয়ে নানাজন যখন নানা কথা বলেন তখন ভারতের এই অভাবনীয় জিনিসগুলো আমায় বড় তাড়িত, আলোড়িত করে। এরপর গিয়েছিলাম দিল্লিতে বঙ্গবন্ধুর চিঠি নিয়ে। ইন্দিরাজির সঙ্গে আমার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বঙ্গভবনে দেখা হয়েছে। ভারতে সেটাই প্রথম দেখা। অ্যাম্বাসির এক লাল গাড়িতে গিয়েছিলাম। ১ নম্বর সফদর জং রোডের বাড়ির বারান্দায় তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন। খাদ্য সংকটের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর চিঠি পড়ে বলেছিলেন, ‘তুমি সংসদে এসো।’ সেদিন তিনি গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলেন। এর চার-পাঁচ বছর পর তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না, তখন আমরা খুব কাছাকাছি ছিলাম। মায়ের মতো স্নেহ-যত্ন করে খাওয়াতেন। তেমনি এক পরিবেশে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমার মতো ছোট্ট একটা ছেলেকে প্রথম দেখায় গাড়ি থেকে নিয়ে এবং গাড়ি পর্যন্ত বিদায় দিয়েছিলেন কেন? খুব সহজভাবে হাসতে হাসতে ইন্দিরাজি বলেছিলেন, ‘টাইগার! ভারতে তুমি তো তোমার অবস্থান জানো না। তোমার মর্যাদা এখানে অনেক ওপরে।’

সেদিন সংসদে গিয়েও অভিভূত হয়েছিলাম। দর্শক গ্যালারির প্রথম সিট ছিল আমার জন্য। মহারাষ্ট্রের একসময়কার মুখ্যমন্ত্রী তখনকার লোকসভার সদস্য ভারতের কাছে বঙ্গবন্ধুর খাদ্য চাওয়ার চিঠি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এই অল্প দিন আগে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছি, তাদের সঙ্গে আমরা রক্ত দিয়েছি। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে লিখেছেন তাদের খাদ্যের অভাব। আমরা যদি এক বেলা খাই বাংলাদেশের বীর জনতা এক বেলা খাবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি নিঃসংকোচে বাংলাদেশের জন্য খাদ্য বরাদ্দ করুন। আমরা সবাই আপনার সিদ্ধান্ত সানন্দে গ্রহণ করব।’ এর বেশি পরের কথা নয়, কত আর হবে দু বছর। ঘাতকের হাতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হন। তার প্রতিবাদে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। কীভাবে কীভাবে আগস্টের ২৭-২৮ তারিখ আমাকে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হয়। তখন রাত ২টারও বেশি। আমি ঘরে ঢুকতেই আমার পিঠে এবং মাথায় হাত বুলিয়ে ইন্দিরাজি বলেছিলেন, ‘তুমি বেঁচে আছো আমরা খুশি। বঙ্গবন্ধুর হত্যা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। তোমাদের সম্মান রক্ষা করে যেভাবে যতটা সম্ভব আমরা সহযোগিতা করব।’ বাংলাদেশের মাটিতেই ছিলাম প্রায় দু বছর। এরপর ’৭৭-এ ভারতে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে। ব্রিটিশ চলে যাওয়ার পর সেই প্রথম কংগ্রেসের পতন, নতুন গঠিত জনতা পার্টির উত্থান। আমেথিতে রাজনারায়ণের কাছে হেরে যান ইন্দিরাজি। মোরারজি দেশাই হন প্রধানমন্ত্রী। তখন কংগ্রেসের চরম দুর্দিন। আমরা যারা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ সংগ্রামী ছিলাম আমাদেরও দুর্দিন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও দুর্দিন। ওই সময় ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতা একসময় নেতাজি সুভাষ বোসের ব্যক্তিগত সহকারী শ্রী সমর গুহ এমপির সহযোগিতায় সর্বোদয় নেতা শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের কাছে যাই। শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ আমাদের কথায় মুগ্ধ হন। তিনি তার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। জনতা পার্টির সভাপতি চন্দ্র শেখরসহ অনেকের কাছে ব্যক্তিগত চিঠি দেন। দিল্লিতে থাকার ব্যবস্থা করেন। যে কারণে চরম ক্ষুব্ধ হয়েও মোরারজি দেশাই আমাদের তেমন ক্ষতি করতে পারেননি। চলে যায় আরও কয়েক বছর। ইন্দিরাজির কাছে একটা চিঠি দিয়ে একসময় বাসসের প্রধান জাওয়াদুল করিমকে দিল্লিতে পাঠাই। আমি পাঠিয়েছি শুনে তাকে ভীষণ গুরুত্ব দেন। চিঠি খুলে পড়তে গিয়ে দেখেন বাংলায় লেখা তাও আবার হাতে। ইন্দিরাজি বলেছিলেন, ‘আমি ছাপার বাংলা পড়তে পারি, হাতের লেখা নয়।’ জাওয়াদুল করিমকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি টাইগারের কতটা বিশ্বস্ত?’ জনাব জাওয়াদুল করিম প্রবীণ এবং ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন। তিনি বলেন, যতটা হলে চলে তার চেয়ে মোটেই কম নই। তখন তাকেই চিঠিটা পড়তে বলেন। চিঠির বয়ান শুনে তিনি খুবই মর্মাহত হন। আমাদের অসুবিধার কথায় তার চোখে পানি আসে। তিনি তখনই প্রণবদাকে ডেকে পাঠান, সব সময় যোগাযোগ রাখতে বলেন। তারও ছয়-সাত মাস পর দিল্লির রামমনোহর লহিয়া হাসপাতালের এক ডাক্তারের বাড়িতে প্রণবদার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। তিনি যেমন আমার নাম জানতেন, আমিও তাকে জানতাম, তার কার্যকলাপ জানতাম। তাই প্রথম কথাবার্তা বেশ ফলপ্রসূ হয়। এরপর যোগাযোগ ছিল নিরন্তর। মাঝে-সাঝে প্রণবদা জিজ্ঞাসা করতেন, ‘আমাদের সঙ্গে যোগাযোগে তোমার কোনো ক্ষতি হবে না তো?’ শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ, চন্দ্র শেখর, মধু লিমাই, অশোক দণ্ডপাত, সুরেন্দ্র মোহন, বিজু পট্টনায়েক, জর্জ ফার্নান্ডেজসহ আরও অনেক নেতার সঙ্গে চলাফেরা এবং তাদের মনোভাবে আমার কখনো মনে হয়নি ইন্দিরাজির সঙ্গে যোগাযোগে আমার তেমন অসুবিধা হবে। সরকার আমাদের কোনো সাহায্য করবে না, তখন অন্য কারও সঙ্গে যোগাযোগ হলে কীইবা ক্ষতি হতে পারে।

ইদানীং ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রণবদাকে নিয়ে অনেক অতিরঞ্জিত বলা হয়। যারা একসময় তাকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই গালাগাল করতেন তারাও তার প্রশংসা করেন। আমি একেবারে দলিল-দস্তাবেজ হাজির করে বলতে পারি, জার্মানি থেকে জননেত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি আসার খবর শ্রীমতি ইন্দিরাজি ছাড়া ‘র’-এর বাইরে আর কেউ জানত না, প্রণবদাও না। ’৭৮-এর কোনো একসময় প্রণবদার স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জি গীতা একদিন আমায় বলেছিলেন, ‘বাঘা! শুনছি বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা দিল্লিতেই আছে। তুমি জানলে যোগাযোগ করে দাও না।’ ব্যাপারটা আমার জানা ছিল। দিল্লিতে গেলে জননেত্রীর বাড়িতে নিয়মিত যেতাম। আমার গাড়িতেই একদিন ছেলেমেয়েসহ জননেত্রী শেখ হাসিনাকে ৭ নম্বর তালকাটরা রোডে নিয়ে গিয়েছিলাম। ’৮০ সালে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত প্রণবদার সঙ্গে জননেত্রী শেখ হাসিনার তার বাড়িতে সাধারণ আলোচনা হয়েছে, সরকারিভাবে নয়। জনতা সরকারের আমলে প্রণবদার যেমন অসুবিধা ছিল, তেমনি জননেত্রীরও অসুবিধা ছিল। সেতুবন্ধ হিসেবে জয়প্রকাশজির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ না থাকলে, তিনি আমাদের সাড়া না দিলে মোরারজি সরকার আমাদের মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিত। তেমন করতে পারেননি শুধু জয়প্রকাশ নারায়ণ এবং অন্য নেতাদের কারণে।

’৭৭-’৮০ নানা মত নানা পথের মানুষ নিয়ে জয়প্রকাশ নারায়ণের পরম জনপ্রিয়তা এবং নিষ্ঠার কারণে কংগ্রেসবিরোধী এক বলয় গড়ে ওঠে। সঞ্জয় গান্ধীর নাশ মন্দির মানে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ভারতের মানুষ প্রত্যাখ্যান করে। সেখানে লহিয়াপন্থি জয়প্রকাশ নারায়ণ সবাইকে একত্র করে ’৭৭-এ কংগ্রেসের ভরাডুবি ঘটান। কিন্তু স্বার্থদ্বন্দ্ব জনতা সরকারকে বেশিদিন টিকতে দেয়নি। চরণ সিং ও হরিজন নেতা জাগজীবন রামের মধ্যে দ্বন্দ্ব এত তীব্র হয় যে, মোরারজি দেশাই পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। প্রধানমন্ত্রী হন জাঠ নেতা চরণ সিং। সঞ্জয় গান্ধী তার সঙ্গে যথার্থই রাজনীতি করতে সক্ষম হন। রাষ্ট্রপতি নিলম সঞ্জীব রেড্ডি চরণ সিংকে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখাতে বললে তিনি মধ্যবর্তী নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে সংসদ ভেঙে দেন। ’৮০ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মধ্যবর্তী নির্বাচন হয়। কংগ্রেস নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে পড়ে। ইন্দিরাজির সঙ্গে তখন তেমন কোনো বড় নেতা ছিল না। রাজীব গান্ধী তখনো পাইলট, সঞ্জয় কংগ্রেসের ভরসা, ইন্দিরাজি তখন বিহারের পাটনায় গান্ধী ময়দানে ভারতের ইতিহাসে সব থেকে বড় সভা করেন ৩০-৪০ লাখ লোকের। ইন্দিরাজি মুক্তকণ্ঠে বলেন, ‘ভাই ও বেহেনো গলতি হোগেয়া, মাফি মানতাহু, মাফ করদো।’ ৪০ লাখ লোকের জনসভা থেকে ইন্দিরাজি গেলেন সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের কদমকুয়ার বাড়িতে। গেটে দেড় ঘণ্টা গাড়িতে বসে থাকলেন, গেট খোলা হলো না। জয়প্রকাশ নারায়ণের দেখা পেলেন না। কারণ তখন চরম ইন্দিরাবিরোধী কর্পুরী ঠাকুর বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। এরও মাস দুই পর ’৭৯-এর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ইন্দিরাজি আমায় ডেকে পাঠালেন তার উইলিংডন স্কয়ারের বাড়িতে। নিজে হাতে বেড়ে খাওয়ালেন। শেষে বললেন, ‘টাইগার! জয়প্রকাশজি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসেন। একটু খোঁজ করো এই নির্বাচনী প্রচারে জনতা পার্টির পক্ষে তিনি নামবেন কিনা। তিনি না নামলে আমরা সাড়ে তিন শ সিট নিয়ে সরকার গঠন করব। তুমি একটু তার কাছে গিয়ে জেনে আসো তার মনোভাব কী।’ গেলাম জয়প্রকাশজির কাছে। আমি কখনো কোনো কথা লুকোচুরি করার চেষ্টা করতাম না, এখনো করি না। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু আর হুজুর মওলানা ভাসানীর সঙ্গে অবলীলায় চলেছি। কেউ কোনো দিন প্রশ্ন করেননি, তুই বা তুমি কার? জয়প্রকাশজির কাছে গিয়ে বলেছিলাম, ইন্দিরাজি আমাকে ডেকেছিলেন। সামনে নির্বাচনে আপনি সরাসরি জনতা পার্টির হয়ে শরিক হবেন কিনা? আপনি শরিক না হলে তিনি সরকার গঠন করবেন বলে আশা করেন। সত্যিই জয়প্রকাশজি আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন, আদর করতেন। শুনেছি, বিদেশি নেতা নেপালের প্রধানমন্ত্রী ভি বি কৈরালা ও তার ছোট ভাই জে বি কৈরালার সঙ্গে খাবার খেতেন। যেটা পরে একমাত্র আমাকে নিয়ে হয়েছে। যতবার তার কাছে গেছি দু বেলা খাবার খাইয়েছেন, পারলে কখনো-সখনো সকালের নাস্তায়ও ডাকতেন। তিনি কী দেখেছিলেন আমার মধ্যে তা তিনিই জানেন, আমি জানি না।

আমার কথা শুনে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বুঝি ইন্দিরার সরকার হলে তোমার ভালো হয়। তুমি গিয়ে ওকে বলো আমার শরীর ভালো না। এ নির্বাচনে আমি বাইরে যাব না।’ ইন্দিরাজির মা কমলা নেহরু আর জয়প্রকাশজির বাঙালি স্ত্রী দুজন খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। একই সঙ্গে আন্দোলন করেছেন। পাটনা থেকে দিল্লি গিয়ে ইন্দিরাজিকে শুভ সংবাদ দিয়েছিলাম। তিনি যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন। সেখানেই বলেছিলেন, ‘প্রণবের সঙ্গে সাক্ষাতের একটা ব্যবস্থা করতে পারবে না?’ তাও পেরেছিলাম। সে নির্বাচনে ভারতের রাজনৈতিক চিত্রপট বদলে গিয়েছিল। ৩৭০ আসন নিয়ে কংগ্রেস সরকার গঠন করেছিল। কংগ্রেস ক্ষমতায় এলো, কিন্তু হঠাৎই ছোট্ট এক বিমান চালাতে গিয়ে সঞ্জয় গান্ধী মারা গেল। যখন সঞ্জয় মারা যায় তখন আমি দিল্লিতে। বিকালেই গিয়েছিলাম সফদর জং রোডে। ইন্দিরাজিকে পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি। সেদিনই প্রথম কান্না সামলাতে পারছিলাম না। তিনি বার বার আমার মাথা এবং কাঁধে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন।

প্রণবদা প্রসঙ্গে এবার আসি। ’৭৮ থেকে প্রণবদা আমাদের পারিবারিক মানুষ হয়ে যান, যা এখনো আছেন। গতকাল ছিল তার রাষ্ট্রপতি হিসেবে শেষ দিন। রাতে টেলিফোনে কথা বলেছিলাম সেই একই মানুষ, একই ভাব। কোনো আকার-বিকার নেই। প্রণবদা দিল্লিতে বেশি সময় ৭ ও ১৩ নম্বর তালকাটরা রোডে বাস করেছেন। কমার্স মিনিস্টার হিসেবে কিছু সময় যন্তরমন্তর রোডে ছিলেন। তার পাশের বাড়ি ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির। সেই বাড়িতেই জীবনের প্রথম আমার দাদু আলাউদ্দিন সিদ্দিকীর ছবি দেখেছিলাম। দেয়ালে টাঙানো মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে অটল বিহারি বাজপেয়ির বাবা এবং আমার দাদু আরও কিছু নেতার সঙ্গে কোলবালিশ ঠেস দিয়ে বসে আলাপ করছিলেন। ক্যাপশনে ছিল ‘আলাউদ্দিন সিদ্দিকী অব বেঙ্গল’। তাই দাদুকে খুঁজে পেয়েছিলাম। মহান রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার বিদায়ে কোনো বেদনা নয়, অপার আনন্দ অনুভব করছি।

লেখক : রাজনীতিক।

সর্বশেষ খবর