মঙ্গলবার, ২৫ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

গরুবিষয়ক রচনা এবং নানা প্রসঙ্গ

মাকিদ হায়দার


গরুবিষয়ক রচনা এবং নানা প্রসঙ্গ

পৃথিবীতে সবকিছু আছে। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-তারা থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। দ্বিপদ, চতুষ্পদ জন্তু থেকে শুরু করে পানির জাহাজ, উড়োজাহাজ। পূজা-পার্বণ, ঈদ-মহররম এবং আমাদের প্রাইমারি-হাইস্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় তখনো ছিল, এখনো আছে। তখন ছিলেন টিকিধারী ক্ষিতিশ পণ্ডিত, ছিলেন মহিউদ্দিন আহমদ। একজন আমাদের সংস্কৃত পড়াতেন, অন্যজন পড়াতেন আরবি। তবে পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ শ্রেণিতে যেসব সম্মানিত শিক্ষক ষাণ্মাসিক কিংবা বাৎসরিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করতেন, তারা নিচের ক্লাসে না পড়ালেও হেড মাস্টারের নির্দেশেই হয়তো কোমলমতি ছেলেমেয়েদের জন্য ষাণ্মাসিক এবং বাৎসরিক পরীক্ষার জন্য কয়েকটি রচনার যে কোনো একটি লিখতে দিতেন বাংলায়, যেমন  নৌকাভ্রমণ, একটি গ্রামের বর্ণনা অথবা গরুর রচনা।

আমার বিশ্বাস, একদা আমরা যারা স্কুলে পড়েছি তাদের অবশ্যই ওই তিনটির একটিকে নিয়ে রচনা লিখতে হয়েছে। তবে নৌকাভ্রমণ কিংবা গ্রামের বর্ণনার চেয়ে গরুর রচনা লেখা সবচেয়ে সহজ, তা না বলাই ভালো। কারণ আমরা যারা পল্লীগ্রামের ছেলে তাদের বাড়িতে হয়তো গোয়ালঘর, দু-একটি বলদ, দু-একটি গাভী এবং বাছুর থাকা অসম্ভব কিছু নয়। তাই গরু নিয়ে রচনা যে কেউই লিখতে পারত। যারা শহরে বাস করত তাদের পক্ষে একটু অসুবিধা হতো। আমার সহপাঠী পাবনা সদর হাসপাতালের প্রধান ডাক্তার আনিসুল হকের ছেলে সাইফুল হক— সে আগে দু-একটি গরু দেখেছে তবে খুব কাছে থেকে নয়। সাইফুলের দাদার বাড়ি ঢাকা শহরের চকবাজারে। তাই তার ভাগ্যে ভালো করে গরুর সংস্পর্শে যাওয়া হয়নি। সে শুধু জানে গরুর মাংস দিয়ে কাবাব হয়। তবু সে গরুবিষয়ক রচনা লিখতে পেরেছিল। ‘গরু একটি গৃহপালিত চার পা-ওয়ালা পশু। গরুর দুটি বাঁকানো শিং আছে। গরুর  চোখ বেশ বড় বড় হয়। গরুর চামড়া দিয়ে জুতা হয় এবং প্যান্টের বেল্ট তৈরি করা হয়। স্যান্ডেলও হয়, সেই স্যান্ডেল দিয়ে আব্বা আমাকে পিটিয়েছিলেন। গত বছর ফাইনাল পরীক্ষায় ইংরেজিতে যখন মাত্র ২০ পেয়েছিলাম, মার্কশিট হাতে নিয়ে আব্বা তেড়ে এলেন। রেগে গিয়ে মাকে ডেকে বললেন, তোমার ছেলের মাথায় গোবর ভরা, লেখাপড়া কিছুই হবে না। ছোট মামা বললেন, তুই একটি আস্ত গরু। এত ভালো করে মাসের পর মাস ইংরেজি শেখালাম আর সেই তুই— ইংরেজিতেই মাত্র ২০ পেলি, দুলাভাই এবার তোকে গোয়ালঘরে থাকতে দেবে।’ গরুর রচনা লিখতে গিয়ে সেই সহপাঠী আরও লিখেছিল, ‘গরু ঘাস খায়। নিয়মিত সাদা রঙের দুধ দেয়। সেই দুধে মিষ্টি, ছানা, ঘি বানানো হয়, যা আমরা নিয়মিত খাই আমাদের বাসায়।’ সবশেষে লিখেছিল, ‘গরুর গলায় ঘণ্টি বাঁধা থাকে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে ঘণ্টা বাজে। মানুষ বুঝতে পারে গরু আসছে। তাকে রাস্তা ছেড়ে দিতে হবে।’

গরুবিষয়ক রচনায় আমি লিখেছিলাম, ‘গরুর জীবন জাবর কাটার জীবন। ক্রমাগত শুকনো স্বাদবিহীন, ঘাস, খড় চিবোতে চিবোতে দুধ দিতে হয় গরুকে। সাদা ধবধবে। সেই ধবধবে দুধ গরুর ওলান থেকে বের করার আগে শিশু বাছুরটিকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে দূরে সরিয়ে রেখে নিষ্ঠুর গোয়ালা ওলানে শর্ষের তেল মাখিয়ে চকচকে বালতিতে শুভ্র, ধবল, স্বচ্ছ নির্মল দুধ টেনে টেনে বের করে এনে খেতে দেয় মানুষকে। গরু কারণে অকারণে ডাকাডাকি করে, রাখাল গরুর পাল নদীতে গোসল করাতে নিয়ে যায়।’ তবে মজাটা হলো গরু কবি নয়, রাজনীতিবিদ নয়, এমনকি দার্শনিকও নয়, সাধু কিংবা জোচ্চোরও নয়। সে নিছক একটি গরু, গৃহপালিত চতুষ্পদ প্রাণী। তাকে আল্লাহ মাছি তাড়ানোর জন্য একটি লেজ দিয়েছেন, মারামারি করার জন্য দুটো শিং, আর দিয়েছেন শান্ত সহজ-সরল বিষাদ মাখানো দুটি চোখ ও একটি নির্জীব মুখমণ্ডল। আগেই বলেছি, সহজ-সরল গরু রাজনীতিবিদ নয়। আজকাল সেই গরুকে নিয়ে ভারতে চলছে ভীষণরকমের রাজনীতি। এ বছরের জানুয়ারিতে পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরে বিশ্ব বাংলা কবিতা উৎসবে বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত কবিদের মধ্যে আমিও ছিলাম। প্রয়াত কবি তমালিকা শেঠ পাণ্ডে বেঁচে থাকতে পূর্ব মেদিনীপুরের হলদিয়ায় তিনি উভয় বঙ্গের কবিদের নিয়ে আটবার হলদিয়া কবিতা উৎসব করেছিলেন। এ বছর তার অনুপস্থিতিতে তার স্বামী প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ সাবেক এমপি লক্ষণ শেঠের আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম বন্ধু গাজী আজিজুর রহমান, মাহবুব সাদিকসহ আরও অনেকেই। সেই কবিতা পাঠের এক সন্ধ্যায়, ভারত ও বাংলাদেশের রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য, চোরাচালান এবং গরু প্রসঙ্গ এসেছিল। পশ্চিমবঙ্গের এক কবি সহাস্যে জানালেন, ‘ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের চাইতেও অনেক বেশি সুরক্ষিত ভারতের গরু।’ ইতিমধ্যে বিজেপি সরকার মুসলিমদের দু-এক জনকে হত্যা করেছে গরুর মাংস খাওয়ার দায়ে। যেহেতু গরু হিন্দুদের গো-মাতা, কোনো অবস্থাতেই হত্যা করা যাবে না। উপরন্তু গরুর দুধ হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে চলে এলো বর্ডার প্রসঙ্গ। এমনকি কাঁটাতারে ঝুলে থাকা ফেলানি হত্যা।

ভারতবর্ষ বিশাল দেশ। অতি সম্প্রতি গরু নিয়ে অনেক উল্টাপাল্টা খবরও হলদিয়ায় বসেই শুনলাম। অনেক রাজ্যে ধরপাকড়, মারধর, হুমকি, মৃত্যু, অশান্তি লেগেই আছে। যেহেতু দেশটি আমার বাংলাদেশের চেয়ে ২২-২৩ গুণ বড়, কথক শুধু জানালেন সব খবর তো পূর্ব মেদিনীপুর পর্যন্ত পৌঁছে না। কলকাতার কফি হাউসে আড্ডা দিতে গিয়ে শুনলাম এক মজার কাহিনী। ভারতের রাজস্থান রাজ্যের সাবেক বিচারপতি মহেশ চন্দ্র শর্মা, তিনি চেয়ারে যখন ছিলেন তখন একটি রায়ে গরুকেই জাতীয় পশু হিসেবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘোষণা দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন। তিনি কারণও দেখিয়েছিলেন, ‘গরু শুধু গরুই নয়, তিনি গো-মাতা।’

গরুকে নিয়ে চমৎকার একটি লেখা লিখেছিলেন কবি, চিত্রী এবং ছায়াছবির পরিচালক (স্ত্রীর পত্র ছায়াছবি) পূর্ণেন্দু পত্রী। তার কাছে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন অনুজ দাউদ হায়দার ১৯৭৭-৭৮ সালের দিকে। আলাপচারিতায় জানিয়েছিলেন হাস্যোচ্ছলে। ভারতীয়দের সামনে গরু সম্পর্কে বক্তৃতা করছিলেন এক রাজনীতিবিদ, গরু কেন মাতা? তার বক্তব্য ছিল, আমাদের মায়েরা যেহেতু গরুর দুধ খাইয়ে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেন, তাই গরু গো-মাতা। পত্রী মহাশয় আরও জানালেন সেই রাজনীতিবিদকে একজন জিজ্ঞাসা করলেন, হে মান্যবর প্রিয় নেতা! আমরা তো ছাগলের দুধও খাই, মহাত্মা গান্ধী আমাদের জাতির জনক তিনি তো নিয়মিত ছাগলের দুধ খেতেন। নেতা তখনই ব্যাখ্যা দিয়ে জনসভায় জানিয়ে দিলেন, গরুকে তো আর সব জায়গায়, বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলেই বাপুজি, ছাগল সঙ্গে রাখতেন, নিয়মিত সেই ছাগলের দুধও খেতেন, সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে ছাগলও মা হতে পারে এবং ধরা যেতে পারে ছাগল আপন মা নন, সৎ মা।

এখন সৎ মায়ের কথা ভুলে গিয়ে, ভারত সরকার আপন মায়ের সেবায় পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার আশায় বিভিন্ন রাজ্যে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে গো-নিধন। অতি সম্প্রতি কেরালা রাজ্যের খ্রিস্টান ও মুসলমান সম্প্রদায় সরকারের হুকুম অমান্য করায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশঙ্কাও সৃষ্টি হয়। গরু নিয়ে রাজনীতিটা অন্য সব রাজ্যে প্রাধান্য পেলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যে বোধহয় কড়াকড়ি কম। যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সম্প্রদায়ের ভোট তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীর বিশেষ প্রয়োজন আছে সেহেতু তিনি কিছুটা শিথিল। নিকটতম প্রতিবেশী বাংলাদেশকে তিস্তার পানি না দিলেও মাত্র মাসখানেক পরের কোরবানির ঈদে ভারতীয় গরু বাংলাদেশে আসতে দেবেন কিনা জানি না, তবে তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের হয়তো কোরবানির ঈদে গো-মাতা হত্যায় বাধা দেবেন না। কেননা মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, মালদহ ও কলকাতায় মুসলিম সম্প্রদায়ের বসবাস। অন্যদিকে ভারতের অন্যান্য রাজ্যে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে বিজেপি, শিবসেনা, বজরং এরা সবাই মুখিয়ে আছে, কোথাও কোনো মুসলমান গরু নিধন করে কিনা কিংবা ফ্রিজে মহিষের মাংস রাখলেও গরুর মাংস বলে জনগণকে উত্তেজিত করতে পারলেই শুরু করা যাবে সেই গোধরা ও গুজরাটের মতো ভারতের অন্যান্য রাজ্যে, হাজার হাজার মুসলিম নিধনযজ্ঞ। তবে গো-মাতার মাংস যে সুস্বাদু এবং এর কাবাব অতি মধুর, সে কথা ব্রাহ্মণ থেকে নমশূদ্রও স্বীকার করেছেন এবং কলকাতার বিখ্যাত কয়েকটি মুসলিম হোটেলের ভিতরে হোটেল দাওয়াত, আমজাদিয়া, আমিনিয়া এবং সিরাজ হোটেল, ওই সব হোটেলের রুমালা রুটি যেমন বিখ্যাত তেমনি  বিখ্যাত গো-মাতার কাবাব, রেজালা, ভুনা ও গরুর মগজ। কয়েক বছর আগে অনুজ আরিফ হায়দার যখন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলার ছাত্র ছিলেন, তখন একদিন আরিফ তার সহপাঠী-সহপাঠিনীসহ আমাকে নিয়ে হোটেল আমজাদিয়ায় গিয়েছিলেন, সহপাঠী-পাঠিনী বাদে আমরা দুই ভাই ছিলাম মুসলিম। লক্ষ্য করলাম আমার এবং অনুজের চেয়ে অনেক বেশি খেলেন গো-মাতার শিক কাবাব, রেজালা, মাথার মগজ— তবে ওরা সবাই বসেছিল উল্টোমুখে, যেন পরিচিত কেউ চিনতে না পারে ব্রাহ্মণ কায়েতের ছেলেমেয়েরা গো-মাংস ভক্ষণ করছে।

আর চাকরিজীবনে বিসিকের চেয়ারম্যান ছিলেন সিএসপি মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন। তিনি একদিন আমাকে তিরস্কারান্তে ছাগল বলেছিলেন, আমি প্রতিবাদ করে বলেছিলাম, আমাকে স্যার গরু বললে খুশি হব। তিনি ব্যাখ্যা জানতে চাইলে বললাম এক সের গরুর দাম ৪০ টাকা, অথচ ছাগলের এক সের ৭০ টাকা এবং ছাগল সাইজে ছোট। গরু আমার মতো লম্বা। তবে ওর চারটি পা, আমার মাত্র দুটি। সেটা ১৯৮৩ সালের কথা। আজকাল আমার খুব গরু হতে ইচ্ছা করে। যদি হতে পারতাম সামনের কোরবানির ঈদে বিক্রি হতে পারতাম ৪ থেকে ৫ লাখ টাকায়। অথবা ভারতে হলে বিজেপি হয়তো আমাকে নিয়ে রাজনীতি করতে পারত, জানি না আল্লাহ আমার বাসনা পূর্ণ করবেন কিনা।

লেখক : কবি।

সর্বশেষ খবর