মঙ্গলবার, ২৫ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

পিতা-মাতার খিদমতের গুরুত্ব

মুফতি মাওলানা মুহাম্মাদ এহছানুল হক মুজাদ্দেদী

পিতা-মাতার খিদমতের গুরুত্ব

আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ হিসেবে আমাদের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হলো আল্লাহর ইবাদত করা, তার সঙ্গে কাউকে শরিক না করা এবং প্রিয় নবী (সা.)-কে ভালোবাসা ও আনুগত্য করা। এর পরপরই আমাদের করণীয় হলো বাবা-মায়ের প্রতি সুন্দর ব্যবহার করা, তাদের অনুগত থাকা, কোনোভাবেই তাদের মনে কষ্ট না দেওয়া। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সঙ্গে শরিক করো না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার কর।’ (সূরা নিসা, আয়াত ৩৬)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর আমি নির্দেশ দিয়েছি মানুষকে, তার পিতা-মাতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার জন্য।’ (সূরা আহকাফ, আয়াত ১৫)। আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি যে তুমি আমার এবং তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমার কাছেই তো ফিরে আসতে হবে।’ (সূরা লুকমান, আয়াত ১৪)। হাদিসেও পিতা-মাতার খিদমত এবং তাদের প্রতি গভীর আনুগত্য প্রকাশ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, পিতা-মাতা হলো তোমার জান্নাত এবং জাহান্নাম। অর্থাৎ তুমি ইচ্ছা করলে তাঁদের খিদমত করে উত্তম আচরণের মাধ্যমে জান্নাত অর্জন করতে পারো; আবার ইচ্ছা করলে তাঁদের অবাধ্য হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করতে পারো।’ (ইবনে মাজা)। মাতা-পিতার খিদমত না করার কারণে যারা জান্নাত থেকে বঞ্চিত হলো, জাহান্নামের বেড়ি গলে পরল, প্রিয়নবী (সা.) তাদের লানত করেছেন। হাদিসে এসেছে, ‘একদা জুমার দিনে রসুলুল্লাহ (সা.) মিম্বারের প্রথম ধাপে পা রাখলেন এবং বললেন, আমিন! অতঃপর দ্বিতীয় ধাপে পা রাখলেন এবং বললেন, আমিন! এরপর তৃতীয় ধাপে পা রাখলেন এবং বললেন, আমিন! এরপর খুতবা দিলেন ও নামাজ আদায় করলেন। নামাজ শেষে সাহাবায়ে কিরাম প্রশ্ন করলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! আজ যা দেখলাম তা এর আগে কখনো দেখিনি। আপনি একেক ধাপে পা রেখে, আমিন! আমিন!! আমিন!!! বললেন; এর রহস্য কী? রসুল (সা.) বললেন, হজরত জিবরাইল (আ.) আমাকে বলেছেন, আমি তিনটি দোয়া করব আপনি আমিন বলুন। তাই আমি তার দোয়ার উত্তরে আমিন বলেছি। এ তিনটি দোয়ার মধ্যে একটি হলো, যে ব্যক্তি পিতা-মাতার একজনকে বা উভয়কে পেল কিন্তু জাহান্নাম থেকে মুক্তি নিয়ে জান্নাত নিশ্চিত করতে পারল না তার জন্য ধ্বংস!’ (মুসলিম)। পিতা-মাতার অবাধ্যতার জন্য যেমন রয়েছে অভিসম্পাত, তেমন তাদের আনুগত্যের জন্য রয়েছে পুরস্কারের ঘোষণা। শুধু তাই নয়, তাদের প্রতি নেক নজরে তাকালেও হজের সওয়াব পাওয়া যায়। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যখন কোনো অনুগত সন্তান স্বীয় পিতা-মাতার প্রতি অনুগ্রহের নজরে দৃষ্টিপাত করে, আল্লাহতায়ালা তার প্রতিটি দৃষ্টির বিনিময়ে একটি করে কবুল হজের সওয়াব দান করেন। (বায়হাকি)। পিতা-মাতার জীবদ্দশায় যেমনিভাবে তাদের সেবা করা জরুরি, তেমনি তাদের ইন্তেকালের পরও তাদের জন্য দোয়া করা দরকার। এ পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তুমি বলো, হে আমার প্রতিপালক! আপনি তাদের প্রতি দয়া করুন, যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছেন।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ২৪)।

বনু সালিমা গোত্রের এক ব্যক্তি রসুল (সা.)-কে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া নবী! আমার পিতা-মাতার ইন্তেকালের পরও কি তাদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহারের কোনো দায়িত্ব অবশিষ্ট আছে? নবী (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, আছে। তা হলো : ১. তাদের জন্য দোয়া করা। ২. তাদের গুনা ক্ষমার জন্য তাওবা-ইসতিগফার করা। ৩. তাদের শরিয়তসম্মত অসিয়তগুলো আদায় করা। ৪. তাদের আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। ৫. তাদের বন্ধুবান্ধবদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। এগুলো পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণের শামিল।’ (আবু দাউদ)।

পিতা-মাতার ইসলামী শরিয়তবিরোধী আদেশ ছাড়া সবকিছু মানতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর যদি পিতা-মাতা তোমাকে চাপ দেয় আমার সঙ্গে কাউকে শরিক করার জন্য, যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি তাদের কথা মানবে না। তবে পার্থিব জীবনে তাদের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলবে।’ (সূরা লুকমান, আয়াত ১৫)। হজরত মুসয়াব বিন সাদ বর্ণনা করেন, ‘আমার মা একদিন আমাকে কসম দিয়ে বললেন, আল্লাহ কি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করতে এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে নির্দেশ দেননি? অতএব আল্লাহর কসম! আমি কিছুই খাব না ও পান করব না, যতক্ষণ না মৃত্যুবরণ করব অথবা তুমি মুহাম্মাদ (সা.)-এর সঙ্গে কুফরি করবে। এভাবে তিন দিন পর যখন মায়ের মৃত্যুর উপক্রম হলো, তখন সূরা আনকাবুতে এই আয়াত নাজিল হলো, “আর আমরা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি যেন তারা পিতা-মাতার সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করে। তবে যদি তারা তোমাকে এমন কিছুর সঙ্গে শরিক করার জন্য চাপ দেয়, যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে তুমি তাদের কথা মান্য করো না। আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তনস্থল। অতঃপর আমি তোমাদের জানিয়ে দেব যেসব কাজ তোমরা করতে”।’ (সূরা আনকাবুত, আয়াত ৮)।

পিতা-মাতা অসুস্থ হলে তাদের সেবা করা, তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করা, তাদের মনে কষ্ট না দেওয়া, তাদের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করা এবং আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে পিতা-মাতার বাধ্য, অনুগত সন্তান হিসেবে তাদের খিদমতে আমাদের কবুল করে জান্নাতের মেহমান বানিয়ে দিন। আমিন।

লেখক : মুফাসসিরে কোরআন, বেতার, টিভির ইসলামী উপস্থাপক, প্রিন্সিপাল, মনিপুর বাইতুর রওশন মাদ্রাসা কমপ্লেক্স, মিরপুর, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর