বৃহস্পতিবার, ২৭ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

মেয়েদের যাওয়ার কোনও জায়গা নেই!

তসলিমা নাসরিন

মেয়েদের যাওয়ার কোনও জায়গা নেই!

কিছুদিন আগে আহমেদ ফারিহা নামের ২২ বছর বয়সী এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করেছে। ভিডিওতে সে বলেছে তার বাবা তাকে বছরের পর বছর শারীরিক-মানসিক অত্যাচার করছে। সে তার বাবার বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। ও বাড়িতে ফেরার তার কোনও ইচ্ছে ছিল না। তার বাবা নামাজ রোজা করা পরহেজগার লোক, অথচ মেয়েকে গোসল করিয়ে দেওয়ার নাম করে সারা গায়ে তার হাত বুলোনো, টিন পার হওয়া মেয়েকে বলা তোমার জন্য প্যান্টি কিনে এনেছি, শেষ রাতে নিঃশব্দে পাশে শুয়ে থাকা, মেয়ে ঘুম ভেঙে তাকালে মুচকি মুচকি হাসা- এইসব ভালো লাগেনি ফারিহার। ফারিহা ওই ঘৃণ্য জঘন্য অনিরাপদ, অসুস্থ পরিবেশ থেকে বাঁচতে চেয়েছিল। ভিডিওটি ফারিহার আর্তনাদ, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন এবং যৌন হেনস্তার বিরুদ্ধে তার একার প্রতিবাদ। সবচেয়ে অবাক হলাম, ভিডিওটি দেখার পর প্রচুর লোক মেয়েটির দিকে সাহায্যের হাত বাড়ানোর বদলে ছুড়ে দিয়েছে অবিশ্বাস আর ঘৃণা। সহানুভূতি তো প্রকাশ করেইনি বরং গালাগালি করেছে। বাবার ‘সুনাম’ নষ্ট করেছে মেয়ে, এই মেয়েকে কেউ ক্ষমা করতে চাইছে না। অনেকে বলেছে, ‘ফারিহা মেয়েটি এত খারাপ যে অভিযোগ করেছে তার বাবা নাকি তার গোপনাঙ্গে হাত দিয়েছে, কোনও বাবা কি এই কাজ করতে পারে?’ এই নিন্দুকগুলো জানে না যে, যৌন নির্যাতন বাইরের মানুষের চেয়ে ঘরের মানুষই ঘটায় বেশি, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ঘটে। কেউ কেউ বলেছে, ‘ফারিহা ড্রাগ অ্যাডিক্ট, বাবা ড্রাগ কেনার টাকা দিতে চায়নি, তাই ফারিহা বাবার বিরুদ্ধে যা নয় তাই বলে প্রতিশোধ নিয়েছে। ড্রাগ অ্যাডিক্ট মেয়ে ঐশী, যে মেয়ে ড্রাগের জন্য নিজের বাবা মা’কে খুন করেছে, সেই ঐশী আর ফারিহার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই।’ কেউ এমনও বলেছে, ‘কান্নার অভিনয় করেছে ফারিহা। সত্যি সত্যি কাঁদলে চোখের জল বেরোতো, ওর বেরোয়নি’। ফারিহার ভাই, বাবা, খালা ফারিহাকে নষ্ট হয়ে যাওয়া মেয়ে, ধর্ম না মানা মেয়ে, মাদকাসক্ত মেয়ে, মিথ্যুক মেয়ে কী না বলেছে! বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফারিহা কোনও একটি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কেন্দ্রের শরণাপন্ন হয়েছিল। ওরাই পুলিশ ডেকে সমস্যার সমাধান করতে চায়। পুলিশ ফারিহার বাবার হাতে ফারিহাকে বুঝিয়ে দেয়। ফারিহা উধাও, ফেসবুক থেকে ফারিহার আইডিও উধাও। ফারিহা এখন তার বাবার বাড়িতে কী অবস্থায় আছে, বাবা তাকে আর কী রকম শারীরিক নির্যাতন করছে, কী রকম মানসিক এবং যৌন নির্যাতন করছে, তা আমাদের আর জানার সুযোগ নেই।

প্রতাপশালী পুরুষের সুনাম, সত্যি কথা বলেও যদি নষ্ট করা হয়, তবে যে নষ্ট করে তার রেহাই নেই, সাফ কথা। এ তো ফারিহার বেলায় বেশ দেখা হলো আমাদের। ফারিহা সত্যি বলেছে, নাকি মিথ্যে বলেছে, তা নিয়ে বেশ বিতর্ক হচ্ছে ফেসবুকে। মিথ্যে বলেছে, এই প্রমাণ বাবার সঙ্গে ফারিহা সেলফি তুলেছে আর থাইল্যান্ডের ফুকেটে বেড়ানোর সময় ফেসবুকে লিখেছে, ভাইকে আর বাবাকে সে মিস করছে। যারা বলছে ফারিহা সত্যি বলছে, তাদের যুক্তি, কোনও মেয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার না হলে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে এই দাবি সাধারণত করে না, কারণ এই সমাজে যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও মুখ বুজে মেয়েদের সব সয়ে যাওয়ার নিয়ম। মেয়েটি এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, পরিবার থেকে বহিষ্কৃত হলে তার জীবন যে দুর্বিষহ হয়ে উঠবে, তা বোঝার বুদ্ধি তার নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল মেয়েটির। ভেবেছিল দুনিয়াতে নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও তার মতো অসহায় মেয়ের আশ্রয় জুটবে। দুনিয়াতে মন্দ লোক আছে বটে, কিন্তু ভালো লোকের অভাব নেই, এ কথা বিশ্বাস করেই সে মনের কথা খুলে বলেছে। এ সময় ঠিক কতটা চোখের জল ফেললে তার কথাগুলো বিশ্বাসযোগ্য হবে, তা সে হিসাব করে দেখেনি। চোখের জল কারো কারো অল্পতেই বেরোয়, কারো কারো অল্পতে বেরোয় না। চোখের জলের পরিমাণ দিয়ে কিন্তু সত্যি মিথ্যে যাচাই করা যায় না।

ফারিহা বাবার বাড়ি ফিরে যাওয়ার আগে ফেসবুকে লিখে গেছে, তার ভিডিওর কারণে তার বাবার সুনাম নষ্ট হয়েছে ঠিকই, তবে ভিডিওটা ফেক ছিল না। ফারিহার ভিডিও, তার আত্মীয়স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষী এবং নিন্দুক- সকলের মন্তব্য দেখে, পড়ে, শুনে, আমার কিন্তু মনে হয়নি ফারিহা মিথ্যে কথা বলছে। তার বাবার প্রতি হয়তো তার শ্রদ্ধা ছিল, একই সঙ্গে ঘৃণাও ছিল। দুটো যে একই সঙ্গে থাকতে পারে না তা নয়। বাবা যখন ভালো কোনও কাজ করে, বাবার জন্য গর্ব হয়, আবার যখন ঘৃণ্য কিছু করে, তখন এ আমার বাবা- এ কথা ভাবতেও লজ্জা হয়। সম্পর্কগুলো সব সময় সাদা কালো হয় না। যে ভালো তার সব ভালো, যে খারাপ তার সব খারাপ... এরকম খুব কমই হয়। ডাকাতও সোনার হার ডাকাতি করে এনে বউ-এর গলায় আদর করে পরিয়ে দেয়। কারো কাছে সে নিষ্ঠুর, কারো কাছে সে হৃদয়বান।

ফারিহাকে আমি চিনি না। কিন্তু তার প্রতিবাদ এবং আত্মসমর্পণের চিত্র দেখে আমি বিস্মিত এবং বাকরুদ্ধ। একটি মেয়ে, যে অকপটে এবং নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জানালো তার বাড়িতে তার ওপর নির্যাতন চলছে এবং যৌন হেনস্তারও ইঙ্গিত দিলো, তার পরও তাকে ওই বাড়ি থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখার কোনও ব্যবস্থা নিলো না কেউ। তার জায়গা নেই কোথাও যাওয়ার। তাকে ফিরে যেতে হলো সেই নরকেই, যে নরক থেকে সে বেরিয়ে এসেছিল আর ফিরবে না ভেবেই। কী অসহায় হতে পারে মেয়েমানুষের জীবন! স্বামীর বাড়ি থেকে বাঁচার জন্য বেরিয়ে আসা নির্যাতিত মেয়েদেরও, শুনেছি, বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফের অত্যাচারী স্বামীর বাড়িতেই পাঠিয়ে দেয় ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কেন্দ্র’গুলো। এখন দেখলাম বাবা যৌন হেনস্তা করলেও বাবার বাড়িতেও পাঠিয়ে দেওয়া হয় মেয়েদের। হয় বাবার বাড়ি, নয় স্বামীর বাড়ি। এ ছাড়া মেয়েদের যাওয়ার আর জায়গা নেই। এ ছাড়া মেয়েদের আর আশ্রয় নেই। ওই দুই বাড়ির পরিবেশ যদি নারকীয় হয়, তবুও ওই পরিবেশেই মেয়েদের বাস করতে হবে। মেয়েদের নিজের বাড়ি থাকতে নেই। যেখানে সে নিজের মতো করে বাস করতে পারবে।

কিছু মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, একা বাস করছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের একা থাকা আর একা চলা কঠিন বিপ্লবের মতো। প্রাপ্তবয়স্ক হলেও মেয়েরা যদি অবিবাহিতা বা তালাকপ্রাপ্তা বা তালাকদাতা মেয়ে হয়-তাদের শিশু হিসেবে বিচার করা হয়। তাদের জন্য অভিভাবকের দরকার পড়ে বলে সবাই মনে করে। অভিভাবকহীন মেয়েদের তো ‘বেশ্যা’ ডাকা হয়। ফারিহাকে হয়তো তাই ডাকা হতো, ও যদি ফেরত না যেত বাবার বাড়িতে।

এই সমাজে মেয়েদের নিরাপত্তা এক ফোঁটাও নেই। নিরাপত্তা নেই বলেই ফারিহার কোনও আশ্রয় নেই। ফারিহার সামনে তিনটে রাস্তা, বাবার বাড়িতে নির্যাতন সওয়া, বিয়ে করে স্বামীর বাড়িতে অনিশ্চিত ভবিষ্যেক সঙ্গী করে চলে যাওয়া, অথবা আত্মহত্যা করা। সেই কবে রাগ করে বলেছিলাম, ‘মেয়েদের কি না মরে মুক্তি নেই?’ তাহলে কী, এই একবিংশ শতাব্দীতেও দেখতে হবে যে, আসলেই মেয়েদের না মরে মুক্তি নেই? আমরা মেয়েরা আজও কি ভীষণভাবে হেরে যাচ্ছি!

এই সেদিনও এক প্রকৌশলীকে গ্রেফতার করা হলো কারণ সে তার মেয়েকে দীর্ঘদিন যাবৎ ধর্ষণ করছিল। অনেকে প্রশ্ন করেছে, ‘মেয়েটি পুলিশের কাছে রিপোর্ট করতে এত সময় নিলো কেন? কেন আগে জানালো না?’ কত আগে জানালে সেটিকে মানুষ গ্রহণ করবে? ফারিহার ঘটনা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে ফারিহা কিন্তু ধর্ষণ হওয়ার আগেই জানিয়েছিল। তাকে লোকেরা মিথ্যুক আখ্যা দিয়ে ফেরত পাঠাচ্ছে তার কাছেই, যার কাছ থেকে ফারিহা পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। ফারিহা যদি মিথ্যে কথা বলে থাকে, তবে তো তাকে বাড়িতে ফেরত নিয়ে কী করে সত্য কথা বলতে হয় বাবা মা শিখিয়ে দেবে। কিন্তু ফারিহা যা বলেছে সব যদি সত্যি হয়, তবে কি তাকে বাবার বাড়িতে ফেরত পাঠানো উচিত হয়েছে? ওই বাড়িতে তার ওপর কী বর্বরতা চলবে আমরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারি। মেয়ের সুনাম নষ্ট হলে কারো কোনও ক্ষতি নেই, কিন্তু বাবার সুনাম যেন নষ্ট না হয়, পুরুষের সুনাম যেন নষ্ট না হয়, বিশেষ করে সেই পুরুষ যদি ধনী পুরুষ হয় বা সমাজের নামিদামি পুরুষ হয়। ফারিহা এখন ধর্ষণের শিকার হলেও মিথ্যুক, ড্রাগ অ্যাডিক্ট, ফেক ইত্যাদি আখ্যা পাওয়ার ভয়ে মুখ খুলবে না। নীরবে সে ধর্ষিতা হয়ে যাবে। একদিন যদি ফারিহা জানায়, সে অনেক বছর যাবৎ ধর্ষিতা হয়ে যাচ্ছে, তাহলে আমাদের কিন্তু বলার মুখ নেই, ‘আগে সে জানালো না কেন’। সে তো জানিয়েছিলই, আমরা শুনিনি। একদিন যদি নির্যাতন সইতে না পেরে ফারিহা আত্মহত্যা করে, তবে কি আমরা চুক চুক করে দুঃখ করে বলব, ‘মেয়েটি আমাদের জানালেই পারতো তার কষ্টের কথাগুলো’? সে তো আমাদের জানিয়েছিলই। আমরা গুরুত্ব দিইনি। এমন ঘটনা না ঘটুক, ফারিহা লেখাপড়া করুক, আরও দীর্ঘকাল সুখে স্বস্তিতে বেঁচে থাকুক। কিন্তু কারও আত্মহত্যার পরে নয়, আত্মহত্যার আগে যেন আমাদের টনক নড়ে। আমরা যেন জীবনকে গুরুত্ব দিতে মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা না করি।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর