আজকের এদিনে ২০১৫ সালে ভারতের মহান রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম বাংলাদেশের সন্নিকটে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ে আকস্মিকভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হন। তিনি সেখানে এসেছিলেন তরুণ ছাত্রসমাজে বক্তৃতা দিতে। বক্তৃতারত অবস্থায় তিনি রোস্ট্রামেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে নিচে ঢলে পড়েন।
তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়, কিন্তু তিনি সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে পরপারের যাত্রী হয়ে ইহজগৎ ত্যাগ করেন।।
কয়েক সহস্র বছরের রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে আধুনিক গণতান্ত্রিক চীনের গোড়াপত্তন করেন মহান বিপ্লবী নেতা ডা. সান ইয়াৎ সেন। তার মৃত্যুতে শ্রদ্ধা জানিয়ে গভীর অনুরাগী মাওসেতুং বলেছিলেন, ‘মৃত্যু অতি স্বাভাবিক নিত্য ঘটনা, তা যেন পাখির পালক খসে পড়া, যেন গাছের শুষ্ক পাতা ঝরে পড়া। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু আছে যা পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দেয়, যেন থাই পর্বত ধসে পড়ে।’ভারতের মহান রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের মহাপ্রয়াণে সান ইয়াৎ সেনের জন্য মাওসেতুং উচ্চারিত কথাগুলো আমার অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং যথাযথ মনে হয়েছে। মনে হয়েছে তার মহাপ্রয়াণে সত্যি হিমালয় ভেঙে পড়েছিল।
গোটা ভারতবর্ষের মানুষ, বাংলাদেশের মানুষ, দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ গভীরভাবে শোকাহত হয়েছিল। হয়েছিল শোকে গভীর মুহ্যমান। তিনি জ্ঞানতাপস, বিজ্ঞান সাধক, পরমাণু গবেষক। মহাবিজ্ঞানী আবদুল কালাম ভারতের নভোচারী মিসাইলম্যান। তিনি স্বপ্নদ্রষ্টা, যুগস্রষ্টা, দার্শনিক ও কবি। গভীর মানবতাবাদী শান্তিবাদী। রবি ঠাকুরের কথায়, ‘সীমার মাঝে অসীম’। কোনো সীমারেখা আবদুল কালামকে সীমাবদ্ধ করতে পারেনি। তিনি জীবনভর শুধু স্বপ্ন দেখেছেন, অনেক বড় বড় স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখাই ছিল তার মহত্ত্ব ও বিশালতা। তিনি গোটা জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তিনি তরুণদের বলতেন ‘যা তোমরা ঘুমের মধ্যে দেখ তা স্বপ্ন নয়। স্বপ্ন সেটাই, যা তোমাকে ঘুমাতে দেয় না।’ আবদুল কালামের স্বপ্ন আত্মজয়ের। তার স্বপ্ন বিশ্বজয়ের, মহাকাশ জয়ের। স্বপ্নগুলো মানুষের অদম্য চেতনার, মানুষের সীমাহীন সম্ভাবনার বিকাশ সাধনের।’
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বৈজ্ঞানিক আবদুল কালামের সঙ্গে এক দুর্লভ সাক্ষাৎ লাভের। সেটা ১৯৯৬ সালের শেষের দিকের কথা।
আমি সেনাবাহিনী প্রধান। ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল শংকর রায় চৌধুরীর আমন্ত্রণে ভারত সফরে যাই। দিল্লির সাউথ গেটে বাহিনী প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করি। আই কে গুজরালের মন্ত্রিসভায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মুলায়েম সিং যাদবের সঙ্গে আমার আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ হয়। প্রতিরক্ষামন্ত্রী এক পর্যায়ে আবদুল কালামের কথা উল্লেখ করেন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে তার সহযোগিতার ইঙ্গিত দেন। আবদুল কালামের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। মাথাভরা দীর্ঘকেশ সৌম্য শান্ত উদার ও বিনয়ী মানুষটির মধুর আচরণ আমাকে মুগ্ধ করে। তিনি আমাকে বলছিলেন, ‘শুনেছি আপনি সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোরে কমিশনপ্রাপ্ত। নিজেও ইঞ্জিনিয়ার। ভারতে আমরা নিজেরাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ ঘটিয়ে সামরিক বাহিনীকে আধুনিকায়ন করছি। সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নে আপনারাও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কাজে লাগাতে পারেন। চাইলে আমরাও সহযোগিতা করতে পারি।’ বাংলাদেশ সম্বন্ধে তার অনেক কৌতূহল দেখেছিলাম। জ্ঞান বিজ্ঞানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমূল্য অবদানের কথা উল্লেখ করে তিনি জগদীশ চন্দ্র বসু ও সত্যেন বোসকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। আমার মনে পড়ে তিনি আমাকে কয়েকটি ব্যক্তিগত পত্রও লিখেছিলেন। আমি আনন্দসহকারে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সেগুলোর জবাব দিই। আমার মনে পড়ছে, সফর শেষের সন্ধ্যায় আমি ও আমার স্ত্রী নাগিনা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতায় এগিয়ে আসা কিছু বিশিষ্ট ভারতীয় বন্ধুর সম্মানে দিল্লির এক অভিজাত হোটেলে নৈশভোজের আয়োজন করি। তিন বাহিনীর প্রধানগণসহ জেনারেল জ্যাকব, রাষ্ট্রদূত মুচকুন্দ দুবে ও আরও অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব উপস্থিত হয়েছিলেন। জেনারেল অরোরা অসুস্থ বিধায় তার কন্যাকে পাঠিয়েছিলেন। সেই সন্ধ্যায় বিজ্ঞানী এপিজে আবদুল কালামও নৈশভোজে অংশ নিয়ে আমাকে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছিলেন।
বিজ্ঞানব্রতী আবদুল কালাম ভারতকে বিশ্বসভায় সম্মানিত করেছেন। আত্মবিশ্বাস ও শক্তি জুগিয়েছেন। ভারতকে প্রযুক্তিমনষ্ক করেছেন। স্বপ্নবিভোর করেছেন। সৃজনশীলতায়, মননশীলতায় নতুন নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। বিশ্বের প্রথম কাতারের দেশগুলোর সঙ্গে ব্রাকেটভুক্ত করেছেন। বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশলী স্বপ্নচারী সাধক আবদুল কালাম রচিত আত্মজীবনীমূলক বই ‘উইংস অব ফায়ার’-এর শেষ কয়েকটি লাইন এ রকম— “এই গল্প শেষ হবে আমার সঙ্গেই, যেহেতু পার্থিব কিছুই আমার নেই। আমি কোনো কিছুরই মালিক নই, কিছুই সৃষ্টি করিনি, অধিকারী নই কোনো কিছুর-না পরিবার, না পুত্র-কন্যা।
I am well in this great land
Looking at its millions of boys and girls
To draw from me
The inexhaustible divinity And spread His grace everywhere
As does the water drawn from a well.
আমার প্রপিতামহ আবুল, আমার পিতামহ পাকির, আমার পিতা জয়নুলাবেদিন-এর ব্লাড লাইন হয়তো শেষ হবে আবদুল কালাম (অকৃতদার) এ এসে। কিন্তু খোদার মহিমা কখনো থামবে না, যেহেতু তা চিরন্তন।”
না। রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মোটেই শেষ হয়ে যাননি। কখনো যাবেনও না, খোদার মহিমায় তিনি তার অবিস্মরণীয় কীর্তির মধ্য দিয়ে চিরজাগরূক থাকবেন। চির জাগরূক থাকবেন বাংলাদেশের মানুষের মনেও। তিনি বাংলাদেশে একাধিকবার এসেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানগুলোতে, বিদগ্ধ বিভিন্ন সভা-সমাবেশে মহামূল্যবান বক্তৃতা দিয়েছেন। ছাত্র ও যুবসমাজকে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা তুলে দিয়েছেন। বিশাল বিশাল স্বপ্ন দেখিয়েছেন।
এপিজে আবদুল কালামের মৃত্যু এক অবিস্মরণীয় মৃত্যু। তিনি কর্মের মধ্যেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। আমরা সামরিক বাহিনীতে এমন মৃত্যুকে বলি, to die with boots on. ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় সৈনিকের মৃত্যু। তার মৃত্যু রণাঙ্গনে একজন বীরযোদ্ধার গৌরবোজ্জ্বল মৃত্যু।
এপিজে আবদুল কালামের স্মৃতির প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা, এপিজে আবদুল কালামকে আমার চৌকস স্যালুট।
লেখক : সাবেক সেনাপ্রধান।