শনিবার, ২৯ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

শিক্ষা, বিজ্ঞান ও বিশ্বাস

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

শিক্ষা, বিজ্ঞান ও বিশ্বাস

শিক্ষা একটি চলমান পদ্ধতি। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যত আবিষ্কার হয়েছে তাতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষা মানুষকে যেমন পাণ্ডিত্য লাভের পথে সহায়তা করে তেমনি শিক্ষা যদি যথাযথভাবে প্রয়োগ না হয় তাহলে যেমন বিপদ, তেমনি কুশিক্ষার সংস্পর্শ মানুষকে যে কোনো পশুর চেয়ে অধম করতে পারে। যেমন অসংখ্য মানুষের সঙ্গে আপনার সান্নিধ্য হয় এবং সেই চলার পথে লোকের সঙ্গে মেলামেশার মাধ্যমে, পরিবেশ থেকে, প্রকৃতি থেকেও মানুষ শিক্ষা লাভ করে জ্ঞান সমৃদ্ধি করতে পারে। ইতিহাস মানুষের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার জন্য অনেক বেশি ভূমিকা রাখে। ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্মীয় শিক্ষা সর্বোপরি দর্শণশাস্ত্র ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা আজ পৃথিবীতে বিবর্তন এনেছে। আদি যুগ থেকে অর্থাৎ বন্য বা প্রস্তর যুগ থেকে মানুষের আজকের এত উৎকর্ষতা সব জীবের ওপরে শুধু শিক্ষার মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে। বলছিলাম চলার পথে মানুষ সবার কাছ থেকে কিছু না কিছু শিক্ষা গ্রহণ করে। প্রতিটি মানুষ সে একজন বন্ধু, শিক্ষক, দার্শনিক, ধর্মগুরু, রাজনীতিবিদ অথবা যেই হোক না কেন তার কাছ থেকেও শেখার কোনো শেষ নেই। তবে প্রতিটি মানুষের মধ্যে সৎ গুণ এবং কিছু অসৎ গুণও থাকতে পারে। শিষ্য তার গুরুর কাছ থেকে যা শিখবে তাকে বেছে নিতে হবে যে আমি তার খারাপ দিকগুলো গ্রহণ করব কি করব না।

দেবতা বা ফেরেস্তাদের চরিত্রে হয়তো কোনো খারাপ দিক নেই, কিন্তু আমরা যারা মানুষ আমাদের অনেক ভালো গুণের সঙ্গে খারাপ দিকও থাকতে পারে। এ ছাড়া আমরা যাদের আদর্শবান মনে করি, বড় হয়ে যাদের মতো হতে চাই, তাদের কিছু সিদ্ধান্তও কিন্তু ভুল হতে পারে। যিনি সিদ্ধান্তটি নেন, তিনি কিন্তু তা সঠিক মনে করেই নেন। যেহেতু আমি একজন চিকিৎসক, তাই চিকিৎসার পেশার সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে আমার যে ভুলভ্রান্তিগুলো আমি দেখেছি, তা-ই আমার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরছি। আমি স্রষ্টায় ও সৃষ্টিতে বিশ্বাসী। আমি পেশাগত দিক থেকে আমার সিনিয়রদের কাছ থেকে যা শিখেছি তা অনেকটা প্রান্তিক বা অবিশ্বাসীর কাজের মতো হয়েছে। যদিও ঘটনা ঘটার পরই তা শুধরে নিতে সচেষ্ট হই। ১৯৭৬ সালে ডাক্তারি পাস করলেও পেশাগত জীবন অর্থাৎ প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করি জুলাই, ১৯৮৪ সালে, যখন আমি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে সহকারী অধ্যাপক ইএনটি। ফিস নিয়ে রোগীদের সঙ্গে বাড়াবাড়ি কখনো করেছি বলে মনে হয় না। বরং আমার পেশাগত জীবনে আমি যে পরিমাণ রোগীর সেবা ফ্রি দিয়েছি তা হয়তো অনেক ডাক্তার সারা জীবনে দেখার সুযোগ পাননি। এখনো এই ফ্রি সেবা দিতে কার্পণ্য করি না।

আমার চেম্বারে স্পষ্ট করে সবার চোখে পড়ার মতো লেখা আছে ‘ফিস দিতে আর্থিক অসুবিধা হলে দয়া করে বলুন’। এ লেখাটি আমি লেখার জন্য মানবিক শিক্ষা পেয়েছি এক রোগীর কাছ থেকে। ১৯৮৫ সালের কোনো একসময়, আমাকে দেখানোর জন্য দীর্ঘকায়, সৌম্য চেহারার এক ভদ্রলোক এলেন, পরনে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি ও ধুতি। বয়স ৭০-এর কাছাকাছি হলেও চেহারায় একটি জমিদারি আভিজাত্য ও তারুণ্য শোভা পাচ্ছিল। আমি তাকে দেখলাম। অনেক সময় কোনো কোনো রোগীকে ফিস দেওয়ার আগেই দ্রুত বলে দিই, ফিস নিও না। সাধারণত আমার সহকারী চিকিৎসক আমি ‘নো’ বললেই বোঝেন ফি নেওয়া যাবে না। প্রাইভেট প্র্যাকটিসের শুরু থেকেই আমি সব সময় ন্যূনতম দুজন সহকারী চিকিৎসক নিয়ে চেম্বার করি এবং এদের প্রায় সবাই নাক, কান ও গলা রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে আজ দেশে-বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত।

বলছিলাম দীর্ঘকায় সৌম্য চেহারার ভদ্রলোকের কথা। তিনি একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন বোয়ালখালীতে। অবসর নিয়েছেন প্রায় ১০ বছর আগে। গলার স্বর ভঙ্গের জন্য তিনি আমার কাছে এসেছিলেন। কেউ একজন বলেছেন, প্রাণ গোপালের কাছে যান, তিনি আপনাকে দেখে, দরকার হলে বিনা পয়সায় মেডিকেলে ভর্তি করে চিকিৎসা করিয়ে দেবেন। তাকে দেখে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে দিলে তিনি পাশের সোফায় বসে রইলেন। আরও দু-তিন জন রোগী দেখার পর যখন জিজ্ঞাসা করলাম, বাবা আপনি কি কিছু জানতে চাচ্ছেন, নাকি আরও কিছু বলবেন। ভদ্রলোকের দুই চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে শুরু করল। আমি উঠে গিয়ে তার পাশে বসার পর তার আর্থিক অক্ষমতা এবং অতীতে কী ছিলেন, তার কত ছাত্র ডাক্তার সব বলতে শুরু করলেন। আসলে প্রধান শিক্ষক মহোদয় ফি দিতে পারবেন না, এটা বলতেই অসম্মান বোধ করছিলেন। বর্তমানে আমার চেম্বারে যে লেখাটি আছে, তা যদি ওই সময় লেখা থাকত তাহলে হয়তো তিনি সাহস নিয়ে বলতে পারতেন, আমার আর্থিক অসুবিধা আছে। সেদিন থেকেই চেম্বারে ওই লেখাটি লিখে রেখেছি। তবে কিছু দুষ্ট ছেলে আছে যারা মা-বাবার কাছ থেকে ঠিকই টাকা নিয়ে আসে কিন্তু বলে আর্থিক অসচ্ছলতা আছে। এ সংখ্যা খুবই নগণ্য, আর এটা তারুণ্য। তারুণ্য মানুষকে অনেক কিছুই করতে বাধ্য করে যখন বিবেক তার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় না।

উত্তরাধিকারসূত্রে শিখেছি প্রাইভেট কোনো অপারেশন যদি কেউ বুকিং দেয় তাহলে কিছু টাকা অগ্রিম রেখে দিয়ে অপারেশনের তারিখ দেওয়া। তাও ১৯৮৫ সালের কথা। নুরুল ইসলাম নামে ১৮ বছরের একটি ছেলে সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য সাময়িকভাবে অনুপযুক্ত বিবেচিত (Temporary Unfit) হয়েছে। নাকের হাড় বাঁকা Septal deviation অপারেশন করে গেলে সে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারবে। চার সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে। নুরুল ইসলাম ৫০০ টাকা অগ্রিম দিয়ে অপারেশন বুক করে গেল। বুকিংয়ের খাতায় অপারেশনের তারিখ, ধরন, নাম এবং সংক্ষিপ্ত ঠিকানা লিখে রাখতাম। পরদিন দৈনিক আজাদী পত্রিকায় একটি দুর্ঘটনার খবর দেখলাম। অর্থাৎ চকরিয়ার একটি বাস দুর্ঘটনার খবর পত্রিকায় দেখলাম। চকরিয়ায় একটি বাস দুর্ঘটনায় পাঁচজনের মৃত্যুর মধ্যে নুরুল ইসলাম নামে একটি নাম আছে। আমি দুশ্চিন্তায় পড়লাম। অপেক্ষা করলাম অপারেশনের তারিখ পর্যন্ত। সত্যিই রোগীটি এলো না। আমার বন্ধু ও অ্যানেসথেটিস্ট ডা. হারুন অর রশিদকে বললাম, আমি ৫০০ টাকা অগ্রিম রেখেছি এবং ছেলেটি পরশু চকরিয়ার বাস দুর্ঘটনায় মারা গেছে। এখন আমি কী করব? হারুন নিরুত্তর।

সিদ্ধান্ত নিলাম শুক্রবার আমি ও হারুন চকরিয়ায় দুর্ঘটনাস্থলে যাব এবং সত্যিই ওই লোকটি মারা গেল কিনা খোঁজ নিতে চকরিয়ায় দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছলে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় নিশ্চিত হলাম নুরুল ইসলাম নামে ১৮-২০ বছরের যুবক মৃতদের একজন। একজন রিকশাওয়ালাকে নিয়ে তার বাড়ি গেলাম। পরিচয় দেওয়ার আগেই ছেলেটির বন্ধু যাকে সঙ্গে নিয়ে নুরুল ইসলাম আমার চেম্বারে এসেছিল, সে পরিচয় দিয়ে আরেক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি করল। ফেরার পথে তার বন্ধুর হাতে ২ হাজার টাকা দিয়ে চলে এলাম।

একজন গরিব কৃষকের ছেলে সেনাবাহিনীর চাকরি হলে হয়তোবা পরিবারটি সুখী হতো, সচ্ছল হতো। কিন্তু ঠিক উল্টো ঘটনাটি যদি ঘটে যেত অর্থাৎ সার্জন হিসেবে আমি বেঁচে না থাকতাম তাহলে ছেলেটির টাকাটা কে ফেরত দিত? দ্বিতীয়ত সব ধর্মেই স্বীকার্য যে, জীবন-মরণ এবং ধন-দৌলত সবই নাকি স্রষ্টার হাতে আর তাই যদি হয় তাহলে টাকাটা অগ্রিম নিয়ে আমি কি স্রষ্টার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলিনি। সনাতন ধর্মে তো আরও স্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘মানুষের আগমন উলু ও শঙ্খ ধ্বনি সৃষ্টি করে জানান দিয়ে আসে, মৃত্যুর আগমন হয় নিঃশব্দে।’ আমাদের মধ্যে এমনও অনেকে আছেন, যাদের চেম্বার সহকারীরা রোগীর নামের তালিকা করার সময় আমাদের সম্মানীটা নিয়ে রসিদ দিয়ে দেন। যদিও এ সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। তবে বিদ্যমান। সকাল ৬টায় রোগী এসে অগ্রিম টাকা দিয়ে নাম লিখে গেলেন। আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে গেলাম বিকাল ৫টায় তাকে দেখব। এই বিরাট সময়ের মধ্যে আমার জন্য মহাযাত্রাও নির্দিষ্ট হয়ে থাকতে পারে। তাহলে আমার মহাপ্রস্থানের পরে, অগ্রিম টাকা দেওয়া ওই রোগীকে কে দেখবে। তাই বিশ্বাসী হলে এ পদ্ধতিও ত্যাগ করা উচিত। আলবার্ট আইনস্টাইন তার ধর্ম ও বিজ্ঞান প্রবন্ধে লিখেছিলেন, যে ঈশ্বর পুরস্কৃত করেন এবং শাস্তিদান করেন সেই ঈশ্বরের উপলব্ধি তার সাধ্যাতীত; কারণ, মানুষের যাবতীয় কর্মকাণ্ড তার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কার্যকারণ দ্বারা নির্ধারিত হয় যে কার্যকারণ অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী, ফলে ঈশ্বরের কাছে তার কোনো দায়বদ্ধতা থাকতে পারে না, যেমন কোনো জড় বস্তু তার গতির জন্য ঈশ্বরের কাছে দায়ী হয় না। এজন্য বলা হয় যে, বিজ্ঞান নৈতিক প্রশ্নকে উপেক্ষা করে। কিন্তু বিজ্ঞান সম্পর্কে এ অভিযোগ অন্যায়। মানুষের নৈতিক আচরণের কার্যকর ভিত্তি হওয়ার প্রয়োজন নেই। মৃত্যুর পর শাস্তির ভয় আর পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা হলে মানুষ যথার্থই দুরবস্থার দিকে ধাবিত হবে।

এ থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায়, কী জন্য যাজক সম্প্রদায় সব সময় বিজ্ঞানের বিরোধিতা করেছে, বিজ্ঞানে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। অন্যদিকে আমি মনে করি, মহাজাগতিক ধর্মীয় অনুভূতি হচ্ছে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী ও মহৎ প্রেরণা। এটা যারা অনুধাবন করতে পারেন কেবল তারাই উপলব্ধি করতে পারেন সেই আবেগের শক্তি যে আবেগ ওই অগ্রগতিকে সম্ভব করে। সন্দেহ নেই, ওই আবেগ জীবনের উপস্থিত বাস্তব থেকে বহু দূরবর্তী ব্যাপার। মহাকাশ বলবিদ্যার মূল সূত্রগুলো আবিষ্কার করার জন্য নিউটন ও কেপলারকে দৃঢ়চিত্ততার সঙ্গে নির্জনে নিঃসঙ্গ অবস্থায় বছরের পর বছর ধরে যে শ্রম দিতে হয়েছিল, পৃথিবীর খুব কম লোকই তা জানেন। পৃথিবীর যাবতীয় ঘটনার যৌক্তিক কার্যকারণ সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাসই ছিল তাদের সাফল্যের মূল শক্তি। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের জগতে যারা প্রায়োগিক ফলার ওপর নির্ভরশীল তারা সহজেই যারা পৃথিবীব্যাপী সংশয়পূর্ণ পরিমণ্ডলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ওই জাতীয় আবেগে পথ চলেছেন তাদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভুল ধারণা পোষণ করেন। যিনি একই উদ্দেশ্যে তার জীবন উৎসর্গ করেছেন একমাত্র সেই ব্যক্তিই পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করতে পারেন যে, অসংখ্য বাধা-বিপত্তি ও পৌনঃপুনিক ব্যর্থতা সত্ত্বেও ওই সব স্মরণীয় ব্যক্তি কীসের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে তাদের উদ্দেশ্যের পথে শেষ পর্যন্তই অবিচল থেকেছেন। একই মহাজাগতিক ধর্মীয় অনুভূতিই মানুষকে এই শক্তি ও প্রেরণা জোগাতে পারে। সাম্প্রতিককালের একজন মনীষী যথার্থই বলেছেন যে, ‘আমাদের এই বস্তুবাদী যুগে একমাত্র বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ সাধকরাই প্রকৃত ধার্মিক লোক।’ (রতনতনু ঘোষ সম্পাদিত নোবেল বিজয়ীদের নির্বাচিত প্রবন্ধ থেকে নেওয়া পৃষ্ঠা ২৭৫-২৭৬) আমরা চিকিৎসকরা বিজ্ঞানের ছাত্র হলে, কোনো রোগীর চিকিৎসা বা রোগ নিরাময়ে ব্যর্থ হলে সব সময়ই ঈশ্বরকে স্মরণ করি। শুধু স্মরণ করি না, পারি তো চিকিৎসক হিসেবে নিজের জীবনটাও ওই রোগীর নিরাময়ের জন্য উৎসর্গ করি। এ ব্যাপারে ফরাসি দার্শনিক, ইতিহাসবিদ ও লেখক Voltaire (১৬৯৪-১৭৭৮)-এর উক্তি, Men who are occupied in the restoration of health to other men, by the joint exertion of skill and humanity, are above all the great of the earth. They even partake of divinity, since to preserve and renew is almost as noble as to create. চিকিৎসক হিসেবে জেনেভা ঘোষণা, হিপোক্র্যাট শপথ বা Tuft University কর্তৃক হিপোক্র্যাট শপথের দীর্ঘ বর্ণনা, আমাদের এই প্রেরণা দেয়, চিকিৎসকের জীবন নিবেদিত, উৎসর্গীকৃত শুধু  অন্যের জন্য। এ ব্যাপারে মাদার তেরেসার এক মহান বাণীও আমাদের প্রেরণা জোগাতে পারে।

‘প্রভু! আমাদের যোগ্য কর, যেন আমরা সারা পৃথিবীতে যেসব মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে, ক্ষুধার মধ্যে জীবনযাপন করেন, মৃত্যুমুখে পতিত হন, তাদের সেবা করতে পারি। আমাদের হাত দিয়ে তাদের প্রতিদিনের খাদ্য দান কর, আমাদের বিবেচনা এবং ভালোবাসার সাহায্যে তাদের দান কর শান্তি এবং আনন্দ। প্রভু! তোমার শান্তি আমার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হোক, যেন যেখানে ঘৃণা সেখানে আমি প্রেম আনতে পারি, যেখানে অন্যায় সেখানে ক্ষমা আনতে পারি, যেখানে বিরোধ সেখানে মৈত্রী আনতে পারি, যেখানে ভ্রান্তি সেখানে সত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারি, যেখানে সংশয় সেখানে বিশ্বাস আনতে পারি, যেখানে হতাশা সেখানে আশা আনতে পারি, যেখানে ছায়াচ্ছন্নতা সেখানে আলো আনতে পারি, যেখানে বিষাদ সেখানে আনন্দ আনতে পারি। প্রভু! আমি যেন সান্ত্বনা না চাই, সান্ত্বনা দিতে চাই; সহানুভূতি না চাই, সহানুভূতি দিতে চাই; ভালোবাসা না চাই, ভালোবাসাতে চাই; কারণ পেতে গেলে নিজেকে তুলতে হয়, ক্ষমা পেতে গেলে ক্ষমা করতে হয়, অনন্ত জীবন পেয়ে জেগে উঠতে গেলে মরতে হয়। আমেন।’

আমরা চিকিৎসকরা অধিকাংশই প্রবলভাবে স্রষ্টায় বিশ্বাস করি। বিশেষ করে শল্যচিকিৎসক হলে তো কথা নেই। ছুরি ধরার আগে কতবার যে স্রষ্টাকে স্মরণ করি তার কোনো হিসাব নেই। আমরা জীবন ও জীবাণু নিয়ে খেলা করি। রোগীর অপারেশন করতে গিয়ে পৃথিবীতে কত চিকিৎসক হেপাটাইটিস বি ও সি-তে, এইচআইভি সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছেন, তা আমাদের অজানা নয়। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, মানব জাতির ভবিষ্যৎ অনেকখানি নির্ভর করছে গবেষককে তার নিজের চিন্তাধারা সাধারণভাবে মেনে গবেষণা করে যাওয়ার ওপর। আলেকজান্ডার ফ্লেমিং প্রথম জীবাণু প্রতিরোধক পেনিসিলিন আবিষ্কার করে সগর্বে বলেছিলেন, ‘আমি পেনিসিলিন আবিষ্কার করিনি, প্রকৃতিই করেছে। শুধু হঠাৎ পাওয়ার সুযোগে তা খুঁজে পেয়েছি।’ অর্থাৎ অনেকেই জীবনের কোনো না কোনো এক সময়ে স্রষ্টায় প্রবল বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন, যদিও কখনো কখনো বিশ্বাস হারিয়েও ফেলেন।

 

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর