শনিবার, ২৯ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীতে খাঁচায় মাছ চাষে সাফল্য

শাইখ সিরাজ

চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীতে খাঁচায় মাছ চাষে সাফল্য

স্রোতস্বিনী নদীতে বাঁশের খাঁচা স্থাপন করে তার মধ্যে মাছ চাষ, পৃথিবীর ইতিহাসে প্রায় ৭০০ বছরের পুরনো এক চর্চা। আমাদের দেশেও বিভিন্ন নদীতে অনেক আগে থেকেই কমবেশি খাঁচায় মাছ চাষের নজির রয়েছে। এ দেশে খাঁচায় মাছ চাষের গোড়াপত্তন ঘটে সত্তরের দশকে কাপ্তাই লেকে। যেসব নদীতে খাঁচায় মাছ চাষ সফল তার অন্যতম হচ্ছে চাঁদপুরের ডাকাতিয়া। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে তুলে ধরেছিলাম হাবিবুর রহমান নামের এক উদ্যোক্তার হাত ধরে গাজীপুরের কালিগঞ্জের বালু নদে খাঁচায় মাছ চাষ নিয়ে প্রতিবেদন। সে সময় ‘কেয়ার বাংলাদেশ’ খাঁচায় মাছ চাষ সম্প্রসারণে বেশকিছু কাজ করেছিল। পরে এর ধারাবাহিকতা দেখা যায়নি। একই সময় অর্থাৎ নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে FRI মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদীকেন্দ্রিক চাঁদপুর, চাঁদপুরের বহরিয়া খালে স্থানীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পেনে ও খাঁচায় মাছ চাষ প্রকল্প গ্রহণ করে। সে সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে ধারাবাহিকভাবে এর উন্নয়ন নিয়ে অনুষ্ঠান প্রচার করেছিলাম মনে পড়ে। ড. জুবাইদা নাসরিন FRI চাঁদপুরের এ প্রকল্পটি দেখভাল করতেন। তখন তিনি FRI-এর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। এরপর চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীতে বেলাল হোসেন নামের এক উদ্যোক্তার হাত ধরে দিনে দিনে সম্প্রসারণ ঘটতে থাকে খাঁচায় মাছ চাষ। এখনো ডাকাতিয়া নদীতেই খাঁচায় মাছ চাষ দারুণ লাভজনক একটি কার্যক্রম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ডাকাতিয়ায় কৃষক সাত-আট বছর ধরে খাঁচায় মাছ চাষ করে আসছে। নদীতে ভাসমান খাঁচা বানিয়ে ব্লক করে করে মাছ চাষ করছে। মাছ চাষের এই আধুনিক পদ্ধতিতে নদীর পানি প্রবহমান থাকে বলে মাছের বৃদ্ধি হয় দ্রুত। মাছ চাষিরা এখানে সাধারণত তেলাপিয়া, কই, মাগুর প্রভৃতি মাছ চাষ করছে। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় স্থানীয় কৃষকও এ রকম খাঁচায় মাছ চাষ করে আসছে, তা অনেক আগে একবার ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানেও দেখিয়েছিলাম। গজারিয়ার মেঘনা নদীতে খাঁচায় মাছ চাষের উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেখানকার প্রান্তিক মত্স্যজীবীরা। সমবায় সমিতির মাধ্যমে ওই উদ্যোগ নেওয়া হলেও একসময় নদীদূষণসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় ওই উদ্যোগ আর এগোতে পারেনি। চাঁদপুরে খাঁচায় মাছ চাষের মাধ্যমে ডাকাতিয়া নদীতীরবর্তী স্থানীয় কৃষক যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে তেমন পুষ্টি ও আমিষের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খাঁচায় মাছ চাষের উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। এর মাধ্যমে প্রান্তিক নারী-পুরুষ দ্রুতই আর্থ-সামাজিক উন্নতির সুযোগ করে নিতে পারছে। কিন্তু ঘুরেফিরে ডাকাতিয়া নদীতেই খুঁজে পাওয়া যায় খাঁচায় মাছ চাষ ঘিরে দৃষ্টান্তমূলক সাফল্যের গল্প। স্রোতস্বিনী নদীর বুকে মাছ চাষ যেন সৌভাগ্যকে খাঁচায় ধরার অনন্য এক পদ্ধতি। এযাবৎকালে বহু মানুষই খাঁচায় মাছ চাষ করেছে। কেউ সফল হয়েছে। কেউ ধৈর্যের পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে সরে গেছে। এখানেই ব্যতিক্রম চাঁদপুর সদরের পূর্ব শ্রীরামদী গ্রামের তরুণ চাষি সোহেল মিয়াজী। চাঁদপুর সদরের এই তরুণ কর্মজীবনে বেছে নিয়েছিলেন টেইলারিংয়ের কাজ। আবার ভাবছিলেন নিজের ভাগ্য অন্বেষণের জন্য বিদেশে পাড়ি জমানোর কথাও। কিন্তু দিশা পাচ্ছিলেন না। হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে ঘুরে বেড়ানোর সময় চোখে পড়ে নদীতে কেউ কেউ খাঁচায় মাছ চাষ করছে। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া এ ডাকাতিয়া নদীই ঘুরিয়ে দেয় সোহেলের জীবনের স্বপ্ন। নদী থেকে ওঠানো বাঁশের খাঁচায় মাছের নৃত্য দেখে মজে যায় সোহেলের মন। আগ্রহ তৈরি হয় তার। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন কপাল ফেরাতে তিনিও শুরু করবেন নদীতে খাঁচায় মাছ চাষ। পরিবারের লোকজন ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা নিয়ে ২৫টি খাঁচায় শুরু করেন মাছ চাষ। এরপর তাকে পেছনে তাকাতে হয়নি। সাফল্য এসেছে। ২৫টি বাঁশের খাঁচা দিয়ে শুরু করা মাছ চাষ আট বছরে বেড়ে এখন ৪২টি পাইপে পরিণত হয়েছে।

সোহেল জানালেন ৪২টি স্থায়ী খাঁচায় বছরে উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ২৬ টন মাছ। মাত্র আট বছরে সোহেল নিজে জমি কিনে বাড়ি করেছেন, গড়ে তুলেছেন মাছের খাদ্যের দোকান। এসব জায়গায় জীবন-জীবিকার সন্ধান পেয়েছে স্থানীয় আরও কিছু মানুষ। সোহেল মিয়াজীর সাফল্যে গর্বিত এলাকার অনেক তরুণ। সোহেলের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বেকারত্ব ঘুচিয়ে ফেলেছে অনেকেই। কথা হলো মাছ চাষি মোহাম্মদ জাকারিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, তিন বছর আগে প্রথমে ২৮টি খাঁচায় মাছ চাষ শুরু করেন। ২৮টি খাঁচা নির্মাণ করতে তার খরচ হয়েছিল ৫ লাখ টাকা। খাঁচাসহ মোট ৯ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে তিনি তিন বছরে বিনিয়োগকৃত টাকা তুলে আরও বাড়িয়েছেন মাছ চাষের পরিধি। সোহেল মিয়াজী এখন সবার কাছেই এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্তের নাম। সোহেল মিয়াজী খাঁচায় মাছ চাষের সব নিয়ম মেনে এগিয়ে যাচ্ছেন আর স্বপ্ন দেখছেন আরও অনেক দূর যাওয়ার। সম্প্রতি শ্রেষ্ঠ কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে সিটি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি।

আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকাসহ পৃথিবীর দেশে দেশে মুক্ত জলাশয়ে রয়েছে খাঁচায় মাছ চাষের রীতি। চীনের হ্রদবেষ্টিত এলাকাগুলোয় সরকারি প্রণোদনায় খাঁচায় মাছ চাষ করে শুধু আর্থিক সচ্ছলতাই নয়, ক্ষুদ্র চাষি থেকে বড় উদ্যোক্তায় পরিণত হয়েছে বহু মানুষ। ২০০৫, ২০০৬ ও ২০০৭ সালে চীনের ইউনান ও হুনান প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় গেছি। দেখেছি হুনানের চাংশা সিটির আশপাশের বিশাল আয়তনের লেকগুলোয় বহু উদ্যোক্তা সফল মত্স্যজীবীতে পরিণত হয়েছে। একসময় যারা ক্ষুদ্র শ্রমজীবী ও দিনমজুর শ্রেণির লোক ছিল তারা মাছ চাষ করে লেকের পাশে সুরম্য অট্টালিকা তুলেছে। সেখানে হ্রদে খাঁচায় মাছ চাষের ক্ষেত্রে রয়েছে সরাসরি সরকারি ভর্তুকি। একেকজন মত্স্যজীবীর খাঁচার সংখ্যা ও তার পরিবারের চাহিদার দিক মাথায় রেখেই চীন সরকার তাদের প্রয়োজনমাফিক ভর্তুকি প্রদান করছে। একইভাবে থাইল্যান্ডের বিভিন্ন এলাকায়ও এখন স্রোতস্বিনী জলাশয়ে, বিশেষ করে যেগুলোর সঙ্গে সমুদ্রের যোগসূত্র আছে, সেগুলোয় চাষ হচ্ছে লবণপানির মাছ ভেটকির। স্থানীয়ভাবে ভেটকিকে বলা হয় ‘সি বাস’। সেখানে সি বাস দারুণ লোভনীয় একটি মাছ। হোটেল-রেস্তোরাঁয় ওই মাছের চাহিদা ও দাম দুটোই বেশ ভালো। থাইল্যান্ডের বিভিন্ন এলাকায় মাছ চাষিরা একসময় লবণপানি আটকিয়ে চিংড়ি চাষ করত। এখন ফুকেটসহ সে দেশের বিভিন্ন এলাকায় চিংড়ি চাষের কারণে পরিবেশে নানা বিপর্যয় নেমে আসায় অনেক চাষি এখন বেছে নিয়েছে খাঁচায় মাছ চাষকে।

প্রিয় পাঠক! দেশের সব নদ-নদীতে ব্যাপকভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ করা হলে বছরে বিপুল পরিমাণ মাছ অতিরিক্ত উৎপাদন করা সম্ভব, যা একদিকে দেশের প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি পূরণ করবে, অন্যদিকে অর্থনীতিতে মত্স্যসম্পদের ভূমিকাকে আরও উচ্চে তুলে ধরবে। পাশাপাশি খাঁচায় মাছ চাষ প্রকল্প হাতে নিয়ে বহুমুখী সাফল্যও আনতে পারবে বেকার জনগোষ্ঠী। সোহেল মিয়াজীর মতো দেশের অগণিত এমন সফল উদ্যোক্তা, মত্স্যজীবী ও চাষির হাত ধরেই আজ মাছ উৎপাদনে পৃথিবীতে চতুর্থ স্থানে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। বাঙালির চিরায়ত পরিচয় ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ দিনে দিনে বিকশিত হচ্ছে বিশ্ববাসীর সামনে। একই সঙ্গে ছোট ছোট উদ্যোক্তাও গড়ছেন ব্যক্তি সাফল্যের অনন্য নজির। সোহেল মিয়াজী তাদেরই একজন। পরিকল্পিত উদ্যোগ, সঠিক ব্যবস্থাপনা, নিষ্ঠা ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে অসংখ্য এমন সাফল্যের নজির গড়ে উঠুক— এ প্রত্যাশা আমার।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

     [email protected]

সর্বশেষ খবর