শনিবার, ২৯ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

ইসলামের দৃষ্টিতে জবানের হেফাজত

ড. মাওলানা মো. মোরশেদ আলম

সব প্রশংসা আল্লাহতায়ালার জন্য, যিনি মানব জাতিকে অগণিত নিয়ামত দিয়ে সুন্দর অবয়বে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে সৃষ্টি করেছেন, একমাত্র তাঁরই ইবাদত করার জন্য। দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.), তাঁর পরিবারবর্গ, সাহাবায়ে কিরাম ও সালিহিনদের ওপর। আল্লাহতায়ালার নিয়ামতরাজির মধ্যে জবান অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। সঠিক কাজে জবান ব্যবহার করা, অন্যায়, অসত্য ও হারাম থেকে জবানকে বিরত রাখা আল্লাহর দিদার লাভের সহজ উপায়। এক কথায়, জবানের হেফাজত করা মুমিন জীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল কোরআনের সূরা মুমিনুনের শুরুতে আল্লাহ খাঁটি মুমিনদের সাতটি গুণের কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে দ্বিতীয় গুণ হচ্ছে ‘যারা অনর্থক কথাবার্তায় নির্লিপ্ত’। এ আয়াতে ‘লাগউন’ শব্দের অর্থ অনর্থক কথা বা কাজ। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল। তাহলে আল্লাহ তোমাদের কার্যক্রমসমূহ সংশোধন করবেন এবং তোমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (সূরা আহজাব : ৭০-৭১)।

ইসলামের দৃষ্টিতে জবানের হেফাজত : কিছু মানবিক উত্তম গুণের সমন্বিত একটি রূপকে ইসলামের দৃষ্টিতে জবানের হেফাজত বা বাক সংযম বলা হয়। এবার সেসব গুণের কিছু জেনে নিই : ১. কথা বলায় সাবধানতা : হজরত বিলাল বিন হারিস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টির এমনও কথা বলে যার কল্যাণের কথা সে ধারণাই করতে পারে না অথচ তার দরুন কিয়ামত অবধি তার সন্তুষ্টি লিপিবদ্ধ করে দেন। আবার মানুষ আল্লাহর অসন্তুষ্টির এমনও কথা বলে যার অকল্যাণের কথা সে ধারণাই করতে পারে না অথচ তার দরুন কিয়ামত অবধি তার অসন্তুষ্টি লিপিবদ্ধ করে দেন। (তিরমিজি, মুয়াত্তা মালিক)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ইমান রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে। (বুখারি ও মুসলিম)। অন্য হাদিসে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি রসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, কোনো বান্দা ভালোমন্দ বিচার না করে এমন কোনো কথা বলে ফেলে যার কারণে সে পদস্খলিত হয়ে জাহান্নামের এত দূর গভীরে চলে যায়, যা পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের দূরত্বের সমান। (বুখারি)।

২. মিষ্টভাষী হওয়া : হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, নিশ্চয় জান্নাতে বালাখানা থাকবে, যার ভিতরের সবকিছু বাইরে থেকে দেখা যাবে। একজন বেদুইন দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, ওই বালাখানা কাদের জন্য হবে? রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, যারা মিষ্টভাষী হবে, অভাবীদের আহার করাবে, রাতের গভীরে নামাজ পড়ে। (তিরমিজি)।

৩. নাজাতের পথ বাক সংযম : হজরত উকবা ইবনে আমের (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রসুল! নাজাত পাওয়ার উপায় কী? তিনি জবাব দিলেন, তোমার কথাবার্তা সংযত রাখো, তোমার ঘর প্রশস্ত কর (মেহমানদারি করা) এবং তোমার কৃত অপরাধের জন্য আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি কর। (তিরমিজি)। হজরত আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সকালে মানুষ যখন ঘুম থেকে ওঠে, তখন তার দেহের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জিহ্বাকে অনুনয়-বিনয় করে বলে, তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। কেননা, আমরা তোমার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তুমি যদি সঠিক পথে থাকো, আমরাও সঠিক পথে থাকতে পারি। আর তুমি যদি বাঁকা পথে চল তাহলে আমরাও বাঁকা পথে যেতে বাধ্য। (তিরমিজি)।

৪. সর্বোত্তম মুসলিম : এ বিষয়ে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, প্রকৃত মুসলমান সে-ই, যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে। (বুখারি)।

৫. জান্নাতের জিম্মাদারি : জবানের হেফাজত এত বড় আমল যার বিনিময়স্বরূপ রসুলুল্লাহ (সা.) জান্নাতের জিম্মাদারি হয়ে যান, হজরত সাহল ইবনে সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী বস্তু, অর্থাৎ জিহ্বা এবং তার দুই ঊরুর মধ্যবর্তী তথা লজ্জাস্থানের জিম্মাদার হবে আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হব। (বুখারি)। জবানের হেফাজত না করার কারণে জাহান্নাম ঠিকানা হতে পারে, যেমনিভাবে হজরত আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) একবার বললেন, হে আল্লাহর রসুল! আমরা যা বলি তা নিয়ে কি আমাদের পাকড়াও করা হবে? তখন রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে মুয়াজ! জবানের হেফাজত না করার কারণে মানুষকে উপুড় করে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ)।

৬. মিথ্যা পরিহার করা : হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যখন কোনো বান্দা মিথ্যা বলে তখন এর দুর্গন্ধে ফেরেস্তারা তার কাছ থেকে এক মাইল দূরে চলে যায়। (তিরমিজি)। অন্য হাদিসে হজরত মুয়াবিয়া বিন হাইদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, দুর্ভোগ তার জন্য, যে লোকদের হাসানোর উদ্দেশ্যে মিথ্যা (গল্প বানিয়ে) বলে। দুর্ভোগ তার জন্য, দুর্ভোগ তার জন্য (আবু দাউদ)।

৭. দোষচর্চা পরিহার করা : আল্লাহতায়ালা কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা একে অন্যের গিবত (পরনিন্দা) করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? তোমরা তো তা অপছন্দ করে থাকো। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর নিশ্চয়ই আল্লাহ অধিক তওবা কবুলকারী, অসীম দয়ালু। (সূরা হুজুরাত : ১২)। রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, গিবত (পরনিন্দা) জেনার (ব্যভিচার) চেয়ে জঘন্য অপরাধ। সর্বত্র জবানের হেফাজত করা মুমিন মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। বাসায়, পরিবার-পরিজনের সঙ্গে; ছাত্র শিক্ষকের সঙ্গে, মালিক কর্মচারীর সঙ্গে, নেতা কর্মীর সঙ্গে। এক কথায় প্রত্যেকে তার অধীনস্থের সঙ্গে। তাই আসুন ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির উদ্দেশ্যে কম কথা বলা এবং জবানের হেফাজতের জন্য প্রাণপণে সর্বদাই চেষ্টা করি। আমিন।

সর্বশেষ খবর