রবিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

নিশ্চিত হোক নারী কর্মীর নিরাপত্তা

মোহসিনা হোসাইন

নিশ্চিত হোক নারী কর্মীর নিরাপত্তা

‘স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন একটা বালিশের ওয়ারের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ (সেলাই করিবার জন্য) মাপেন!’ বিশ শতকের শুরুতেও এ দেশের নারীদের অবস্থা ও অবস্থান ঠিক এভাবেই উঠে এসেছে বেগম রোকেয়ার লেখায়। সময় বদলেছে। চার দেয়ালের ঘেরাটোপে আজ আর বন্দী নন নারীরা।  অচলায়তন ভেঙে তারা পাড়ি জমাচ্ছেন দূরদেশেও।

পুরুষরা বিদেশে যাবেন, আর সংসার-সন্তান সামলাবে নারী। কোনো কারণে স্বামী টাকা না পাঠালে অথৈ পাথারে পড়তে হবে নারীকে— এমন গতানুগতিক চিত্রের বাইরে একটা সময় কিছু ভাবা যেত না। চিত্রটা আমূল পাল্টে না গেলেও কাজের খোঁজে নারীরা বিদেশে যাচ্ছেন, নিঃসন্দেহে এটা ইতিবাচক। নারী কর্মীরা বিদেশে গিয়ে রেমিট্যান্স প্রেরণ করছেন। এটি একদিকে যেমন নারীর ক্ষমতায়নে বড় পদক্ষেপ, অন্যদিকে তা বেগবান করছে দেশের অর্থনীতির চাকা। জনসংখ্যার অর্ধেকই যেখানে নারী, সেখানে তাদের সমান অংশীদারিত্ব না থাকলে উন্নয়ন সূচকে বড় পরিবর্তন আসবে না, এটা সহজ হিসাব।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ থেকে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বের ১৮টি দেশে তিন লাখ ৬৬ হাজার ৩১ জন নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। গত দুই বছরে বিদেশে নারী শ্রমিক পাঠানোর হার বেড়েছে। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের গত বছরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের ৬৮টি দেশে নারী কর্মী পাঠানো হয়েছে। সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরবের সঙ্গে নারী গৃহকর্মী নিয়ে চুক্তি সইয়ের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতেই গেছেন প্রায় দেড় লাখ নারী। ২০১৭ সালের প্রথম চার মাসে দেশটিতে যাওয়া নারী গৃহকর্মীর সংখ্যা ৪৩ হাজার ৩১১। গার্মেন্টকর্মী, নার্স, গৃহকর্মী, কেয়ার গিভার, বেবি সিটার, ডে কেয়ার কর্মী, ক্লিনার, ড্রাইভার, মালি, গার্ড ও বিউটিশিয়ানসহ নানা পেশায় বিদেশ যাচ্ছেন নারীরা।

২০১৫ সালে ৮০০ রিয়াল (প্রায় ১৬ হাজার টাকা) বেতনে বাংলাদেশ থেকে গৃহকর্মী নেওয়ার ব্যাপারে সৌদি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি সই হয়। সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে অনেক কম বেতনে নারী শ্রমিক পাঠানো হচ্ছে। বেতন নিয়ে বিস্তর অভিযোগ অনেক নারী শ্রমিকেরই। পাশাপাশি নারী গৃহকর্মীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ করে আসছেন। সৌদি আরবে বাংলাদেশের নারী গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন নিয়ে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। ধর্ষণসহ নানা রকম নির্যাতনের শিকার হয়ে অন্তত ২২ জনকে জীবন দিতে হয়েছে। অনেকে অপমান-নির্যাতন সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন।

বিদেশে গিয়ে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন এমন উদাহরণ অসংখ্য। নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। সবচেয়ে বেশি শিকার গৃহকর্মীরা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে নিপীড়নের বিষয়টি। প্রতিবেদনে প্রকাশ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে এক নারী কর্মীকে নির্যাতনের পর চাকরিদাতা হুমকি দিয়েছেন, ‘তোমাকে আমরা কিনেছি, অভিযোগ করবে না।’ এ থেকেই স্পষ্ট, প্রবাসে নারী কর্মীদের সঙ্গে কী নির্মম আচরণ করা হয়। দেশে ফিরে অনেক নারী কর্মী যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার কাছে মধ্যযুগীয় দাসপ্রথার বর্বরতাও হার মানে।

আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার এক জরিপে দেখা যায়, ভাগ্যান্বেষণে দূরদেশে গিয়ে প্রতি তিনজনে দুজন নারী কর্মী নিয়োগকর্তা দ্বারা কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হন। অভিবাসী নারীদের বিপদগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা পুরুষদের তুলনায় বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে বেড়ে গেছে মানব পাচার। অনেক নারী দালালদের দ্বারা আর্থিক প্রতারণার শিকার হন বা পাচারকারীর হাতে পড়েন। অনেক নারীকে চাকরি দেওয়ার নাম করে বিদেশে নিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়। যৌনকর্ম ও মাদক ব্যবসার মতো গর্হিত কাজ করতেও বাধ্য হন কেউ কেউ। অবৈধ ও অপরিকল্পিতভাবে বিদেশে গিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেন অনেক নারী। উদয়াস্ত খেটেও ন্যায্য বেতন পান না, ঠিকমতো খাবারও জোটে না অনেকের। নিশ্চিত হয় না নিরাপদ বাসস্থান, চিকিৎসা ও অন্যান্য সুবিধা। দেশে এই অপরাধচক্রের সঙ্গে জড়িত দালালদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত না করা গেলে এটা চলতেই থাকবে। আন্তর্জাতিক চক্রও যাতে দেশে হাত বাড়াতে না পারে, সে বিষয়েও সরকারের সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকতে হবে।

নারী গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনসহ নানা ধরনের অভিযোগে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কা নারীদের সৌদি আরবে পাঠানো বন্ধ করে দেয়। বিদেশের কর্মক্ষেত্র নারীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াটা সমাধান হতে পারে না। তবে নারী কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে বিদেশে পাঠানো উচিত হবে না। নারী শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়গুলোর আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করাও জরুরি। সংশ্লিষ্ট দেশ, নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করার সময় নারীদের নিরাপত্তা, অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার বিষয়টি সামনে আনতে হবে।

বৈধ তালিকাভুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে সঠিক নিয়মে ও নিরাপদ উপায়ে বিদেশ গমন নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশি নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কেও খোঁজখবর নিতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে নারী কর্মীদের ন্যায্য বেতন, নিরাপত্তা, উন্নত কর্মপরিবেশ ও আবাসনের বিষয়টি। নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য এজেন্সি, লেবার উইংস ও দূতাবাসগুলোকে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। নিয়োগদাতা দেশের বাংলাদেশি দূতাবাসে রাখতে হবে শেল্টার হোমের ব্যবস্থা। বিদেশে নারীর কর্মস্থলে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেওয়া, সঙ্গে পাসপোর্ট রাখা ও ব্যাংকের মাধ্যমে বেতন সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

বিদেশে যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নেওয়াটা জরুরি। বিদেশে যেতে ইচ্ছুক নারীদের ভাষা ও গৃহস্থালি কাজের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোও বিভিন্ন কারিগরি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। প্রশিক্ষণ নেওয়া থাকলে যেমন সম্মানজনক ও বেশি বেতনের কাজ পাওয়া যায়, তেমনি নিরাপত্তার বিষয়টিও জোরদার হয়। বিদেশি ভাষা জানা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে হয়রানি এড়ানো যায়। তাই বিদেশ যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও ভাষা শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। নারী কর্মীদের সচেতনতাও কমিয়ে আনতে পারে নির্যাতন-নিপীড়নের হার।

নারী কর্মীরা কেবল প্রবাসেই বৈরী পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেশে ফেরার পরও সমাজ ও পরিবার তাদের সহজভাবে গ্রহণ করে না। পারিবারিক ও সামাজিক দিক থেকে তারা এক দুর্বিষহ জীবনের মুখোমুখি হন। বিদেশে উপার্জনকারী একজন পুরুষ কর্মী যেভাবে নন্দিত হন, একজন নারী কর্মী ততটাই হন নিন্দিত। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি।  প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও যারা পরিবার ও দেশের জন্য রেমিট্যান্স পাঠিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন, তাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষার দায় আমাদের সবার।

লেখক :  শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

সর্বশেষ খবর